লকডাউনের তিন মাস থাবা বসিয়েছে রুটিরুজিতে। বেঁচে থাকাটুকুও করে তুলেছে দুর্বিসহ। লাল পোশাকের উজ্জ্বলতা হারিয়ে গেছে তাঁদের জীবন থেকে। ঘিরে ধরেছে একরাশ ধূসরতা। যার ফলে এখন চরম হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন সুবে সিং, সাব্বির আহমেদ বা চন্দ্রপ্রকাশরা।
৪০ বছর নতুন দিল্লী রেল স্টেশনে মালবাহক সুবে সিং। বয়স ৬০–এর কোঠায়। এখন বেশিরভাগ দিন নুন-রুটিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। বললেন, ‘হাতে কানাকড়ি নেই। পাঁচজনের পরিবার। স্টেশনের কাছেই ভাড়াবাড়িতে থাকি। বাড়িওয়ালা ভাড়া ছাড়তে নারাজ। রেশন কার্ডও নেই। ধার করে বেঁচে আছি। এভাবে আর কতদিন?’
অন্যান্য স্টেশনের মালবাহকদেরও একই অভিজ্ঞতা। ২৪ মার্চ লকডাউনের আগের দিন স্টেশনে শেষ ট্রেন থামার পর থেকে কারও হাতেই কোনও পয়সা নেই। কীভাবে সংসার চলবে, সেই আতঙ্কে দিশাহারা। শ্রমিক স্পেশাল কিছুটা আশা জাগালেও রোজগারের ঝুলি শূন্যই। শ্রমিক স্পেশালের ভরসায় ২৫-৩০ জন ফিরে এসেছিলেন বিভিন্ন স্টেশনে। যাত্রীরা করোনা আতঙ্কে কি আদৌ ওঁদের সাহায্য নিতে চাইবেন?
এই টানাটানির মধ্যেও রুজি বাঁচাতে বেশ কিছু মালবাহক স্যানিটাইজার, মাস্ক, গ্লাভস কিনেছেন। মানছেন সামাজিক দূরত্ব। তার ওপর দিনে দিনে ট্রলি ব্যাগ ও সুটকেসের ব্যবহার বাড়ায় ওঁদের ভাতে টান পড়েছে। লকডাউন শুরুর দিকে দিল্লির বেশ কিছু মালবাহক হেঁটে বা সাইকেলে গ্রামের বাড়ি চলে গিয়েছেন। যাঁরা আটকে পড়েছেন, তাঁরা খাবার, নিরাপত্তা, এমনকী প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবাটুকুও পাচ্ছেন না!
দিল্লী থেকে দেশের বাড়ি মোরাদাবাদে চলে গিয়েছিলেন সাব্বির আহমেদ। কিন্তু রোজগারের আশায় ফিরে এসে রীতিমতো পস্তাচ্ছেন। বললেন, টাকাপয়সা ধার করে কোনওমতে সংসার টানছি। প্রতিদিন সকালে স্টেশনে যাই আর সন্ধেবেলা খালিহাতে ফিরি। একজন যাত্রীও মেলে না!
অনেকেই সরকারি পদক্ষেপ দাবি করছেন। গোটা দেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত মালবাহকের সংখ্যা ২০ হাজারেরও বেশি। শুধু দিল্লীর বিভিন্ন স্টেশনেই ১,৪৭৮ জন। তার মধ্যে পুরনো দিল্লী রেলস্টেশনে ১০০০জন, হজরত নিজামুদ্দিন স্টেশনে ৫০০–৬০০ জন এবং ৯৭ জন আছেন আনন্দ বিহারে।
১২ বছর নতুন দিল্লী স্টেশনে কর্মরত মালবাহক চন্দ্রপ্রকাশ বলেন, ধার করা টাকাতেই সুরক্ষা সরঞ্জাম কিনেছি। কী করব?, অসুস্থ হলে কে দেখবে! কুলিদের তো কোনও স্বাস্থ্যবিমাও নেই! আমরা দৈনিক মজুরির শ্রমিক। ভিক্ষে তো করতে পারব না!
কাজ হারিয়ে অনেকেই আশ্রয় খুঁজেছেন এক টুকরো ঘরে। সামাজিক দূরত্বের পাট চুকিয়ে ছোট্ট ঘরে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে ছ-সাতজনকে। লকডাউনের আগে ভোর ৫টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত এক–একজনের রোজগার হতে কম করে ৫০০–৭০০ টাকা। সেই অঙ্কটা এখন দাঁড়িয়েছে ১০০ বা তারও কম। তাও হাতেগোনা কয়েকজনের।
‘সবাই পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে ভাবছে। কেউ আমাদের দুর্দশার কথা মাথাতেই আনছে না!’ ক্ষোভ ভীম সিংয়ের। বলেছেন, ‘১৫ এপ্রিল রেল থেকে আধার কার্ড, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বর চেয়েছিল। প্রায় ৯০০ জন অনলাইনে সে সব জমাও দিয়েছি। দু মাস হয়ে গেছে। কোথায় কী! সামান্য সাহায্যও পেলাম না!’
তাঁর কথায়, নতুন দিল্লী স্টেশনের ২০ শতাংশ মালবাহকের বয়সই ৫৫-র বেশি। কীভাবে এই সমস্যায় বাঁচবেন তাঁরা? যত শিগগির সম্ভব সরকারি সাহায্য প্রয়োজন। ভীম সিংয়ের কথায় সায় দিয়েছেন সহকর্মী রমেশও। তাঁর দাবি, বেশিরভাগ কুলিই লকডাউনে ধারদেনায় ডুবে গেছেন। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে জরুরি ভিত্তিতে আর্থিক সাহায্য দরকার।
যদিও কুলিরা রেলের কর্মচারী নন। রেলে যাতায়াতের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় পান এবং বছরে দু দফা পোশাক পান। স্টেশনে কাজের জন্য বছরে ১২০ টাকা লাইসেন্স ফি দিতে হয় তাঁদের। ছাড়ের মধ্যে বছরে এক বা দুবার সস্ত্রীক যাতায়াত করতে পারেন। এই বিশেষ ছাড়টি সাধারণ ভাড়ার এক তৃতীয়াংশ।