লকডাউনের জেরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফেরাতে প্রথম থেকেই অনীহা দেখা গিয়েছিল কেন্দ্রের। পরে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে দেশের অন্যান্য বিরোধী নেতা-নেত্রীরা সরব হতেই বাধ্য হয়ে শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন চালু করতে বাধ্য হয় কেন্দ্র। আর তারপরেই অন্যান্য রাজ্যের মত বাংলাতেও ফিরতে শুরু করেন ঘরের ছেলে-মেয়েরা। এই সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকরা রাজ্যে ‘লক্ষ্মী’ নিয়ে ফিরেছেন বলে মত অর্থনীতিবিদদের।
তৃতীয় দফায় লকডাউন কিছুটা শিথিল হতেই এ রাজ্যে শ্রমিকরা ফিরে আসতে শুরু করেন। তার পর থেকেই কলকাতার বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলি প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুত ছন্দে ফিরছে বলে তাদের দাবি। অর্থনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মতে, শ্রমিকরা কাজে ফেরায় বিশেষ করে বয়নশিল্প, গণ পরিবহণ, নির্মাণ শিল্প, পণ্য পরিবহণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সমস্যা দ্রুত মিটছে। শ্রমিকদের ঘাটতি এই ক্ষেত্রগুলিকে ফের চালু করার প্রধান প্রতিবন্ধকতা ছিল। সেটা মিটে যাওয়ায় বাংলা অনেক দ্রুত অর্থনৈতিক সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে।
মহারাষ্ট্র ও দিল্লীর বহু শ্রমিক কলকাতায় নানা ক্ষেত্রে কাজ করেন। লকডাউনের কারণে এঁরা নিজেদের রাজ্যে ফিরে গিয়েছিলেন। লকডাউন শিথিল হওয়া মাত্রই তাঁরা ফিরে এসেছেন। এর অন্যতম কারণ, ওইসব জায়গায় করোনা সংক্রমণ ভয়ংকরভাবে বেড়ে চলেছে। অনেকে আবার সামর্থ্য না থাকায় দ্রুত কাজ ফিরে পেতে এখানে চলে এসেছেন।
অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকারের মতে, আগামীদিনে সর্বত্র শ্রমিক সমস্যা ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ে কাছে বড় হয়ে দেখা দেবে। সেক্ষেত্রে শ্রমিকদের ফিরে আসা রাজ্যের অর্থনীতির পক্ষে শুভ ইঙ্গিত। রাজ্য পরিকল্পনা পর্ষদের এই সদস্য বলেন, এঁরা ফিরে আসায় ব্যবসায়িক কাজকর্ম দ্রুত বাড়ছে। আগে ভাবা হয়েছিল, এঁদের ফিরে আসতে কয়েক মাস লেগে যাবে। কিন্তু যেভাবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সবাই ফিরছেন, তাতে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে।
রাজ্যে বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির শীর্ষ সংগঠন কনফেডারেশন অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, মার্চ মাসে লকডাউন ঘোষণা হওয়া মাত্র ৭৫ শতাংশের বেশি শ্রমিক বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশের পূর্ব অংশ এবং উড়িষ্যায় ফিরে যান। কিন্তু এঁদের অর্ধেকই ফিরে এসেছেন। আরও অনেকে এখন ফেরার পথে।
সংগঠনের সভাপতি সুশীল পোদ্দার বলেন, আমরা যাখন আবার ব্যবসা কেন্দ্রের ঝাঁপ তুললাম, তখন শ্রমিক পাওয়াটাই আমাদের কাছে বড় সমস্যা ছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অনেকটা সহজ হয়ে গিয়েছে। প্রতিদিন প্রচুর শ্রমিক শহরে এসে পৌঁছোচ্ছেন। মে মাসের শেষদিক থেকেই শ্রমিকদের ফিরে আসা শুরু হয়েছিল। জুনের শুরু থেকে ফিরে আসাদের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়।
পোস্তা বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক বলেন, প্রথমদিকে পোস্তা ও বড়বাজারের মতো পাইকারি বাজার মাত্র ২০ শতাংশ শ্রমিক দিয়ে চালানো হচ্ছিল। এখন পুরো বাজার খুলে গিয়েছে। কেননা মুটিয়া, ড্রাইভার, হেল্পার সহ ৭০ শতাংশ শ্রমিক ফিরে এসেছেন। আমাদের আরও লোক লাগলেই বাকি সবাই ফিরে আসবেন।
চেম্বার অফ টেক্সটাইল ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সম্পাদক মহেন্দ্র জৈন বলেন, আমাদের শিল্প পুরোপুরি শ্রমিক নির্ভর। কাঁচামাল আনতে এবং উৎপাদিত সামগ্রী পাঠানো ইত্যাদি সবকিছুতেই শ্রমিকের প্রয়োজন। আনলক পর্ব শুরুর সময় ৯০ শতাংশ শ্রমিক ছিলেন না। বহু ব্যবসায়ী তাঁদের লোভনীয় অফার দেন। বেশি মাইনে, ভালো থাকার ব্যবস্থা ইত্যাদি আশ্বাস দিয়ে তাঁদের কলকাতায় ফেরানো হয়। এখন প্রতিদিন শয়ে শয়ে শ্রমিক ট্রাক ও অন্য গাড়িতে কলকাতায় ফিরছেন।