মুজফফরপুর রেল স্টেশনে প্ল্যাটফর্মের ওপর পড়ে মহিলার নিথর দেহ। আর তাঁর চাদর ধরে ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করছে তিন বছরের শিশু। কখনও চাদর ধরে টানছে সে। কখনও সেই চাদর নিয়ে নিজের মাথা ঢাকছে। কখনও চাদর ফেলে রেখে একবার প্ল্যাটফর্মে ঘুরে আসছে। এসেই আবার মায়ের গায়ের চাদর ধরে টানছে। মা শুয়ে আছে… অনেকক্ষণ ধরে। কিছুতেই উঠছে না। আর মাকে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দুধের শিশু। দেশজুড়ে পরিযায়ী শ্রমিক সমস্যার এই নিদারুণ মর্মান্তিক ছবি ক্যামেরাবন্দি হয়েছিল বিহারে। আর তা প্রকাশ্যে আসতেই এখন দুই নাতিকে নিয়ে মাথা গুঁজে আছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব শায়রুন বিবি ও ভোকা মিরের অ্যাসবেস্টসে ছাওয়া ঘরে এসে ভিড় জমাচ্ছেন সরকারি অফিসার থেকে জনপ্রতিনিধি, নেতা থেকে স্বেচ্ছাসেবী। সবাই পাশে থাকার আশ্বাস দিচ্ছেন।
মেয়ে আরভিনা খাতুনকে কবর দেওয়ার পর সেই যে ঘরে ঢুকেছেন, আর বেরোননি শায়রুন ও ভোকা। বেরোনোর দরকারও হয়নি। কারণ, এখন যে সবাই ওঁদের একচিলতে উপহার-আদরে ভরিয়ে দিচ্ছেন দুই নাতি আরমান ও রহমতকে। অথচ আহমেদাবাদ থেকে বিহারের মুজফফরপুরে আসার সময় ঠিকমতো খাবার জোটেনি দুই শিশুর। অনাহারক্লিষ্ট রুগ্ন শরীরে ট্রেনযাত্রার ধকল নিতে পারেননি দুই শিশুর মা আরভিনা খাতুন। মুজফ্ফরপুরে নামার পর প্ল্যাটফর্মে শুয়ে পড়েছিলেন ২৩ বছরের তরুণী। আর ওঠেননি। দেড় ঘণ্টা প্ল্যাটফর্মেই পড়ে ছিল আরভিনার নিথর দেহ। সহযাত্রীরা একটি কাপড়ে ঢেকে দিয়েছিলেন আরভিনাকে। দেড় বছরের রহমত বারবার সেই কাপড় সরিয়ে মাকে জাগানোর চেষ্টা করেছে। অবোধ শিশুর সেই মিনিটখানেকের ভিডিও নিমেষে ভাইরাল রয়েছে। তার দৌলতেই এখন রহমতদের ঘরে রাজা-উজির সবাই।
আরজেডি-র তেজস্বী যাদব ৫ লাখ টাকা দিয়েছেন। বিহারের সমাজকল্যাণ দপ্তর ‘পরবরীস’ প্রকল্পের আওতায় মাসে মাসে ৪ হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। মুখ্যমন্ত্রীর পরিবার কল্যাণ তহবিল থেকেও ২০ হাজার টাকা অনুদান মিলেছে। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে গেলেন অখ্যাত ‘সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অফ ইন্ডিয়া’র বিহার রাজ্যের সভাপতি নাসিম আখতার। তিনি নিজে দু’টি বাচ্চার সারাজীবনের দায়িত্ব নিতে চাইলেন। সরকারি আধিকারিকদের সঙ্গে নিয়ে যান কাটিহারের প্রাণপুরের মায়াদঙ্গি গ্রামে। যেখানে নানা-নানির সঙ্গে রয়েছে আরমান-রহমত। নাসিম জানান, ‘বাচ্চা দুটোর সারা জীবনের খরচ বহন করতে চাই। দরকার হলে বাড়িতে এনে নিজের ছেলের মতো মানুষ করব। সেই ইচ্ছে নিয়েই রহমতদের বাড়ি গিয়েছিলাম।’
তিনি আরও জানান, ‘খুব দুঃখজনক ঘটনা। রহমত পেটে থাকার সময় আরভিনাকে ছেড়ে চলে যায় স্বামী মহম্মদ ইসলাম। ছেলে দুটোকে মানুষ করার জন্যই আট মাস আগে আহমেদাবাদ গিয়ে নির্মাণ শ্রমিকের সহযোগীর কাজ নিয়েছিল আরভিনা।’ উল্লেখ্য, বছর সাতেক আগে উত্তরপ্রদেশের বরেলির ইসলামের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল আরভিনার। শায়রুনের অভিযোগ, পোয়াতি অবস্থায় মেয়েকে তালাক দিয়ে চলে যায় ইসলাম। কোনও খোঁজ নেয়নি। শায়রুনের আর এক জামাই মহম্মদ ওয়াজির আমেদাবাদে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। তিনিই আমেদাবাদে আরভিনার ৩০০ টাকা রোজের হেল্পারের কাজের ব্যবস্থা করে দেন। লকডাউন হওয়ার পর টাকায় টান পড়তে বাধ্য হয়েই দুই ছেলেকে নিয়ে কাটিহারে ফেরার ট্রেন ধরেন আরভিনা। আর তারপরের ছবিটা সবার জানা।