উম্পুনের মত ভয়ানক ঘূর্ণিঝড়ের জেরে রীতিমত ‘তাসের ঘর’-র ন্যায় ভেঙে পড়েছিল রাজ্যের বিদ্যুৎ সরবরাহ, টেলি পরিষেবা। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগেই ত্রাণ ও পুনর্গঠন অভিযানের রাশ নিজের হাতে নিয়েছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যার নিট ফল হল, অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের মারাত্মক তাণ্ডবের কয়েক দিনের মধ্যেই স্বাভাবিকতার পথে ফিরতে শুরু করল রাজ্যের শহর থেকে গ্রামাঞ্চল। মূলত বিদ্যুৎ এবং পানীয় জল নিয়েই সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দিয়েছিল ঘূর্ণিঝড়ের পরে।
তবে মুখ্যমন্ত্রীর কড়া ধমকের জেরেই তৎপরতা বাড়ে কলকাতা ও শহরতলিতে বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা সিইএসসি-র। ফলে শহরের ৯৭ শতাংশ এলাকাতেই বিদ্যুৎ সংযোগ ফিরে এসেছে এদিন সন্ধের মধ্যে। এদিকে, বিদ্যুৎ ফিরতেই মিটে যায় পানীয় জলের সমস্যাও। কিছু এলাকা থেকে জল ও বিদ্যুৎ নিয়ে ক্ষোভের খবর এ দিনও এসেছে। তবে নজরদারি চালাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। ফলে সে সব সমস্যাও দ্রুত মিটবে বলে নবান্নের উচ্চমহল সূত্রে খবর। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ চলছে বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলেও।
গত কয়েকদিনের বেনজির পরিস্থিতির মুখে উল্লেখযোগ্য তৎপরতাও কিন্তু দেখা গেল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তরফ থেকে। সর্বাগ্রে সড়ক যোগাযোগ পুনরুদ্ধার করে এবং বিদ্যুৎ ও পানীয় জল সরবরাহ ফিরিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানোর নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রশাসনিক গাফিলতির অভিযোগ কোনও কোনও এলাকা থেকে উঠছিল না, এমন নয়। বিক্ষোভও দানা বাঁধছিল। কিন্তু পরিস্থিতির গুরুত্ব আঁচ করে খোদ মুখ্যমন্ত্রীই রাশ হাতে নেন ত্রাণ ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার। তার জেরেই দুর্যোগের ৬ দিনের মধ্যেই পরিস্থিতি এতটা বদলে দেওয়া সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন নবান্নের উচ্চপদস্থ কর্তারাও।
কলকাতার কিছু কিছু অংশে মঙ্গলবারও পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক নয়। বিক্ষোভের খবরও এসেছে। তবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শহরের ৯৭ শতাংশ এলাকাতেই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে বলে খবর। ফলে পানীয় জল সরবরাহের সমস্যাও সে ভাবে আর নেই। শহরের বাইরে থাকা দুর্গত এলাকাতেও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ত্রাণ সামগ্রী পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ঘূর্ণিঝড় তাণ্ডব চালিয়ে যাওয়ার ছ’দিন পর রাজ্য সরকারের তরফে যে বিশদ তথ্য সামনে আনা হল, তাতে কিন্তু গ্রামাঞ্চলেও পরিস্থিতির উন্নতির ছবিই স্পষ্ট।
নবান্ন সূত্রে জানা গিয়েছে, গ্রামাঞ্চলে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পুনর্গঠনের কাজ করছেন কর্মীরা। চলছে ত্রাণ বণ্টনের কাজও। আর রাজ্যের যে ১০৩টি পুর এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ পুরোপুরি বা আংশিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল তার মধ্যে ৯৪টি পুর এলাকার বেশির ভাগ জায়গাতেই বিদ্যুৎ সরবরাহ ফিরেছে বলে এ দিন জানানো হয়েছে নবান্নের তরফে।
রাজ্য সরকারের তরফ থেকে এ দিন যে হিসেব দেওয়া হয়েছে, তাতে দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার ছবিই উঠে এসেছে। নবান্ন জানিয়েছে যে, বিধ্বস্ত এলাকাগুলিতে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে কাজ করছেন রাজ্য সরকারের কর্মীরা। কলকাতা ও বৃহত্তর কলকাতা এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে সিইএসসি। রাজ্যের অন্যত্র এই কাজের দায়িত্ব পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার (ডব্লিউবিএসইডিসিএল)। দুই সংস্থার তথ্য পরিসংখ্যান তুলে ধরে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন নবান্নে বলেছেন, ‘ডব্লিউবিএসইডিসিএল-এর ৫৮টি ট্রান্সমিশন সাব স্টেশন বিকল হয়েছিল। তার সব ক’টিই চালু করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে অকেজো হয়ে পড়া ২৭৩টি ডিস্ট্রিবিউশন সাব-স্টেশনের মধ্যে ২৫৯টি মেরামত করে কাজ শুরু করা গিয়েছে।’
আমপানের তাণ্ডবে বিদ্যুৎ সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে ১০৩টি পুর এলাকায়, তার মধ্যে ৯৪টি-ই বিদ্যুৎ সংযোগ ফিরে পেয়েছে বলে জানিয়ে নবান্নের তরফে বলা হয়েছে যে, কিছু কিছু জায়গা বিদ্যুৎহীন থাকতে পারে। তবে সেই সব জায়গাতেও দ্রুতগতিতে কাজ চলছে বলে স্বরাষ্ট্রসচিব জানিয়েছেন। বাকি ৯টি পুরসভায় আংশিক সংযোগ দেওয়া সম্ভব হয়েছে এবং এই ন’টি পুরসভাই দুই ২৪ পরগনার মধ্যে পড়ছে বলে জানানো হয়েছে।
বিদ্যুৎ সরবরাহ দ্রুত স্বাভাবিক করার জন্য রাজ্য প্রশাসন যে ভাবে ঝাঁপিয়েছে, তার অনেকটাই কিন্তু সম্ভব হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত সক্রিয়তায়। ঘূর্ণিঝড়ের পরের দিন কয়েক কলকাতা এবং শহরতলির নানা এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ না ফেরায় বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। অবরোধ চলছিল যত্রতত্র। এই পরিস্থিতি চলতে দিতে চাননি মুখ্যমন্ত্রী। তিনি নিজেই পৌঁছে গিয়েছিলেন সিইএসসি সদর দফতরে। সেখানকার আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করে দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার পরিকল্পনা তৈরি করে দিয়ে এসেছিলেন। তারপরই শহরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সংযোগ ফেরানোর কাজ আরও গতি পায়।