জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ী – বঙ্গদেশে প্রতিভার আঁতুড়ঘর। পাথুরিয়াঘাটা থেকে বেরিয়ে এসে নীলমণি জোড়াসাঁকোয় যে বাড়িটা তৈরি করেছিলেন সেটার বর্তমান ঠিকানা – ৬, দ্বারকানাথ ঠাকুর লেন। আক্ষরিক অর্থে নীলমণি ঠাকুরের জন্মসাল পাওয়া যায় না, তবে ঠাকুরবাড়ীর পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, তিনি দর্পনারায়ণ ঠাকুরের থেকে বছর সাতেকের বড় ছিলেন। তার অর্থ, নীলমণি ঠাকুর ১৭২৪ সালে জন্মেছিলেন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ীতে গৃহপ্রবেশের সময় তাঁর বয়স ছিল ষাট বছর। ইংরেজি ক্যালেন্ডারের হিসেবে সেটা ছিল ১৭৮৪ সাল। ঠাকুরবাড়ীর পুত্রসন্তানদের মধ্যে সেই বাড়িতে প্রথম জন্মেছিলেন রাধানাথ ঠাকুর। দ্বারকানাথ, রমানাথ এবং মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ প্রমুখ, দ্বারকানাথের পুত্ররা ও রবীন্দ্রনাথ সমেত মহর্ষির পুত্ররা এই বাড়িতেই জন্মেছিলেন। বর্তমানে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ীর যে চেহারা দেখা যায় সেটা দ্বারকানাথ ঠাকুরের সংযোজন। ৫ নং দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনে তিনি তাঁর বৈঠকখানার বাড়িটা তৈরি করিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে, ৬ নং বাড়িটি পেয়েছিলেন বড় ছেলে দেবেন্দ্রনাথ এবং ৫ নং বাড়িটি পেয়েছিলেন গিরীন্দ্রনাথ। বাড়ি দুটো আলাদা, কিন্তু একটাই প্রধান ফটক। এই বাড়ির ঘরে ঘরে প্রতিভার মিছিল। দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, গণেন্দ্রনাথ, গুণেন্দ্রনাথ, স্বর্ণকুমারী, সুধীন্দ্র, সুরেন্দ্র, হিতেন্দ্র, ক্ষীতিন্দ্র, রীতেন্দ্র, বলেন্দ্র, গগনেন্দ্র, অবনীন্দ্র, ইন্দিরা, রথীন্দ্র, দীনেন্দ্র, সৌমেন্দ্র, সুভোগেন্দ্র (সুভো), বাসবেন্দ্র প্রমুখ প্রতিভা বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের এক একটা বিশিষ্ট নাম। আর আছেন জোড়াসাঁকোর নক্ষত্রমণ্ডলে সূর্য – রবীন্দ্রনাথ। গগনেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, সুনয়নী দেবী জন্মেছিলেন পাঁচ নম্বর বাড়িতে – ছবির জগতে এই অসামান্য প্রতিভাদের নতুন করে পরিচয় দেবার পরিচয় নেই। শুধু জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ীর প্রতিভার সরণিতে আরও এক চিত্রকরের নাম যোগ করা যায় – অসিতকুমার হালদার, তাঁর জন্মও হয়েছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে।
সাবেক বাঙালিবাড়ীর বারান্দা, ঠাকুরদালান, উঠোন ইত্যাদি নিয়ে গড়ে ওঠা নীলমণি ঠাকুরের বাড়ি শৌখিন দ্বারকানাথ ঠাকুরের হাতে চাকচিক্যময় চেহারা পেয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পরে সেই চাকচিক্য বদলে যায়, ঠাকুরবাড়ীর জীবন ভিন্ন রূপ নেয়, বিলাসবহুল আবহাওয়াও বদলে যায়। দ্বারকানাথের মৃত্যুর পরে তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই রমানাথ কয়লাহাটায় গিয়ে বাড়ি করেন, সেখান থেকেই কয়লাহাটা ঠাকুরবাড়ীর সূচনা হয়েছিল – পরে বাঙ্গুর এভিনিউ তৈরির সময় সেই বাড়ী ভাঙা পড়ে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ী নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেছেন তাঁদের অভিমত যে, দ্বারকানাথের মতন শৌখিন ও রুচিশীল মানুষের উপযুক্ত স্থাপত্যের পরিচয় কিন্তু ঠাকুরবাড়ীতে নেই। দ্বারকানাথ ম্যাকিনটশ বার্ন কোম্পানীকে দিয়ে বাড়িটা সংস্কার করিয়েছিলেন, তাই বাড়ির গায়ে সাহেবিয়ানার ছাপ প্রকট। চালাঘর ও মন্দির ছাড়া বাঙালির কেন কোন নিজস্ব স্থাপত্যরীতি নেই, যুগ পরম্পরায় কেন সেই ঐতিহ্য গড়ে ওঠেনি, তার উত্তর পাওয়া মুশকিল। বাঙালি এত কিছু করল, এত কিছু ভাবল, কিন্তু বাঙালির নিজস্ব স্থাপত্যরীতি কোথায়? সাহিত্যে, শিল্পে, এমনকি বিজ্ঞানের কিছু জটিল শাখা-প্রশাখাতেও বাঙালির নিজস্ব কিছু পরিচয় গড়ে উঠেছে – কিন্তু বাদ গিয়েছে স্থাপত্যের দিকটাই। এই শূন্যতার দায়ভাগ বাঙালি এখনও বহন করে চলেছে। এখন এত যে ‘হাইরাইজ’ বাড়ি উঠছে, তার কারণ সম্ভবতঃ এই যে, শহরে জায়গার বড়ই অভাব। অল্প জায়গাকে যতটা সম্ভব ব্যবহারিক প্রয়োজনে লাগানো যায়, সেই চেষ্টাই চলছে। কিন্তু সেই সঙ্গে মর্মান্তিকভাবে আমরা নিজস্বতা ও গোপনীয়তা হারিয়ে ফেলেছি। মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ওপরে উঠে যাবার মধ্যে যে ছিন্নমূল মানসিকতা এবং স্বাৰ্থপরতা ও নিরাপত্তাহীনতা কাজ করে, এখনকার উঁচু উঁচু ঘরবাড়ীর মধ্যে অভ্রান্তভাবে তার ছায়া পড়ছে। কোন বাড়ি দেখে যদি বোঝাই না যায় যে সেই বাড়ির মালিক কেমন, তাহলে তার স্থাপত্যমূল্য সম্পর্কেই প্রশ্ন ওঠে না। এ এক করুণ অবস্থা। বাঙালির গৃহসজ্জারও একটা বাঁধাধরা ছক তৈরি হয়ে গেছে।
আর এখানেই রবীন্দ্রনাথকে বিশেষভাবে মনে পড়ে। সবার প্রতিদ্বন্দ্বী আছে, কিন্তু তিনি এখনও প্রতিদ্বন্দ্বীহীন। বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে তাঁকে আলাদা আলাদাভাবে অনুভব করতে হয়। কোথায় যে তিনি নেই সেটাই তখন ভাবতে হয়। প্রচলিত শিল্পসত্বার বাইরে তাঁর অস্তিত্ব ও উপস্থিতি হঠাৎ-হঠাৎ আবিষ্কার করা যায়। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথ যে স্থাপত্যরীতি নিয়ে রীতিমতো চিন্তাভাবনা করেছিলেন তার প্রমাণ শান্তিনিকেতনের ‘উত্তরায়ণ’ কমপ্লেক্স। এই ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ পাশে পেয়েছিলেন নন্দলাল বসু, রামকিঙ্কর বেইজ ও বিশেষ করে সুরেন করকে। নিঃসন্দেহে ‘শ্যামলী’ই হল বাঙালির স্থাপত্যরীতির মডেল। যেটা কলকাতায় করা সম্ভব হয়নি, রবীন্দ্রনাথ সেটাকেই শান্তিনিকেতনে রূপ দিয়েছিলেন।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ী এখন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। রবীন্দ্রভারতী মিউজিয়াম সংশ্লিষ্ট যুগ ও কালকে চমৎকারভাবে ধরে রেখেছে। কিন্তু ঠাকুরবাড়ী কমপ্লেক্সে রবীন্দ্রভারতী সোসাইটির কুলুপ আঁটা তোরঙ্গে গগনেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল ও অসিতকুমারের বহু ছবি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাচ্ছে। এ থেকেই বোঝা যায় যে, ঠাকুরবাড়ীর মুক্ত, স্বাধীন শিল্পীদের সাধনার তাৎপর্যটাই আমরা অনুধাবন করতে পারিনি। জীবনকে শিল্পের মতন গড়ে তোলার যে কাজ ঠাকুরবাড়ীতে শুরু হয়েছিল, আমাদের হাতে সেটা অসমাপ্তই থেকে গিয়েছে।
(তথ্যসূত্র:
১- বনেদি কলকাতার ঘরবাড়ি, অলক মিত্র ও দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স।
২- জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার, অমিতাভ চৌধুরী, সপ্তর্ষি প্রকাশন।
৩- রবীন্দ্রনাথ ও জোঁড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি কিছু ভাবনা, প্রত্যূষ কুমার রীত, নান্দনিক।)