রবীন্দ্রনাথের প্রথম পরিচয় – তিনি একজন বিশ্ববরেণ্য কবি, যদিও রাজনীতি নিয়ে অনেক সময় তিনি মতামত দিয়েছেন। তাছাড়া নোবেল পুরস্কার লাভ কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দেশে ও বিদেশে তাঁকে নিয়ে নানা ধরনের অপপ্রচার, গোষ্ঠীগঠন, ষড়যন্ত্র হয়েছে, এমনকি তাঁকে গোয়েন্দা নজরদারিতে পর্যন্ত পড়তে হয়েছে। কিছু তৎকালীন সংবাদপত্রে বেরিয়েছে, কিছু বা তেমন করে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নি। রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্রে রেখে, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এমন কয়েকটি ঘটনার কথা ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে আনা যাক।
অমর বিপ্লবী শ্রী ক্ষুদিরাম বসু ও শ্রী প্রফুল্ল চাকীর কিংসফোর্ড সাহেব কে বোমা মেরে হত্যার প্রচেষ্টা ছিল তৎকালীন অবিভক্ত বঙ্গের প্রথম বোমা দ্বারা হত্যার মামলা। এর আগে বঙ্গে বৈপ্লবিক কার্যকলাপে বোমার ব্যবহার হয় নি।
বঙ্গদেশ তথা কলকাতার অগ্রগণ্য সংবাদপত্র রামানন্দ চট্যোপাধ্যায়ের ‘মডার্ন রিভিউ’-এ এই বোমাকাণ্ড নিয়ে কয়েকটি সম্পাদকীয় প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় (জুন, ১৯০৮)। সেগুলোর কয়েকটার বিষয় ছিল –
(১) রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ও পাশ্চাত্য ভাবাবেগ,
(২) বাঙলায় সন্ত্রাসবাদের উৎপত্তি,
(৩) বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে রাজনৈতিক হত্যা,
(৪) হত্যার মাধ্যমে রাজনৈতিক মতাধিকার,
(৫) কী ভাবে সাহস করতে হয় ও মরতে হয়,
(৬) পথের সমস্যা,
(৭) গীতা ও বোমানিক্ষেপ ইত্যাদি।
এর মধ্যে দ্বিতীয় রচনাটির কিছু অংশের মর্মার্থ ছিল এরকম –
“বাংলার সন্ত্রাসবাদের চরম কারণ খুঁজতে হবে সরকারের একান্ত স্বার্থপর, উদ্ধত ও উৎপীড়নমূলক নীতির মধ্যে আর অধিকাংশ সরকারি ও বেসরকারি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানেরা যে-রকম ঘৃণাপূর্ণ ও অপমানজনক ভাবে বাঙালিদের সঙ্গে কথা বলে আর ব্যবহার করে, তার ভেতরে। চরিত্রে আর পদ্ধতিতে প্রশাসনের যেভাবে রুশীকরণ করা হয়েছে, তার ফলেই জনগণের এক ক্ষুদ্র অংশ রুশ সন্ত্রাসবাদী পদ্ধতির অবলম্বনকারীতে পরিণত হয়েছে। এটা শুধুই ক্রিয়া আর প্রতিক্রিয়ার প্রশ্ন – ‘উত্তেজনা’ আর তার ‘সাড়া’র ব্যাপার। … এর ফল দাঁড়াল একটা ভুল, যার পরিণতি ভয়াবহ। যে লোকটিকে তারা মারতে চেয়েছিল, তার পরিবর্তে হত্যা করে বসল দু’ জন নিরপরাধা স্ত্রীলোককে, যাদের মৃত্যুতে গভীর শোকপ্রকাশ করা হচ্ছে।”
উদ্ধৃত মন্তব্যে মূলত ভারতে ইংরেজের শাসনপ্রক্রিয়া ও ব্যবহারকে বোমার রাজনীতির জন্য দায়ী করা হলেও এর ঠিক পরেই ‘বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে রাজনৈতিক হত্যা’ শিরোনামে মন্তব্য করা হয়েছিল,
“এটা হচ্ছে অবধারিত ভাবে বোমা ছুঁড়ে রাজনৈতিক হত্যাসাধন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এতে মরে নিরীহ মানুষেরা, যাদের বোমা নিক্ষেপকারীরা দোষী মনে করছে, তারা নয়। এমন কি, যখন দ্বিতীয়োক্ত মানুষেরা মরে, তখনও তাদের সঙ্গে কিছু নিরীহ মানুষেরও প্রাণ যায়। তাই এই পদ্ধতি নিশ্চিতভাবেই বেপরোয়া, খারাপ এবং এর সঙ্গে আমরা যোগ করতে পারি – কাপুরুষোচিত। কারণ একজন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার মধ্যে কোনো বীরত্ব তো নেই-ই, সর্বোপরি তার সামনাসামনি আসার সাহস ও হত্যাকারীর নেই।”
একই রকম ভাবে উপরিউক্ত চতুর্থ ও পঞ্চম প্রবন্ধগুলোতেও বোমার কারবারীদের যথেষ্ট নিন্দা করা হয়েছিল।
এর পাশাপাশি বাংলার পুরানো পত্রিকা ‘হিতবাদী’-র যুক্তি ছিল সোজা ও তীক্ষ্ণ –
“বলা হচ্ছে যে, ক্ষুদিরাম হত্যা, কাপুরুষোচিত কাজ ও নারকীয় অস্ত্র ব্যবহারের জন্য অপরাধী। জবাবে বিপ্লবীরাও বলতে পারে যে, প্রত্যেক শাসক, যে মানুষকে নিষ্পেষিত করে ও তাদের ফাঁসিকাঠে ঝোলায়, একই অপরাধে দোষী।” (২৮শে মে, ১৯০৮)
বাংলার এই কয়েকটি সংবাদপত্রের নামী সম্পাদকদের মন্তব্যকে বাদ দিলে একজন ছাড়া এখানকার আর কোনও লেখক বুদ্ধিজীবীই বাংলার এই বোমার আবির্ভাবে মতপ্রকাশে অধুনা মহারাষ্ট্রের গঙ্গাধর তিলক বা পরাঞ্জপের মতো তেমন ভাবে এগিয়ে আসেননি! মহারাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবীদের এইসব মন্তব্য প্রকাশের সমকালে ওই বোমার রাজনীতির রঙ্গভূমি বঙ্গদেশে ওই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় যিনি প্রকাশ্যে মন্তব্য করার কর্তব্যবোধ ও সৎসাহস দেখিয়েছিলেন, তিনি অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের স্পষ্ট ও প্রথম প্রতিক্রিয়া দেখা যায় মজঃফরপুর বিস্ফোরণের দু’ দিন পর কালীমোহন ঘোষকে লেখা তাঁর চিঠির এই মন্তব্যে –
“মজঃফরপুরে বম্ব ফেলিয়া দুইটি ইংরেজ স্ত্রীলোককে হত্যা করা হইয়াছে শুনিয়া আমার চিত্ত অত্যন্ত পীড়িত হইয়া আছে। এইরূপ অধর্ম ও কাপুরুষতার সাহায্যে দেশকে যাহারা বড় করিতে চায় তাহাদের কিসে চৈতন্য হইবে জানিনা, কিন্তু তাহারা সমস্ত দেশকে বিষম দুঃখে ফেলিবে। ধর্মের মুখ চাহিয়া দুঃখ সহা যায় কিন্তু এমন পাপের বোঝা দেশ কি করিয়া বহন করিবে?” (১৯শে বৈশাখ, ১৩১৫)
এর কাছাকাছি সময়েই (৬ই মে) নির্ঝরিনী সরকারকে লেখা এক চিঠিতে গুপ্তবিপ্লববাদ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের অকপটে লেখেন, যে-উদ্দেশ্যেই গুপ্তহত্যার রাজনীতি প্রয়োগ করা হোক, তা পাপ এবং তার শাস্তি বিধাতার বিধান বলে অবশ্যস্বীকার্য –
“নিজের বা পরিবারের বা দেশের কাজে ধর্মকে লঙ্ঘণ করিলে ঈশ্বর ক্ষমা করেন না। যদি মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যও পাপকে আশ্রয় করি, তবে তাহার প্রায়শ্চিত্ত করিতেই হইবে … দেশের যে দুর্গতি আমরা আজ পর্যন্ত ভোগ করিয়া আসিতেছি তাহার গভীর কারণ আমাদের জাতির অভ্যন্তরে নিহিত হইয়া রহিয়াছে – গুপ্ত চক্রান্তের দ্বারা নরনারী নরহত্যা করিয়া আমরা সে কারণ দূর করিতে পারিব না আমাদের পাপের বোঝা কেবল বাড়িয়াই চলিবে।”
বোমার বিপ্লবীদের গ্রেপ্তারের সপ্তাহ তিনেক পরেই ২৫শে মে কলকাতায় এক জনসভায় তিনি তাঁর সুদীর্ঘ প্রবন্ধ ‘পথ ও পাথেয়’ পাঠ করেন। এতে তিনি স্পষ্টতই ধৃত বিপ্লবীদের প্রতি কিছুটা নরম মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন তাঁদের নিন্দায় আর পাঁচজনের সঙ্গে গলা মেলাতে অস্বীকার করে। এটা লক্ষ্য করার মতো ব্যাপার যে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাষাভঙ্গীতে এ কথা প্রচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করেননি, এই স্বদেশী যুবকদের ভাগ্যে যে দোর্দন্ড রাজশক্তির খাঁড়া ঝুলছে, এ কারণেও তাঁদেরও সমবেদনা প্রাপ্য। তাঁর ভাষায় –
“যাহারা অপরাধ করিয়াছে, ধরা পড়িয়াছে, নির্মম রাজদন্ড যাহাদের ’পরে উদ্যত হইয়া উঠিয়াছে, আর কিছু বিচার বিবেচনা না করিয়া কেবলমাত্র বিপদ ঘটাইয়াছে বলিয়াই তাহাদের প্রতি তীব্রতা প্রকাশ করাও কাপুরুষতা। তাহাদের বিচারের ভার এমন হাতে আছে যে, অনুগ্রহ বা মমত্ব সেই হাতকে লেশমাত্র দন্ডলাঘবের দিকে বিচলিত করিবে না। অতএব ইহার উপরেও আমরা যেটুকু অগ্রসর হইয়া যোগ করিতে যাইব তাহাতে ভীরু স্বভাবের নির্দয়তা প্রকাশ পাইবে।”
যেসব ভারতীয়রা বিদেশী প্রভুকে তুষ্ট করতে স্বদেশী বিপ্লবীদের প্রাণ খুলে নিন্দা ও কঠোর ভাবে দমনের সুপারিশ করেছিলেন, তিলক তাঁর ‘কেশরী’ পত্রিকার প্রবন্ধে তাঁদের ধিক্কার দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথও যেন এই শ্রেণীর লোকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন এ-রকম সমালোচনার অমর্যাদাকর কাপুরুষতা।
রবীন্দ্রনাথ প্রথমেই স্বীকার করলেন যে বাংলাদেশের ‘মনের জ্বালা’ দেখতে দেখতে ক্রমশই যেমন অগ্নিমূর্তি ধরে প্রকাশ পাচ্ছে, আমাদের জ্ঞানী দূরদর্শী ব্যক্তিরাও এটা কল্পনা করতে পারেননি কিন্তু কোন পক্ষের বিরুদ্ধে এই গোলমালের দিনে নালিশ তোলা তাঁর উদ্দেশ্য নয়, এর কার্যকারণ ও ফলাফল নিরপেক্ষভাবে বিচার করে পথ খোঁজাই তাঁর অভিপ্রায়। স্পষ্টতই এই প্রবন্ধে সশস্ত্র বিপ্লববাদকে তিনি মন থেকে সমর্থন করতে পারেননি। তাই তিনি বললেন, যে-চিত্তদাহের উত্তেজনা “আমরা প্রত্যেকে নানাপ্রকারে অনুভব ও প্রকাশ করিয়াছি, তাহারই একটি কেন্দ্রক্ষিপ্ত পরিণাম যদি এই প্রকার গুপ্তবিপ্লবের অদ্ভুত আয়োজন হয়, তবে ইহার দায় ও দুঃখ বাঙালিমাত্রকেই স্বীকার করিতে হইবে। …”
‘কেশরী’তে তিলকের প্রবন্ধগুলিতে দেখা যায় যে, বোমাকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও বিপ্লবীদের বোমাবাজি যে সমর্থনযোগ্য নয়, সেকথাও (হয়তো বা আইন বাঁচাবার জন্যই) উল্লেখ করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু গুপ্তবিপ্লবকে আন্তরিক ভাবেই পছন্দ করেন না, যদিও এর কার্যকারণ সম্পর্কে তাঁর অনেক বিশ্লেষণই কিন্তু তিলকের সঙ্গে মিলে যায়। কিছু সাদৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।
বোমার আবির্ভাব যে কাপুরুষ বাঙালির রূপান্তর ঘটিয়েছে, ‘মারাঠা’ পত্রিকার এই মতের প্রতিধ্বনি করে রবীন্দ্রনাথও বলেন,
“বহুদিন হইতে বাঙালিজাতি ভীরু অপবাদের দুঃসহ ভার বহন করিয়া নতশির হইয়াছে বলিয়াই বর্তমান ঘটনা সম্বন্ধে ন্যায়-অন্যায় ইষ্ট-অনিষ্ট বিচার অতিক্রম করিয়াও অপমান-মোচন উপলক্ষে বাঙালির মনে একটা আনন্দ না জন্মিয়া পারে নাই।”
দ্বিতীয়ত মজঃফরপুরের বিস্ফোরণের মতো ঘটনার পেছনে মূল কারণ যে শাসকদের বৈষম্য ও দমননীতি আর দেশের লোকের আহত আত্মসম্মান – এই রোগনির্ণয় তিলকের মতো রবীন্দ্রনাথেরও –
“একদিকে প্রজার বেদনাকে উপেক্ষা করিয়া বলপ্রকাশ প্রবল মূর্তি ধরিতেছে, অন্যদিকে দুর্বলের নিরাশ মনোরথ সফলতার কোন পথ না পাইয়া প্রতিদিন মরিয়া হইয়া উঠিতেছে। এ অবস্থায় সমস্যাটি ছোট নহে।”
বিপ্লবীদের অধীর অসহিষ্ণু এবং বুদ্ধিভ্রষ্ট বলে রবীন্দ্রনাথ যে ভাবে ভর্ৎসনা করলেন, তিলক ততটা না করলেও তাঁদের কাজের জন্য তিলকের মতো নেতাদের দায়ী করাকে তিনিও সমর্থন করেন না, এটাই তিলকের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের তৃতীয় সাদৃশ্য। চতুর্থতঃ রবীন্দ্রনাথও তিলকের মতো মনে করেছিলেন যে, নিছক বলপ্রয়োগ করে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় –
“বিরোধবুদ্ধি এতই গভীর ও সুদূরবিস্তৃত ভাবে পরিব্যাপ্ত যে, কর্তৃপক্ষ ইহাকে বলপূর্বক কেবল স্থানে স্থানে উৎপাটিত করিতে চেষ্টা করিয়া কখনোই নিঃশেষ করিতে পারিবন না, বরঞ্চ ইহাকে আরও প্রবল ও প্রকাণ্ড করিয়া তুলিবেন।”
রবীন্দ্রনাথ একথা বলে রাজশক্তিকে যেমন হুঁশিয়ারি দিতে চাইলেন, তেমনি আবার তাদের স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, ‘শক্তস্য ভূষণং ক্ষমা’ – যদিও তাঁর এই ‘সাত্ত্বিক উপদেশ’ রাজপুরুষেরা শ্রদ্ধা সহকারে শুনবেন, এমন ভরসা যে তাঁর নেই, সে কথাও স্বীকার করলেন। কিন্তু এদের মধ্যে যে সব লোক গুপ্ত পন্থাকেই রাষ্ট্রহিতসাধনের একমাত্র পথ বলে স্থির করেছে, তাদের গালি দিয়েও কোন ফল হবেনা, আবার ধর্মোপদেশ দিতে গেলেও তারা হেসে উড়িয়ে দেবে। অত্যাচারী কর্তৃপক্ষ আর চরমপন্থী দেশবাসী- এদের কারও সমর্থনই রবীন্দ্রনাথ করেননি। তাই এই দুই পক্ষের সংঘর্ষ তাঁর কাছে অধর্ম সংঘর্ষ, যার অগ্নিদাহ তাঁর মতে সহ্য করতে হবে নিরীহ তৃতীয় পক্ষকেও, যারা প্রত্যক্ষ ভাবে এ সব কাজে লিপ্ত নয়। তাঁর মূল বক্তব্য তাই নিছক উপদেশের খাতিরে নয়, বাস্তব প্রয়োজনের দিক থেকেই এবং সেই বাণী হলো এই যে, প্রয়োজন অত্যন্ত গুরুতর হলেও প্রশস্ত পথ দিয়েই তা মেটাতে হয় – সংকীর্ণ রাস্তা ধরে কাজ সংক্ষেপ করতে গেলে একদিন দিক ভুল হয়ে পথও হারাতে হবে, কাজও নষ্ট হবে।
এই ‘পথ ও পাথেয়’ প্রবন্ধটির বক্তব্যে বঙ্গদেশে কিছু প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, সে কথা রবীন্দ্রনাথ নিজেই উল্লেখ করেছেন। তাঁর কাছে এটা শুধু ‘নির্বিচার নিষ্ঠুরতা’ই নয়, এই পথের পথিকেরা তাঁর চোখে নিছকই ‘ক্ষুদ্র স্বার্থের’ পূজারী। বিপ্লববাদীদের সম্পর্কে অনুকম্পা প্রকাশ করেও তাঁদের আদর্শ সম্বন্ধে এই সব কঠোর মন্তব্যই এই ভাষণটি সম্পর্কে জনমনে প্রতিকূলতা সৃষ্টির সম্ভাব্য কারণ বলে মনে করলে হয়তো অসঙ্গত হবেনা, কারণ এই বিপ্লবীরা ক্ষুদিরামের বোমা-কাণ্ডের পর থেকেই জনতার বীরপূজা পেতে শুরু করেছিলেন। তাই এই প্রতিকূলতার কারণেই নিজের অভিমত খোলসা করতে রবীন্দ্রনাথকে পুনশ্চ কলম ধরতে হয়, লিখতে হয় ‘সমস্যা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি।
এই রচনাটিতে তিনি ভারতবাসীর প্রতি শাসক ইংরেজের অমানবিক ব্যবহার, তাদের তল্পিবাহক মুখপাত্রদের দ্বারা স্পর্ধিত দোষারোপ ও স্বদেশী দাবিকে অবদমিত করার ফতোয়ার কথা স্পষ্ট করেই উল্লেখ করলেন এবং এগুলোকেই ভারতবর্ষের চরম হিত যে কী, তা বোঝার পথে সর্বপ্রধান বাধা বলে উল্লেখ করলেন। তাঁর মতে ইংরেজ কোনোমতেই ভারতীয়দের মানবপ্রকৃতি বলে গণ্য করতে চায়না। জনমনের আলোচ্য ক্ষোভের পেছনে যে ইংরেজ শাসকের দুঃশাসন- নীতিই দায়ী, আর এর উপশম যে আরও উৎকট পীড়ন দিয়ে করা যাবেনা, এ-কথা শাসকদের তীব্র ভাষায় স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, যে-সব ইংরেজশাসক বলেন, ‘কাগজগুলোকে উচ্ছেদ করো, সুরেন্দ্রবাঁড়ুয্যে বিপিনপালকে দমন করিয়া দাও’, দেশকে ঠাণ্ডা করার এই একমাত্র উপায় যারা অনায়াসে কল্পনা করতে পারে আর অসঙ্কোচে প্রচার করতে পারে, তাঁরা যে দেশের শাসকপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, এটাই কি দেশের রক্ত গরম করে তোলার পক্ষে প্রধান কারণ নয়! বঙ্গদেশের এক ভূতপূর্ব হর্তাকর্তা, ইলিয়ট বলেছিলেন যে, ভারতবর্ষে যারা ইংরেজের গায়ে হাত তোলে, তাঁরা যেন কোনওমতেই নিষ্কৃতি না পায়, সে-বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এ কথা উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন করেন –
“আর যে সকল ইংরেজ ভারতবর্ষীয়কে হত্যা করিয়া কেবলই দন্ড হইতে অব্যাহতি পাইয়া ব্রিটিশ বিচার সম্বন্ধে চিরস্থায়ী কলঙ্কের রেখা আগুন দিয়া ভারতবর্ষের চিত্তে দাগিয়া দিতেছে তাহাদের সম্বন্ধেও সতর্ক হইবার কোনো প্রয়োজন নাই?”
দেখা যাচ্ছে, ‘বলদর্পে অন্ধ ধর্মবুদ্ধিহীন’ ইংরেজ শাসনের এই স্পর্ধাকে ধিক্কার দিতে রবীন্দ্রনাথ কোনরকম দ্বিধা প্রকাশ করলেন না এবং দেশের লোকের যে অসন্তোষ তাঁদের ইংরেজের গায়ে হাত তোলায় প্ররোচিত করেছে, তার জন্য ইংরেজ শাসনের ঐ চরিত্রকেই নিঃসঙ্কোচে দায়ী করলেন। শুধু তা-ই নয়, আত্মপ্রসাদস্ফীত বিদেশী শাসককে মহাকালের কন্ঠে শুনিয়ে দিলেন, তাঁরা জেলে দিতে পারে, ফাঁসি দিতে পারে, কিন্তু নিজের রাজদন্ডকে যদি বিশ্ববিধানের চেয়ে বড় বলে জ্ঞান করে, তবে তার স্তূপীকৃত সেই পাপের বোঝার ঘোরতর অসামঞ্জস্য একদিন নিদারুণ বিপ্লবে পরিণত না হয়ে পারেনা। অর্থাৎ তিনি যদিও তিলকের মতো বোমার রাজনীতিকে নামমাত্র নিন্দা করে বোমার পক্ষে যুক্তির কথা জোর গলায় বললেন না, বরং আরও অগ্রসর হয়ে ক্ষুদিরামের মতো বিপ্লবীদের অনভিজ্ঞ, ক্ষুদ্র স্বার্থের অনুসারী ও নির্বুদ্ধিতার শিকার ইত্যাদি (‘পথ ও পাথেয়’ প্রবন্ধে) বলতেও দ্বিধা করলেন না বটে, কিন্তু এই বোমার রাজনীতির উদ্ভবকে তিনি ইংরেজের ঘৃণ্য নীতির প্রত্যাশিত পরিণতি বলে তিলক, বিপিনচন্দ্র ও অন্যান্য নেতাদের মতোই স্পষ্টভাষায় নির্দেশ করলেন, যা তিনি বাংলায় প্রাথমিক বিপ্লবকাণ্ডগুলির সূত্রে কিছুদিন আগেও উপলব্ধি করতে পারেননি -এটি অবশ্যই একটি লক্ষ্য করবার মতো ব্যাপার।
কোনও রাষ্ট্রনেতার ভাষণে বা রচনায় যে ঋজুতা সম্ভব ছিলনা, সেই স্পষ্টতর ভাষায় শাসকদের উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথ বললেন,
“যদি কেবল আমাদের দিকে তাকাইয়া এই কথাই বল যে, অকৃতার্থের অসন্তোষ ভারতের পক্ষে অকারণ অপরাধ এবং অপমানের দুঃখদাহ ভারতের পক্ষে নিরবচ্ছিন্ন অকৃতজ্ঞতা – তবে সেই মিথ্যাবাক্যকে রাজতক্তে বসিয়া বলিলেও তাহা ব্যর্থ হইবে এবং তোমাদের টাইমসের পত্রলেখক, ডেলি মেলের সংবাদ রচয়িতা এবং পায়োনীয়র-ইংলিশম্যানের সম্পাদকে মিলিয়া তাহাকে ব্রিটিশ পশুরাজের ভীমগর্জনে পরিণত করিলেও সেই অসত্যের দ্বারা তোমরা কোনো শুভফল পাইবেনা। তোমার গায়ে জোর আছে বটে, তবু সত্যের বিরুদ্ধেও তুমি চক্ষু রক্তবর্ণ করিবে এত জোর নাই। নূতন আইনের দ্বারা নূতন লোহার শিকল গড়িয়া তুমি বিধাতার হাত বাঁধিতে পারিবে না।”
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের এ-সব নির্ভীক বক্তব্য যে-কারণেই হোক, রাজদ্রোহের দায়ে অভিযুক্ত না হলেও তিনি ব্রিটিশ শাসকদের কিছুই প্রায় বলতে বাকি রাখলেন না। ইলিয়টের মতো প্রাক্তন শাসকের দম্ভোক্তিকে তিনি সোজাসুজি মিথ্যাভাষণ বললেন, বিলেতি কাগজগুলোকে এক হাত নিতে ছাড়লেন না এবং লক্ষ করার বিষয়, ‘ব্রিটিশসিংহ’ না বলে ‘ব্রিটিশ পশুরাজ’ বললেন, যাতে তার পাশবিকতার প্রতি ইঙ্গিতটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। স্মরণীয় যে, প্রায় একই সতর্কবাণীকে রবীন্দ্রনাথ কয়েক বছর আগেই গানে বেঁধেছিলেন – “বিধির বাঁধন কাটবে তুমি, এতই শক্তিমান/ আমাদের ভাঙাগড়া তোমার হাতে এমনি অভিমান!/ শাসনে যতই ঘেরো, আছে বল দুর্বলেরও/ বোঝা তোর ভারী হলেই ডুববে তরী খান।” কিংবা – “ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে, ততই বাঁধন টউটবে/ ওদের আঁখি যতই রক্ত হবে, ততই আঁখি ফুটবে! …”, তখনও বাংলায় বোমার যুগ শুরু না হলেও ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কে তাঁর যে-ধারণা অনেকটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল, মজঃফরপুর-বিস্ফোরণের কার্যকারণ বিশ্লেষণে রবীন্দ্রনাথ যেন সে-ধারণারই যৌক্তিকতা খুঁজে পেলেন।
শুধু শাসকপক্ষকে ধিক্কার দিয়েই যে রবীন্দ্রনাথ ক্ষান্ত হলেন না, যে-কাজকে তিনি ‘অধর্ম’ ও ‘পাপ’ বলে মনে করেন, তাতে লিপ্ত হবার জন্য নিজের দেশের মানুষকে তিরস্কার করতেও ছাড়লেন না। ‘দেশহিত’ নামে তাঁর একটি প্রবন্ধেও (বঙ্গদর্শন, আশ্বিন, ১৩১৫) তিনি বিশেষ ভাবে অভিযোগের তর্জনী তুললেন গুপ্তবিপ্লবের হোতাদের দিকে –
“রাজার সন্দেহ জাগ্রত হইয়া আমাদের চারিদিকে যে শাসনজাল বিস্তার করিতেছে তাহার বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগ আমরা সর্বদা উচ্চকন্ঠেই প্রচার করিতেছি, কিন্তু যেখানে আমাদের স্বদেশের লোক আমাদের যজ্ঞের পবিত্র হুতাশনে পাপ-পদার্থ নিক্ষেপ করিয়া আমাদের হোমকে নষ্ট করিতেছে, তাহাদিগকে আমরা কেন সমস্ত মনের সহিত ভর্ৎসনা করিবার, তিরস্কৃত করিবার শক্তি অনুভব করিতেছি না। তাহারাই কি আমাদের সকলের চেয়ে ভয়ংকর শত্রু নহে।……”
গুপ্তবিপ্লবরূপী শক্তিসাধনায় যাঁরা মেতে উঠেছিলেন, বিশেষ ভাবে সেই বিপ্লবী দলগুলোকেই তিনি যেন মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন যা আসলে শক্তি নয়, শান্তির বিড়ম্বনা, শক্তিধর্মসাধনায় সেই উচ্ছৃঙ্খলতার মতো সর্বনেশে বিঘ্ন আর কিছুই নেই। তিনি লক্ষ্য করলেন, “আজ দস্যুবৃত্তি, তস্করতা, অন্যায় পীড়ন দেশহিতের নাম ধরিয়া চারিদিকে সঞ্চরণ করিতেছে।” তাই দেশবসীকে সতর্ক করে দিলেন যে, কেবলমাত্র বীর, ত্যাগী ও তপস্বীরাই আত্মহিত, দেশহিত ও লোকহিতের যথার্থ সাধক আর ধর্মই হচ্ছে প্রকৃত শক্তি। তাই “জাতির চরিত্রকে নষ্ট করিয়া আমরা জাতিকে গড়িয়া তুলিব”, এমনটা ভাবা ‘ভয়ংকর ভুল’।
এটা বুঝতে অসুবিধা হয়না যে, সমকালীন পরিস্থিতির মূল্যায়নে দুটি পরস্পর সংঘর্ষশীল পক্ষের মধ্যে যে কোনও একটির দিকে ঝুঁকে না পড়ে নিষ্কম্প কন্ঠে নিজের বিবেকের রায় উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন বলেই রবীন্দ্রনাথ এক অনন্য ও স্বতন্ত্র স্তম্ভপ্রতিম উচ্চতায় অধিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন, যা বেশ কিছুটা অপ্রিয়তা ও লোকনিন্দার মূল্য চুকিয়ে তাঁকে ক্রয় করতে হয়েছিল।
জীবনভর নানা অপবাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই দূষণ পর্বের শুরু করেছিলেন তখনকার সাহিত্যগুরু বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; আর শেষ তোপটি দেগেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভাইপো শিল্পরসিক সুভগেন্দ্রনাথ ঠাকুর ওরফে শুভো ঠাকুর। এই দুজনের মাঝখানে আরও অনেকেই ছিলেন – তাঁদের কেউ সুখ্যাত, কেউ স্বভাব-নিন্দুক, কেউ ঈর্ষালু, এমনকি বিদেশিরাও বাদ যাননি। এহেন মানুষটি যে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের একশ্রেণির আমলার — রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ছোট ইংরেজ’ – নজরদারির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবেন এ আর আশ্চর্য কী? ভারতের ব্রিটিশ রাজশক্তির কাছে তিনি ছিলেন – ‘Robi Tagore, I. B. Suspect Number 11’। ইতিহাসের কী বিচিত্র গতি, এই I. B. সন্দেহভাজনকেই জগৎ নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করে আর তাঁকেই নাইট উপাধি দিয়ে গৌরবান্বিত হয় স্বয়ং ব্রিটিশ রাজশক্তি।
পুলিশের নথিতে রবীন্দ্রনাথের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৯০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে, সরকারের কাছে পাঠানো আইজি পুলিশের এক বিশেষ রিপোর্টে। এতে বলা হয়েছে, ১৮৯৭ সালে ‘কবি-রাজনীতিবিদ’ (Poet-Politician) রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় ‘স্বদেশি ভান্ডার’ নামে এক প্রতিষ্ঠান খোলেন। তাঁর এই কার্যক্রম ছিল অরাজনৈতিক। এরপর থেকে গোয়েন্দাদের বিশেষ শাখার কয়েকটি প্রতিবেদনে রবীন্দ্রনাথকে কবি-রাজনীতিবিদ হিসেবে উল্লেখ করলেও কোনো বিশেষ রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতার উল্লেখ পাওয়া যায় না।
বিপ্লবী তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের পুলিশ প্রশাসনে দমন-পীড়ন কঠোর হতে লাগল। রবীন্দ্রনাথ কখনোই হিংসাত্মক কার্যক্রম কে সমর্থন করেননি। শান্তিনিকেতনকেও যথাসম্ভব সক্রিয় রাজনৈতিক কার্যকলাপের বাইরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। তবু বিপ্লবীদের দেশপ্রেম, তাঁদের আত্মত্যাগের প্রতি কবির শ্রদ্ধা ছিল গভীর। বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলনে তাঁর কিছুদিনের সংশ্রব ও সক্রিয় ভূমিকা ছিল, সন্দেহ নেই। কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর থেকে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সব অধিবেশনে তিনি উপস্থিত থেকেছেন। এসবই নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে মান্য বলে স্বীকৃত।
সেই উত্থান ও ঝঞ্ঝাবহুল সময়ে নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির সঙ্গে গুপ্ত বিপ্লবী দলের সহিংস সব কর্মসূচির মিল ছিল না ঠিকই। তবু এই দুই বিরুদ্ধ মতাদর্শের দলের মধ্যে কোনো যোগাযোগ ছিল না, এমন সিদ্ধান্তও যথার্থ নয়। সুরেন ব্যানার্জি, বিপিন পাল, চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। রাজনৈতিক গোয়েন্দা পুলিশের মূল্যায়নে তাই অনেক সময় নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন ও বিপ্লবী আন্দোলনের পথকে বিশেষ পার্থক্যসহকারে দেখা হতো না। যেকোনো প্রকার ব্রিটিশ বিরোধিতাকে ‘রাজদ্রোহ’ বলে তকমা এঁটে দেওয়া হতো।
শ্রী অরবিন্দ ঘোষের গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কার কথা শুনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘নমস্কার’ কবিতাটি রচনা করে সেটির এক কপি শ্রী অরবিন্দকে পাঠিয়ে দেন। কবিতাটি ৭ই সেপ্টেম্বর ১৯০৭-এর বন্দেমাতরম পত্রিকায় ছাপা হয়। বন্দেমাতরম -এর বিরুদ্ধে মামলায় অরবিন্দ আইনের ফাঁকে মুক্তি পেলেন, কিন্তু বিপিন পাল ছয় মাসের বিনা শ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। পত্রিকার প্রকাশকের দুই বছরের জেল হয়। রবীন্দ্রনাথের কবিতার সুর এবং তাঁর এহেন মনোভাব ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের যে খুব আশ্বস্ত ও সন্তুষ্ট করেনি, তা সহজেই অনুমেয়।
রবিঠাকুরের উদার মানবতাবাদ ও নিজস্ব শিক্ষাচিন্তা গোয়েন্দাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি। তাঁর প্রতিবাদের ভাষা সব সময় প্রচলিত স্লোগান অথবা আন্দোলনের পথে স্ফুরিত হয়নি। ‘নাইটহুড’ প্রত্যাখানের দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত কিংবা সাহিত্যের রূপকের মধ্য দিয়ে তাঁর আবেগ আরও তীব্রভাবে প্রকাশিত হয়েছে। কখনো কণ্ঠে ক্ষোভ ঝরিয়ে দেশবাসীর প্রতি অভিমান জানিয়ে তিনি লিখেছেন:
‘‘ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে
ততই বাঁধন টুটবে
মোদের ততই বাঁধন টুটবে।
ওদের যতই আঁখি রক্ত হব
মোদের আঁখি ফুটবে
ততই মোদের আঁখি ফুটবে। …’’
ইত্যাদি।
স্বভাবতই ইংরেজ সরকারের পক্ষে তাঁর কর্মপদ্ধতি পুরোপুরি বুঝে ওঠা হয়নি, ফলে তাদের চোখে তাঁর ক্রিয়াকাণ্ড ক্রমেই ‘সন্দেহজনক’ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের স্পষ্ট প্রকাশ ছিল না।
শান্তিনিকেতনে তাঁর ব্রাহ্মচর্যাশ্রমকে সরকারবিরোধী প্রতিষ্ঠান বলে সন্দেহ করা শুরু হয়। এমনকি গোয়েন্দারা সূক্ষ্মভাবে গুজব ছড়িয়েছিলেন, শান্তিনিকেতন আসলে একটি ‘রিফরমেটরি’। তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ ও আসাম সরকারের এক গোপন প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, সরকারি কর্মকর্তাদের সন্তানদের পক্ষে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন অবাঞ্ছিত। এই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করলে সরকারি কর্মচারীদের সন্তানেরা ভবিষ্যতে সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হতে পারে। পরে অবশ্য এই বিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলীতে বেশ কিছু রদবদল করার কারণে এই প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই যেসব ইউরোপীয় ও অন্য বিদেশি ভারতে ছিলেন, তাঁদের ওপর আইবি, সিআইডি কড়া নজর রেখেছিল। প্রথম মহাযুদ্ধের পর অনেক মনীষী অধ্যাপক ইউরোপ থেকে শান্তিনিকেতনে অধ্যাপনা করতে আসেন। রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণেই তাঁরা এসেছিলেন। যুদ্ধের সময় জার্মান ভারতীয় ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধে জার্মানির শত্রুতা এবং যুদ্ধোত্তরকালে বলশেভিক শত্রুতার ফলে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপ থেকে আগত ব্যক্তিদের সম্পর্কে ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগ সন্দিহান ছিল। ফলে বিশ্বভারতী ও শান্তিনিকেতনও তাঁদের নজরদারির মধ্যে চলে এল।
শান্তিনিকেতনের কর্মকাণ্ডের খবর সংগ্রহের জন্য ইংরেজ সরকারের প্রচেষ্টার বিরাম ছিল না। সরাসরি গোয়েন্দা বিভাগের এজেন্টরা শান্তিনিকেতনের ওপর নজর রাখত। শান্তিনিকেতনের ঠিকানায় পাঠানো চিঠি নিয়মিতভাবে সরকারি আদেশে খুলে পড়া শুরু হয়। শান্তিনিকেতন থেকে লেখা চিঠিও এই নজরদারির আওতায় ছিল। এ ছাড়া শান্তিনিকেতনের কিছু ছাত্র বা কর্মীকে চর হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল। অনেক সময়েই রবীন্দ্রনাথের চিঠি যে খুলে পড়া হয়েছে তা কবি বুঝতে পারতেন। একবার দুজন বিদেশিকে লেখা দুটি চিঠি একই খামের মধ্যে কবির কাছে পৌঁছেছিল। ক্ষুব্ধ কবি লিখেছেন: ‘বেশ বুঝা যাইতেছে আমাদের রাজকীয় শনির সন্দেহদৃষ্টি আমার প্রতি তীক্ষ্ণভাবে পড়িতেছে।’ (রবীন্দ্রনাথ, এন্ডরুজ পত্রাবলি, পৃষ্ঠা- ২১২)।
১৯২৫ সালে গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্মকর্তা তাঁর উপরিওয়ালা ব্রামফিল্ডের কাছে লেখা একটি চিঠি সম্প্রতি উদ্ঘাটিত হয়েছে। এই চিঠিতে দেখা যায়, শান্তিনিকেতনের এক ছাত্র সেখানকার অন্যান্য ছাত্র, শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষের আচরণের বিস্তারিত খবর দিয়েছেন। এই ছাত্রটি নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে বিশ্বভারতীতে ভর্তি হন এবং এক সপ্তাহ পর বোর্ডিংয়ে তিনজন গুজরাটি ছাত্রের ঘরে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। চিঠিতে আশ্রমের পরিবেশ সম্পর্কে চর-ছাত্রের মন্তব্য – ‘সেখানকার সাধারণ আবহাওয়া এই রূপ যে সকলেই যাচিয়া আলাপ-পরিচয় করে, কিন্তু সহজে ঘনিষ্ঠতায় আসে না।’ এই হাতে লেখা চিঠিতে তৎকালীন ছাত্র পুলিনবিহারী সেন, মনমোহন ঘোষ, কৃষ্ণ আইয়ার এবং বিভিন্ন শিক্ষকের বিস্তারিত পরিচয় আছে, বিশেষত তাঁদের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত প্রেক্ষাপট তুলে ধরার কোনো ঘাটতি ছিল না। পুলিনবিহারীর পিতা ময়মনসিংহের ‘নন কো-অপারেশন’ আন্দোলনের নেতা ছিলেন, মনোমোহন ঘোষের ঘরে বলশেভিক পুস্তক থাকত ইত্যাদি সংবাদের সঙ্গে শান্তিনিকেতনের অন্যান্য শিক্ষকেরও পরিচয় দেওয়া হয়েছে।
আবার মনমোহন ঘোষ সম্পর্কে ওই চরের ভাষ্য, ‘তাহাকে দেখিয়াই আমার কেমন সন্দেহ হইত। সে ছাত্রদের কাহারও সঙ্গে মিলিত না, কেবল অধ্যাপকদের সঙ্গে মিলিত। তাহাও সকলের সঙ্গে নহে। বিশেষ করিয়া জার্মানি অধ্যাপক, চীনা অধ্যাপক ও সংস্কৃত অধ্যাপক বিধু শেখর শাস্ত্রী মহাশয়ের সঙ্গে টলস্টয়, লেনিন ও অন্য রাশিয়ানদের পুস্তকের ইংরেজি অনুবাদে তাহার টেবিল ভরা থাকিত। জার্মান ভাষা সে ভালোরূপে আয়ত্ত করিয়াছে। জার্মানিতে জার্মান প্রফেসরের সঙ্গে সুন্দরভাবে কথা বলিতে পারিত।’ এরপর চিঠিতে মনমোহনের ক্লাস রুটিন দেওয়া হয়েছে। মনমোহনকে লেখা কৃষ্ণ আইয়ারের একটি চিঠি লুকিয়ে পড়ে এই চিঠির কিছু অংশ নকল করে পাঠানো হয়। শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনের কার্যকলাপের বিস্তারিত বিবরণও বাদ পড়েনি এই চরের পাঠানো চিঠিতে।
মনমোহন ঘোষ তাঁকে পুলিশের ইনফরমার বলে সন্দেহ করেছিলেন, কিন্তু পুলিনবিহারী তা মানতে রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ তথাকে ছাত্র হিসেবে স্থায়ীভাবে নিতে অস্বীকার করে।
১৯০৯ সালে বাংলার স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি এক প্রজ্ঞাপন দিয়ে জেলার এসপি ও কলকাতার পুলিশের কমিশনারকে কয়েকজন ‘পাবলিক অ্যান্ড প্রমিনেন্ট পারসন কানেকটেড উইথ পলিটিক্যাল অর্গানাইজেশন’-এর ওপর নজর রাখার নির্দেশ দিলেন। এই তালিকায় সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম ছিল। এই নির্দেশনামার উল্লেখিত ব্যক্তিরা সবাই পুলিশের পরিভাষায় ‘Suspect’ বা সন্দেহভাজন ব্যক্তি। সহজ চলতি কথায় ‘দাগি’ – যদিও দাগি বলতে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরই বোঝায়। অমিয় কুমার সামন্ত এই প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘যেহেতু রাজনৈতিক গোয়েন্দাগিরি ও নজরদারি ছিল সদ্য সংগঠিত ব্যবস্থা, তাই অপরাধ ও অপরাধীসংক্রান্ত শব্দগুলিই রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয়েছে।’ যদুনাথ সরকার রবীন্দ্রনাথের কাছেই শুনেছিলেন, এক কনস্টেবল থানায় রবীন্দ্রনাথকে ‘দাগি’ হিসেবে উল্লেখ করছে। অপরাধ ক্ষেত্রের শব্দগুলো রাজনৈতিক সন্দেহবানদের ক্ষেত্রে ব্যবহারের ফলে রবিঠাকুরকে ‘দাগি’ ইত্যাদি অবমাননা সহ্য করতে হয়েছিল – ঠাকুর: আ বায়োগ্রাফি গ্রন্থের ২১৯ পৃষ্ঠায় কৃষ্ণ কৃপালিনীও উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ‘Suspect no 11, class B’।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতার মধ্যে রাজদ্রোহের গন্ধ খোঁজ করেছিল গোয়েন্দা বিভাগ ও আইনবিষয়ক দপ্তর। ১৯১২ সালের একটি নথিতে দেখা যায়, গোয়েন্দাকর্তাদের দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের ১২টি গান আপত্তিজনক। একটি গান – ‘আমরা গাব মনে বন্দে মাতরম’ – রবীন্দ্রনাথের রচিত বলে ধরা হয়। (যদিও গীতবিতান-এ এ রকম কোনো গান নেই)। তিনটি গানে রাজদ্রোহের প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে বলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে আইন বিভাগ। এদের মধ্যে একটি – ‘যে তোমারে দূরে রাখি নিত্য ঘৃণা করে, হে মোর স্বদেশ’ – কবিতা হিসেবেই পরিচিত। সরকার অবশ্য কবির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক মতামত খতিয়ে দেখতে গোয়েন্দা বিভাগ তাঁর দু-একটি রচনার অনুবাদ করে তাদের সুবিধামতো অর্থ আলাদা করেছে – রবীন্দ্রনাথের ‘সুপ্রভাত’ কবিতাটির কিছু অংশ অনুবাদ করে তাঁকে বিপ্লবীদের সমর্থক প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছিল।
১৯২৫ সালে বুয়েনস এইরেস থেকে রবীন্দ্রনাথের লেখা একটি চিঠির কিছু কবিতাংশ ইংরেজিতে অনুবাদ করে তাঁকে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের কঠোর সমালোচক প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ডেভিড পেট্রি। লাইনগুলো হলো, ‘দেশের খবর পাইনে কিছুই গুজব শুনি নাকি, পুলিশ পাণি পুলিশ হেথায় লাগায় হাঁকাহাঁকি। শুনছি নাকি বাংলাদেশের গান হাসি সব ফেলে, কলুপ দিয়ে করছে আটক আলিপুরের জেলে।’
চার অধ্যায় উপন্যাসটি বের হওয়ার পর বাংলার গোয়েন্দা বিভাগের ধারণা হলো, এই উপন্যাসটি ‘হ্যাজ এক্সটোল্ড রেভল্যুশনারি কাল্ট ইন বেঙ্গল’ – সুতরাং এটি বাজেয়াপ্ত করা উচিত। তবে সরকার বইটি বাজেয়াপ্ত করেনি।
রবীন্দ্রনাথের প্রতি কয়েকজন সন্দেহবাতিক ইংরেজ কর্মকর্তা তাঁকে যারপরনাই হেনস্তা করার চেষ্টা করেছিলেন। এঁদের একজন হলেন ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগের কর্তা চার্লস ক্লিভল্যান্ড, আইসিএস। ১৯১২ সালের ডিসেম্বরে দিল্লিতে ভাইসরয়ের ওপর বোমা নিক্ষেপের কোনো সুরাহা না করতে পারায় তাঁর প্রচণ্ড সমালোচনা হয়েছিল। ফলে এই কর্তাব্যক্তিটি আরও সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠেন। ১৯১৩ সালে ভাইসরয় হার্ডিঞ্জ যখন কবিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডিলিট দিতে চান তখন ক্লিভল্যান্ড আপত্তি তোলেন। কারণ, রবীন্দ্রনাথের আনুগত্যের রেকর্ড সন্তোষজনক নয়। হার্ডিঞ্জ বাংলার গভর্নর কারমাইকেলকে লিখলেন, ‘গোয়েন্দা বিভাগে রবীন্দ্রনাথকে ভালো বা মন্দ যা-ই আখ্যা দিন আমি এর তোয়াক্কা করি না। আমি তাঁকে সাম্মানিক ডিগ্রি দিতে বদ্ধপরিকর।’ রবীন্দ্রনাথকে যথাসময়ে সাম্মানিক ডিগ্রি দেওয়া হয়েছিল।
শুধু সাম্মানিক ডিগ্রিই নয়, রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠান যেন কোনো বিদেশি অনুদান না পায় সে ব্যাপারে গোয়েন্দা বিভাগের পদস্থ কর্মকর্তা ডেভিড পেট্টিও যথেষ্ট কাঠখড় পুড়িয়েছিলেন। সেই সময় ১৯২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এক নারী শান্তিনিকেতনে ৫০ হাজার ডলার দান করতে চান বলে লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিসে চিঠি লিখে শান্তিনিকেতন বিষয়ে জানতে চান। এরপর শুরু হলো দীর্ঘ চিঠি চালাচালি, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা আর বাংলার রাজনৈতিক গোয়েন্দা দপ্তরের মধ্যে। বাংলার রাজনৈতিক গোয়েন্দাপ্রধান জানালেন, ‘আমাদের হাতে যেসব তথ্য রয়েছে তা থেকে অন্তত এটুকু জানা যায় যে ভারতের বিপ্লবীরা ড. রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর প্রতিষ্ঠানকে বিপ্লবের কাজে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে ড. ঠাকুর এ বিষয়ে কিছু জানেন বলে কিংবা তাঁর প্রতিষ্ঠানের কোনো রকম বিপ্লবী পরিচয় আছে বলে জানা যায়নি।’ এসব মতামত যখন ভাইসরয় লর্ড লিটনের কাছে পেশ করা হলো তখন তিনি স্যার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিষয়ে পুলিশ প্রতিবেদনের ওপরই পুরোপুরি ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতে চাইলেন না। তাঁর অভিমত ছিল, বাংলা সরকারের শিক্ষা বিভাগের কাছ থেকে রিপোর্ট নেওয়া হোক। অনুকূল রিপোর্ট দিলেন সেই সময়ের বিখ্যাত ডিপিআই ই. এফ. ওটেন সাহেব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো টাকা শান্তিনিকেতনে আসেনি।
নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথের ওপর নজরদারির ব্যবস্থা শিথিল হতে শুরু করে এবং তারপর একসময় ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “ছোট ইংরেজ ‘রাগ ও আতঙ্কের সময়’ অল্প প্রমাণেই ‘ছায়াকে বন্ধু বলিয়া ঠাহর’ করেন; সকল মানুষকে সন্দেহ করাটাই তাদের ব্যবসা” এবং “অবিশ্বাস করাটাই স্বভাব হইয়া ওঠে।” রবীন্দ্রনাথের উক্তি যে কতখানি সত্য, কবির ওপর ছোট ইংরেজের নজরদারির অনাবশ্যক ব্যবস্থাই তা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট।
শান্তিনিকেতনের ওপর নজরদারি করতে গিয়ে অনভিজ্ঞ ও অদক্ষ গোয়েন্দারা নানা হাস্যকর কাণ্ড করতেন। রাজলক্ষ্মী দেবী ১৯০৭ সালের ৩রা সেপ্টেম্বরে একটি ঘটনার কথা তাঁর এক চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, ‘কাল সকালে হঠাৎ একটা লোক এসে হাজির। বলে কিনা স্কুল দেখবে। প্রথম থেকেই রবীন্দ্রনাথের লোকটার ওপর সন্দেহ হয়েছিল—তিনি কোনো রকমে স্কুলের শিক্ষকদের হাতে দিয়ে নিষ্কৃতি লাভ করলেন – কিন্তু সে কি তা শোনে – ঘুরে ঘুরে ক্রমাগত খবর নিতে লাগল। আমাদের ছেলেরা লাঠি অভ্যাস করে কিনা বন্দুক ধরে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। দুপুরে রবীন্দ্রনাথকেও নানা প্রশ্ন করতে লাগল – তিনি বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য বুঝিয়ে বললেন। কিন্তু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে ছেলেদের লাঠিখেলা শেখানো হচ্ছে কিনা এই জাতীয় অবান্তর প্রশ্ন করতে লাগল। তখন রবীন্দ্রনাথ তাকে পরিষ্কারভাবে বললেন – চলুন, আপনাকে সব ঘর দুয়ার দেখাচ্ছি – কোনো ঘরেই কামান গোলা-বারুদের সন্ধান পাবেন না – তখন লোকটি থতমত খেয়ে ওখান থেকে চলে গেল।’ (সূত্র: রবীজীবনী, পঞ্চম খণ্ড)
(তথ্যসূত্র:
১- আ ট্রিবিউট টু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গ্লিমপসেস ফ্রম আকাইভাল রেকর্ডস, সম্পাদক: অতীশ দাশগুপ্ত, ডাইরেকটরেট অব স্টেট আর্কাইভস, গভমেন্ট অব ওয়েস্ট বেঙ্গল, কলকাতা।
২- রবীন্দ্রনাথ, এন্ডরুজ পত্রাবলি, পৃষ্ঠা- ২১২।
৩- ঠাকুর: আ বায়োগ্রাফি, কৃষ্ণ কৃপালিনী, পৃষ্ঠা- ২১৯।
৪- রবীজীবনী, পঞ্চম খণ্ড।
৫- নির্ঝরিনী সরকারকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি – চিঠিপত্র সপ্তম খণ্ড, বিশ্বভারতী।
৬- আত্মশক্তি ও সমূহ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্ররচনাবলী (জন্মশতবার্ষিক
সংস্করণ), দ্বাদশ খণ্ড।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত