ঋষি: যেখানে যাচ্ছি সেখানে খাবারদাবার কেমন? ভালো স্কচ পাবো? আমার কিন্তু তন্দুরিটা কেউ জ্বালিয়ে দিয়ে রোস্ট বানালে বোতল ছুঁড়ে মারতে ইচ্ছে করে। ওখানে কি আয়োজন কে জানে। দুর ভালো লাগে না।
ইরফান: আরে চিন্টু দাদা, এই তো এলেন। প্রায় ২৪ ঘন্টা ট্রানজিটে যম সাহাব আমাকে ওয়েট করালো৷ বড় স্টার আসছে নাকি। তা বড় স্টারকে আলাদা গাড়ি দে। এই বিল্লু বারবার, পান সিং তোমারের সাথে দেওয়ার কি দরকার। ঘুম ও হলো না। ইতনা মচ্ছর।
(ঋষি অন্যদিকে তাকিয়ে উদাস মনে বসে।)
স্বগতোক্তি – বাড়ির কথা মনে পরছে। নিতু এখন ঠিক কি করছে? কাকে অনিয়মের জন্য বকা দেবে? কাল থেকে একলা হয়ে যাবে। রনবীর আর কার উপর অভিমান করবে। ছেলেটা বড্ড সরল। টুপি পরিয়ে দেয় অনেকে। ইশ যদি ভূত হয়ে ফিরে নজর রাখতে পারতাম। অবশ্য রনবীর দেখতে পেলে গন্ডগোল হতো৷ ড্যাড বলে এমন বকুনি দিতো৷
ইরফান আবার কথা বলছে: নিচে অতিমারী না মহামারীর জন্য জলদি হয়ে গেল৷ কোন মিনিট টু মিনিট আপডেট নেই, একশোটা ক্যামেরা নেই। একদম শান্ত, বলতে হে না, একদম পিসফুল। মুঝে তো মজা আ গায়া!
ঋষি: But I loved to get the pampering & attention. আজ ও কিরকম তোমার সেকেন্ড লিড হয়েই থেকে গেলাম। কিন্তু আমি তো স্টার। রাজ কাপুরের বংশধর, দি কাপুর ফ্যামিলির একজন। তুমি যেন এখানে ও নায়ক হয়ে গেলে। জানো ঠিক এটাই সিনেমাগুলোতে ও হতো৷ স্পেশালি অমিত সাহাব। সব জায়গায় লাইমলাইট নিয়ে চলে যেত।
ইরফান: আরে আজব মানুষ আছেন আপনি৷ শুভ শুভ বলুন। আজ ও মুখে আসে বলে দেন। আপনার মুখে মিউনিসিপালিটির একটা টাইম কল বসিয়ে দেবো। আমির আদমি আছেন তো। তাই এসব দেখেন নি আপনি। আমাদের রাজস্থানের বাড়িতে ছিল৷ আহা কি সব দিন। বেকার বেকার এতো সময় ওয়েট করতে হলো আপনার জন্যে। আম্মি ওদিকে খাবার নিয়ে বসে। উফ কতোদিন পরে দুজনে খাবো একসাথে।
ঋষি: তুমি কথাটা কম বলে চুপচাপ বসবে? এসি ও ঠিকঠাক কাজ করছে না। কি জ্বালা বলোতো। তার উপর জানালার ধারের সিটটা তো আগে এসে নিয়ে নিয়েছো৷ বকরবকর বকরবকর।
(ইরফান চুপ, শান্ত চোখে দূরের দৃশ্য দেখছে। মায়ের কথা মনে পরছে, মাকে জড়িয়ে ধরার কথা। সেই দৃশ্য ভারী সুন্দর নিশ্চয়ই কিন্তু নশ্বরদের ও দৃশ্য ইহলোকে থাকাকালীন দেখার উপায় নেই। তাই হয়তো টাইট ফ্রেমের এই শটটা পাঠানো হয়েছে৷ পক্ষীরাজটা দেখতে কিরকম সেটা ও বোঝা যায় না৷)
ঋষি: কি হলো, এরকম চুপ মেরে গেলে কেন? মরতে যাচ্ছি নাকি! কথা বলো।
ইরফান: আজিব সটেলা আদমি আছেন। আপনার চেয়ে তো পিকুতে ওই ভাস্কর ব্যানার্জি ভালো ছিল। (একটু থেমে) বলছি আপনার ও কি চেয়ার নিয়ে আসা হয়েছে নাকি? (সেই সিগনেচার হাসিটা খ্যাকখ্যাক করে হাসতে হাসতে)
ঋষি: এই মুখ সামলে কথা বলবে। এই ড্রাইভার এর সাথে কে দিতে বলেছিল। এতো আবার মেরে দেবে দেখছি। ডেঞ্জারাস লোক। চোখ গুলো দেখো কিরকম। বাপ রে।
ইরফান: আপনার তো চোখই দেখা যাচ্ছে না। কিরকম সানগ্লাস পরা লাল আপেল লাগছে৷ কালো চশমাটা খুলুন। এখানে কেউ আপনার অটোগ্রাফ নেবে না।
(ইরফান ভূবন ভুলানো হাসিটা হাসতে হাসতে ফের জানালার দিকে তাকালো। ঋষি কাপুর এই বাচালতার কোন উত্তর দেবে না ঠিক করেছে। কিন্তু চুপ করে থাকতে খারাপ ও লাগছে। মৃত্যুর পরে ইহলোক থেকে এই যে পরলোকে যাওয়ার রাস্তাটা সেটা অনেক আলোকবর্ষ দূরে। কি জানি কোন গাড়িতে এতো তাড়াতাড়ি পৌঁছে দেয় এরা৷ এতোদিন পরে কাপুর খানদানের বাকিদের সাথে দেখা হবে। পাপার সাথে দেখা হবে। শ্রীদেবী ও শুনেছি ওখানেই এখন। আনন্দ আর বেদনার ওলটপালট করা একটা কান্না বেরিয়ে এলো চোখে৷ )
ঋষি কাপুর ছেলেমানুষের মতো ভেউ ভেউ করে কাঁদছে। এটা ঋষি কাপুর বলেই সম্ভব৷ দুম করে রেগে যায়, হঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে পরে, প্রকাশ্যে কেঁদে ফেলে তারপর জীবন কে উদযাপন!
ইরফান : কি আংকেল! আরে দেখুন কান্ড। আরে…. মাথা খারাপ হো গয়া ক্যা! আঁসু পুছে ফেলুন। নিন টিশ্যু নিন। সব কুছ পাবেন রে বাবা। মাকে পাবেন, বাবাকে পাবেন, পুরোনো তারকাদের পাবেন, আরডি সাহাবকে পাবেন, কিশোর দাকে পাবেন, নতুন সিনেমা প্ল্যান করতে পারবেন আর দারু ভি পাবেন, আচ্ছা ওয়ালা। ইয়ে লম্বা সফর হে কাপুর সাহাব! যেতে হবে, যেতে হবে, যেতে হবে!
(গাড়ির রেডিও: “চলা যা তা হু কিসিকে ধুন মে… ধরকতে দিল কে তরানে লিয়ে!” বাজছে)
সিনেমাতে এই সময়টা একটা লং শটে গাড়িটার চলে যাওয়া দেখায়। লম্বা হাইওয়ে, দুদিকে ধুসর প্রান্তর, গাড়িটা একটু একটু করে মিলিয়ে যাবে। কিন্তু এটা তো সিনেমা না, এখানে কি হয়, কবে হয়, কতোদিন থাকতে হয় কেউ জানেনা। অনন্ত এক সিন্ধুপার। কেউ বলে জর্জর, ঝিল্লিমুখর রাতির মতো এক নিদ্রিত পুরী। কেউ বলে ইরফান, ঋষি কাপুরের মতো ভালো মানুষ, জীবনকে উদযাপন করতো এরকম মানুষ গেলে নাকি এ বদলে যায় উল্লাসের আড্ডাখানায়, জরা নেই, জীর্ণতা নেই, শোক নেই, শান্তির এক মালভূমি যেখানে রোজ স্বজন বন্ধুরা এসে বসে,পৃথিবীতে কাটানো কয়েকটা দিন নিয়ে গল্প করে। অনন্তকাল, অসংখ্যকাল।
বি.দ্রঃ কারো ভাবাবেগে আঘাত দিতে কাল্পনিক এই কথোপকথন লেখা নয়। এদেরকে সেলিব্রেট করতে এই লেখা, এদের ভালোবেসে, সিনেমাপোকা বলে এই লেখা। আগাম ক্ষমা চাইছি কেউ আঘাত পেলে। সত্যকে সহজ ভাবে নিন। পজিটিভ থাকুন।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত