ক্ষয় নেই যার সেটাই অক্ষয়!
সংস্কৃত ভাষায়, ‘অক্ষয়’ শব্দটি ‘সমৃদ্ধি’, ‘প্রত্যাশা’, ‘আনন্দ’, ‘সাফল্য’, ‘ত্রিত্য’ অর্থ ‘তৃতীয়’, ‘অর্থে অবিস্মরণীয়, চিরস্থায়ী, সর্বদা নিকৃষ্টতম’। হিন্দু ক্যালেন্ডারে ভাস্কাকের বসন্ত মাসের ‘তৃতীয় চন্দ্র দিন’ এর নামকরণ করা হয়, এটি যেদিন পালন করা হয়।
বিভিন্ন পুরাণে অক্ষয় তৃতীয়ার মাহাত্ম্য নিয়ে বেশ কিছু কাহিনী প্রচলিত। তার মধ্যে একটি হল, একবার মহামুনি শতানিক যুধিষ্ঠিরকে জলদানের মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে একটি কাহিনী শুনিয়েছিলেন। বহু যুগ আগে এক ক্রোধী ও নির্দয় ব্রাহ্মণ ছিলেন। এক দিন এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ তাঁর কাছে কিছু খাবার চাওয়ায় তিনি গালমন্দ করে দরজা থেকেই তাঁকে তাড়িয়ে দিলেন। অপমানিত ব্রাহ্মণ চলে যাচ্ছেন এমন সময় ব্রাহ্মণ পত্নী তাঁকে যেতে দিলেন না।অতিথির কাছে ক্ষমা চেয়ে তাঁকে বললেন, সেখানেই আহার করতে। এর পর ব্রাহ্মণপত্নী অতিথিকে যথাসাধ্য আহার-সহআপ্যায়ন করলেন। যাওয়ার আগে সেই ব্রাহ্মণ তুষ্ট হয়ে ব্রাহ্মণপত্নীকে আশীর্বাদ করে বললেন, তাঁর অন্ন-জল দান অক্ষয় হোক। তারপর কেটেছে গিয়েছে বহু বছর। এক সময় সেই ক্রোধী ও নির্দয় ব্রাহ্মণের মৃত্যু আসন্ন জেনে তাঁকে নিয়ে যেতে একই সঙ্গে হাজির হল যমদূত ও বিষ্ণুদূতের দল। কিন্তু তাঁকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে এই নিয়ে তুমুল বিবাদ শুরু হল দুই দল দূতের মধ্যে। একদল তাঁকে বিষ্ণুলোকে নিয়ে যেতে চাইল। অন্য দল তাঁকে নরকে নিয়ে যেতে চাইল। এরই মাঝে তৃষ্ণায় কাতর ব্রাহ্মণ একটু জল চাইলেন। যমদূতেরা তখন ব্রাহ্মণকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, অতিথি ব্রাহ্মণকে জল না দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার সেই ঘটনাটি। এর পরে তাঁরা ব্রাহ্মণকে যমরাজের কাছে নিয়ে গেলেন। যমরাজ ব্রাহ্মণকে দেখেই চমকে উঠলেন। তাঁর দূতদের বললেন, তাঁর মতো পুণ্যবানকে কেন যমলোকে নিয়ে এসেছে তাঁরা? বৈশাখর শুক্লা তৃতীয়ায় ব্রাহ্মণপত্নী তৃষ্ণার্ত অতিথিকে অন্ন-জল দান করেছেন। সেই দান অক্ষয় দান। স্ত্রীর পুণ্যে তিনিও তাই পুণ্যবান হয়েছেন। আর সেই পুণ্যের ফলে ব্রাহ্মণের স্থান নরকে নয়, স্বর্গেই হবে। কাহিনী শেষে শতানিক মুনি যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন, বৈশাখ মাসের শুক্লা তৃতীয়া তিথিতে ব্রাহ্মণকে অন্ন বস্ত্র জল দান করলে সব পাপ থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। অর্থাৎ এই দিনে কিছু দান করলে পুন্য সঞ্চয় হয়। তবে শতানিক মুনির গল্পের শেষে আরও একটু আছে। বিষ্ণুলোকে পৌঁছনোর পরে ভগবান বিষ্ণু সেই ব্রাহ্মণকে বলেন, তাঁর স্ত্রী মাত্র এক বার অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে ব্রাহ্মণকে অন্নজল দান করেছেন। কিন্তু সেই দান বা ‘অক্ষয়ব্রত’ পর পর আট বার করতে হবে। তবেই অক্ষয় পুণ্যলাভ হবে। এই বলে বিষ্ণু ব্রাহ্মণকে কী ভাবে অক্ষয় ব্রত পালন করতে হবে তা বিশদে বলে ফের মর্ত্যে পাঠিয়ে দেন। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী মিলে আরও সাত বার অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে বিষ্ণু কথিত পদ্ধতিতে অক্ষয়ব্রত পালন করেন।
এই ব্রতের প্রধান উপকরণ হল যব। শুক্লা তৃতীয়া তিথিতে যব দিয়ে লক্ষী-নারায়ণের পুজো করে ব্রাহ্মণকে অন্ন, বস্ত্র, ভোজ্য, ফল ইত্যাদি দিয়ে বরণ করতে হয়। ব্রতীরা এ দিন যব দিয়ে তৈরি খাবার খান। এ পার-ও পার দুই বাংলাতেই এখনও এই দিনে সেই রীতি মেনে পালন করা হয় অক্ষয়ব্রত। সধবা মহিলারা (এয়ো) সূর্য ওঠার আগেই নদীঘাটে ফুল, দূর্বা, বেলপাতা, সিঁদুর, সরষের তেল প্রভৃতি উপকরণ নিয়ে জড়ো হন। সূর্য এবং গঙ্গাদেবীকে আবাহন এবং পরিবারের মঙ্গল কামনার মধ্য দিয়ে স্নান সম্পূর্ণ করেন। গোত্রভেদে কোনও কোনও পরিবারে ‘সরিষা ধোওয়া’ রেওয়াজের প্রচলন রয়েছে। এই সরষে দিয়ে কাসুন্দি তৈরি করা শুরু হয়। ক্রমশ কমে এলেও গ্রামবাংলায় এখনও এই ব্রত পালনের রেওয়াজ রয়েছে।
স্মার্ত রঘুনন্দন তাঁর ‘স্মৃতি তত্ত্বে’ অক্ষয়ব্রতের চারটি ভাগ করেছেন। অক্ষয়ঘট ব্রত, অক্ষয়সিঁদুর ব্রত, অক্ষয়কুমারী ব্রত এবং অক্ষয়ফল ব্রত। এই ব্রতগুলি চার বছর একটানা পালন করতে হয়। ব্রাহ্মণ থেকে কুমারী, সধবা, সর্বস্তরের মানুষকে জড়িয়ে অক্ষয়তৃতীয়া লৌকিক ধর্মাচরণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
অক্ষয় তৃতীয়া লোকবিশ্বাসের সর্বভারতীয় চরিত্রের একটি চমৎকার নিদর্শন। এবং এই তিথি হল হিন্দুদের সাড়ে তিনটি সর্বাধিক শুভমুহূর্তের অন্যতম। অন্য দুটি হল পয়লা চৈত্র এবং বিজয়া দশমী, আর কার্তিকের শুক্লপক্ষের প্রথম দিনটি হচ্ছে আধখানা তিথি। এই দিনে জৈন ধর্মালম্বীরা পূজা করে থাকেন জৈন তীর্থঙ্কর ঋশভদেবের। কথিত আছে, এই তিথিতেই ব্যাসমুনি গণেশকে মহাভারত বলতে শুরু করেছিলেন; এই দিনেই কৃষ্ণ দ্রৌপদীকে বস্ত্রহরণের অমর্যাদা থেকে রক্ষা করেছিলেন; এই দিনেই সূর্যদেব পাণ্ডবদের ‘অক্ষয়পাত্র’ দান করেছিলেন, যে পাত্রের খাবার কখনও ফুরোবে না। আরও নানা উপকথা এই দিনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। অনেকের মতে এই দিন ত্রেতাযুগ শুরু হয়েছিল, আবার অনেকে বলেন সত্যযুগ। মুশকিল হল, এগুলো একটু পুরনো দিনের ব্যাপার, তর্কের মীমাংসা করতে পারেন এমন কেউ বেঁচে নেই। আবার, এই তিথিতেই নাকি গঙ্গার মর্তে অবতরণ ঘটেছিল। অন্য দিকে, কৃষ্ণ এই দিনেই পরশুরাম রূপে জন্ম নিয়েছিলেন এবং সমুদ্রের বুক থেকে জমি উদ্ধার করেছিলেন। কোঙ্কণ ও মালাবার উপকূলে অক্ষয় তৃতীয়ায় পরশুরাম এখনও পূজিত হন। বছরের এই সময়টাতে গ্রীষ্মের তাপ বাড়তে শুরু করে, মাটি শুকিয়ে ওঠে। ওডিশা থেকে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ ও হরিয়ানা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে কৃষকরা এই দিন জমিতে লাঙল দেওয়া শুরু করেন। উত্তর-পশ্চিম ভারতে প্রবীণ জাঠ কৃষিজীবীরা চাষের সরঞ্জাম নিয়ে শস্যক্ষেত্রে যান, যাওয়ার পথে পশুপাখি চোখে পড়লে তাকে সুলক্ষণ বলে গণ্য করেন। গুজরাতেও কৃষকরা এই দিন লাঙল তুলে নেন এবং পরশুরামকে স্মরণ করেন। দক্ষিণ ভারতে এই দিন চাষ শুরু করার ঐতিহ্য নেই বটে, কিন্তু সেখানেও পাঁজিতে এটি শুভতিথি হিসেবে চিহ্নিত। সৌভাগ্যের দেবতাদের প্রসন্ন করার উদ্দেশ্যে অনেকেই এ দিন উপবাস করেন। কৃষিতে হোক অথবা বাণিজ্যে, অক্ষয় তৃতীয়ায় সমৃদ্ধির উপর জোর দেওয়া হয় এবং তা থেকেই বোঝা যায়, হিন্দু জীবনাদর্শে জাগতিক বিষয়কে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই দিন দেবী অন্নপূর্ণার জন্মদিন, ধনসম্পদের দেবতা কুবেরের আরাধনাও এ তিথির সঙ্গে জড়িত। কুবের এক আশ্চর্য দেবতা। তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত বিবিধ উপকথায় সমাজ-ইতিহাসের মূল্যবান রসদ আছে। ব্রাহ্মণ্য কাহিনিগুলি পশ্চিমী উপাখ্যানের মতো সরল নয়, বহুমাত্রিক, সেখানে সমাজের বিবর্তন সম্পর্কে নানা ধারণা খুঁজে নেওয়া যায়। কুবেরকে বর্ণনা করা হয় এক কুদর্শন, খর্বকায় এবং স্ফীতোদর যক্ষ রূপে। প্রথম যুগে ভারতে নবাগত আর্যদের জীবিকা ছিল পশুচারণ, সুতরাং তাঁরা ভ্রাম্যমাণ জীবন যাপন করতেন। অন্য দিকে, পুরনো অধিবাসীদের স্থায়ী বসতি ছিল, তাঁদের আর্থিক অবস্থাও ছিল আর্যদের তুলনায় সমৃদ্ধ। কিন্তু তাঁদের গায়ের রং আর্যদের মতো ফরসা নয়, এবং আর্যরা তাঁদের তুলনায় দীর্ঘাঙ্গী। দেখতে খারাপ বলে আর্যরা তাঁদের নিচু চোখে দেখতেন। বৈদিক, বেদ-উত্তর এবং পৌরাণিক কাহিনিতে অনার্য জনগোষ্ঠীর বিপুল ঐশ্বর্যের বিস্তর উল্লেখ আছে। এই সম্পদের একটা কারণ হল, তাঁরা পশুপালন এবং কৃষি থেকে অর্জিত সম্পদের একটা অংশ স্বর্ণ ও মণিরত্নের আকারে সঞ্চিত রাখতেন। অক্ষয় তৃতীয়ায় সঞ্চয় করা ও সঞ্চিত অর্থ দিয়ে সোনারূপো কেনার ঐতিহ্য এই সূত্রেই এসেছে। এর ছ’মাস পরে ধনতেরাসেও একই রীতি অনুসৃত হয়। অর্থনীতিবিদ ও লগ্নি-বাজারের উপদেষ্টারাও এই উপদেশই দেন। কুবেরকে বৈদিক সাহিত্যে প্রথমে দেখা যায় ‘ভূতেশ্বর’ রূপে। দেবতা হিসেবে তাঁর স্বীকৃতি মেলে পুরাণের যুগে, হাজার বছর পরে। তত দিনে মনু-কথিত ‘মিশ্র জনগোষ্ঠী’ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বসবাস করছেন। ক্রমশ কুবেরকে বৌদ্ধরা বৈশ্রবন্ত নামে এবং জৈনরা সর্বন-ভূতি নামে স্বীকৃতি দেন। লক্ষ্মী ঐশ্বর্যের দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া অবধি কুবের হিন্দুদের কাছে সম্পদের দেবতা হিসেবে পূজিত হয়ে চলেন। দেবতাদের সম্পদরক্ষী হিসেবে তাঁর গায়ের রংও ক্রমশ পরিষ্কার হতে থাকে, যদিও তিনি গণ, যক্ষ, কিন্নর, গন্ধর্ব গুহ্যক প্রমুখ ‘পশ্চাত্পদ গোষ্ঠী’র প্রতিনিধিই থেকে যান। লোকদেবতা থেকে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের উচ্চতর কোটিতে ওঠার স্পর্ধা দেখিয়েছেন তিনি, তার মূল্য দিতে হয়েছে কুবেরকে, তাঁর একটি চোখ নষ্ট হয়েছে, একেবারে মনসার মতোই। লড়াই না করে কিছু পাওয়া যায় না। অক্ষয় তৃতীয়া এবং ধনতেরাসে অনেক হিন্দু তাঁর আরাধনা করে। হিন্দুধর্ম কোনও দেবতাকেই একেবারে ছেঁটে ফেলে না, দরকার মতো একটা সাম্মানিক আসন দিয়ে এক পাশে সরিয়ে দেয়। প্রসঙ্গত, বৌদ্ধধর্মের আধারে কুবের দিব্যি অন্য একাধিক দেশে পৌঁছে গেছেন। জাপানে তিনি বিশামন নামে পূজিত। অন্য অনেক প্রদেশের মতোই বাংলাতেও অক্ষয় তৃতীয়া নতুন ব্যবসায়িক উদ্যোগ সূচনার প্রশস্ত দিন হিসেবে গণ্য হয়, অনেকে এই দিন হালখাতাও করেন। আবার, কৃষ্ণকে সুদামার চিড়ে উপহার দেওয়ার কাহিনি স্মরণ করে এই দিনটিতে বড় হোক, ছোট হোক, উপহার দেওয়ার চল আছে। ১৮৩৬ সালে রেভারেন্ড কে এস ম্যাকডোনাল্ড লিখেছিলেন, ‘হিন্দুদের কাছে এই দিনটি পবিত্র, কারণ শাস্ত্রমতে এই দিন ভিক্ষা বা উপহার দিলে অক্ষয় পুণ্য অর্জিত হয়, ভবিষ্যতে পাপ করলেও সেই পুণ্যফল নষ্ট হয় না, তাই কৃপণরাও এই দিন হাত উপুড় করে দেন।’
দ্বাপর যুগে শ্রীকৃষ্ণ তখন দ্বারকার রাজা। বাল্যসখা সুদামা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বৃন্দাবন থেকে সুদূর দ্বারকায় এলেন। দরিদ্র সুদামা কৃষ্ণের জন্য কাপড়ের পুটুলিতে বেঁধে এনেছিলেন তিনমুঠো তণ্ডুল। নানা বিষয়ে কথা হলেও সুদামা তাঁর দারিদ্রের কথা সঙ্কোচে কৃষ্ণকে বলতে পারলেন না। কৃষ্ণের কাছে কিছুই অজানা নয়। সুদামা বৃন্দাবনে ফিরে দেখেন তাঁর পর্ণকুটিরের জায়গায় রয়েছে সুন্দর এক বাড়ি। অভাব নেই কোনও কিছুরই। সেই দিনটিও ছিল অক্ষয় তৃতীয়া।
তাই যুগ যুগ ধরে বৈশাখের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া দিনটি এতপবিত্র ও তাৎপর্যপূর্ণ। কৃষিপ্রধান ভারতে অক্ষয় তৃতীয়ার দিনটিতে অনেক জায়গায় ধরিত্রীদেবীর পুজো করা হয়। এ ছাড়াও দেশ জুড়ে পালিত হয় নানা উৎসব ও শুভ কাজ। এদিন থেকেই পুরীধামে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উপলক্ষে রথ নির্মাণ শুরু হয়।
তবে শুধু মহাকাব্য বা পৌরাণিক কাহিনিতেই নয়, বাংলার ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনেও অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে রয়েছে অক্ষয় তৃতীয়া। প্রাচীন বাংলায় পুণ্যাহ উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। পুণ্যাহ বাংলার রাজস্ব আদায়ের বার্ষিক বন্দোবস্তের একটি উৎসব। আঞ্চলিকতা ভেদে এই উৎসব কোথাও পয়লা বৈশাখ, কোথাও বা অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে পালিত হত। এর কারণ ১লা বৈশাখে প্রতি বছর কোনও নির্দিষ্ট শুভ তিথি না থাকলেও অক্ষয় তৃতীয়া দিনটি সব দিক থেকে শুভ। তাই এই দিনেই বহু অঞ্চলে পুণ্যাহ পালিত হত। যদিও ঔপনিবেশিক কালে এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তা লুপ্ত হয়। তার পরিবর্তে ১লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের দিন হালখাতার পুজো প্রাধান্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। আজও বহু দোকানে এবং বনেদি পরিবারে এই দিনটিতে বিশেষ পুজোর মাধ্যমে নতুন হিসেবের খাতার সূচনা করা হয়।
একশো বছরেরও বেশি আগে ব্রিটিশ পর্যবেক্ষকরা লক্ষ করেছিলেন, ‘ভারত জুড়ে বৈশাখের শুক্লপক্ষের তৃতীয় দিনে অক্ষয় তৃতীয়া পালন করা হয়। মানুষের বিশ্বাস, এই দিন স্নান করে ব্রাহ্মণকে পাখা, ছাতা এবং অর্থ দান করলে অক্ষয় পুণ্য অর্জিত হয়। ফলে এই তিথি উদযাপন অত্যন্ত জনপ্রিয়।’
অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্যতিথি উপলক্ষ্যে সোনার অলংকার কেনার জন্য পত্রিকা ভরে যায় নানান ছাড়ের বিজ্ঞাপনে। সকাল সকাল পুজো সেরে খানিক সোনা কিনবেন। লোকবিশ্বাস, তার ফলে পুণ্যে সোনালি ঝলক লাগবে। কিন্তু অক্ষয় তৃতীয়া মানে কি তাই? ভারতের প্রায় সব পালাপার্বণ সূর্যের শাসনে চলা ঋতুচক্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে। বেদের কাল থেকে সূর্যের এক নাম মিত্রাবরুণ। মাঘ থেকে আষাঢ় তিনি মিত্র , প্রখর তাঁর রূপ। শ্রাবণ থেকে পৌষ সূর্যের নাম বরুণ, তিনি বর্ষার দেবতা। এখন বৈশাখ মাস। সূর্য প্রখর চেহারা নিয়েছেন। সূর্য ও বিষ্ণু সমার্থক, বারো মাসে তাঁর বারোটি নাম। বৈশাখের সূর্য-বিষ্ণুর নাম মধুসূদন যাঁকে সঙ্কটে স্মরণ করার পরামর্শ দেওয়া আছে প্রাচীন কাল থেকে। প্রখর গ্রীষ্মের প্রধান সঙ্কট তৃষ্ণা। বাংলার নদী পুকুর জলার দেশে তৃষ্ণার ভয়াবহ রূপ হয়তো তত প্রকট নয় , কিন্তু বৃষ্টিহীন শুকনো শুকনো নদীতে ভরা রাঢ় ভূমিতে তথা ভারতের অন্যান্য অংশে পানীয় জলের কষ্ট কী জানেন ভুক্তভোগীরা। পরিত্রাতা মধুসূদনের রূপ নিতেন সেকালের প্রজাবৎসল রাজারা। প্রান্তরের প্রান্তে স্থাপিত হত প্রপা বা জলসত্র, রাজার ব্যয়ে। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বর্ণনা মত কেবল প্রপাপালিকারাই থাকতেন বা সর্বদাই তাঁরা খুব আকর্ষণীয়া হতেন এমন নয়; তাঁদের উত্তরসূরী স্টেশনের গোঁফওয়ালা পানিপাঁড়েদের কথাও মনে আছে অনেকের। এখনও লাল শালু মোড়া জালা ভর্তি জল নিয়ে বসে থাকা স্বেচ্ছাসেবকদের দেখা যায় কলকাতার রাস্তায়। আজকাল সমাজসেবকদের উদ্যোগে শরবত বিলি করে জনসেবাও দেখা যায় হামেশাই। তারপর প্লাস্টিকের সাদা গ্লাসরা রাস্তায় গড়াগড়ি খেতে খেতে কোথায় যায় কে জানে, তবে পুণ্য বোধহয় খানিক হয়। অস্বীকার করা যাবে না যে জল খাওয়ানোর মূল তাগিদ অবশ্যই মমত্ববোধ, অক্ষয় পুণ্যলাভ অনেক পরের কথা। অক্ষয় তৃতীয়ার বিহিত কর্ম হল স্নান, দান, তপ, হোম ও পিতৃতর্পন। জলদানের বিষ্ণুব্রত পালন হল অক্ষয় তৃতীয়া। অবশ্য অক্ষয় তৃতীয়ার গৌরব এখানেই শেষ নয়। ত্রেতাযুগে রামচন্দ্রের আগে জন্ম নিয়েছিলেন জামদগ্নি পুত্র পরশুরাম। তিনি ছিলেন বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার। তাঁর জন্মজয়ন্তী অক্ষয় তৃতীয়া। অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে গণেশকে লিপিকর করে মহাভারত রচনার কাজ শুরু করেছিলেন ব্যাসদেব। এই তিথিতে গঙ্গাদেবী মর্ত্যে অবতরণ করলেন। এই তিথিতেই জন্ম নিলেন দশ মহাবিদ্যার এক বিদ্যা ধূমাবতী। প্রখর দাবদাহ থেকে রেহাই পেতে শ্রীকৃষ্ণ শরীরে চন্দন লেপন করলেন। বৈষ্ণবতীর্থে উদযাপিত হচ্ছে চন্দন যাত্রা। বর্ধমান শহরকে তৃষ্ণার পীড়ন থেকে বাঁচাতে ১৮৮৫ সালে স্থাপিত হল লাকুর্ডি জলকল। অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে তার উদ্বোধন হয়েছিল কিনা জানা নেই, তবে সে কীর্তি অক্ষয় হয় নি কারণ দামোদরে জলাভাব। এখন বিডিএ-র উদ্যোগে সারা শহরের অলিগলি রাজপথের তলা দিয়ে শিরা উপশিরার মত জলের পাইপ লাইন বসছে। বর্ধমানবাসী হয়তো অপেক্ষা করে আছেন সেই দিনের জন্য যেদিন নালিকা পথে গঙ্গার আবির্ভাব ঘটবে, উদযাপিত হবে অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্যদিন।
সেকালে মেয়েদের নিজস্ব সম্পত্তি বা স্ত্রীধন বলতে বোঝাতো পরিবারের গিন্নি, মেয়ে, বউদের গয়নাপত্র। তাই সচ্ছল সম্পন্ন পরিবার থেকে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারেও বিয়ের সময় বউ-মেয়েদের সাধ্যমতো গয়না দেওয়া হত। গা ভরা সোনা-জড়োয়ার গয়নায় মেয়ে-বউদের রূপের জৌলুস বাড়বে। আবার ভবিষ্যতে নিতান্ত প্রয়োজন হলে ওই গয়নাই কত কাজে আসবে। কতরকমের গয়না—মুকুট, সিঁথি, ঝাপটা, চিক, নেকলেস, সীতাহার, বীরবৌলি, কানপাশা, ঝুমকো, চুড়ি, চূড়, বালা, ব্রেসলেট কত বলা যায়? এছাড়াও ছিল দুটি সুন্দর গয়না— নথ আর ব্রোচ।
বিয়ে, বউভাত, পুজো বা অন্যান্য উৎসবে, নিজের বাড়ি বা কুটুম্ব-আত্মীয়বাড়িতে গা ভরা গয়নায় সেজে মেয়ে-বউরা পালকি বা জুড়িগাড়ি থেকে নামত আশপাশের সকলের চোখ ঝলসে দিয়ে। আর এই গয়না পরা নিয়ে বিভিন্ন পরিবারের মধ্যে চলত একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা বা রেষারেষি। তেমনই একটি স্মৃতির ছবি দেখতে পাই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক পুত্রবধূ, প্রফুল্লময়ীর আত্মকথায়।
‘উৎসবের সময় আমাদিগকে নানারকম গহনা পরিয়া সাজিতে হইত। বাড়ির যে নতুন বউ … তাহাকে আরও বেশি গহনার উৎপাত সহ্য করিতে হইত। গহনার ভারে কোনওরকমে বাঁকিয়া চুরিয়া চলিতাম, তাহাতে বাহিরের লোকেরা মনে করিত যে আমি গহনার জাঁকে ও গুমরে ঐরূপভাবে চলিতেছি।’
গয়নার ভারে তন্বী ত্রয়োদশী বধূটির অবস্থা আজকের যুগে মনে হবে গল্পকথা!
তবে গল্পকথা নয়, এমন গয়নাই সেকালের সচ্ছল পরিবারের রীতি ছিল সেকথা জানা যায় সেকালের আর এক গরবিনী সীমন্তিনী-কৈলাসবাসিনীর নিজের কথায়। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কিশোরীচাঁদ মিত্রের স্ত্রী কৈলাসবাসিনী লিখে গিয়েছেন তাঁর অলংকার ঐশ্বর্যের কথা আজ থেকে একশো চৌষট্টি বছর আগে।
‘কোমরে দুই ছড়া চন্দ্রহার আর গোট চাবিশিকলি। হাতে দমদম মিচরি তিনজোড়া। পিনখাড়ু তিনজোড়া। ঘোড়োয়া পঁইছা। হাতাহার জাল ও হাতের মুকুতা। হাতে চালদানা, সরদানা। নঙ্গ (লবঙ্গ) কলি, নঙ্গফুল নারিকেল ফুল, মাদুলি, সোনার পঁইছা, বাউটি ও হাতমাদুলি। ওপর হাতে তাবিজ ও বাজ। তাগা, জমন (জসম) ঝাঁপা ও নবরত্ন। গলায় ডামন (ডায়মন্ড) কাটা চিক ও গোপহার ও ছড়িহার ও হেঁসো (হাঁসুয়া) হার। ন-নর গোলমালা। সাত নরদানা। পাচনর পানহার, ন-নর মুকুতা। দো-নর মুকুতা। মুকুতার কন্টি ও আরেক ছড়া কন্টি (কণ্ঠি)। কানে তিনজোড়া চউদানি, দু’জোড়া কানবালা, মুকুতার গোচা ও কান, ঝোমকা (ঝুমকা)। মাতায় সিঁতি ও ফুলকাঁটা ও গোট। গলায় চাপকলি ও ধুকধুক। এছাড়া পায়ে ছ’গাছা মল ছিল আশি ভরির। জড়োয়া নথও ছিল কয়েকটি। আরও গয়না নানা উপলক্ষে পেয়েছিলেন বাবা, স্বামী ও শাশুড়ির কাছ থেকে’।
সেকালে গয়নাগাটি মেয়েদের এমনই ছিল। ভারী গয়না। অবনীন্দ্রনাথ দেখেছেন তাঁর সুন্দরী পিতামহীর কিছু গয়না ছিল মায়ের কাছে। ‘হীরে মুক্তো দেওয়া কান, ঝাপটা। …. একটি সাতনরীহার ছিল কী সুন্দর। দুগগো প্রতিমার গলায় যেমন থাকে। সেই ধরনের।’ সেকালেও পুরনো দিনের ভারী জমকালো গয়নার কদর ছিল বেশি। গগনেন্দ্রনাথের মেজ মেয়ে পূর্ণিমা লিখেছেন সেকথা। তাঁর দাদার বিয়েতে বউ আনতে যাওয়ার সময় পিতামহী সৌদামিনী তাঁর নিজের সেকেলে সব গয়না বের করে দিলেন। বললেন, ‘তোমাদের নতুন গয়না যৌতুক কর। ভারী গয়না না হলে কি বউ মানায়।’ সেইসব ভারী সেকেলে গয়নার কথাও বলেছেন পূর্ণিমা। ‘হীরের কণ্ঠা, কঙ্কন, বাউটি, কানবালা, হীরের কান।’
লেখিকা জ্যোতির্ময়ীদেবী লিখেছেন তাঁর বিয়ের গয়নার কথা। জয়পুর রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী সংসারচন্দ্র সেনের পৌত্রী ছিলেন তিনি। তাঁর বিয়েতে বাপের বাড়ি থেকে দেওয়া হয়েছিল ‘মুকুট নয় ভরি, কান ছয় ভরি। সাতলহরী চোদ্দো ভরি চূড় চোদ্দো ভরি। বালা পাঁচ ভরি, তাবিজ সাত ভরি বাঁক পাঁচ ভরি, গোট দশ ভরি।’ আর ছিল হাতভরা চুড়ি, খোঁপার ফুল চিরুনি চার ভরি, জড়োয়া মুক্তো মিনার সরস্বতীহার, নেকলেস, রুপোর মল ছিল ত্রিশ ভরি, পাঁয়জোর কুড়ি/পঁচিশ ভরি।’
উত্তরবাংলার হরিপুরের জমিদারবাড়ির মেয়ে কবি প্রসন্নময়ী লিখেছেন—বাড়ির মেয়ে-বউদের বারোমাসের আটপৌরে গয়না ছিল ‘হাতে বেঁকি চুড়ি, নারকেল ফুল, পৈঁচে, গলায় চাঁপকলি, তুলসীদানা, কানে কদমফুল, পিপুলপাতা, নাকে বেশর, কোমরে গোট।’— এই সামান্য বারোমেসে গয়না হলে জমিদারবাড়ির আভিজাত্যের ঠাঁট বজায় রাখা যেত না।
দ্বারকানাথ ঠাকুরের পরিবারের ছ’বছর বয়সের গৌরাঙ্গী সারদা পুত্রবধূ হয়ে আসার পর সংসারে নানা শ্রীবৃদ্ধি ঘটল। তাতে পরম সন্তুষ্ট দ্বারকানাথ পুত্রবধূকে কিনে দিয়েছিলেন— লক্ষ টাকা দামের জড়োয়া খেলনা। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে খুব খুশি করেছিলেন বিদুষী দৌহিত্রী সরলা, মাতামহের প্রিয় কবি হাফেজের কবিতায় সুর বসিয়ে, গান গেয়ে শুনিয়ে। দেবেন্দ্রনাথ দৌহিত্রীকে উপহার দিয়েছিলেন চুনি ও হীরে বসানো নেকলেস আর ব্রেসলেট। মামাবাবু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে গান শুনিয়ে সন্তুষ্ট করে সুগায়িকা ভাগনি সাহানা উপহার পেয়েছিলেন— হীরের আংটি আর বড় বড় মুক্তো বসানো নেকলেস। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে ছিল একটি দুর্লভ মোহর। যার একপিঠে জাহাঙ্গির অন্য দিকে ছিল নূরজাহানের ছবি। আর ছিল একটি বড় পান্না। নিজের জহুরিকে ডেকে সেই মোহর ও পান্না দিয়ে অবনীন্দ্রনাথ স্ত্রী সুহাসিনীকে একটি সুন্দর ব্রোচ তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন। ইন্দিরা দেবীচৌধুরানির বিয়ের সময় বাবা মা তাঁকে দিয়েছিলেন একটি ‘প্ল্যাটিনামের উপর হীরে বসানো বেশ বড় একটি ফুলপাতা নকশার ব্রোচ। তার বড় ফুলটা কাঁপত।’ লীলা মজুমদার লিখেছেন তাঁর ছোট পিসিমার মেয়ে মালতীর ব্রোচে ‘মস্ত মুক্তোর ভিতরে আলো জ্বলত।’
প্রাক বিবাহ পর্বে ইন্দিরা ভাবী স্বামী প্রমথনাথের কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলেন এক চেন ব্রেসলেট যা সেকালে বিদেশিনী মেমদের হাতে দেখা যেত।
গয়না নিয়ে চিরদিনই সংসারে, পরিবারে অনেক কথা! অনেক বিবাদ। ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা। অনেক দম্ভ, লোভ, মান অভিমান, এমনকী মামলা-মোকদ্দমাও হয়েছে। গয়নার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে কত রোমান্স, রোমাঞ্চ আর ভালোবাসা, আবার দুঃখ ও চোখের জলও। তবুও সংসারে মেয়েদের গয়নার প্রতি দুর্বলতা থাকবেই।
একালেও মেয়েরা গয়না পরে সাজতে ভালোবাসেন। তবে সেকালের মতো একশো/দেড়শো ভরির সোনার গয়না এখন গল্পকথা। মেয়ের বিয়েতে পনেরো-বিশ ভরির গয়না দিতেই গৃহস্থের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়ছে।
যুগের প্রয়োজনে স্বর্ণব্যবসায়ী, স্বর্ণকাররাও নতুন ধরনের গয়না করার চেষ্টা করছেন। সেকালের ভারী ভারী গয়নার বদলে নান্দনিক নকশার হালকা গয়না তৈরি করছেন। মধ্যবিত্ত মানুষের কেনার ক্ষমতার দিকে নজর রেখেই।
ক্ষয় নেই যার সেটাই অক্ষয়! দিন বদলায়, তবু অক্ষয় তৃতীয়ার মাহাত্ম্য অক্ষয় হয়েই থেকে যায়।
(তথ্যসূত্র:
১- উইকিপিডিয়া।
২- বাংলাপিডিয়া।
৩- বর্তমান পত্রিকা, ২৯শে এপ্রিল ২০১৭ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত