এ বছর ও স্বজন -বন্ধুকে পবিত্র মাসের প্রথম দিনে শুভেচ্ছা জানানোর আগে এই দ্বন্দ্বটা চলছিল। কি লিখবো? ওটা লিখলে ঠিক হবে কি? বাজার এবার ও ছেয়ে গেছে রামাদান করীম শুভেচ্ছায়। রমজান মুবারক একটু ব্যাকসিটেই। এমনিতে রামাদান করীম শব্দটা ও কানে মিঠে লাগে, এবার রামাদান করীম লেখা শুভেচ্ছাপত্রই পাঠিয়েছি। কিন্তু এখন যেহেতু অনেকটা সময়, ভাবলাম ফের জানাই এই বিষয়ে। ছোট বিধর্মীর বড় মুখের গুনহা মাফ করে দিয়েন সংযম মাসে।
কথাটা রমজান। রামজান বা রামযান না। আর শ্রীরামচন্দ্রের সাথে এর দূর দূরান্তর অবধি কোন সম্পর্ক নেই তবু ও কয়েক বছর ধরেই দেখছি আশেপাশের বেশ কিছু মানুষ স্রেফ রামাদানেরই শুভেচ্ছা বিনিময় করছে ফেসবুকে হোয়াটসঅ্যাপ এ। অথচ মনে করে দেখুন, কয়েক বছর আগে অবধি রমজানই ছিল আমাদের। যেমন এই উপমহাদেশের নিজস্ব কিছু গল্প ছিল যা আরব্যরজনীর চেয়ে আলাদা, মিঠে, মাটির গন্ধ ছিল।
রমজান শব্দটা এসেছে পারস্যদেশের ভাষা থেকে। আর রামাদান সৌদি আরব থেকে। ঐতিহাসিকভাবে ভারত বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মুসলমানদের ভাষা পারসি, উর্দু বা বাংলারই প্রধানত। উপমহাদেশে মোগল সাম্রাজ্যের বিস্তারের সাথে সাথে সুফিবাদ আর ফারসিক প্রভাব বেশি করে আসতে শুরু করে। আল্লাহহাফিজ যেমন এখানে খুদাহাফিজ পারস্য প্রভাবে। কিন্তু ক্রমশ গোটা উপমহাদেশে জুড়ে ওয়াহাবি সংস্কৃতি গ্রাস করতে শুরু করে। উগ্রতা, কট্টরপন্থা ও। অথচ আদর্শ মানুষ তথা খাঁটি মুমিন হওয়ার জন্য কোরান শরিফে বর্ণিত গুণাবলির মধ্যে ক্ষমা ও উদারতাকে উত্তম বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
যে কোন আগ্রাসন বা সাম্রাজ্যবাদের প্রথম লক্ষ থাকে সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত আগ্রাসন। হয়তো আরব ঠিক সেটাই করছে আমাদের এই কয়েকটা দেশ জুড়ে। আর তাই আরো বেশী করে শুনতে পাচ্ছি আরবী শব্দ বাংলাভাষী মানুষদের মুখে।
সৌদি আরব গোটা পৃথিবী নয়। তার যেরকম একটা সংস্কৃতি আছে, আপনার নিজের ও একটা সংস্কৃতি আছে আর তার সাথে আপনার ধর্মীয় বিশ্বাসের কোন দ্বন্দ্ব নেই। ঠিক যেমন মুসলিম হলে ও আপনি একজন বাঙালি, বিহারী, মালায়লি বা ভারতীয়। প্রত্যেকটা অংশ আপনার, আমাদের সকলের।
আত্মশুদ্ধির এই পবিত্র মাসে আসুন আমাদের ঐতিহ্যগুলো সগর্বে বহন করি। আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি, জাত্যাভিমান, আম্মির হলুদমাখা আঁচল, আব্বার গুনগুন করে সাঁইয়ের গান গাওয়াটা ও আমারই ইবাদতের অংশ। আমার শষ্য শ্যমলা মাতৃভূমির মতোই। বিদেশী মরুভূমির মধ্যে এক চিলতে জলের হাতছানিতেই দৌড়োতে যাবো কেন শুধু? এতে না শেখা হবে শুদ্ধ বাংলা না বোঝা হবে বিশুদ্ধ আরবী। মানবজমিন সাধনার এই বোধ যতদিন আমাদের মধ্যে থাকবে আমাদের কোন শক্তি আলাদা করবে আগুন লাগিয়ে?
বেশ অনেকদিন আগে লুফতর রহমান দা লিখেছিল, এই সব্বার রামাদান করীম নিয়ে হামলে পড়া দেখে সে জনৈক একজনকে জিজ্ঞেস করেছিল। “রামাদান কি চাচা??চাচা,মেকুরের বাচ্ছার মতো গলা তুলে,কোন রকমে বলেছিল: রুমজানের চাচাতো ভাই।হজ্ব করে এয়েচে। নাম নিয়েছে,হাজী রামাদান!”
কি এসে গেল রমজান আর রামাদানের ভাগে! নিজের নিজের গল্পগুলো নিজের নিজের ভাষায় বানিয়ে নিয়েই বেঁচে থাকি না! নিজের শিকড়কে আঁকড়ে থেকে বাঁচার মজাই আলাদা। মাথায় রাখবেন মুসলমানি, হিন্দুয়ানী হয়ে বাঁচা না, মানবজমিনে মানুষ হয়ে বাঁচার স্বাদ ঈদের সেমাইয়ের চেয়ে ও মিঠে।
ছোট বিধর্মী মুখে অনেক বড় বড় কথা বলে ফেললাম। ক্ষমা করবেন। ফাঁকা সময় পেলে অলীক কল্পনা করি কিনা। আপনি ও পারলে এক ফকিরের গান শুনবেন।
“এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে/
যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান,
জাতি গোত্র নাহি রবে।।
ধর্ম কুল গোত্র জাতির/
তুলবে না গো কেহ জিগির।
কেঁদে বলে লালন ফকির,
কেবা দেখায়ে দেবে।”
রমজান মুবারক হো ♥️!
©️—- ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ
মতামত লেখকের ব্যাক্তিগত