লোকসাহিত্য, লোকশিল্প, লোকসঙ্গীত ও লোকনৃত্য প্রভৃতির মধ্যেও যে স্বাভাবিক সৌন্দর্য্যের ঐশ্বর্য্য থাকে, উচ্চশিক্ষিতদের দৃষ্টি প্রায়ই তার দিকে আকৃষ্ট হয়না। কিন্তু মাঝে মাঝে এক-একজন সত্যদ্রষ্টা কলাবিদ যখন সেইসব নিত্যদৃষ্ট ব্যাপারে ভেতর থেকেই অদৃষ্টপূর্ব সুষমা আবিষ্কার করে তুলে ধরেন সকলের চোখের সামনে, তখন আমাদের বিস্ময়ের শেষ থাকে না। লোকসাহিত্যের দিকে রবীন্দ্রনাথ বহুকাল আগেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, এবং তারপর লোকসঙ্গীতও যে কি বিচিত্র সৌন্দর্য্যের খনি, সুরকার রবীন্দ্রনাথ তারও উজ্জ্বল প্রমাণ দিতে বাকি রাখেননি। আগে যে সব সুর হেটো বা মেঠো বলে শিক্ষিতদের গানের বৈঠকে ঠাঁই পেত না, তিনি সেগুলিকেই সুকৌশলে ব্যবহার করে জাতে তুলে দিয়েছিলেন। নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্কর বলেছিলেন, ‘Everything is Folk!’ তাঁর মতে, ভারতের মত লোকনৃত্যের বিপুল ভাণ্ডার পৃথিবীর আর কোথাও নেই। যথার্থ গুণীর হাতে যথাযথ ভাবে ব্যবহৃত হলে লোকনৃত্যও অনন্য সাধারণ হয়ে উচ্চশ্রেণীর রূপরসিকদেরও যে আনন্দবিধান করতে পারে, সেটা তাঁর নৃত্য দেখলেই বোঝা যায়। বঙ্গদেশে বড় বড় শিল্পীর অভাব কোন কালেই ছিল না, কিন্তু প্রাচীন বাংলার ঘরোয়া পট রচনা পদ্ধতি অবলম্বন করে যে বর্তমান কালেও যুগোপযোগী উচ্চশ্রেণীর কলাবস্তু প্রস্তুত করা যেতে পারে এটা দেখার মতন দৃষ্টিশক্তির যথেষ্ট অভাব ছিল। আমাদের শিল্পীরা যখন প্রতীচ্যের নানাবিধ ‘ইজমের’ দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে আত্মপ্রকাশের পথ খুঁজে পাচ্ছেন না, যামিনী রায় তখন রূপলক্ষ্মীর মূর্তি গঠনের জন্য উপকরণ সংগ্রহে নিযুক্ত হলেন গৌড়-বাংলার নিজস্ব ঐশ্বর্য্য ভাণ্ডারে। কিন্তু তিনিও একবারে নিজের পথ কেটে নিতে পারেননি। প্রথম প্রথম তিনিও এমন সব ছবি এঁকেছিলেন, যাদের ভেতর থেকে আবিষ্কার করা যায় পাশ্চাত্য প্রভাব, চৈনিক প্রভাব বা অন্য কোন প্রভাব। তারপরেই তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির বদল হতে থাকে। শিল্পী যামিনী রায়ের অপরূপ রেখাকাব্যগুলো বাংলার খাঁটি প্রাণপদার্থ দিয়ে গড়া। তার মধ্যে বহু যুগের ওপার থেকে ভেসে আসে সাবেক বাংলার সোঁদা মাটির গন্ধ এবং সেই সঙ্গে পাওয়া যায় বাংলার পরিচিত প্রাণের ছন্দ। তাঁর হাতের নব নব পরিকল্পনায় উচ্ছাসিত হয়ে উঠেছিল রসরূপের যে নির্মল আনন্দ, কোথাও কোন বিজাতীয় মনোবৃত্তির ছোঁয়া তাকে ম্লান করতে পারেনি। নিশ্চিত হাতের টানে আঁকা চিত্রার্পিত ও লীলায়িত রেখার সমারোহের মধ্যে সর্বত্রই অনুভব করা যায় ভাবসাধক শিল্পীর মনের গভীর নিষ্ঠা। পথ ঠিক হয়ে গেল – সে পথের শেষ নেই। জীবন সংক্ষিপ্ত, কিন্তু আর্ট অনন্ত। যামিনী রায় একাধিকবার বাংলার রঙ্গালয়ের দৃশ্য-পরিকল্পকের কার্য্যভার গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু সেক্ষেত্রেও তিনি বাংলার পট পদ্ধতি বর্জন করেননি। বাংলার পট হচ্ছে প্রধানতঃ আলঙ্কারিক আর্ট। তাই রঙ্গমঞ্চের উপরেও তার মধ্যে ছন্দপতন হয়নি।
যামিনী রায়ের চোখে জগৎ ছিল একান্তভাবেই বাস্তব সত্য। তাঁর কাছে যেটা চাক্ষুষ, সেটাই ছিল সত্য। তাঁর জীবনের বেশ কিছু প্রত্যক্ষ ঘটনায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
ডা. রাজেন্দ্রপ্রসাদ তখন ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে আসীন। একদিন যামিনী রায় তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু কবি বিষ্ণু দে কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি রাষ্ট্রপতির ফটো দেখেছেন খবরের কাগজে তিনি উচ্চপদে বসার পর?’ বিষ্ণু দে জানিয়েছিলেন যে তিনি দেখেন নি। যামিনী রায়ের প্রত্যুত্তর ছিল, ‘সব সময়ে তাঁর গোঁফ ছিল নিশ্চয় – কিন্তু এখন যেই না গদিতে বসেছেন, একটা নতুন শক্তি তাঁর গোঁফে এসেছে। গোঁফ দাঁড়িয়ে উঠেছে বাঘের মতন আত্মপ্রত্যয়ে।’ শুনে বিষ্ণু দে একচোট হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ফটোগ্রাফটা নিশ্চই গদিয়ান হবার খবরের আগের ফটো – গতকালের আগের তোলা।’ কিন্তু যামিনী রায় তাঁর সাথে একমত হতে পারেননি। বিষ্ণু দে লিখেছেন, ‘যামিনীদা মানতে পারলেন না, কারণ যা প্রত্যক্ষ (appearance) তাই হচ্ছে সত্য। অন্তত তাই হওয়া উচিত।’
একদিন সেই সময়ের সুপরিচিত কমিউনিস্ট নেতা, বিদ্বান ও বুদ্ধিজীবী হীরেন মুখোপাধ্যায় ও কবি বিষ্ণু দে গিয়েছেন যামিনী রায়ের বাগবাজারের বাড়ির স্টুডিওতে। তখন রাজনৈতিক পালা বদলের সময়। যামিনী রায় খুব অন্তরঙ্গতার সাথে হীরেন মুখোপাধ্যায়কে বললেন, ‘আমি আপনাদেরই সঙ্গে আছি, একটা আমূল রূপান্তরের পক্ষে। আচ্ছা, আপনারা কি ভেবেছেন – কি রকম পুলিশ আমাদের হবে? তাদের পোষাক, পাগড়ী বা টুপি কি রকম হবে?’ হীরেন মুখোপাধ্যায়ের উত্তর ছিল, ‘আমার মনে হচ্ছে আমরা বোধহয় ওই একটা ডিটেইলসের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত ভাবিনি।’ এই উত্তরে যামিনী রায়ের প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘ওটা একটা ছোট ডিটেল? আপনারা বিশ্বাস করেন যে আপনারা একটা ভাবী পরিকল্পিত সমাজ ভাবতে পারেন নিজের মনে ছবিটা না ভেবে, অন্তত খানিকটা, গভর্নমেন্টের যেটা সবচেয়ে বড় ব্যাপার – পুলিশের সাজপোষাক সেটা কি হবে। এরকম ভাবে চললে আপনাদের শ্রেণীহীন সমাজের স্বপ্ন একেবারে ঘোঁট পাকিয়ে যাবে।’
১৯৪৭ সাল নাগাদ পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী শ্রী প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ তাঁর সাথে দেখা করতে আসেন। যামিনী রায়, তাঁরই ভাষায় ‘পোট্রেট’-এ বা চেহারায় শিল্পীর চোখের অভিজ্ঞতায় বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন, চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন রাজ্যের মঙ্গলের বিষয়ে। এরপরে যখন বিমূঢ় মুখ্যমন্ত্রী উঠে দাঁড়ালেন, শিল্পী আরও বিচলিত হয়েছিলেন ও বলেছিলেন – ‘না মশায়, আপনাকে দিয়ে তো হবে না। আপনি রাজ্য চালাতে পারবেন না।’ শুধুমাত্র মানুষের আকার ও চোখমুখের ভঙ্গি দর্শকদের মনে ছাপ রেখে যায় না, আসলে মানুষের গোটা ব্যক্তিত্বই জাতশিল্পীর চোখে প্রত্যক্ষভাবে ধরা পড়ে যায়। প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ বেশিদিন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পদে টিকতে পারেননি।
একবার গভর্নমেন্টে হাউজে (বর্তমানের রাজভবন) বাংলার বড় বড় শিল্পীদের কাজ নিয়ে একটা প্রদর্শনীর আয়োজন হয়েছিল। বড় লাটের স্ত্রী মিসেস কেসি, যাঁর উদ্যোগে ওই প্রদর্শনী হয়েছিল, যামিনী রায়কে প্রাক-প্রদর্শনীতে আহ্বান করে নিয়ে গিয়েছিলেন। যামিনী রায় যখন ঘুরে ঘুরে প্রদর্শনী দেখতে ব্যস্ত সেইসময় লাটসাহেব সেখানে উপস্থিত হলেন, তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর এডিসি এবং তাঁদের এগিয়ে গিয়ে সম্ভাষণ করেছিলেন বাংলার মস্ত একজন গণ্যমান্য পুরুষ, যাঁর চেহারা ও শরীর ছিল প্রকাণ্ড (কোন অজ্ঞাত কারণে যামিনী রায় নিজের স্মৃতিচারণে তাঁর নামোল্লেখ করেননি)। পরে যামিনী রায় জানিয়েছিলেন, ‘আমার হঠাৎ মনে হল, আমি যেন দেখছি এক রাজ-গোখরোর স্বাধীন গতিবিধি, তার মারাত্মক ক্ষমতার সম্পূর্ণ জ্ঞানে, আর যুবাটি যেন আজ নবীন তাজা কেউটে। আর তারপরেই তুলনায় এসে দাঁড়ালো আমাদের এক নেতা, তাঁর প্রকাণ্ড ঢ্যমনা সাপের শরীর নিয়ে, যে সাপের কামড় আছে কিন্তু মারণ বিষ নেই। আচ্ছা যদি তুমি সাপ হতেই চাও, কামড়ের ক্ষমতা নিয়ে, তাহলে তো তোমার শক্ত উদ্ধত দাঁতে মৃত্যু থাকবে।’
যামিনী রায় তাঁর স্বভাবধর্ম অনুসারে জন্তুজানোয়ারের বিষয়ে যেমন বিরূপ, সন্ত্রস্ত ছিলেন, তেমনই তিনি মানুষের সন্ত্রাসের বিষয়েও সিঁটিয়ে থাকতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এক ইংরেজ সাহেব তাঁর এক বাঙালি বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে যামিনী রায়ের বাগবাজারের বাড়িতে তাঁর সাথে দেখা করতে আসেন। নানা বিষয়ে আলোচনা চলছিল, সাহেব চেষ্টা করছিলেন যামিনী রায়ের অন্তরঙ্গ হবার। সভ্যতার ভেদাভেদজনিত একটা আলোচনার মাঝে যামিনী রায় সাহেবের বাঙালি বন্ধুকে সটান বলে বসেছিলেন, ‘আপনারা দু’জনেই আমার হিতাকাঙ্খী। আপনি কোন কোন বিষয়ে আমার সঙ্গে একমত নাও হতে পারেন, কিন্তু আপনি তো আমাকে মেরে ফেলতে পারেন না, অথচ উনি আমার যতই ভালোবাসুন (সাহেবকে দেখিয়ে), যে কোন মুহুর্তে উনি আমায় গুলি করতে পারেন। আপনার পাশে তাঁকে বসে থাকতে দেখছি, আর আমি প্রায় দেখতে পাচ্ছি তাঁর বন্দুক, রিভলভার, তলোয়ার – তাঁর বসায়, চলায়, গোটা শরীরের ধরণে।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন মার্কিন সরকারের এক কর্তাব্যক্তি যামিনী রায়কে এমন একটা ছবি এঁকে দিতে বলেন, যাতে লোকে বুঝতে পারবে যে ভারতে কতটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোগ্রেস হচ্ছে। ছবির দাম যতই হোক না কেন, সেটা নিয়ে তাঁর কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু যামিনী রায় ঐরকমের কোন ধরাবাঁধা প্রগতিতে বিশ্বাস করতেন না, তাই তৎক্ষণাৎ এই লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর নিজের ধারণাই ছিল অন্যরকম। তিনি মনে করতেন, আমদানী করা পাশ্চাত্য পণ্যবিপ্লব – ঐ রকমের শিল্পবিপ্লব ভারতে স্বাভাবিক নয়। চাষবাস আর পণ্য উৎপাদন ভারতে আলাদাভাবে চলে না। তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘দেশের মানুষ ছাড়া কিভাবে দেশের যন্ত্রপাতির বিকাশ হবে? দ্রব্যের ব্যবহার দেশের মানুষই করতে পারে। তোমরা কেন অন্তত কয়েকটি দেশকে ছেড়ে দাও না। তারা স্ববশ থাকুক না। তোমরা নাহয় একটু বিদেশে পিকনিক করো। তোমাদেরই নানা পণ্যদ্রব্য ও কৌশল থাক না।’
যামিনী রায়ের নানা বিষয়ের উক্তিতে আপাতদৃষ্টিতে অনেকেরই মনে হত নানা মানবিক স্ববিরোধ। কিন্তু বাস্তবে তিনি তাঁর চোখ দিয়ে যেটা দেখতেন, সেটাই বলতেন। তিনি নিজেই এই বিষয়ে বলতেন যে, দুনিয়ার অনেক কিছুই তাঁর মনোমত হয় না, কিন্তু সবই জানতে হয়, কারণ সবই মানুষের। একেই বোধহয় একজন পাশ্চাত্য জ্ঞানী বলেছিলেন, ‘a new discipline of suffering.’ বস্তুতপক্ষে, স্থান-কাল-পাত্র হিসেবে এমনাকি দর্শকদের ও শ্রোতার স্বভাব বা প্রয়োজন হিসেবে তিনি যা বলতেন, তা সহ-অনুভূতির ডায়ালেকটিকে – দ্বন্দ্ব ও দ্বন্দ্বত্তোরণে – শুনলে, পড়লে ও দেখলে স্পষ্ট মূল্য পেত।
(তথ্যসূত্র:
১- যামিনী রায়: তাঁর শিল্পচিন্তা ও শিল্পকর্ম বিষয়ে কয়েকটি দিক, বিষ্ণু দে (১৩৬৭ বঙ্গাব্দ)।
২- এখন যাঁদের দেখছি, হেমেন্দ্রকুমার রায় (১৩৬২ বঙ্গাব্দ)।
৩- সাধক-শিল্পী যামিনী রায়, লীলাময় মুখোপাধ্যায়, বাংলার আভাষ।)
মতামত লেখকের ব্যাক্তিগত