১৯২১ সালের ২রা মে উত্তর কলকাতার ১০০ নম্বর গড়পাড় রােডের রায় পরিবারে যাঁর জন্ম সেই বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী সত্যজিৎ রায়ের প্রয়াণ ঘটে ১৯৯২ সালের ২৩শে এপ্রিল। তাঁর মৃত্যুর পর অতিক্রান্ত হল প্রায় আঠাশটি বছর। শুধুমাত্র চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবেই তিনি খ্যাতির চরমসীমায় পৌঁছাননি, সাহিত্য-সংস্কৃতি আর চিত্রশিল্পের অঙ্গনেও তিনি ছিলেন সমান অগ্রগণ্য।
১৯৫৭ সালে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের একেবারে শেষ পর্বে সত্যজিৎ রায়ের ‘অপরাজিত’, ভিস কন্তি- ‘লা নটি ব্লেন্স’ আর আকিও কুরােসােয়ার ‘ম্যাকবেথ’- এর মধ্যে দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত ‘অপরাজিত’ ও ‘ম্যাকবেথ’ যুগ্মভাবে ‘গােল্ডেন লায়ন’ লাভ করে। এই প্রসঙ্গে মেরি সিটন তাঁর ‘পোট্রেট অব এ ডায়রেক্টর সত্যজিৎ রায়’ গ্রন্থে লিখেছেন- দীর্ঘকায় সত্যজিৎ রায়ের চমকপ্রদ চিন্তাধারায় সৃষ্ট অপরাজিত এবং কুরােসােয়ার ম্যাকবেথ (থ্রোন অব ব্লাড) জিতে নিয়েছিল ‘গােল্ডেন লায়ন’। সেইসঙ্গে ভিস কন্তির ‘লা নটি ব্লেন্স’- এই ত্রয়ী মিলে সবচেয়ে বেশি পুরস্কার জিতে নিয়েছিল।
তবে ভিত্তোরিয়া ডেসিকা’র যেমন ‘বাইসাইকল থিভস’, আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটেলশিপ অব পুটেমকীন’, কুরোশােয়ার ‘রশােমান’, তেমনই সত্যজিৎ রায়ের বিশ্বপরিচিতি– তিনি ‘পথের পাঁচালী’র স্রষ্টা। প্রথম শ্রেণির চলচ্চিত্র সমালােচক এবং ‘সিকোয়েন্স’ ও ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ পত্রিকার এক সময়ের সম্পাদক লিন্ডসে এন্ডারসন সেই সময় লিখেছিলেন –
“… ‘পথের পাঁচালী’ ইজ এ পিকচার কমপ্লিটলি ফ্রেশ অ্যান্ড পার্সোনাল রিকোয়ার্ড গ্রেট কারেজ অ্যান্ড পার্সিভারেন্স টু মেক। ইট ইজ টু কমপ্লিমেন্ট রায়, নট টু ডিনাই হিজ অরিজিন্যালিটি দ্যাট আই মেনশন নেমস লাইক রেনােয়ার অ্যান্ড ফ্ল্যাহারথি অ্যান্ড ফারটিলাইজিং ইনফ্লুয়েন্স হ্যাস সিওরলি বিন দ্য নিওরিয়্যালিজম অব ডেসিকা।”
‘অপরাজিত’ ভেনিস-এ ‘গােল্ডেন লায়ন অব সেন্ট মার্ক’ পাওয়ার পর ‘Robert Flaherty’-র নামের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের নাম ওতপ্রােতভাবে জড়িয়ে যায়। তাঁর বিধবা স্ত্রী ফ্রান্সিস সত্যজিতের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের পর মেরী সিটনকে লিখেছিলেন –
“রায় শান্ত, অন্তর্মুখী একান্তে থাকা মানুষ, যেখানে বব অশান্ত, উষ্ণ এবং অত্যৎসাহী। আপনি তো জানেনই যে রায়ের উপস্থিতি সবসময় মনে ছাপ রেখে যায়, বিশেষ করে তাঁর ইংরাজি ভাষার স্পষ্ট উচ্চারণ ও প্রয়ােগের দক্ষতা আমি খুব কম মানুষকেই দেখেছি। মনকে গভীরভাবে স্পর্শ করতে পারে। এমন বিস্ময়কর তথ্য প্রকাশের অদ্ভুত ক্ষমতার বলেই তিনি ‘পথের পাঁচালী’র মতাে ছায়াচিত্র নির্মাণ করতে পেরেছিলেন।”
এখন প্রশ্ন আসে এতখানি প্রশংসার পাত্র যিনি, তিনি মৃণাল সেনের একটি বক্তব্যে এতটাই ক্ষিপ্ত হলেন যে একটি ইংরাজি পত্রিকায় ‘আকাশকুসুম’ চলচ্চিত্রটিকে ‘a crow film’ বলে মন্তব্য করে ফেললেন কেন? আসলে ‘নায়ক’ ছায়াছবির চিত্রনাট্য সরাসরি রচনা করে উত্তমকুমারকে সেই ভূমিকায় অভিনয় করানােয় চিত্র সমালােচকদের সুরে সুর মিলিয়ে একজন সফল চিত্রপরিচালকের অবনমন-এর ধুয়ো তুলে ‘বাণিজ্যিক স্তরে নেমে এসেছেন’ জাতীয় মন্তব্য করেছিলেন মৃণাল সেন। ‘আকাশকুসুম’-এর সাফল্যে তিনি তখন উদ্বেল। একজন চিত্রপরিচালকের এহেন মন্তব্যে একপ্রকার বাধ্য হয়েই প্রতি আক্রমণে উঠে আসতে হয়েছিল সত্যজিৎ রায়কে। প্রয়ােজনে ‘ফেঁস’ করার নির্দেশ তাে স্বয়ং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণই দিয়ে গিয়েছেন।
সত্যজিৎ রায়ের প্রিয়বন্ধু চিদানন্দ দাশগুপ্তের কন্যা অপর্ণা দাশগুপ্ত পরবর্তীকালে যিনি ‘অপর্ণা সেন’ তিনি সত্যজিতের অনন্য আবিষ্কার। সেই অর্পণাই অভিনয় করেছিলেন ‘আকাশকুসম’-এ। অথচ সেই ছবিকে ‘a crow film’ বলেছিলেন সত্যজিৎ রায়- ফলে বােঝাই যায় মৃণাল সেনের ব্যবহারে কতটা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
সমকালীন আর এক বিখ্যাত চিত্রপরিচালক ‘ঋত্বিক ঘটক’ সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে বলেছিলেন,
“… আমি মনে করি ভারতবর্ষে ছবির মাধ্যমটাকে যদি কেউ বােঝেন, তবে তিনি হচ্ছেন একমাত্র সত্যজিৎ রায়। দেখুন, মেজে-ঘষে পড়াশুনাে করে একটা স্তর পর্যন্ত রগড়াতে রগড়াতে পৌছানাে যায়। এমনকী হয়তাে প্রবন্ধকার বা ইস্কুল মাস্টারের স্তর ছাড়িয়ে একধরনের শিল্পীতেও পরিণত হওয়া যায়, কিন্তু জাতশিল্পী হতে গেলে অন্য আরেকটা এলেম লাগে।”
একই ভাবে ঋত্বিক ঘটক সম্পর্কে সত্যজিৎ বলেছিলেন,
“ঋত্বিক মনে-প্রাণে বাঙালি পরিচালক ছিল, বাঙালি শিল্পী ছিল– আমার থেকেও অনেক বেশি বাঙালি। আমার কাছে সেইটেই তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় এবং সেইটেই তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান এবং লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য।”
এই যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবনত ভাব- মণাল সেনের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটেছিল সত্য, তবে পরবর্তীকালে বৈরীভাব দূর হয়ে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।
সত্যজিতের আর একজন কঠোর সমালােচক ছিলেন অভিনেত্রী নার্গিস দত্ত, যিনি সত্যজিৎ রায়ের বিরুদ্ধে দারিদ্র রফতানির অভিযােগ এনেছিলেন।
পঞ্চাশের দশকের প্রথমভাগেই রাজ কাপুর-নার্গিস জুটি নজর কেড়েছিলেন। মধ্যভাগে ‘শ্রী ৪২০’– কৌতুক ও রােমান্সের মিশ্রণে চুড়ান্ত পর্বে পৌছায় কিন্তু তারপর রাজ কাপুর, ক্রমশ নতুন নায়িকার সন্ধানে মেতে ওঠেন। ওয়াহিদা রহমান (তিসরি কসম), পদ্মিনী (জিস দেশ মে গঙ্গা বহতি হ্যায়) এবং বৈজয়ন্তীমালা (সঙ্গম)– তাঁর নায়িকার স্থান পূরণ করতে শুরু করেন। নার্গিসি আর কে গ্রেডকশন থেকেই সেই যে বেরিয়ে গিয়েছিলেন আর কখনওই ফিরে আসেননি। নার্গিসকে এড়িয়ে যে ওয়াহিদা রহমানকে আবিষ্কার করেন রাজকাপুর, সত্যজিৎ রায় তাঁকেই সুযােগ দেন তাঁর অন্যতম চলচ্চিত্র ‘অভিযান’ (১৯৬২)-এ। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ (১৯৬৭)-তে তিনি সুযােগ দেন সিমি গারেওয়ালকে। ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ী’ (১৯৭৭)-তে সুযােগ পেয়েছিলেন শাবানা আজমি এবং শেষমেশ ‘সদগতি’ (১৯৮১)-তে অভিনয় করেন স্মিতা পাতিল, কিন্তু সত্যজিৎ একবারের জন্যও নার্গিসকে ডাকেননি। হয়তাে নার্গিসের একান্ত ইচ্ছে ছিল সত্যজিতের কোনও ছবিতে অভিনয় করার, কিন্তু সুযােগ না পাওয়ার জন্যই বােধ করি ক্ষোভে ১৯৮০ সালে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের পর তাঁর বিরুদ্ধে ‘দারিদ্র রফতানি’র অভিযােগ তুলে ক্ষোভ উগলে দেন। কেউ কেউ এ ব্যাপারে ‘সদগতি’র নাম উল্লেখ করেন, কিন্তু এটি তো নিতান্তই ভারতীয় দূরদর্শন প্রযােজিত চিত্র, যা ১৯৮২ সালের ২৫শে এপ্রিল সম্প্রচার করা হয়। এই ছায়াচিত্রটি কীভাবে দারিদ্র রফতানি করতে পারে? প্রধানত সত্যজিতের সমালােচকরা দারিদ্র প্রচারের অভিযােগ তুলতেন ‘পথের পাঁচালী’ এবং ‘অশনি সংকেত’-এর বিরুদ্ধে।
প্রথম ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত কান চলচ্চিত্র উৎসব থেকে ডেনমার্ক-এর ‘বদিল’ পুরস্কার– মােট এগারােটি পুরস্কার লাভ করে আর তাঁর জীবন-সায়াহ্নে এনে দেয় ‘অস্কার’।
অপরদিকে দ্বিতীয় ছায়াছবিটি ১৯৭৩ সালে চিকাগাের ‘গােল্ডেন হুগাে’ পুরস্কারে ভূষিত হয়। তা ছাড়া সত্যজিৎ শ্রমিক শ্রেণিকে নিয়ে ছবি করেন না বা শ্রেণিসংগ্রামের কোনও বার্তা তাঁর ছবি দিতে পারেনি-বামপন্থীদের এই অভিযােগের জবাব দিতেই তিনি ‘হীরক রাজার দেশে’ আর ‘সদগতি’ নির্মাণে প্রয়াসী হয়েছিলেন।
নার্গিসের অভিযােগের জবাব দেওয়ার বদলে তাঁর একটি কার্টুন এঁকেছিলেন সত্যজিৎ রায়। তিনি ছিলেন শিল্পী। ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় সহ বহু বিখ্যাত মানুষের রেখাচিত্রও অঙ্কন করেছিলেন তিনি। তাইতো প্রয়াণের দুই দশক পরেও সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের মিলন জগতে তিনি অমর হয়ে আছেন।
অনেকদিন ধরেই উত্তমকুমারকে নিয়ে ছবি করার কথা ভাবছিলেন পরিচালক সত্যজিৎ রায়। চিত্রনাট্যও রেডি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি হবে ‘ঘরে বাইরে’। সন্দীপের চরিত্রে উত্তমকে ভেবেছিলেন সত্যজিৎ। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত নায়ক উত্তম সেই চরিত্রে অভিনয় করতে চাননি।
‘ঘরে বাইরে’তে উত্তমকুমারকে না পেলেও, স্রেফ তাঁকে ভেবেই একটি ছবির চিত্রনাট্য সাজিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। ‘নায়ক’। অভিনেতা অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লড়াই। তাঁকে ঘিরে জনমানসের উন্মাদনা। একজন সুপারস্টারের জীবন সবকিছুই তুলে ধরা হয়েছিল ছবিতে। ১৯৬৬। উত্তমকুমার তখন মধ্যগগনে। ইন্দিরা হলে ছবির প্রিমিয়ার হবে। সত্যজিৎ স্পষ্টই বলে দিলেন প্রিমিয়ারে হাজির হতে হবে উত্তমবাবুকে। উত্তমও সবিনয়ে মানিকদাকে জানালেন, এই ভরদুপুরে শোয়ে তাঁর হাজির হওয়াটা ঠিক হবে না। গুরুগম্ভীর কণ্ঠে সত্যজিৎ জানিয়ে দিলেন, এটা সত্যজিৎ রায়ের ছবি। তাই তাঁকে হাজির হতেই হবে। এই খবর জানাজানি হতে দেরি হয়নি। সেদিন কেলেঙ্কারির একশেষ। রাস্তায় ভিড়। ‘গুরু’কে দেখতে হাজির অসংখ্য মানুষ। মারপিট, হাতাহাতি চলছে। হলমালিকও মানিকবাবুকে বললেন, উত্তমবাবুকে আনাটা কী ঠিক হবে। সত্যজিৎ নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। উত্তম এলেন। সঙ্গে সঙ্গে দর্শকদের মধ্যে আলোড়ন। আর গুরু, গুরু রব। উত্তমকুমার স্টেজে এসে বললেন, এটা কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের ছবি। এখানে এসব দয়া করে করবেন না। ব্যস দর্শক চুপ। এমনই ছিল তাঁর জনমোহিনী ভাবমূর্তি। এক লহমায় দর্শককে নিজের কথা শোনাতে বাধ্য করতে পারতেন উত্তমকুমার।
সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতেও অভিনয় করেছিলেন উত্তমকুমার। বাঙালির একান্ত আপন গোয়েন্দা চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সির ভূমিকায় অভিনয় করে দর্শকের প্রশংসা আদায় করে নিয়েছিলেন উত্তমকুমার। এই ছবিতে অভিনয় করে জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছিলেন তিনি। তবে যুগ্মভাবে। তিনি পুরস্কার ভাগাভাগি করেন উত্তমকুমারের সঙ্গেই। ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’র জন্যও তাঁকে ওই পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।
‘ঘরে বাইরে’ ছবিতে নেগেটিভ রোল ছিল বলে তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন উত্তমকুমার। কিন্তু সেই উত্তমকুমারেরই জীবনের অন্যতম সেরা অভিনয় ছিল ১৯৭৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘বাঘ বন্দি খেলা’ ছবিতে। পীযূষ বসুর নির্দেশনার এই ছবিতে উত্তম অভিনয় করেছিলেন ভবেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্রে। লম্পট, দুর্নীতিগ্রস্ত, স্মাগলিংয়ের কারবারি ভবেশকে পুলিসের হাতে ধরিয়ে দিতে চেয়েছিল তাঁর ছেলেই। আত্মঘাতী হয়ে জীবন শেষ করে দিয়েছিলেন ভবেশ। ১৯৮১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রায় একই ধরনের ছবি ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’তে রাজশেখর রায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন উত্তম।
‘‘… অরিন্দম, এই যে তোর খুঁতখুতেমি, এর মানে, তুই একদিন সাইন করবি। … করবো। আলবাৎ করবো। আই উইল গো টু দ্য টপ… দ্য টপ… দ্য টপ …’’
‘নায়ক’ সিনেমায় কাঠের টেবিলে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত ঠুকে অরিন্দমের এই সদর্প উচ্চারণ, পঞ্চাশ বছর পর, আজও অনেককেই উজ্জীবিত করে।
অরিন্দম মুখোপাধ্যায়, মানে, উত্তমকুমার। সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’, বাংলা চলচ্চিত্রের ‘মহানায়ক’।
বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের মাত্র দু’টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন উত্তমকুমার। ‘নায়ক’ এবং ‘চিড়িয়াখানা’।
অনেকের মতো আমারও এ প্রশ্ন বারবার মনে আসে, সত্যজিৎ তার চলচ্চিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। শুধুমাত্র বাংলা নয় পৃথিবীর অন্যত্রও তাকে পরিচিতি দিয়েছেন। অসংখ্য বাংলা সিনেমায় সৌমিত্র নায়ক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। বাংলা সিনেমার দর্শক একটা সময় পর্যন্ত দ্বিধাবিভক্ত ছিল, উত্তম না সৌমিত্র?
তবে, সৌমিত্রকে ছেড়ে সত্যজিৎ উত্তমকুমারকে নিয়ে ‘নায়ক’ তৈরি করলেন কেন?
সিনেমার কাহিনিটি একবার মনে করে নিই:
‘নায়ক’ ছবির প্রধান চরিত্র বাংলা চলচ্চিত্রের ম্যাটিনি আইডল অরিন্দম মুখোপাধ্যায়। বিমানের টিকেট না পেয়ে রেলপথে কলকাতা থেকে দিল্লি যাচ্ছেন একটি জাতীয় পুরস্কার গ্রহণের জন্য। সেদিনের সংবাদপত্রেই তার চারিত্রিক কুৎসা প্রকাশিত হয়েছে।
এই চব্বিশ ঘন্টার যাত্রাপথে ‘আধুনিকা’ পত্রিকার সম্পাদক অদিতি সেনগুপ্ত নায়কের একটি সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। যদিও অদিতি এইসব ম্যাটিনি আইডলদের খুব একটা পছন্দ করেন না এবং সেদিনের প্রকাশিত সংবাদ পড়ে অরিন্দমকে অপছন্দই করছিলেন।
কিন্তু অরিন্দমের কথা শুনে বুঝতে পারেন তার খ্যাতির আড়ালে মনের গভীরে রয়েছে ভীষণ একাকীত্ব। এই বাইরের নায়ক আর ভেতরের মানুষ একরকম নয়। অরিন্দমের প্রতি অদিতির সহানুভূতি জাগে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, নায়কের কথা জনমানসে প্রকাশ করবেন না, ম্যাটিনি আইডল যাতে জনমানসে তার ভাবমূর্তি বজায় রাখতে পারেন, সেই বিষয়ে তিনি সাহায্য করবেন।
সাতটি ফ্ল্যাশব্যাক এবং দু’টি স্বপ্নদৃশ্যের মধ্য দিয়ে নায়কের জীবন ও তার মনস্তাত্ত্বিক অবস্থানের বিবর্তমান প্রবাহ প্রকাশিত। মনে হয়, এই রেলযাত্রার মতোই নায়কের জীবন যাত্রা, কখনো দুরন্ত, কখনো ধীর লয়ে।
১২০ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই চলচ্চিত্রটি ভারতে মুক্তি পায় ৬ই মে ১৯৬৬ তে। ৬৬তেই বার্লিন আন্তর্জতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘বিশেষ জুরি পুরস্কার’ পায় এবং এই উৎসবেই ‘শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র’ বিভাগে মনোনয়ন পায়। ১৯৬৭তে শ্রেষ্ঠ বাংলা কাহিনিচিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে।
উত্তমকুমার এই সিনেমায় অভিনয়ের জন্য ১৯৬৬ তে বি. এফ. জে. এ (বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোশিয়েশন অ্যাওয়ার্ড) পুরস্কার পান ‘শ্রেষ্ঠ অভিনেতা’ হিসেবে।
অবশ্য ১৯৬৮ তে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান সত্যজিতের ‘চিড়িয়াখানা’ এবং ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য। প্রসঙ্গত, উত্তমকুমার-ই প্রথম অভিনেতা যাকে পুরস্কার প্রদানের মধ্য দিয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের ‘শ্রেষ্ঠ অভিনেতা’ বিভাগটি শুরু হয়। তার সঙ্গে ‘শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী’ হিসেবে এই পুরস্কার পান নার্গিস, ‘রাত অওর দিন’এ অভিনয়ের জন্য।
মহানায়কের অন্যতম জীবনসঙ্গী চিত্রনায়িকা সুপ্রিয়া দেবী পরে বিভিন্ন জায়গায় জানিয়েছিলেন, “সৌমিত্র তো নায়কটাও করতে চেয়েছিল। তখন মানিকদা (সত্যজিৎ) ওকে বুঝিয়ে বলেছিলেন কেন উত্তম। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি।উত্তমকে দেখেই‘নায়ক’মনে হয়। উত্তমকে দেখেই প্রেমিক মনে হয়। সৌমিত্র ভালো অভিনেতা নিশ্চই। কিন্তু নিত্য নতুন প্রেমে পড়ানোর ওই যে লুক, ছোটো ছোটো দিক, সেটা আমি সৌমিত্র-র মধ্যে কখনো দেখিনি।”
সত্যজিৎ-পুত্র চলচ্চিত্র নির্মাতা সন্দীপ রায় আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, “বাবা তো উত্তমকুমারকে মাথায় রেখেই ‘নায়ক’ লেখেন। অরিজিনাল স্ক্রিপ্ট। কোনও গল্প থেকে নেওয়া নয়। ওকে বাদ দিয়ে কোনও বিকল্পও ভাবেননি … ভাবা যাবে না বলেই ভাবেননি নিশ্চয়ই।”
আসলেই। রুপালি পর্দায় ২১২টিরও বেশি ছবিজুড়ে ‘নায়ক’ উত্তমকুমারের যে গ্ল্যামারাস উপস্থিতি, তাকে এখনও কোনো বাঙালি অভিনেতা অতিক্রম করতে পারেননি।
দার্জিলিঙে বসে সত্যজিৎ রায়ের নিজের মুখে ‘নায়ক’-এর স্ক্রিপ্ট শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল আরেক চলচ্চিত্র নির্মাতা তপন সিংহ-র। সস্ত্রীক ঝাড়া চার ঘন্টা সেই চিত্রনাট্য তিনি শুনেছিলেন। চিত্রনাট্য শোনানোর পর সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন “এ ছবিতে উত্তমকে নেব ভাবছি … ঠিক হবে না?” উত্তরে তপনবাবু বলেছিলেন, “উত্তম ছাড়া এ চরিত্র হয় না।”
শুধু মাত্র বাহ্যিক স্টার-ইমেজ নয়, ‘নায়ক’ সিনেমাটি দেখলেই বুঝতে পারা যায় চূড়ান্ত সফল একজন নায়ক, তার উজ্জ্বলতার গভীরে লুকিয়ে রেখেছিলেন ভাঙাচোরা, বিপর্যস্ত নিঃসঙ্গ এক মন। সেই অন্যদিকটির সন্ধান পেয়েছিলেন অদিতি।
সন্দীপ রায় ঐ সাক্ষাৎকারেই জানাচ্ছেন, “ছুটি পড়লেই বাবা পুরী কিংবা দার্জিলিং বেড়াতে নিয়ে যেতেন আমাদের। সেবার এক আমন্ত্রণেই আমি মা বাবা গেছি দার্জিলিং। উঠেছি ‘মাউন্ট এভারেস্ট’ হোটেলে। গিয়ে শুনি উত্তমবাবুও এসেছেন ঐ হোটেলেই। তখন ‘ছোটি সি মুলাকাত’ এর সমস্যায় উত্তমবাবু জর্জরিত। (প্রসঙ্গত, ‘ছোটিসি মুলাকাত’ নামের হিন্দি চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা করেছিলেন উত্তমকুমার। তার সারাজীবনের সঞ্চিত অর্থ লগ্নি করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ চলচ্চিত্রটি ফ্লপ করে।)
এক ভদ্রলোক এসে বাবাকে বললেন, উত্তমবাবু দেখা করতে চাইছেন। বাবা বললেন, ‘অবশ্যই, আসতে বলুন।’ সেই সময় দেখেছিলাম … উনি এলেন। একেবারে ভেঙে পড়া চেহারা, বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত … যেন ‘নায়ক’এর বেদনাক্লীষ্ট অরিন্দম মুখোপাধ্যায়।”
মনে করি ‘নায়ক’ এর একটি স্বপ্নদৃশ্য, বিশাল এক টাকার স্তূপের মধ্যে ডুবে যাচ্ছেন তিনি। তারপর ঝটকা দিয়ে যখন ঘুম ভাঙলো, ট্রেনের কামরায়, আর নায়কের হাত গিয়ে পড়ল জানলার কাচে … সেখানে তার যে অভিব্যক্তি … কষ্ট … বেদনা … সব থেকেও একটি ইনসিকিওরিটি … সমস্তই অনায়াস স্পষ্ট হয়ে ওঠে নায়কের অভিব্যক্তিতে।
আর তার ভুবনভোলানো হাসি?
সন্দীপ বাবু ঐ সাক্ষাৎকারেই জানাচ্ছেন, “ ‘নায়ক’ চলচ্চিত্রের টাকার পাহাড়ের দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল ‘এনটিওয়ান’এ। ঢেউ খেলানো নকল টাকার টিলা… কিন্তু এমন অপূর্ব, লোভনীয় দেখতে লাগছিল… সেট তৈরির পর বাবা একজনকে বললেন, ‘উত্তমকে ডাকো তো, দেখি সে কী বলে’ আমি তখন বাবার পাশেই। দেখলাম সেটে ঢুকেই সেই ভুবনভোলানো হাসি। ঝকঝকে দৃষ্টি। বাবাকে বললেন, ‘মন ভরিয়ে দিলেন মানিকদা … কত টাকা!’ দু’জনেই খুব জোরে হেসে উঠেছিলেন।
‘নায়ক’ এর একদম প্রায় শেষদৃশ্যের কথা মনে আছে নিশ্চই? অদিতি ওরফে শর্মিলা ঠাকুর, তার নেওয়া সাক্ষাতকারের পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলছেন, আর উত্তমকুমার খুব রোমান্টিকভাবে জানতে চাইছেন, “মন থেকে লিখেবেন নাকি?” উত্তরে শর্মিলা বললেন, “মনে রেখে দেব।”
প্রকৃত নায়ক, তারকা তো সেই, যাকে ছোঁওয়া যায় না। পাশে বসে থাকলেও যে থাকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে, পাশে থেকেও কাছে নেই। অথচ যার সঙ্গে শেয়ার করা মুহূর্তগুলো সযত্নে মনের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে চায় সকলেই। সেই-ই তো ‘নায়ক’।…
মহানায়ক উত্তমকুমারের নায়কোচিত এই অভিনয়, কে পারতেন আর? উত্তমকুমার ছাড়া? এটা নায়কের স্রষ্টা সত্যজিৎ রায় ভালোভাবেই জানতেন।
(তথ্যসূত্র:
১- সত্যজিৎ রায় ভিন্ন চোখে, শীতলচন্দ্র ঘোষ ও অরুণকুমার রায় সম্পাদিত।
২- অনন্য সত্যজিৎ, প্রবোধকুমার মৈত্র সম্পাদিত।
৩- দৈনিক স্টেটসম্যান, ২রা মে ২০১৯ সাল।
৪- Satyajit Ray on Cinema by Satyajit Ray, edited by Sandip Ray.)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত