তাঁর পিতার পরিচয় আজও কেউ জানেন না। তাঁর জন্মের সন-তারিখেরই ঠিক নেই। কে বাবা, কেউ জানেন না। কোথায় জন্ম – সেটা সম্ভবতঃ ঈশ্বরই একমাত্র জানেন। কোনও তথ্যই যেখানে নেই সেখানে মতামত নিয়েই চলতে হয়। যেমন এক মতে স্থির হয়েছে কানন দেবীর হয়েছিল জন্ম ২২শে এপ্রিল, ১৯১৬ সালে। আরেক মতে ২২শে এপ্রিল, ১৯১২ সাল। এই ভাবেই তাঁর জন্মস্থানও স্থির হয়েছে কলকাতার কাছেই – হাওড়া। আর তাঁর কষ্টের বেড়ে ওঠা? তা তো ভাষায় আনা যায় না। তিনি নিজেও সেটা পারেননি সন্ধ্যা সেনকে শোনানো তাঁর আত্মজীবনী ‘সবারে আমি নমি’-তে। নানা লেখায় ছড়িয়ে থাকা তাঁর মেয়েবেলার কথা পড়তে পড়তে যে কারোরই মনে হতে পারে যে তিনি গজেন্দ্রকুমার মিত্রের ‘কলকাতার কাছেই’ উপন্যাসের পাতা উল্টাচ্ছেন। আবার অনেকেরই তাঁর জীবন কথা পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে চ্যাপলিনের ‘মাই অটোবায়োগ্রাফি’-র পাতা উল্টে যাচ্ছেন। মা নেই, বাবা নেই, খাওয়া-পরা নেই, ঝি-গিরি করে, দোরে দোরে মাথা ঠুকে, কানন থেকে কাননবালা তার পর কাননদেবী হওয়া বাংলা সিনেমার সব চেয়ে আশ্চর্য সাফল্য গাথা। যা সিনেমা করে দেখালেও বাংলা বায়োস্কোপের বাড়াবাড়ি মনে হবে। তিনি ‘কানন দেবী’, ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের ‘কাননবালা’ – চলচ্চিত্র জগতের প্রথম মহিলা গায়িকা সুপারস্টার।
অনেকেই কাননদেবীকে সুচিত্রা সেনের আগের জমানার ‘সুচিত্রা সেন’ বলেন – তাঁরা সম্ভবতঃ খুব একটা ভুল বলেন না। সেই অপরূপ মুখশ্রী! মুহূর্তের পর মুহূর্তের পর মুহূর্ত আলো নেওয়া আর ক্যামেরার লেন্সে উদ্ভাসিত হয়ে থাকার ক্ষমতা! পরের পর ছবি হিট করানো, রুপোলি পর্দা ও পর্দার বাইরেও সমানভাবে নায়িকা থাকা, ইন্ডাস্ট্রির মাথাদের কব্জায় আনা, নিজেকে প্রায় একটা ব্র্যান্ডে গড়ে নেওয়া! এবং সর্বোপরি, কয়েক প্রজন্মের পুরুষের স্বপনচারিণী হয়ে ভেসে থাকা— সুচিত্রার কেরিয়ারের নীল নকশাই যেন তৈরি করে গেছিলেন কানন দেবী। তাই চাইলে সুচিত্রাকেও পরের যুগের কানন বললে সিনেমার মানহানি হয় না।
তবে দুই নায়িকার দুটো মস্ত ফারাকও আছে। সুচিত্রা, তখন রমা, তাঁর পাবনার জীবনে গান গাইলেও এবং নায়িকা জীবনে এক সময় একটা বেসিক বাংলা আধুনিকের ডিস্ক করলেও নিজের প্লে-ব্যাক কখনও করেননি। সে-কাজ করেছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, গীতা দত্ত। কানন দেবী কিন্তু একাই এক নিখুঁত, অতুলনীয় প্যাকেজ। আর গান বলে গান! কার নয়? আর হায়, কী গান! কী বাংলায়, কী হিন্দিতে। রবীন্দ্রনাথ সিনেমায় তাঁর গানের চিত্ররূপ অনুমোদন করলে সেই প্রথম গানটি ছিল কাননের – ‘আজ সবার রঙে রং মেশাতে হবে’।
জানা যায়, গান নিয়ে করা প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘মুক্তি’ ছবি দুরন্ত হিট হওয়ার পর হিন্দুস্তান রেকর্ডজে রবীন্দ্রনাথকে প্রথম দেখেছিলেন কানন। প্রশান্তচন্দ্র মহালানবিশ কবিগুরুর সাথে তাঁর আলাপ করাতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘এ হল কানন, তারকা অভিনেত্রী।’’ কানন প্রণাম করতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ঠোঁট ছুয়ে বলেছিলেন, ‘‘কী সুন্দর মুখ তোমার! গান করো?’’ এই ঘটনা ঘটেছিল ‘বিদ্যাপতি’ ছবির সময়ে। কবির মনে ছিল না এই মেয়েটিই ‘মুক্তি’-তে তাঁর লেখা গান গেয়েছে। প্রশান্তচন্দ্র তখন যোগ করেছিলেন, ‘‘ও তো আপনার গান গেয়েই বিখ্যাত।’’ রবীন্দ্রনাথ তখন বলেছিলেন, ‘‘তাই? তা হলে একবার শান্তিনিকেতনে এসে গান শুনিয়ো আমাকে।’’ সেই সৌভাগ্য কানন দেবীর আর হয়নি।
গল্পগাছা, শোনা কথা ছাড়া কানন দেবীর মেয়েবেলায় ঢোকার আর কোন উপায় নেই। কারণ বিভিন্ন বৃত্তান্ত ছাড়া কোন প্রামাণ্য তথ্য কারও হাতে নেই। এই সব ছড়ানো বৃত্তান্ত এক জায়গায় এনে সম্ভাব্যের একটা তালিকা দিয়েছেন শ্রীমতী মেখলা সেনগুপ্ত তাঁর ‘কানন দেবী: দ্য ফার্স্ট সুপারস্টার অফ ইন্ডিয়ান সিনেমা’ বইয়ে। যা এই রকম দাঁড়ায় –
এক বৃত্তান্তে জানা যাচ্ছে, বালিকা কাননকে প্রথম পাওয়া যায় হাওড়ার এক গরিব পাড়ায়। হাওড়ার এক কনভেন্ট স্কুলে ওর নাম লেখানো হয়েছিল, কিন্তু মাইনে জোগানো যায়নি বলে বার করে আনতে হয়।
আরেকটিতে আছে যে ওকে শিশু অবস্থায় আনা হয় ভাগলপুরে গঙ্গা তীরবর্তী রাজবাটী আদমপুরের পোস্তা বাগানবাড়িতে। সেটা ছিল স্ববর্ণিত ‘রাজা’ শীলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বসতবাড়ি। ভদ্রলোক পেশায় উকিল। শিশু কাননকে ওঁর কাছে আনা হয় কলকাতার হাড়কাটা গলি থেকে। এবং পাঁচ-ছ’বছর বয়েসে কলকাতায় ফিরিয়ে দেওয়া হয় বায়োস্কোপে নেমে কিংবা গান গেয়ে রুজি দেখতে।
অন্য শ্রুতি আছে যে তাঁর বাবা ছিলেন দর্জি। মা ছিলেন বাঈজি। কোথাও বলা হচ্ছে ওকে কলকাতায় আনা হয় তাঁর গানের গলা দেখে, কিন্তু পেট চালাতে হচ্ছিল বাড়ি-বাড়ি পরিচারিকার কাজ করে। সেই আয়ে গান, নাচও চালিয়েছেন।
এই সব সম্ভাবনার যে-কোনটি সত্যি হতে পারে।
সব ধরনের শ্রুতির মধ্যে একটি শ্রুতি, যেটা কোনও ভাবেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তা হল, কাননকে প্রতিপালন করেছিলেন রাজবালা দেবী ও রতনচন্দ্র দাস। কানন দেবী তাঁর আত্মকথায় তাঁদেরই মা ও বাবা বলে উল্লেখ করছেন। অমিয়া নামে এক দিদির কথাও বলছেন। কিন্তু বলেন নি বাড়িটা কোথায় ছিল বা কোন ধরনের মানুষের আনাগোনা ছিল সেখানে। রাজবালা নাকি নানা ঠিকানায় কাজের লোক ছিলেন, কাননকে তাঁর জিম্মায় রাখা হয়েছিল বড় করে তোলার জন্য। এই করতে করতে তিনি তাঁর মা হয়ে যান। কিন্তু তিনি কানন দেবীর জন্মদাত্রী মা ছিলেন না। কানন দেবী মেনে নিয়েছিলেন যে তাঁর মা ও বাবার হয়তো বিয়েই হয়নি কখনও। তাঁরা সহবাস করেছেন শুধু। তিনি নিজেই বলেছিলেন, ‘‘কে বাবা, কে মা, এই ভেবে বুকের ব্যথা বাড়িয়ে কাজ কী? আমি কানন, এই পরিচয়টুকুই তো যথেষ্ট।’’
জানা যায়, রতনচন্দ্রের টাকা ডুবেছিল রেসে। সঙ্গে তাসের জুয়ো খেলতেন ও মদ্যপানও করতেন। মার্চেন্ট অফিসে চাকরি ও একটা সোনার দোকান ছিল তাঁর। নিজের ফিটন হাঁকিয়ে বেড়াতেন। এই করে অকালে গতও হন এবং রাজবালাকে হঠাৎ করে নেমে আসতে হয় পরিচারিকার জীবনে, কারণ রতনচন্দ্রের আত্মীয়রাই হাতিয়ে নিয়েছিল তাঁর যাবতীয় সম্পত্তি। তবে ওই সীমিত ক’বছরের প্রতিপালনে কাননের মধ্যে দু’দুটো টান তিনি সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন। একটা বইয়ের প্রতি আর একটা গানের দিকে। কানন যখন পড়তে শেখেনি, রতনচন্দ্র বই কিনে এনে তাঁকে পড়ে শোনাতেন। আর তাঁকে গান শোনানোর জোগাড়যন্ত্র করতেন। সেই সব গল্প ও গান শুনে শুনে বালিকার অভ্যেস তৈরি হয়েছিল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নেচে গেয়ে নায়িকা সাজার। রতনচন্দ্রের সম্পত্তির কানাকড়িও পাননি রাজবালা, কারণ তিনি তো ছিলেন রক্ষিতা মাত্র! কিন্তু গায়ের গয়না, ঘরের আসবাব বেচে ও টুকিটাকি জমানো টাকা দিয়ে মিটাতে হয়েছিল ‘বাবু’র অঢেল ধার।
এরপরে কাননকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে লাগানো হয়েছিল ধনীগৃহে রান্না, ঘর ঝাড়া, ঘর নিকানো, কাপড় কাচার কাজে। পড়াশুনো দূরস্থান, একটু আধটু খেলার সময়ও হত না, খাওয়া জুটত এক বেলা, তাও চাট্টিখানি ভাতের সঙ্গে ডাঁটার সবজি, কচুঘেচু ইত্যাদি! বহু পরে তিনি তাঁর পুত্রবধূ রুবিকে বলেছিলেন যে পেটে খিদে সারাক্ষণ চড়ে থাকত। খাটাখাটুনিতে রাজবালার শরীরস্বাস্থ্য চেহারা দিনকে দিন ক্ষয়ে শুকনো হয়েছিল, কিন্তু না খেয়ে, শুকিয়ে শিটিয়েও কাননের পরির মতো রূপে আঁচড়টি পড়ে নি। কানন নিজেই তাঁর স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন যে, দুঃসহ পরিস্থিতির সামাল দিতে তাঁদের এক সময়ে উঠে যেতে হল চন্দননগরে এক অবস্থাপন্ন আত্মীয়ের বাড়ি। আত্মীয়ই বটে, যে দিন তাঁরা গিয়ে উঠলেন সে দিনই আত্মীয়রা বাড়ির কাজের লোকেদের বিদেয় করে দিলেন! কারণ নতুন কাজের লোক তো এসেই গেছে না? কাননদেবী তাঁর এই আত্মীয়দের নাম জানাননি, যদিও তিনি সেখানে মা-মেয়ের উদয়াস্ত ঝিগিরির নিটোল বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর পুত্রবধূর অবশ্য দৃঢ় ধারণা হয়েছিল ওই আত্মীয় ছিলেন কাননেরই দিদি অমিয়া। সেই বাড়িতে মা-মেয়ের কাজের বহর আর গালমন্দ শোনার রুটিন বাঁধিয়ে রাখার মতন। তারপর এক দিন রাজাবালার হাত থেকে একটা রেকাব ছিটকে পড়ে ভাঙামাত্র গালাগালির ঝড় উঠেছিল। কানন তখন রাজবালার হাত ধরে বলেছিলেন, ‘‘না, মা, আর একটা দিনও এখানে নয়। এক্ষুনি চলো। না খেয়ে মরলে মরব।’’ সেখান থেকে বেরিয়ে হাওড়ার যে-ঘোলাডাঙ্গা পল্লিতে আস্তানা হয়েছিল কানন ও রাজবালার সেটা তখন ছিল ছোট ব্যবসায়ীদের আড়ত। সেখানে সংসার করা লোকজনের বাড়ির সামনে বোর্ড ঝুলত – ‘এটা গৃহস্থের ভিটা’। কে জানে, পাশের বাড়িটাই হয়তো বারবনিতাদের। ঘোলাডাঙ্গা নিয়ে কানন দেবী নিজেই বলেছেন, ‘‘চারপাশের পরিবেশে শ্বাস নিতে অসুবিধে হত।’’ কিন্তু এখানেও বড় করে নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা হয়েছিল কাননের। সেখানে থাকতেন এক রোগাসোগা মধ্যবয়সি বিপত্নীক ভোলাদা। সন্ধেকালে তিনি হারমোনিয়াম নিয়ে বসে ভক্তিগীতি ধরলে একটা নতুন জগৎ খুলে যেত কাননের কাছে। কাননকে তিনি একে একে শিখিয়েছিলেন কীর্তন, বাউল, ভাটিয়ালি, কর্তাভজা, মীরা ও সুরদাসের ভজন, সংস্কৃত মন্ত্র, ব্রহ্মসঙ্গীত এবং অতুলপ্রসাদের গান। এক সময় লালনের গান এল। কানন সেই গানের মানে জানতে চাইতেন, ভোলাদা মানে বোঝাতেন। এক দিন হঠাৎ আর জিজ্ঞাসার সুযোগ রইল না। ভোলাদা নিজেই কোথায় যে হারিয়ে গেলেন ইঙ্গিতটুকুও না দিয়ে।
তখন কাননের আশ্রয় হয়েছিলেন সেকালের এক অতি আশ্চর্যময় কণ্ঠের গায়িকা আশ্চর্যময়ী দাসী। কাননদের বাড়ির পাশেই থাকতেন, মেয়েটির অপরূপ রূপ আর অপূর্ব কণ্ঠ তাঁকে টানল। নতুন নতুন রেকর্ড করা আশ্চর্যময়ী কাননকে গানের জগতে টানার জন্য তালিম দিতে লাগলেন। মন ভাল করার জন্য তখন তাঁর ওখানে না গেলেই হত না কাননের। এই বৃত্তান্তও কিন্তু জনশ্রুতি। কারণ কানন দেবীর স্মৃতিচারণায় এই মহিলাকে উল্লেখ করা হয়েছে কেবলই ‘বৌদি’ বলে। এই বৌদিই কি আশ্চর্যময়ী দেবী? যা বয়ান জোগাড় হয়েছে এত দিনে, তারা সবাই এ প্রশ্নে নিরুত্তর।
কানন দেবী শুধু বায়োস্কোপের যুগের স্বপ্নসুন্দরী বললে কিছুই বলা হয় না। তাঁর জীবন শুরু নির্বাক ছবির আগের যুগে। যে-বছর জীবনের প্রথম ‘রোল’ পেলেন কানন, ‘জয়দেব’ বায়োস্কোপে, সেই ১৯২৬ সালটার একটা তাৎপর্য আছে। সেই বছরই ওয়ার্নার ব্রাদার্স পৃথিবীর প্রথম টকি বা সবাক ছবি আনল বাজারে। ‘ডন জুয়ান’। সবাক, তবে কোনও সংলাপ নেই, কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীতে মোড়া। ‘জয়দেব’-এর পর আরেকটা ছোট্ট রোল পেয়েছিলেন কানন দেবী ‘শঙ্করাচার্য’ (১৯২৭) ছবিতে, একেবারে গোড়ায় যার পরিচালনায় ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, সংক্ষেপে ‘ডিজি’। মধ্যিখানে ‘ডিজি’ কাজ ছেড়ে চলে গেলে তড়িঘড়ি ছবি শেষ করেছিলেন কালিকাপ্রসাদ ঘোষ। ছবিও তড়িঘড়ি পাততাড়ি গুটিয়েছিল হল থেকে। কাননের কপালেও পুরো পারিশ্রমিক জোটেনি বলে অনেকে অনুমান করেন। এর পর তো টানা বেশ কয়েক বছর তাঁর হাতে কাজ ছিল না। কাজে ফিরতে ফিরতে পেরিয়ে গিয়েছিল অনেকগুলো বছর।
জীবনের শেষ দিন অবধি যে-ভূমিকা না করার হতাশা ছেড়ে যায়নি কানন দেবীকে তা হল প্রথমেশ বড়ুয়ার ‘দেবদাস’-এ পার্বতীর। এটা সেই সময়ের ঘটনা, যখন রাধা ফিল্ম কোম্পানিতে কাননবালা চুক্তিবদ্ধ ছিলেন। নিউ থিয়েটার্স-এর জন্য ছবিটা করেছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়া। তাঁর ছবিতে ডাক পাওয়া ছিল কানন দেবীর নানা স্বপ্নের একটা। সেই প্রমথেশবাবুই এক দিন দেখা হতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আমি চাই তোমাকে দিয়ে পার্বতী করাতে, যদি পারো।’’ কানন বলেছিলেন, ‘‘ধন্যবাদ বড়ুয়া সাহেব। এ তো আমি চাই-ই! তা বলে কোম্পানির সঙ্গে এক বার কথা বলে দেখি।’’ রাধা ফিল্মস সে-ঝুঁকি নেয়নি, ফলে কাননেরও পার্বতী হওয়া হয়নি। ‘দেবদাস’ একাধারে ক্লাসিক এবং হিট হওয়ার পর কানন সাধুবাদ জানান প্রমথেশকে। তাতে বাঙালি জীবনে প্রায় মূর্ত দেবদাস (তদ্দিনে টিবি ধরা পড়েছে, কিন্তু মদ্যপান থামেনি) প্রমথেশ বলেছিলেন, ‘‘আমার অন্য পরিকল্পনাও আছে তোমাকে নিয়ে। দেখো, তখন পিছিয়ে যেয়ো না।’’ প্রমথেশবাবুর সেই অন্য পরিকল্পনা ছিল ‘মুক্তি’। যেখানে ছবিতে প্রথন গান এল রবীন্দ্রনাথের। গাইলেন কানন। ছবি তো দেদার হিট। বলা শুরু হল এবং হতেই থাকল যে কাননের এই হল সেরা অভিনয়। সেই সঙ্গে একটা কাণ্ডও ঘটেছিল শহরের এক প্রেক্ষাগৃহে – ছবিতে কাননের পা হাঁটু অবধি দেখানোয় ক্ষিপ্ত জনতা হলের সিট ভাঙাভাঙি শুরু করেছিল। সালটা ছিল ১৯৩৬।
কানন দেবী তাঁর আত্মজীবনীতে একটি নাম কখনো উচ্চারণই করেননি, সেই নাম তাঁর প্রথম স্বামী অশোক মৈত্রের! এক অতীব অকিঞ্চিৎকর পরিস্থিতি থেকে এই বিয়ে হয়েছিল আভিজাত্যে ওঠার এক স্বর্গীয় সিঁড়ি। কারণ শ্বশুরবাড়ি মৈত্র পরিবার ছিল বাঙালি সমাজের ‘ক্রেম দ্য ল্য ক্রেম’। মান্যতার ফিরিস্তিটা বেশ বড়। অশোক ছিলেন অক্সফোর্ড ফেরত। দেশে ফিরে কবির বিশ্বভারতীতে পড়ানো শুরু করেছিলেন। তাঁর পাশাপাশি তখন সেখানে পড়াচ্ছিলেন বলরাজ সাহনি। অশোকের বোন রানীর বিয়ে হয়েছিল সংখ্যাতত্ত্ববিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের সঙ্গে। আর তাঁর পিতা? তিনি ব্রাহ্ম সমাজের দোর্দন্ডপ্রতাপ নেতা ও সিটি কলেজের অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্র মৈত্র। হেরম্বচন্দ্র সম্পর্কে চমৎকার সব গল্প প্রচলিত ছিল শিক্ষিত মহলে। তার একটা হল, তিনি শ্যামবাজারের রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছেন। এক ছোকরা তাঁকে সামনে পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘স্যার, স্টার থিয়েটারটা কোন দিকে?’’ থিয়েটার হলের খোঁজ চাওয়ায় রাগে গরগর হেরম্বচন্দ্র বলেছিলেন, ‘‘জানি না!’’ বলেই হাঁটা দিয়েছিলেন। খানিক গিয়েই দোটানায় পড়েছিলেন নীতিবাদী অধ্যাপক। সে কী, একটা নির্দেশ দেবেন না বলে মিথ্যে বললেন! সঙ্গে সঙ্গে পিছনে ফিরে ছোকরাকে গিয়ে ধরেছিলেন আর বলেছিলেন, ‘‘জানি, কিন্তু বলব না!’’ হেরম্বচন্দ্রের অন্য গল্পটাও অদ্ভুত। কলেজে অপূর্ব নিষ্ঠা ও আবেগে ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা পড়াতেন অধ্যাপক। হঠাৎ এক দিন কবির জীবনীতে হোঁচট খেলেন একটি তথ্যে, ওয়ার্ডসওয়ার্থ তাঁর সৎ বোন অগাস্টার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে ছিলেন! ব্যস, সে দিন থেকে তাঁর প্রিয় কবির কবিতা পড়ানো বন্ধ করে দিলেন। বলা বাহুল্য, জীবনের শেষ দিন অবধি কাননের সঙ্গে পুত্রের বিবাহ মেনে নেননি হেরম্বচন্দ্র। তাই তাঁর জীবিত কালে অশোক, কাননের সম্পর্ক থাকলেও বিয়ে হয়নি। অশোক ও কাননের প্রথম আলাপও যেন বায়োস্কোপ থেকে তোলা।
অশোক তখন শান্তিনিকেতনে পড়ান। আর ফুরসত হলেই কলকাতা চলে আসেন ফুর্তির খোঁজে। সাহেবি আমলের কলকাতা বলে কথা! অশোক রাইফেল হাতে পাকা শিকারি। এক সময় তাঁর মন গেল প্রণয়ের শিকারে। তাঁর কল্পনা ও আবেগ জুড়ে তখন একটাই মুখ, একটাই মানুষ – কাননবালা! এক বার কলকাতা সফরে অঢেল পান হল্লার পর নেশায় চুর অশোক বলেই দিলেন, ‘‘এখন এই সন্ধ্যায় চাওয়া-পাওয়ার কী-ই বা বাকি রইল, শুধু কাননকে পাশে পাওয়া ছাড়া।’’ সঙ্গীসাথীরা বন্ধুর এই বাসনাটুকুও বাকি রাখতে চায়নি। তাই তাঁকে প্রায় বেহুঁশ অবস্থায় বৌবাজার পল্লির কাপালিতলা লেনে কাননের বাড়ির দোরগোড়ায় ফেলে চম্পট দেন তাঁরা। সুদর্শন, সুবেশ, নিদ্রিত পুরুষটিকে নিজের বাড়ির বাইরে ভোরবেলা আবিষ্কার করেন কাননই। তাঁর মাথাটা তুলে নিয়েছিলেন নিজের কোলে। আধো ঘুম ও খোঁয়ারির মধ্যে চোখ মেলে নায়িকাকে দেখে অশোকের মনে হয়েছিল স্বপ্নেই আছেন। কানন জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘আপনি কে? কেমন করে এখানে আসা হল?’’ অশোক তখন নাকি চোখ মুদে বলেছিলেন, ‘‘চলে যান, স্বপ্ন ভাঙবেন না। আমি এখন কানন বালার সঙ্গে আছি।’’
বলা বাহুল্য, এর পর অশোক-কাননের প্রেম দানা বাঁধতে সময়ে নেয়নি। কিন্তু বিয়ে করা যাচ্ছে না, কারণ চিনের প্রাচীরের মতো সম্মুখে অশোকের পিতা হেরম্বচন্দ্র। তাঁরা রাজভবনে হাতার মধ্যে এজরা ম্যানসনে মিলিত হতে লাগলেন। এ ছাড়া সিনেমা দেখা ছিল। আর সময় হলেই গাড়ি হাঁকিয়ে লং ড্রাইভ। কত যে ট্রিপ হয়েছে এ ভাবে! শুধুই ফলতা বন্দর! যাওয়া হয়েছে কাশিমবাজার, মুর্শিদাবাদ। হাঁটা হয়েছে নিজামত ইমামবাড়া চত্বরে। কাননদেবী নিজেই লিখেছেন, ‘‘আমি সামাজিক স্বীকৃতিকেই আমার প্রেমের মুকুট করতে চেয়েছিলাম। সেটা পেলামও। কারণ ও-ও বিয়ে চেয়েছিল।’’
কাননকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন অশোকের মা কুসুমকুমারী দেবী। সুন্দর সম্পর্ক হয়েছিল রানী ও প্রশান্তচন্দ্রের সঙ্গে, তবু অপেক্ষা করতে হয়েছিল হেরম্বচন্দ্রের মৃত্যু অবধি। সে-বিয়ে হল ১৯৪০-এর ডিসেম্বরে। অশোকের বয়স যখন ছত্রিশ, কাননের পঁচিশ।
অনুরাগীদের আশঙ্কা ছিল ১৯৩৯-এ গায়িকা-নায়িকা উমাশশী যেমন বিয়ে করে গান ও অভিনয় ছেড়েছেন কাননও হয়তো তাই করবেন। আর কানন সেটা করলেন না বলেই কালো মেঘ জমল সম্পর্কের আকাশে। কানন দেবী স্বীকার করে গেছেন যে, যে-অশোককে তিনি দেবতার মতো পুজো করেছেন, তাঁর সংস্পর্শে এসে জীবনের রূপরসগন্ধের স্পর্শ পেয়েছেন, পাশ্চাত্য উচ্চাঙ্গে দীক্ষা পেয়েছেন, জেনেছেন ভালবাসা কারে কয়, সেই ঘরের মানুষটিই বিবাগী হয়ে গেল স্ত্রী যে-কাজটা ভালবাসে সেটাই করে বলে! তখনকার অভিনেত্রীদের বিবাহিত জীবনে অবিরত যেটা হত, তাই হল কাননের জীবনে। পাঁচ বছরের মধ্যে বিয়ে ভাঙল। অশোকের বরাবর ধারণা ছিল, কানন যে শেষ অবধি ডিভোর্স ফাইল করেছিলেন, সেটা রানী ও প্রশান্তচন্দ্রের পরামর্শে। অশোক মামলা কন্টেন্ট করেননি। প্রশ্ন হল, এত শ্রদ্ধা ও ভালবাসা যে অশোক মৈত্রর প্রতি, তাঁর নামই কেন করলেন না কানন দেবী তাঁর জীবনীতে? বলা মুশকিল এবং উত্তর কোথাও নেই।
আমরা কানন দেবীর যে অতি রূপবান, ভারী ভদ্র, উচ্চমনা ও রসময় স্বামীর সাথে পরিচিত, তিনি হরিদাস ভট্টাচার্য। ১৯৪৯ সালে কানন দেবীর বর হওয়ার আগে থেকেই কিন্তু হরিদাস ভট্টাচার্য কেউকেটা ছিলেন। যখন বিয়ে হচ্ছে, তখন তিনি ক্যাপ্টেন হরিদাস ভট্টাচার্য। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজ্যপাল ড. কৈলাসনাথ কাটজুর এডিসি। কলকাতার মোস্ট এলিজিবল ব্যাচেলারদের একজন। মেয়েরা তাঁকে বর আর তাঁদের মায়েরা তাঁকে জামাই করতে চাইতেন। কিন্তু হঠাৎ একদিন সেই যুবকের চোখ পড়ে যায় কাননবালার ওপর। হরিদাস তাঁর স্মৃতিচারণায় নিজেই লিখেছিলেন, ‘‘এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম ড. কাটজুর সঙ্গে। সেখানেই দেখা কানন বালার সঙ্গে। প্রায় বাধ্য হয়েই সেখানে এসেছিল ও। সারাক্ষণ মঞ্চে থেকেও একটি কথাও বলেনি।’’
এর পর দ্বিতীয় দেখা যেদিন রাজভবনে গান গাইতে এসেছিলেন কানন। সেই আমন্ত্রণও হরিদাসই জানিয়েছিলেন। এর পরে তাঁদের ফের সাক্ষাৎ হয় যখন নায়িকার ছবির শ্যুটিঙের পারমিশন জোগাড় করে দিলেন রাজ্যপালের এডিসি। কারণ লোকেশন ছিল সরকারি ঘেরাটোপের ফলতা। কাননের প্রেমের সঙ্গে আবার জুড়ে গেল ফলতা।
কানন দেবী বলেছেন যে, একজন জীবনসঙ্গীর কাছে যা কিছু তাঁর চাওয়ার ছিল, সবই পেয়েছিলেন হরিদাসের কাছে। সব চেয়ে বড় পাওয়া হরিদাসের মনের জোর। কাননের অতীত নিয়ে কোনওই প্রশ্ন বা কৌতূহল ছিল না তাঁর। বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে যা চর্চা লেগে গিয়েছিল এবং কাগজপত্রে যা লেখালেখি শুরু হয়েছিল তাতে বিয়ে টেকানো তো তিন দিনের প্র্যাকটিসে ট্র্যাপিজের খেলায় নামার সামিল হয়ে গিয়েছিল। কাননের বুকটা দমে যেত হরিদাসের কথা ভেবে। কিন্তু হরিদাসকে টলায় কে! তোয়াক্কাই করলেন না এই সব কেচ্ছার কেত্তনের। বর-বৌয়ের সব ব্যাপারেই যে মতের মিল ছিল একই রকমের। হরগৌরী যোগ, তাও নয়। কিন্তু ওঁদের সুন্দর ভাবে বেঁধে রেখেছিল তিনটে জিনিস – ভেতরের টান, বাগানের নেশা আর সিনেমার প্রেম।
কানন ও হরিদাসকে নিয়েই একটা স্বতন্ত্র বৃত্তান্ত হয়, এবং সেজন্য কানাঘুষোর ওপর নির্ভর করতে হয় না। তাঁদের দ্বৈত পরিচালনার শ্রীমতী পিকচার্সের ছবি তো বাংলা সিনেমার ইতিহাসে জায়গা নিয়েছে। প্রযোজিকা হিসেবে কানন দেবী এবং পরিচালক হিসেবে হরিদাস ভট্টাচার্য এক দুরন্ত হিট জুটি। শ্রীমতী পিকচার্সের প্রথম হিট ‘মেজদিদি’-তে হরিদাস ছিলেন সহ পরিচালক। তিনি স্বাধীন ভাবে পরিচালনায় এলেন ‘নববিধান’ ও ‘দেবত্র’-য়। ‘দেবত্র’-য় একবারই মাত্র কানন দেবী, উত্তম ও সুচিত্রা ত্রয়ী এক সঙ্গে পর্দায় এসেছিলেন। তবে হরিদাস ভট্টাচার্যকে চলচ্চিত্র প্রেমীরা ভুলতে পারেননি, ভুলবেন না, ‘আঁধারে আলো’, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘ইন্দ্রনাথ, শ্রীকান্ত ও অন্নদাদি’, ‘অভয়া ও শ্রীকান্ত’ এবং থ্রিলার ছবি ‘শেষ অঙ্ক’-র জন্য।
আর কানন দেবীকে তো বাঙালি প্রেমে পড়ে, নিন্দে করে, ভালবেসে, গাল পেড়ে, তার পর বুকে ধরে কাটিয়ে দিয়েছে যুগের পর যুগের পর যুগ। ‘আমি বনফুল’ গেয়ে বাঙালিকে এক কালে মাতিয়েছিলেন যে-নায়িকা তাঁকে আর প্রশ্ন করার ছিল না ‘তুমি কোন কাননের ফুল, কোন গগনের তারা’?
শেষ দিন অবধি অবশ্য হরিদাস ও কানন একসঙ্গে থাকতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল। যদিও তার মাত্র ক’বছর আগে কানন দেবী আত্মকথায় লিখেছিলেন, ‘‘যখন হরিদাস ভট্টাচার্যকে বিয়ে করি তখন লোকের ধারণা ছিল এ বিয়ে পনেরো দিন টিকলে হয়। সেই বিয়েই তো চব্বিশ বছর টিকে গেল।’’
১৯৭৭-এর জানুয়ারিতে হরিদাস ও কানন জোড়ে গিয়েছিলেন দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে। কানন দেবী সে দিন দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার নিলেন। আর ১৯৮৯ সালের এক দিন তাঁর টাকাপয়সা, কাগজপত্র, শখের পিস্তল ও রিভলভার গুছিয়ে হরিদাস তাঁর ১নং রিজেন্ট গ্রোভের বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। এর কয়েক বছর পরে কানন দেবীও ১৭ই জুলাই, ১৯৯২ সালে বেল ভিউ ক্লিনিকের এক নির্জন কেবিনে প্রায় চুপি চুপি সংসার ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।
(তথ্যসূত্র:
১- সবারে আমি নমি, কানন দেবী, এম. সি. সরকার অ্যাণ্ড সন্স প্রাইভেট লিঃ।
২- Kanan Devi: The First Superstar of Indian Cinema, Mekhala Sengupta, Harpercollins (২০১৫)।
৩- Reigning Queen Of Early Gold – Article published in ‘The Outlook’ on 21st December 2015 by Bhaichand Patel.)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত