সংবাদ মাধ্যমে সবসময় দেখি সরকার, সংগঠন, ব্যাক্তি, সংস্থাগুলির কী করা উচিৎ আর কী উচিৎ নয় সে সম্পর্কে লাগাতার উপদেশ দেওয়া হচ্ছে। আমার প্রশ্ন যারা এধরণের বাণী বিতরণ করে চলেছেন তারা নিজেরা তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে কতটা সচেতন? লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে শহর, শহরতলীর রাস্তায় ঘুরছি আমি। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই কথাগুলো লিখলাম। কিছুদিন আগে দক্ষিণ কলকাতায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেশন ব্যবস্থা কেমন চলছে তা নিজে ঘুরে দেখছিলেন। সে সময় আমার কয়েকজন চিত্রসাংবাদিক বন্ধু তাকে বললেন, দিদি, আমাদের একটা করে মাস্ক দেবেন? মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে তারা মাস্ক নিলেনও। এমন চাহিদার কথা ভেবে তিনি এখন রাস্তায় বেরোলেই সঙ্গে কিছু মাস্ক রাখেন। মাস্ক ফুরিয়ে গেলে শাড়ির আঁচল বা রুমাল দিয়ে কীভাবে মুখ ঢাকতে হবে তা দেখিয়ে দেন। করোনার কলকাতায় এ দৃশ্য এখন খুব চেনা। কিন্তু কথা হল সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলি এব্যাপারে তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন? লোককে জ্ঞান দেওয়ার আগে তো তাদের নিজেদের দিকে একবার তাকানো দরকার।
কিছুদিন সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতার থেকে বলতে পারি, দেশে বিদেশে অতিমারি, মহামারি, মন্বন্তর, যুদ্ধ, দুর্ঘটনা, দাঙ্গা, হাঙ্গামা, অগ্নিকান্ডে চিত্রসাংবাদিকরাই একমাত্র সামনের সারিতে থেকে কাজ করেন। আমার খুব জানার ইচ্ছে, করোনা বিধ্বস্ত কলকাতায় সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের নিরাপত্তার কী ব্যবস্থা করেছেন? আমি বলতে পারি, বহু সংবাদপত্র তাদের চিত্রসাংবাদিকদের মাস্ক, স্যানিটাইজার কিছুই দেয়নি। এক্ষেত্রে একমাত্র উজ্জ্বল ব্যতিক্রম সংবাদ প্রতিদিন। এজন্য প্রতিদিন সম্পাদক সৃঞ্জয় বসুকে ধন্যবাদ জানাই। সরকার বাড়ির কর্তৃপক্ষ পুরনো নিয়ম মেনেই চলছেন। অতীতের মত এবারও চিত্রসাংবাদিকদের জন্য সুরক্ষার কোন ব্যবস্থা করেননি তারা। শোনা কথা, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় নিজের উদ্যোগে দুখানা পিপিই( সুরক্ষা পোষাক) তাদের স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টে দিয়েছেন। সেটা একজন সাংবাদিক ব্যবহার করলেও যে তরুণ চিত্রসাংবাদিক বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে ছবি তুলতে যান তিনি পোষাক পান না।
সেদিনও দেখলাম দিদির কাছ থেকে আপনাদের এক চিত্রসাংবাদিক মাস্ক নিলেন। অথচ আপনারাই এই সময় হতে পারতেন কর্তব্যরত চিত্রসাংবাদিকদের সুরক্ষার পথ প্রদর্শক। তৈরি করতে পারতেন তাদের নিরাপত্তা রক্ষার এক নতুন দৃষ্টান্ত। অন্যান্য সংবাদপত্রগুলি আপনাদের অনুসরণ করতো। প্রতিটি সংবাদ প্রতিষ্ঠান যদি এ সময় তাদের কর্তব্যরত সাংবাদিকদের কথা একটু ভাবতেন তাহলে অনেক সাংবাদিকেরই কাজের প্রতি ভালোবাসা আরও বেড়ে যেত। তাদের জীবনের ঝুঁকিও কম হত। বিশেষ করে যে নুন্যতম সুরক্ষার কথা আপনারা দিনরাত বলে চলেছেন সেই সুরক্ষা অনেকেই নিজেদের কর্মীদের দিচ্ছেন না! অবশ্য বৈদ্যুতিন মাধ্যমের সাংবাদিকরা সামান্য হলেও কিছু সুরক্ষা পাচ্ছেন। কিন্তু খবরের কাগজের চিত্রসাংবাদিকরা নৈব নৈব চ।
মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের জন্য বীমার ব্যবস্থা করবেন বলে কথা দিয়েছেন। আপনারা কী করছেন? সুরক্ষার বদলে এই লকডাউনের বাজারে অনেকে মতলব ভাঁজছেন ক’জনকে ছাঁটাই করা যায়! বেতন কমানো যায় ক’জনের! কোন কোন প্রতিষ্ঠান এখন থেকেই বলতে শুরু করেছেন মাস মাইনে না কাটলে ঘাটতি পূরণ করা যাবে না। আর এই ঘাটতি মেটাবেন ১০ থেকে ৩০হাজার টাকা যারা মাইনে পান সেই কর্মীরা। মালিকের ধামাধরা উঁচু থাকের কর্মীদের ঠাটবাট আগের মতই থাকবে। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারছি করোনার আতঙ্কের মধ্যেই তাদের মনে তৈরি হয়েছে কর্মহীনতার আতঙ্ক।
প্রেস ক্লাব, কলকাতা যা আমার কাছে রিপোর্টারস ক্লাব, এই লকডাউনে তারা কী করছেন তা আমার জানতে ইচ্ছে করে। শুনলাম, ভারত সেবাশ্রম সংঘের সহায়তায় আপনারা দুঃস্থ মানুষদের খাবার দিয়ে সেবা করছেন। কিন্তু আরও একটা জরুরি কাজ করা যেত। দোকানপাট তো এখন বন্ধ। লকডাউনের সময়ে যে সাংবাদিকরা পথে নেমে কাজ করছেন ক্লাব চত্বরেই তাদের ভাত, আলুভাজা, ডিমের ঝোল দিয়ে লাঞ্চের ব্যবস্থা করা গেলে তারা সত্যি উপকৃত হতেন। এর জন্য টাকা দিতেও সাংবাদিকরা রাজি থাকতেন।
সেদিন এক চিত্রসাংবাদিক কিছু ছবি পাঠিয়ে জানালো মুম্বই প্রেস ক্লাব সাংবাদিক ও চিত্রসাংবাদিকদের করোনা টেস্ট করার ব্যবস্থা করেছে। সত্যিই তো সাংবাদিকরা কাজের জন্য যেভাবে রাস্তাঘাটে ঘুরছেন তাদের টেস্ট করা সবচেয়ে বেশি জরুরি। মুম্বই প্রেস ক্লাবের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। প্রেস ক্লাব, কলকাতাও সেরকম উদ্যোগ নিতে পারতো। সেদিন মুখ্যমন্ত্রী বলছিলেন, করোনা সচেতনতা গড়তে আমরা আপনাদেরও পাশে চাই। প্রেস ক্লাবের সভাপতি, সম্পাদকের কাছে এই অতিমারির সময়ে আরেকটু সক্রিয়তা আশা করেছিলাম। সবই কি মুখ্যমন্ত্রী বলার পর আপনারা করবেন!
অবশ্য তিনি বলার পরও আপনারা করেন না। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বহুদিন আগে চিত্রসাংবাদিকদের ক্লাবের সদস্য করার অনুরোধ করেছিলেন। আপনারা এখনও এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন নি। নানা আইনি জটিলতা দেখাচ্ছেন! সংবাদ কর্মীদের গণ ছাঁটাই নিয়ে প্রেস ক্লাব, কলকাতার কোন বক্তব্য আমরা এখনও পাইনি। অথচ মুম্বই প্রেস ক্লাবের পক্ষ থেকে প্রতিটি সংবাদ মাধ্যম কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে আপনারা সাংবাদিকদের চাকরি নিয়ে টানাটানি করবেন না।
আজ সকালে মুম্বই এর এক চিত্রসাংবাদিক দুঃখ করে বলছিলেন, অশোকদা চিত্রসাংবাদিকদের জন্য কেউই কোনদিন কিছু ভাবেনি। অথচ তাদের ওপর নির্ভর করেই একটা কাগজ বেড়েছে, বৈদ্যুতিন মাধ্যম টিআরপি বাড়িয়েছে। তোমরাও পারোনি, আমরাও পারছি না। চিরকাল চিত্রসাংবাদিকরা দলিতই রয়ে গেল। আর লেখনী সাংবাদিকরা ব্রাহ্মণ। আমি তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। স্বীকার করছি আমরা দলিত।
এই অবস্থায় চিত্রসাংবাদিকদের নিজের টাকায় মাস্ক, স্যানিটাইজার কিনে কিংবা মুখে কাপড় বা গামছা বেঁধেই কাজ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। পেশার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে তারা সেটাই করছেন। করোনা বিধ্বস্ত একটা সময়কে ধরছেন তারা। তাদের ছবিগুলি অতিমারির সময়ে দেশ-মানুষ-জীবনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত দলিল হয়ে থাকবে এই দায়িত্ববোধ থেকেই মৃত্যুকে উপেক্ষা করছেন। চিত্তে ভাবনা নিয়েই জীবন মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করছেন তারা।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত