তাঁর নিজের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘কিছু স্মৃতি কিছু কথা’তে তাঁর সহ-অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের সম্বন্ধে কিছু অকপট স্বীকারোক্তি দিয়ে গিয়েছেন তিনি। যেমন, শ্রীমতী সুচিত্রা সেন সম্বন্ধে লিখেছেন – “ওকে আমি ভালোবেসে পাগল! দেবকী বসুর ‘ভালোবাসা’ ছবিতে উনি আমার স্ত্রী। তখন ডায়লগ বলব কি? ঘাড় গুঁজে প্রেমে পড়লাম। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতাম। সুচিত্রাও বুঝেছিলেন সেটা। অসীম ভদ্রতাবোধে আমায় চড়-থাপ্পড় মারেননি।”; নৃপতি চট্টোপাধ্যায় সম্বন্ধে জানিয়েছেন – “মদ খাওয়া মানেই প্রভু। প্রভুর নিজের ভাষায় ‘প্রভৃতির আগে নৃপতি’। পরিচালকদের বলতে হত না কোথায় কি অভিনয় করতে হবে। ও যে এত ভাল অভিনয় করত, সেটা বললে একটুও মানতে চাইত না। ছবিদাও ওর অভিনয়ের জন্য ওকে ‘প্রভু’ বলে ডাকতেন।”; ছায়াদেবী সম্বন্ধে তাঁর বক্তব্য – “ফ্লোরে থাকলে ভয় পেতাম কখন কি করে বসেন। ওঁর অভিনয়ের জন্যই ‘হারমোনিয়াম’ বহুবার দেখেছিলাম। মজাও করতাম। মানুষের নাম ভুলে যেতেন ছায়াদেবী। দেখা হলেই বলতাম, নমস্কার, আমার নাম বিকাশ রায়।”, অভিনেত্রী মঞ্জু দে সম্বন্ধে জানিয়েছেন – “একে আমি পেল্লায় ভালোবাসতাম, সে কথা ওকে বলাই হয়নি কোনও দিন।”; পাহাড়ী সান্যাল সম্বন্ধে তাঁর মতামত – “আদর করে গালি দিতেন আমায়। বহু অকৃতজ্ঞ প্রযোজক, পরিচালকের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেও যোগ্য সন্মান পাননি পাহাড়ীদা। অসম্ভব ভাল গানের গলা ছিল।”; চন্দ্রাবতী দেবী সম্বন্ধে জানিয়েছেন – “সাজের জন্য পাগল অপরূপ সুন্দর দেখতে। আর মেক আপে নিজেকে আরও মোহময়ী করে তুলতেন। হাসিও ভারী মিষ্টি ছিল।”
১৯৮৪ সালে অভিনয় জগৎ থেকে অবসর নিয়েছিলেন বিকাশ রায়। আজকের এই প্রজন্ম তাঁকে কতটা মনে রেখেছে সেটা বলা মুশকিল, কিন্তু দুহাজার সালের কিছুদিন আগে পরেও লোকে তাঁকে একডাকে চিনত বাংলা সিনেমার এক জনপ্রিয় অভিনেতা হিসেবে। কে বিকাশ রায়? জিজ্ঞাসা করতে বা ভাবতে হয় না কেন? কি আছে তাঁর অভিনয়ে যা তাঁকে আবছা হতে দেয়নি বা মুছে যেতে দেয়নি ওপর ওপর দেখলে বলা যায়, যে কোনো চরিত্রে, ছোট-বড়, নায়ক, ভিলেন – বিকাশ রায় একটা ছাপ রেখেছেন তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও অভিনয় ক্ষমতার জোরে। সেই যুগে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত বিকাশ রায়, শুধু মাত্র হৃদয় বা মন দিয়ে অভিনয় করেননি – তাঁর অভিনয়ের মধ্যে তাঁর বিচক্ষণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার ব্যবহার সুস্পষ্ট দেখতে পাওয়া জাগ। একই ধরনের চরিত্রে সামান্য একটু বাচন ভঙ্গি বা অঙ্গ ভঙ্গি রদবদল করেই, চরিত্রটিকে অনন্য করে তুলতেন। বিকাশ রায়ের মৃত্যুর পরে পরেই পশ্চিমবঙ্গের বাংলা আর ইংরেজী কাগজে তাঁকে নিয়ে যা লেখা হয় তার প্রায় সবকটায় তাঁর মনে রাখার মত ছবির একটা করে তালিকা দেওয়া হয়। তার মধ্যে প্রধান কিছু কাগজ, যথা অমৃতবাজার, আনন্দবাজার, উল্টোরথ – এগুলোতে সব মিলিয়ে তাঁর চল্লিশটি ছবির নাম পাওয়া যাচ্ছে তাঁর স্মরণীয় ছবি বলে। কিন্তু কোন অভিনেতা বা অভিনেত্রী কি খালি তাঁর স্মরণীয় ছবির হিসেব দিয়েই স্মরণীয় হন? চলচ্চিত্রের হিসেবে এই স্মরণীয় সংখ্যাটাই যে আপেক্ষিক। যে ছবি একজনের কাছে স্মরণীয়, সেটা অন্য কারও কাছে স্মরণীয় নাও হতে পারে। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বিকাশ রায়ের দুশো আটচল্লিশটি ছবি রিলিজ হয়েছে, সংখ্যাটা উপেক্ষা করার মত নয়। যত বেশী ছবিতে অভিনয় করবেন, ভালো ছবির সম্ভাবনা ততই বাড়বে, দর্শকের মনে দাগ রেখে যাবার মত ছবির সংখ্যা ততই বেশী হবে। বিকাশ রায়ের ক্ষেত্রেও এইরকম ঘটেছিল। বিশেষ করে ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ (তাঁর নিজের মতে ১৯৬০-৭০) পর্যন্ত সিনেমার অভিনেতা হিসেবে তাঁর সবচেয়ে ভালো সময়। এই সময়ে তিনি দেড়শো মত ছবি করেছেন, আর ওপরের তালিকার প্রায় সব ছবিই এই সময়ের থেকে। অবশ্যই অনেক ছবি ছবি হিসেবে খুব ভালো হয়নি, ছবি হয়তো ভালো চলে নি – তিনি তো মাত্র অভিনেতা, ছবির সব ভালোমন্দ তো তাঁর হাতে নয়। তবে ভালো ছবি অনেক হয়েছে, এটাই আসল কথা। পঞ্চাশের দশকে, বিশেষত গোড়ার দিকে তিনি অনেক ছবিতে নায়কের পার্ট করেন তার অনেকগুলোই খুব সফল, যথা ‘রত্নদীপ’, ‘রাত্রির তপস্যা’, ‘ছেলে কার’, ইত্যাদি। কিন্তু এর পর নায়ক হিসেবে উত্তমকুমারের খ্যাতি বাড়তে শুরু করার পর নায়কের ভূমিকা ওঁরই মোটামুটি একচেটে হয়ে যায়। কিন্তু ভিলেন বা অন্য সব পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতার দরকার হয়। এ সব পার্শ্বচরিত্র হতো নানা রকম টাইপের। সিনেমায় নামার প্রায় শুরু থেকেই, অর্থাৎ ‘ভুলি নাই’ বা ‘৪২ ছবি থেকে ভিলেন চরিত্রে অভিনয় করে বিকাশ রায়ের খুব নাম হয়েছিল। তারপর উনি দেখালেন যে শুধু নানা ধরণের ভিলেন চরিত্র নয়, তাছাড়াও অন্য প্রায় যে কোনো পার্শ্বচরিত্রে তিনি খুব সার্থক অভিনয় করতে পারেন – সে একদিকে স্যুটবুট পরা ইংরেজী-আওড়ানো অভিজাত লোক থেকে আরম্ভ করে নেশাখোর সাপুড়ে পর্যন্ত, উদাহরণ – ‘সূর্যতোরণ’ ছবির রাজশেখর বা ‘শ্রীকান্ত-ইন্দ্রনাথ-অন্নদাদিদি’ ছবির শাহজী। আসলে সে সময়ে এত রকমের চরিত্রে একজনই রূপ দিতে পারেন এমন অভিনেতা উনি ছাড়া আর কেউ ছিলেন না বললেই হয় (হয়তো উৎপল দত্ত, কিন্তু তিনি স্টেজের অভিনয়েই ব্যস্ত থাকতেন)। কাজেই ভিন্ন ভিন্ন ছবিতে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করার জন্য বিকাশ রায়ের ডাক পড়তো বেশী। ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গ- বা বাচনভঙ্গি ব্যবহার করে বিকাশ রায় একই ধরণের চরিত্রকে রূপায়িত করতেন। তার একটা উদাহরণ হলো ‘৪২ ও ইন্দ্রনাথ-শ্রীকান্ত-অন্নদাদিদি। ছবি দুটিতেই বিকাশ রায় ভিলেন চরিত্রে অভিনয় করেন, কিন্তু কত পার্থক্য তাঁর চরিত্র চিত্রণে। ৪২ -এ তিনি ক্ষমতাসীন, ক্রূর একজন পুলিশ অফিসার, মেজর ত্রিবেদী। মেজর ত্রিবেদী অর্থাৎ বিকাশ রায় ধীরে ধীরে চিবিয়ে চিবিয়ে মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে কথা বলার মধ্যে দিয়ে জানিয়ে দেন যে যা ইচ্ছে তাই করার ক্ষমতা তিনি রাখেন। আবার ইন্দ্রনাথ-শ্রীকান্ত-অন্নদাদিদিতেও বিকাশ রায় ভিলেন। এখানে তিনি ধূর্ত, চক্রান্তকারী, চরিত্রহীন। এই ছবিতে সাপুড়ের বেশে বিকাশ রায় শুধু মাত্র দৃষ্টিভঙ্গিমা দিয়েই তাঁর স্ত্রী অন্নদাকে ঘর ছাড়া করেন। দুটি চরিত্রই ভিলেন-এর কিন্তু অভিনয় ও বাচন ভঙ্গির পরিবর্তন করে বিকাশ রায় তাদের দুটি ভিন্ন ধরনের ভিলেন চরিত্রে পরিবর্তিত করেছেন।
তাঁর প্রায় আড়াইশো ছবি ধরে হিসেব দেওয়া প্রায় অসম্ভব কিন্তু তাঁর অভিনয়ের প্রসার যে কতখানি ছিল, কয়েকটা ছবির উদাহরণ দিলে তা নিয়ে সন্দেহ থাকবে না। বিকাশ রায় বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন কিন্তু তাঁর বিশেষ খ্যাতি ভিলেন বা পার্শ্বচরিত্র অভিনয়ে। ভিলেনের ভূমিকায় অভিনীত – ‘ভুলি নাই’, ‘জিঘাংসা’, ‘ইন্দ্রনাথ-শ্রীকান্ত-অন্নদা-দিদি’, ‘অভয়া -শ্রীকান্ত’, ‘বধূ’, ‘রাজদ্রোহী’, ‘কাঁচের স্বর্গ’, ‘পাড়ি’, ‘অদ্বিতীয়া’ ছবিতে তাঁর অভিনয় আজও ভোলা যায় না| ‘৪২ ছবির কথা আগে বলেছি, সেখানে তাঁর জীবন্ত চরিত্রচিত্রণের ফলে অনেক দর্শকেরাই ছবি চলা কালীন তাদের রাগ ও ঘৃণা চেপে রাখতে পারতেন না। ইন্দ্রনাথ-শ্রীকান্ত-অন্নদাদিদি ছবিতে “সাঁপের খেলা দেখবে” কথাগুলি, সাপুড়ের বেশে বিকাশ রায়র বিশেষ বাচনভঙ্গি ও সেই দৃশ্যে তাঁর চোখের দৃষ্টি, কি ভয়ানক! সাপের চোখকেও হার মানায়। এই ছবিতেই সাপের কামড়ে মৃত্যুর সময় সাপটিকে টেনে ছিঁড়ে মেরে ফেলার সময় তাঁর অভিনয় অতুলনীয়। বধূ ছবিতে হাত কচলে-কচলে কি পরিমাণই না বিষ ছড়িয়েছিলেন। ‘না’ ও ‘রত্নদীপ’ ছবিতে ভালোমন্দ মেশানো মানুষের চরিত্রে বিকাশ রায় অনবদ্য। তিনি তা কত সহজে, কত সংযত অভিনয় দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন, তা বোধয় ওঁর দ্বারাই সম্ভব ছিল। না ছবিতে একটি সহজ সরল মানুষ কি ভাবে ধীরে ধীরে একটি অমানুষে পরিণত হয়ে যাচ্ছে তা বিকাশ রায় সহজে ফুটিয়েছেন। রত্নদীপে তিনি এক প্রতারকের চরিত্রে অভিনয় করেন। যদিও এই ছবিতে চরিত্রটি প্রধানত ভিলেন-এর কারণ তিনি প্রতারক কিন্তু এই চরিত্রে উনি প্রেমিকের অভিনয়ও করেছিলেন। ছবিটি বক্স অফিস হিট হয়েছিল। ‘বিভাস’ ছবিতে বিকাশ রায় একটি পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেন। এই ছবিতে, উত্তমকুমার-এর সাথে এক দৃশ্যে “হেরে গেলে দুয়ো দুয়ো” বলার সময়, তাঁর বাচনভঙ্গি প্রমাণ করে দেয় যে তিনি কত উচ্চমানের অভিনেতা ছিলেন। শেষ অঙ্ক ছবিতে বিকাশ রায় এক ডিটেকটিভের ভূমিকায় অভিনয় করেন। যেহেতু বিকাশ রায়, দর্শকের অনুমানে তিনিই নায়কের শত্রু। ‘কাঁচকাটা হীরে’ ছবিতে ভিলেন মনে হলেও তা ছিল দুই প্রজন্মের সংঘাত। এখানেও বিকাশ রায় সংযত অভিনয় দ্বারা চরিত্রটিকে বিশেষত্ব প্রদান করেন। ‘আঁধারে আলো’, ‘জীবন তৃষ্ণা’, ‘সূর্যতোরণ’, ‘মায়ামৃগ’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ‘উত্তরফাল্গুনী’, ‘জীবন কাহিনী’, ‘সন্ধ্যাদীপের শিখা’, ‘প্রস্তর স্বাক্ষর’, ‘বাঘিনী’, ‘দাদু’, ‘পরিণীতা’, ‘নবরাগ’, ‘আলো আমার আলো’, ‘হার মানা হার’, ‘দেবদাস’ প্রভৃতি ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রগুলিকে বিকাশ বাবু নিজের অভিনয় ক্ষমতা ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার প্রয়োগে এক-একটি অসাধারণ চরিত্রে পরিণত করেন। বিকাশ রায় ল পাশ করেছিলেন, তাই বোধহয় ‘উত্তরফাল্গুনী’ ছবিতে ব্যারিস্টার-এর অভিনয় এত স্বাভাবিক হয়েছিল। ‘আরোগ্য নিকেতন’ ছবিটি ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পায়। তাঁর অভিনীত মশায় চরিত্রটি এই ছবিতে অত্যন্ত গুরুত্ব পূর্ণ। ‘বনপলাশীর পদাবলী’ ছবিতে উত্তম কুমার নায়ক হলেও, বিকাশ রায় অভিনীত গিরিজা চরিত্রটি অন্যান্য চরিত্রগুলিকে এক সূত্রে বেঁধে রাখে। ‘মায়ামৃগ’ ছবিতে দরিদ্র, পঙ্গু আত্মসম্মান-সম্পন্ন পিতার ভূমিকায় মন ভেজানো অভিনয় করেন। ‘পরিণীতা’ ছবিতে দারিদ্র্য জর্জরিত সংসারের কর্তার চরিত্র রূপায়ণ ভোলার নয়। জীবনকাহিনী ও দাদু প্রায় একই রকম চরিত্র কিন্ত উপস্থাপনার গুণে ভিন্ন-ভিন্ন চরিত্র রূপে দর্শক সম্মুখে উপস্থিত হন। ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ ছবিতে কৌতুক প্রিয় দাদুর অভিনয়ে দেখে নিজেদের দাদুর কথা মনে পড়িয়ে দেয়। স্মৃতিটুকু থাক, আলো আমার আলো, মন নিয়ে, ছবিগুলিতে দরদী ডাক্তারের ভুমিকায় তাঁর অভিনয় সবার ভালো লাগে। কমেডিয়ান চরিত্রে তাঁকে দেখা গেছে ‘ছদ্মবেশী’-তে জামাইবাবুর চরিত্রে। কতজনেই বা জানে যে জামাইবাবু বা “পূজ্য জিজাজী”-কে প্রথমে বাংলা ছবিটিতেই দেখা যায়। চুপকে চুপকে হিন্দি ছবি পরে তৈরী হয়। বাগদাদ ছবিতে বম্বে-এর নায়িকা বেগম পারাকে তাঁর নায়িকা রূপে দেখা যায়। অত্যন্ত জনপ্রিয় ছেলে কার ছবিতে বিকাশ রায়-এর মুখে গান শোনা গিয়েছিল।
এটাও মনে রাখতে হবে যে বিকাশ রায় অভিনয়ের সঙ্গে-সঙ্গে ছবির প্রযোজনা, পরিচালনা, কাহিনী-রচনা ও চিত্রনাট্য রচনাও করেছেন। অনেকে এই সূত্রে তাঁকে মনে রাখেন। ‘বিকাশ রায় প্রোডাকশন’ -এর ছবি গুলি বিভিন্ন প্রকারের। অর্ধাঙ্গিনী ও সূর্যমুখী পারিবারিক ছবি, বসন্ত বাহার সংগীতবহুল। মরুতীর্থ হিংলাজ মানুষের মনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত-প্রেম নিয়ে একটি নিটোল ভ্রমণ কাহিনী। এইটি সুপার হিট ছবি। ছবিটির গান গুলি অবিস্মরণীয়। চলচ্চিত্র নির্মাণে তার অদ্বিতীয় নৈপুণ্য। ঐতিহাসিক উপন্যাস কেরিসাহেবের মুন্সী অবলম্বনে তৈরী ছবির চিত্রনাট্য, পরিচালনা ও প্রযোজনা তিনিই করেন। নতুন প্রভাত ও উত্তমকুমার অভিনীত রাজা-সাজা ছবির কাহিনী রচনা করেন বিকাশ রায়। তা ছাড়া বহু ছবির চিত্রনাট্য রচনা করেছেন – যেমন ‘কাজললতা’, ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘দুই পুরুষ’।
পর্দায় অভিনয় ছাড়াও বিকাশ রায় রেডিও ও মঞ্চেও অভিনয় করেন। মঞ্চে চারটি নাটকই খুব জনপ্রিয় হয়েছিলো। এছাড়া তিনি “শেষের কবিতা” উপস্থাপিত করেন ও নিজে ভাষ্যকারের অংশ পাঠ করেন। এধরণের প্রযোজনার তিনিই বোধহয় প্রথম উদ্যোক্তা। এই শ্রুতিনাটক লং-প্লেয়িং রেকর্ড-এ বেরোয়। তাঁর দু-তিনটি গ্রামোফোন রেকর্ডও আছে। এসব সূত্রেও বিকাশ রায়কে বাংলার মানুষ মনে রেখেছে।
বিকাশ রায় সম্বন্ধে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, তিনি অত্যন্ত স্নেহশীল ও family-oriented ছিলেন। তিনি সহজ অনাড়ম্বর জীবন যাপন করেছেন। আহ্নিক দিয়ে তাঁর সকাল শুরু হত। অতি স্বল্পাহারি ছিলেন। শুটিং-এর সময় তাঁর খাবার বাড়ি থেকে যেত। তাঁর মতে “প্রযোজক-এর গলায় পা দিয়ে খাওয়া আমার পোষায় না”। তিনি কোনদিন মদ্যপান করেননি – স্বাদ কেমন তাও জানতেন না। আত্মীয় স্বজন , বন্ধুবান্ধব নিয়ে বাড়িতে দুর্গা পূজাও করেছিলেন। পুজোর সময় সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত মায়ের মূর্তির সামনে বসে তন্ত্রধারক হয়ে তাঁর সুললিত কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ করতেন আর পূজার খুঁটিনাটি ঠিক হচ্ছে কিনা খেয়াল রাখতেন। সেই সঙ্গে অতিথি অভ্যাগতদের ঠিক মত সমাদর হচ্ছে কিনা তাও দেখতেন। পূজার দিন গুলিতে বাড়িতে নিরামিষ রান্নার নিয়ম ছিল। অতিথিরা সবাই পাত পেড়ে প্রসাদ পেয়ে যেতেন। তাঁর একটা সুন্দর মিষ্টি ব্যক্তিত্ব ছিল যা তাঁকে একাধারে রাশভারী ও অন্য দিকে বিশেষ স্নেহশীল করেছিল। বয়স্কদের প্রতি তাঁর ব্যবহার শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমপূর্ণ ছিল। ছোটদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার ছিল বন্ধুর মত।
জানা যায় তাঁর শৈশবে তাঁর মায়ের কাছে তাঁর পিতা বলেছিলেন, ‘‘তোমার এই ছোট ছেলেটির লেখাপড়া কিচ্ছু হবে না। রেসিটেশন শিখছে, নকল-টকল করতে পারে। যাত্রা, থিয়েটারে নোটো সেজেই ওর দিন যাবে।’’ বলতেই হয় কী অমোঘ ছিল সেই পর্যবেক্ষণ! বিকাশ রায় নিজেই পরে বলেছেন, ‘‘বাবার ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলেছে। নোটো হয়েই দিন গেল!’’
যে সময়ের কথা, বিকাশ তখন বালক। জন্ম ১৯১৬ সালে, নদিয়ার রানিনগরে। বিত্তবান জমিদার বংশের ছেলে। তবে পূর্বপুরুষের বাবুয়ানি এবং উড়নচণ্ডিপনায় ভাঁড়ার প্রায় সবটাই তত দিনে উজাড় হয়ে গিয়েছিল। টিকেছিল শুধু জমিদারিসূত্রে পাওয়া ‘রায়’ পদবিটুকু। পিতা যুগলকিশোর কলকাতায় এসে সরকারি চাকরি নিলেন। যে কোনও আদর্শ পিতার মতোই তিনি চাইতেন, ছোট ছেলে ‘বিকু’ ভাল লেখাপড়া শিখে আইসিএস হোক। বিকাশ রায় ভর্তি হলেন ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনে। কিন্তু তাঁর বেশি আগ্রহ ছিল আবৃত্তি (সেই শিক্ষা অবশ্য বাবার কাছেই শুরু), অভিনয়ে। তাই হাত-পা নেড়ে ‘পঞ্চনদীর তীরে’ আবৃত্তি করে প্রশংসা কুড়োলেও বাবা যেই ইংরেজি ট্রান্সলেশন ধরলেন, তাঁর হাল খারাপ হল! ম্যাট্রিকে বাংলায় লেটার ও স্বর্ণপদক নিয়ে পাশ করেছিলেন বিকাশ। পড়তে গেলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেখানেও নাটকের ভূত চেপেছিল তাঁর ঘাড়ে। তখন ঘটল আর এক কাণ্ড! কলেজের থিয়েটারের দলে ঢুকে শরৎচন্দ্রের ‘বৈকুণ্ঠের উইল’-এ পেলেন বিনোদের ভূমিকা। চরিত্রের দাবি অনুযায়ী মদ, সিগারেট সবই দরকার। কলেজের নাটকে মদ খাওয়া দেখানোর প্রশ্নই নেই। তবে সিগারেট রেখেই মহলা হল। কিন্তু গোল বাধল শেষবেলায়। চূড়ান্ত মহলা দেখতে এসে অধ্যক্ষ রেগে আগুন। প্রেসিডেন্সির ছেলেদের নাটকে সিগারেট খাওয়া! অতএব সেটি অভিনয় থেকে ছেঁটে দেওয়া হল। যদিও সিগারেটের নেশা তত দিনে রপ্ত হয়ে গিয়েছিল তাঁর। আর মদ? একের পর এক চলচ্চিত্রের খল চরিত্রে মদ্যপান যাঁর কাছে জলপানের চেয়েও স্বাভাবিক লেগেছে, ব্যক্তিজীবনে সেই বিকাশ রায় নেশা করবেন, এতে আশ্চর্য কী! সত্যিই আশ্চর্য। কারণ কোনও দিন মদের গ্লাসে চুমুকটুকুও দেননি তিনি! ঘনিষ্ঠদের আড্ডায় এ সব নিয়ে মজাও করেছেন। বিকাশ রায়ের বিভিন্ন লেখার সংকলনগ্রন্থ প্রকাশের সূত্রে বইপাড়ার প্রকাশক বামাচরণ মুখোপাধ্যায় তাঁর খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। একবার বিকাশবাবুর কাছে তিনি জানতে চান, নিজে মদ না খেলে মদ্যপের নিখুঁত অনুভূতি বোঝা যায়? বিকাশবাবু হেসে জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘অভিনয় তো মনে। মদ কী করবে!’’ অভিনয়ের এই সাবলীলতাই বিকাশ রায়ের সবচেয়ে বড় সম্পদ। চলচ্চিত্র জগতের মানুষজন তো বটেই, একেবারে সাধারণ দর্শকও তাঁর অভিনয় প্রতিভায় মজে থেকেছেন চিরকাল। তিনি আর নেই। কিন্তু সেই স্বীকৃতি আজ পর্যন্ত একই রকম রয়ে গিয়েছে।
বিকাশ রায়ের পাকাপাকি ভাবে অভিনয়ে আসার আগের পথটি কিন্তু খুব মসৃণ ছিল না। চড়াই-উতরাই ছিল বিস্তর। সংসার প্রতিপালনের জন্য কঠিন লড়াই করতে হয়েছে তাঁকে। বিলেত ফেরত চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট দাদার অকালমৃত্যু, বাবার চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে পরিবারে নিদারুণ অর্থকষ্ট, তারই মধ্যে তাঁর বিয়ে। অন্নসংস্থানের জন্য হাড়ভাঙা খাটুনি ছিল তাঁর। সকালে টিউশন দিয়ে শুরু হত দিন। তার পরে বাসভাড়া বাঁচাতে ভবানীপুর থেকে হেঁটে হাইকোর্ট পাড়া। ভাগ্যান্বেষণে এ দুয়ার, সে দুয়ার। প্রেসিডেন্সি থেকে অনার্স নিয়ে বিএ পাশ করেছেন, আইন পাশ করেছেন। ওকালতি করতে গিয়েও সুবিধে হয়নি। বহু ঘাটে ঘুরতে ঘুরতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাজারে অল্প দিন মোটা বেতনে সিভিল ডিফেন্সে পাবলিসিটির চাকরিও করেছিলেন। কাজ করেছিলেন একটি এরোড্রম তৈরির অফিসেও। কিন্তু কোনওটিই তাঁর জীবনে স্থায়ী হয়নি। শেষে অনেক কম টাকায় যোগ দেন রেডিয়োর চাকরিতে। মাইক্রোফোনের আকর্ষণ তাঁকে টেনেছিল। নানা বাঁক ঘুরে সেখান থেকেই তিনি এক সময় পৌঁছেছিলেন সিনেমার জগতে। দেশ তখনও স্বাধীন হয়নি। সিনেমায় নামার আগে স্ত্রীর ‘অনুমতি’ নিয়েছিলেন বিকাশ রায়। কারণ এমন একটি কাজে পদে পদে নানা হাতছানি থাকে, নিন্দা রটতেও দেরি হয় না। স্ত্রী কিন্তু মুক্তমনে সায় দিয়েছিলেন। তিনি জানতেন, তাঁর স্বামী কত ‘খাঁটি’।
১৯৪৭-এ মুক্তি পায় বিকাশ রায় অভিনীত প্রথম ছবি ‘অভিযাত্রী’। ছবির কাহিনি, চিত্রনাট্য, শিল্পী নির্বাচন ইত্যাদির দায়িত্ব পেয়েছিলেন তাঁর রেডিয়ো-জীবনের বন্ধু জ্যোতির্ময় রায়। তিনিই নিয়ে যান বিকাশবাবুকে। আশ্বাস ছিল, নায়ক হবেন। পেলেন চার নম্বর চরিত্র। পাঁচ হাজার টাকাও। মন না মানলেও অবস্থা তা মেনে নিতে বাধ্য করল। এবং বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ পেয়ে গেল অভিনেতা বিকাশ রায়কে। প্রথম ছবির পরিচালক হেমেন গুপ্তের কাছেই বিকাশবাবুর দ্বিতীয় ছবি ‘ভুলি নাই’। সেই সঙ্গে পরিচালকের সহকারী হয়ে বুঝতে শুরু করলেন চলচ্চিত্র নির্মাণের অন্ধিসন্ধি। যেটা পরবর্তী কালে বিকাশকে নানা ভাবে সাহায্য করেছে। পরিচালনা, চিত্রনাট্য তৈরি, প্রযোজনা— সব ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণে দীর্ঘ সময় জুড়ে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা ছবি। এরপরে ১৯৫১ সাল। একের পর এক ছবি করতে করতে অভিনেতা বিকাশ রায় তখন বেশ পরিচিতি পেয়ে গিয়েছেন। সেই সময় হেমেনবাবু তৈরি করেন ’৪২। ছবিটিতে নৃশংস অত্যাচারী মেজর ত্রিবেদীর ভূমিকায় অবিস্মরণীয় অভিনয় করেন বিকাশ রায়। দেশ তখন স্বাধীন হওয়ার আবেগে উত্তাল। পর্দায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উপর মেজরের অত্যাচার দেখতে দেখতে মানুষ এতটাই খেপে উঠেছিল যে, রাস্তাঘাটে বিকাশ রায়কে দেখলে তাড়া করার ঘটনাও ঘটত। ছবির প্রিমিয়ারে তাঁকে দেখতে পেয়ে জুতো তুলে ছুটে এসেছিলেন অনেকে।
ছোট-বড় যে চরিত্রই হোক, নিজেকে সেই অনুযায়ী তৈরি করার কাজে বিকাশ রায় কোনও ঘাটতি রাখতেন না। যখন তিনি রীতিমতো নামডাকওয়ালা, তখনও সেই অভ্যেস তিনি ছাড়েননি। শট দেওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত চরিত্রায়ন নিয়ে নিজের মতো কিছু না কিছু ভেবেই চলতেন। অভিনেত্রী লিলি চক্রবর্তী সংবাদমাধ্যমে শুনিয়েছিলেন তেমনই এক টুকরো অভিজ্ঞতা। তখন টেকনিশিয়ান্স স্টুডিয়োয় কোনও ছবির শুটিং করছিলেন তিনি। পাশের ফ্লোরে অন্য কোনও ছবিতে বিকাশ রায়। এক ফাঁকে বাইরে বেরিয়ে লিলিদেবী দেখেন, পুলিশ অফিসারের পোশাক পরা বিকাশবাবু বাইরের চত্বরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন। ‘‘কী হয়েছে, বিকাশদা? পায়ে লাগল?’’ তাঁর প্রশ্নে বিকাশ রায় জানিয়েছিলেন, এই পুলিশ অফিসারের চরিত্রে একটু পা টেনে হাঁটলে ভাল হবে মনে হয়েছে বলে তিনি শটের আগে সেটা অভ্যেস করছেন। ফ্লোরে অন্য কেউ কিন্তু তা জানেননি, বোঝেননি। তাঁরা শুধু শটটাই দেখেছেন। ‘আমি সিরাজের বেগম’ ছবিতে মিরজাফর হয়েছিলেন বিকাশ রায়। সিরাজের ভূমিকায় ছিলেন অভিনেতা বিশ্বজিৎ। শট দেওয়ার সময় বিশ্বজিতের মনে হত, বিকাশ রায়ের মিরজাফর যেন একটু ভালমানুষ গোছের। চুপচাপ বসে মালা জপছেন, আর ঘাড় হেলিয়ে তাকাচ্ছেন। ক্রূরতার প্রকাশ কি কম হচ্ছে? তখন সংশয় ছিল বিশ্বজিতের। পরে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘‘পরে ছবি দেখে মালুম হল, মিরজাফর চরিত্রকে কী অসীম দক্ষতায় জীবন্ত করে তুলেছিলেন বিকাশদা। ওই ঠান্ডা দৃষ্টিতে কী অসম্ভব কুটিলতা, ভাবা যায় না!’’
প্রমথেশ বড়ুয়া ছিলেন তাঁর প্রিয় শিল্পী। অভিনয়ে আসার আগেই বড়ুয়া সাহেবের স্টাইল তাঁকে টানত। ফিল্মে পরিমিতি বোধের অনুভূতি তিনি বুঝতে শিখেছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়ার ছবি দেখে। বিকাশ রায়ের কাটা কাটা সংলাপ বলার ভঙ্গিতেও অনেকে তাই বড়ুয়া-স্টাইল খুঁজে পান।
আবৃত্তির প্রতি অনুরাগ তো শৈশব থেকেই ছিল। তাই প্রতিটি শব্দ উচ্চারণে যত্ন এবং স্বর প্রক্ষেপণ তাঁর অভিনয় প্রতিভায় যোগ করেছিল বাড়তি মাত্রা। কিন্তু তার বাইরেও আবৃত্তি তাঁকে প্রেরণা দিত। কাজ থেকে ফিরে সময় পেলেই ছেলে সুমিতের সঙ্গে বসে কত কী যে পড়তেন— ‘শেষের কবিতা’, ‘ম্যাকবেথ’, ‘সঞ্চয়িতা’র পাতা উল্টে কোনও কবিতা। বাবা-ছেলের পাঠে ঘর গমগম করে উঠত। তিনি নিজের ছেলেকে ডাকতেন ‘বেণুবাবু’ বলে। তবে ছেলে-মেয়ের মুখে সাদামাঠা ‘বাবা’ শুনতে চাইতেন না। তাঁকে সন্তানেরা বলতেন ‘বাবু’। ধমনীতে জমিদারের রক্ত বলেই হয়তো ‘কর্তা’ ডাকটিও অপছন্দের ছিল না। ছেলেকে নিয়ে এক সান্ধ্য পাঠের আড্ডায় একদিন ঘটল মজার কাণ্ড। সে দিন শেক্সপিয়র-এর লেখা পড়া হবে। বিকাশ রায়ের বাড়ি ছিল বইয়ের গুদাম। পুস্তক অনুরাগী এই অভিনেতার নিজস্ব সংগ্রহে ছিল কয়েক হাজার বই। তাঁর যোধপুর পার্কের ভাড়াবাড়িতে কাজের বাইরে সর্বদা বই নিয়ে মগ্ন থাকতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন শিল্পী। ছেলেকেও বইয়ের নেশা ধরিয়ে দিয়েছিলেন পুরোদস্তুর। কিন্তু সে দিন শেক্সপিয়র পড়তে গিয়ে দেখা গেল, রচনাসমগ্রটি বেপাত্তা! তন্ন তন্ন করে খুঁজে বোঝা গেল, কোনও বহিরাগত অতিথি হয়তো ‘নিজের’ ভেবে সেটি কোনও দিন হস্তগত করেছেন। ‘‘সে হোক। তা-বলে শিক্ষিতের বাড়িতে শেক্সপিয়র থাকবে না! রবীন্দ্রনাথ এবং শেক্সপিয়র যে বাড়িতে নেই, সে বাড়ি বাসের যোগ্যই নয়’’ বলে মেজাজ হারিয়েছিলেন বিকাশ রায়। অতএব সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তখুনি শেক্সপিয়রকে বাড়িতে এনে পুনর্স্থাপন করতে হবে। ছেলেকে আদেশ দিয়েছিলেন, ‘‘বেণুবাবু, গাড়ি বের করো।’’ পুত্র গাড়ি চালিয়ে বাবাকে নিয়ে গিয়েছিলেন চৌরঙ্গির ফারপো হোটেলের কাছে। ফুটপাতের এক পরিচিত বই বিক্রেতা তখন ঝাঁপ ফেলে শোওয়ার আয়োজন করছিলেন। বই পাওয়া গিয়েছিল তাঁর ভাণ্ডারে। স্বস্তি পেয়েছিলেন বিকাশ রায়! আরও একবার একই ভাবে রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্র’ খুঁজে পাননি। পরদিন বিশ্বভারতীর গ্রন্থন বিভাগে কিনতে গিয়ে শুনেছিলেন, ছাপা নেই। আপাতত বাজেট-বরাদ্দও নেই। জানা যায় বিকাশ রায় তাদের বলেছিলেন, আমি যদি গোপনে ছাপার টাকা দিই, তা হলে নেবেন? কাউকে বলতে হবে না। শুধু ছাপলেই হবে। শুনে বিশ্বভারতীর কর্তারা হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন!
চিত্র পরিচালক হিসেবে বিকাশ রায়ের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কাজ ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’। আনুমানিক শ’আড়াই ছবিতে কাজ করেছেন তিনি। পরিচালনা করেছেন আটটি ছবি। এর মধ্যে পাঁচটি আবার নিজেরই প্রযোজনা। ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ তার একটি। ছবির নায়ক থিরুমলের চরিত্রে উত্তমকুমার। নায়িকা সাবিত্রী ছিলেন কুন্তীর ভূমিকায়। দিঘার কাছে সমুদ্র সৈকতের বালিয়াড়িতে মরুভূমি বানানো হয়েছিল। ছবিতে ব্যবহারের জন্য দু’টি উট এনে রেখেছিলেন। এক চরম নাটকীয় মুহূর্তে মানসিক বিকারগ্রস্ত থিরুমল আচমকা কুন্তীর গলা টিপে ধরবে। সেই দৃশ্য গ্রহণের কয়েক দিন আগে থেকে উত্তমকুমার চুপচাপ। বিশেষ কথা বলছেন না কারও সঙ্গে। কেমন যেন আত্মভোলা ভাব। শুটিং শুরু হল। উত্তমকুমারের দৃষ্টি বেশ অস্বাভাবিক লাগছে। গলা টিপলেন যখন, তখন যেন তিনি আর নিজের মধ্যে নেই। সাবিত্রীদেবীর তখন দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শট শেষ করেই ছুটে এসেছিলেন পরিচালক বিকাশ রায়। সাবিত্রীদেবীর তখন হুঁশ নেই, তিনি বমি করে অজ্ঞান। জলটল দিয়ে তাঁকে সুস্থ করে তুলে বিকাশ রায় উত্তম কুমার কে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘তুই তো ন্যাচারাল অ্যাকটিং করতে গিয়ে মেয়েটাকেই মেরে ফেলছিলি!’’ উত্তম ক্ষমা চেয়েছিলেন সাবিত্রীদেবীর কাছে, ‘‘সাবু, প্লিজ ক্ষমা করে দে।’’
ছবির কাজ যখন কমে এল, তখন বেশি বয়সে মঞ্চে গেলেন বিকাশ রায়। সে-ও অনেক সাধ্যসাধনার পরে। তরুণকুমার এবং সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় এক রকম জোর করে রাজি করালেন তাঁকে। প্রথম নাটক ‘চৌরঙ্গি’। তিনি স্যাটা বোস। চলচ্চিত্রের দৌলতে উত্তমকুমারের স্যাটা বোস তত দিনে বাজার মাত করেছে। সেই চরিত্রকে মঞ্চে ফোটাতে গোড়ায় খুব আপত্তি ছিল বিকাশ রায়ের। বলেছিলেন, ‘‘উত্তমকে পর্দায় দেখার পরে আমাকে দর্শক নেবেই না।’’ উত্তম তা শুনে বলেছিলেন, ‘‘তুমি নিজেকে এত কম ভাবছ কেন? আমি জানি, তুমি নিজের মতো করে চরিত্র ফোটাবে। আমি দেখতে যাব।’’ বিকাশবাবু উত্তরে বলেন, ‘‘দর্শক আসনে তোকে দেখলে আরও নার্ভাস হয়ে যাব রে!’’ উত্তমকুমার গিয়েছিলেন। না জানিয়ে অন্ধকারে হলে ঢুকে বসে পড়েছিলেন। পরে গ্রিনরুমে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলেন তাঁর বিকাশদাকে। এর পরেও আরও কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেন বিকাশ রায়। প্রায় সবই তরুণকুমার, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে।
কাজের জগতের বাইরে বিকাশ রায় ছিলেন একেবারেই পারিবারিক। স্বামী, বাবা, গৃহকর্তা ঠিক যেমনটি হন। তাঁদের বাড়িতে ফিল্ম নিয়ে আলোচনা কার্যত নিষিদ্ধ ছিল। কাজ না থাকলে তাঁর একমাত্র বিনোদন ছিল বই এবং গান শোনা। সিগারেট খেতেন। বিদেশি গাড়ির শৌখিনতা ছিল। আর হয়তো বংশের ধারায় কোঁচানো ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি পরতে পছন্দ করতেন। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনচর্যায় অন্য কোনও উচ্ছ্বলতাকে প্রশ্রয় দেননি। হাঁপানির প্রকোপে গলার স্বর যখন ভেঙে গেল, তখন নিজেই সিদ্ধান্ত নিলেন— আর নয়। এ বার সরে দাঁড়াতে হবে। স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘‘যা দিতে চাই, তা দিতে পারব না। মানুষ যা চাইবে, পাবে না। এই অবস্থায় কাজ করলে দর্শকের সঙ্গে প্রবঞ্চনা করা হবে। সেটা সইবে না।’’ ছেলে চেয়েছিলেন, বাবা-মা তাঁর কাছে আমেরিকায় গিয়ে থাকুন। যাননি। নিজের শহর, চেনা পরিমণ্ডল তাঁকে পিছু টেনে ধরেছে। শেষ জীবনে তাঁর ৪৩১, যোধপুর পার্কের ভাড়াবাড়ির রাস্তার দিকের বারান্দায় আরামকেদারায় বসে চলমান জীবন দেখতেন। বই পড়তেন, অথবা আত্মমগ্ন হয়ে ভাবতেন। কোনও দিন কোনও অভিযোগ ছিল না। চাহিদাও ব্যক্ত করেননি। জীবনের পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে নীরবই থেকেছেন। কারও হয়তো মনে পড়তে পারে ‘বনপলাশীর পদাবলি’ ছবির সেই দৃশ্য। কর্মজীবনের শেষে আপন ঘরে ফিরে জগৎ ও জীবনকে যেন নতুন করে চিনলেন শিক্ষক গিরিজাপ্রসাদ। বড় বেদনার সেই অনুভব। ভাঙা মনে, ক্লান্ত পায়ে হেঁটে আসছেন তিনি। নেপথ্যে ভেসে আসছে সংগীত – ‘সাথীহারার গোপন ব্যথা, বলব যারে সে জন কোথা…’
‘‘আমি চলে যাচ্ছি, আমায় মনে রাখবেন। তাঁর বাঁ হাতে ধরা কালো ছড়িটি কেঁপে উঠল।’’ – এ ভাবেই অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন বিকাশ রায়। অনেকেরই মনে হয়েছিল, বহু স্বপ্নভঙ্গের অভিমান এবং ব্যথা থেকে বিকাশ রায় রেডিয়ো, টিভি, মঞ্চ, মাস মিডিয়ার রাজপথ থেকে সরে দাঁড়ালেন। কারও কারও ধারণা হয়েছিল, বিকাশ রায় বয়সের জন্য সরে গেলেন। জীবনের উপান্তে এসে, তিনি যখন বুঝতে পারছিলেন আর বোধহয় বেশি দিন নেই, তখন একবার বলেছিলেন, “হে আমার ভগবান, আমার দর্শক, অতীতের মতো সামনের দিনও তোমাদের দক্ষিণমুখ আমার দিকে যেন উন্মোচিত করে রেখো।”
১৯৮৭ সালে ৭১ বছর বয়সে জীবনাবসান হয় বিকাশ রায়ের।
(তথ্যসূত্র:
১- কিছু স্মৃতি কিছু কথা: বিকাশ রায়, অনুলিখন – অমিয় সান্যাল, করুণা প্রকাশনী।
২- ‘A gentleman actor’, Article published on ‘The Hindu’ on 26th January by Ranjan Das Gupta.
৩- ‘Looking at a forgotten stalwart’, Article published in ‘The Statesman’ on 29th January 2016 by Swapan Mullick.)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত