বাংলায় বারো মাসে তেরো পার্বণ। দূর্গাপূজা, লক্ষীপূজা, কালীপূজা সহ বিভিন্ন পূজা ছাড়াও নানা ধরনের লোকউৎসব ও পালিত হয় আমাদের বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে। এই লোকউৎসবের মধ্যে গাজন ও চড়ক অন্যতম। চৈত্র-সংক্রান্তিতে শিবকে কেন্দ্র করে যে অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়, মূলত সেটিই গাজন নামে পরিচিত। শিব ছাড়াও রাঢ় অঞ্চলে ধর্ম ঠাকুরের গাজন ও পালিত হয়। ‘গাজন’ শব্দটি এসেছে “গা” এবং “জন” থেকে, যার অর্থ গ্রাম এবং জনসাধারন। গ্রামীণ জীবনের জনপ্রিয় লোকউৎসব হল গাজন অনুষ্ঠান।
বাংলার কৃষক সমাজের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয় এই লোকউৎসব। গাজন সে অর্থে কৃষিকর্মের অংশ নয়, এটি যে সময় পালন হয় তখন মাঠের ফসল ঘরে তোলা হয়ে গেছে তাই তাদের কাছে অঢেল সময় আর এই সময় কাটাতেই তাঁরা বেছে নেয় এই লোকউৎসব কে। মূলত বাংলার রাঢ় অঞ্চলের দূর্গাপুর, আসানসোল, অজয় ও দামোদর নদীর তীরের বীরভূম অঞ্চল, মানভূম, বর্ধমান, মূর্শিদাবাদ এও পালিত হয় এই লোকউৎসব। পশ্চিমবঙ্গ বিভিন্ন ধর্মের মিলনস্থল হওয়ায় এখানকার বিভিন্ন উৎসবেও তার প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা যায়, গাজন ও তার ব্যাতিক্রম নয়। আর সেই জন্যই বৌদ্ধ, জৈন, হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন রীতির প্রতিফলন দেখা যায় এই উৎসবে। সারা বছরের বিভিন্ন সময়ে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তরে গাজন পালিত হয়ে থাকে। শিবের গাজনের সাথে সাথে নীলের গাজন, ধর্ম ঠাকুরের গাজন ও সমানভাবে জনপ্রিয়।
বাংলার লোকসংস্কৃতির ইতিহাসে গাজন এক উল্লেখযোগ্য মাইল ফলক। এটি শুধুমাত্র একটি ধর্ম কেন্দ্রিক উৎসব নয়, এর জনপ্রিয়তা একে এক যথার্থ লোক উৎসবের মাত্রা দান করেছে। এর জনপ্রিয়তা যে কতটা তা আমরা বিভিন্ন সাহিত্যে এর উল্লেখ দেখেই আন্দাজ করতে পারি। শরৎচন্দ্রের অনেক উপন্যাসেই পল্লীচিত্রের বর্ণানায় আমরা এর উল্লেখ পাই। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের ‘পঞগ্রাম’ উপন্যাসেও এর উল্লেখ আছে। দীনেন্দ্রকুমার রায় তার ‘পল্লীচিত্র’ জাতীয় একাধিক স্মৃতিকথায় সেকালের গাজনের এক জীবন্ত চিত্র নথিবদ্ধ করে গেছেন। যা বর্তমান গবেষকদের কাছে এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে গণ্য হয়।
লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, গাজন উৎসবের দিনে দেবী হরকালীর সঙ্গে শিবের বিবাহ হয়। বিবাহ উৎসবে সন্ন্যাসীরা বরযাত্রী হিসেবে অংশ নেন। অন্যদিকে, ধর্মঠাকুরের গাজন হল ধর্মঠাকুর ও দেবী কামিনী-কামাখ্যার (বাঁকুড়া জেলা), দেবী মুক্তির বিবাহ উৎসব।
রাঢ়বঙ্গের শৈব-সংস্কৃতির একটি বিশেষ অঙ্গ হচ্ছে ‘গাজন’। গাজন অর্থে (গাঁ= গ্রাম, জন= জনগণ) গ্রামের জনগণের নিজস্ব উৎসব। নবদ্বীপ মহিমার লেখক কান্তিচন্দ্র রাঢ়ি ‘গাজন’-কে ধর্মগাজনের অপভ্রংশ বলেছেন। গাজন বিষয়ে ভারতকোষকার জানিয়েছেন, “বাংলাদেশের লৌকিক উৎসব। ইহা নিম্নশ্রেণির লোকের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। … বাংলাদেশে ইহা নানা পৌরাণিক ও লৌকিক দেবতার নামের সহিত যুক্ত হইয়াছে, যেমন শিবের গাজন, ধর্মের গাজন, নীলের গাজন, আদ্যের গাজন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই উৎসবের লক্ষ্য সূর্য এবং তাহার পত্নী বলিয়া কল্পিত পৃথিবী। সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীর বিবাহ দেওয়াই এই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য। চৈত্র মাস হইতে বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্য যখন প্রচণ্ড অগ্নিময় রূপ ধারণ করে তখন সূর্যের তেজ প্রশমন ও সুবৃষ্টির আশায় কৃষিজীবী সমাজ এই অনুষ্ঠানের উদ্ভাবন করিয়াছিল। গ্রাম্য শিবমন্দিরকে কেন্দ্র করিয়া এই উৎসবের অনুষ্ঠান হয়।”
যে শিবকে সারা বছর আগলে রাখেন ব্রাহ্মণেরা, গাজনের কদিন সেই শিব সমাজের নিম্ন কোটির মানুষের হাতে পূজা গ্রহণ করেন। এখানে কোনও ভেদাভেদ নেই, জাত নেই, কুল নেই, উচ্চবর্ণের অবজ্ঞা অবহেলা নেই। এ কদিন সবাই সমান মর্যাদায় সমাসীন। এখানেই শৈব সংস্কৃতির সঠিক উত্তরণ। গাজনের সময় শিব প্রকৃত অর্থে গণদেবতা।
গাজন যে মূলত শিবকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয় তা আগেই বলা হয়েছে। তবে বাংলায় অতীতে জৈন ধর্মের অস্তিঃত্ব থাকায় শিব ছাড়াও আরও অনেক দেবতা পূজিত হন। তাঁদের মধ্যেই একজন হলেন ধর্ম ঠাকুর। যিনি সূর্যের দেবতা হিসেবে পূজিত হন। প্রাক্ দ্রাবিড় যুগ থেকেই রাঢ় অঞ্চলে ধর্ম ঠাকুরের পূজা হয়ে আসছে। লোকবিশ্বাস ধর্ম ঠাকুরের পূজা প্রসঙ্গে বলা চলে, বাংলার বহু গ্রামে নরনারী রোগ থেকে সুস্থ হবার জন্য, নিঃসন্তান দম্পতি সন্তান লাভের আশায় এবং চাষীরা অনাবৃষ্টিতে বৃষ্টি হওয়ার আশায় এই পূজা করে থাকেন। একটি নিরাকার পাথরকে, গাছের মাঝখানে বা মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে পূজা করা হয়। সারাবছর ধরে পূজিত হন ধর্ম ঠাকুর। পূর্ণিমাতে বিশেষ পূজার আয়োজন ও করা হয়। তবে অনেক স্থানে কুর্মামূর্তি, চৌকো, কোথাও বা একাধিক শিলাখন্ড কে পূজা করা হয়ে থাকে। ধর্ম ঠাকুরের পূজারী মূলত ডোম, বাগদী, জেলে হলেও অনেক স্থানে ব্রাহ্মন পূজারী ও রয়েছেন।
ধর্মরাজের বাৎসরিক পূজা বা গাজন-উৎসব সাধারনত বৈশাখী বুদ্ধ পূর্ণিমা, জৈষ্ঠ পূর্ণিমা, পৌষ সংক্রান্তি বা কোন নির্ধারিত দিনে (যা ‘আপন-গাজন’ নামে পরিচিত) অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ধর্মরাজের গাজনেও শিবের গাজনের মতো বাণফোঁড়া, কাটাঝাঁপ, ধুনা পোড়ানো, বটিঁ ঝাঁপ ইত্যাদি হয়ে থাকে ।
বর্ধমান জেলায় শতাধিক ধর্ম ঠাকুরের পূজা-উৎসব, অনুষ্ঠান বিভিন্ন রীতি বা পদ্ধতিতে, বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন সম্প্রদায় কতৃক অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ধর্ম ঠাকুরের বাৎসরিক পূজা ও উৎসব উপলক্ষে জেলার বিভিন্ন স্থানে মেলা ও বসে। যার মধ্যে জামালপুরের মেলাটি সব থেকে বড়।
ওদিকে শিব বা মহাদেব ‘নীল’ নামেও পরিচিত। নীলের বিবাহ হচ্ছে পার্বতীর সাথে। তাদের বিয়ে উপলক্ষেই এই গাজন পালিত হয়ে থাকে। বিশেষত বিবাহিত মহিলারা শিবকে পূজা করে থাকেন। সারাদিন উপবাস যাপন করার পর তারা শিবের মাথায় দুধ ঢেলে উপবাস ভেঙে থাকেন। সন্তানের মঙ্গল কামনায় এই পূজা করা হয়ে থাকে। এই গাজন ও চৈত্রমাসে হয়ে থাকে।
প্রাগ্-বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত শিব পূজা পেয়ে আসছেন। মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা সভ্যতায় ও শিব পূজার নির্দশন মেলে। রাঢ় অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ও শিব পূজা খুবই জাঁকজমক সহকারে পালিত হয়। তাই বাংলার মানুষের কাছে ‘শিব’ হলেন তাঁদের ঘরের লোক। আর এই শিবের পূজাতে যে তাঁরা আনন্দে মেতে উঠবেন তা বলাই বাহুল্য। এই আনন্দেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে গাজনের মধ্যে দিয়ে। চৈত্র সংক্রান্তির সময় অনুষ্ঠিত গাজন মূলত শিবের গাজন নামেই পরিচিত। শিবের গাজনের ব্যাপারে একটি পৌরানিক কাহিনী কথিত আছে। বলা হয়, শিব এর সাথে পার্বতী বা হরকালীর বিবাহ হচ্ছে এবং এই বিবাহতে খুশি হয়েই শিবভক্তরা নাচ গান করে থাকে। চড়ক হল এই গাজনের এক আনন্দময় প্রকাশ। চড়ক পূজাতে একটি চড়ক গাছকে পূজা করা হয় এবং সন্ন্যাসীরা সেই চড়ক গাছের চারপাশে ঘুরে বিভিন্ন ধরনের ব্রত কর্ম পালন করে থাকেন।
গাজনের রীতি অনুযায়ী চৈত্র সংক্রান্তির ১০/১৫ দিন আগেই গ্রামীণ পুরোহিতের উপদেশে কয়েকজন স্নান করে পুরোনো বস্ত্র ত্যাগ করে নতুন বস্ত্র ও উত্তরীয় ধারণ করেন। নিজস্ব গোত্র ত্যাগ করে শিবগোত্র ও ধারণ করেন। এরা হলেন গাজনের সন্ন্যাসী। গাজনের এই সন্ন্যাসীদের ভক্ত্যা বা ভক্তিয়া বলা হয়। এই সন্ন্যাসীরা যে কোন সম্প্রদায় থেকে আসতে পারেন। ব্রতপালন , সংযমরক্ষা, হরিষ্যন্ন ভোজন, ব্রহ্মচর্য পালন, চুল দাড়ি না কাটা ইত্যাদি নিয়ম পালন করে থাকেন। এদের মধ্যে একজন থাকেন মূল বা প্রধান ভক্ত্যা। এনার নির্দেশেই বাকিরা এই সব নিয়ম পালন করে থাকে। গাজন পর্বের শুরুতেই ভক্ত্যারা বানেশ্বর কাঁধে নিয়ে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষে করে বেড়ান। এই সময় তাদের বাড়ির বা পরিবারের কারোর সাথে কোন সম্পর্ক থাকে না রাখার নিয়ম নেই। বাড়ি যাওয়া বা বাড়ির অন্নজল গ্রহন করার নিয়ম নেই। গাজনের অন্যতম অঙ্গ হল কৃচ্ছ কর্ম সাধন। সন্ন্যাসীরা নিজেদের বিভিন্ন ভাবে শারিরীক কষ্ট দিয়ে তা করে থাকেন। বাঁণফোড়া, কাটান, ঝাঁপান ইত্যাদি হল এর অংশ। পেরেক বা সূচ দিয়ে নিজের শরীর কে বিদ্ধ করা, একটি উঁচু বাঁশের মাথা থেকে আগুনে ঝাঁপ দেওয়া এ সবই এই গাজনের অংশ।
চড়ক পূজা গাজন উৎসবের একটি অঙ্গ। চৈত্রের শেষ দিনে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয় এবং বৈশাখের প্রথম দু-তিন দিনব্যাপী চড়ক পূজার উৎসব চলে।
লিঙ্গপুরাণ, বৃহদ্ধর্মপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে চৈত্র মাসে শিবারাধনা প্রসঙ্গে নৃত্যগীতাদি উৎসবের উল্লেখ থাকলেও চড়ক পূজার উল্লেখ নেই। পূর্ণ পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত গোবিন্দানন্দের বর্ষক্রিয়াকৌমুদী ও রঘুনন্দনের তিথিতত্ত্বেও এ পূজার উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে পাশুপত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীনকালে এ উৎসব প্রচলিত ছিল। উচ্চ স্তরের লোকদের মধ্যে এ অনুষ্ঠানের প্রচলন খুব প্রাচীন নয়। জনশ্রতি রয়েছে, ১৪৮৫ খ্রিষ্টাব্দে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামের এক রাজা এই পূজা প্রথম শুরু করেন।
কথিত আছে, এই দিনে শিব-উপাসক বাণরাজা দ্বারকাধীশ কৃষ্ণের সংগে যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে মহাদেবের প্রীতি উৎপাদন করে অমরত্ব লাভের আকাঙ্ক্ষায় ভক্তিসূচক নৃত্যগীতাদি ও নিজ গাত্ররক্ত দ্বারা শিবকে তুষ্ট করে অভীষ্ট সিদ্ধ করেন। সেই স্মৃতিতে শৈব সম্প্রদায় এই দিনে শিবপ্রীতির জন্য উৎসব করে থাকেন।
গম্ভীরাপূজা বা শিবের গাজন এই চড়কপূজারই রকমফের। চড়ক পূজা চৈত্রসংক্রান্তিতে অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিবসে পালিত হয়। এ পূজার বিশেষ অঙ্গের নাম নীলপূজা। পূজার আগের দিন চড়ক গাছটিকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয়। এতে জলভরা একটি পাত্রে শিবের প্রতীক শিবলিঙ্গ বা সিঁদুরমথিত লম্বা কাঠের তক্তা (‘শিবের পাটা’) রাখা হয়, যা পূজারিদের কাছে “বুড়োশিব” নামে পরিচিত। পতিত ব্রাহ্মণ এ পূজার পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন। পূজার বিশেষ বিশেষ অঙ্গ হলো কুমিরের পূজা, জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর হাঁটা, কাঁটা আর ছুঁড়ির ওপর লাফানো, বাণফোঁড়া, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য, চড়কগাছে দোলা এবং দানো-বারনো বা হাজরা পূজা করা।
এই সব পূজার মূলে রয়েছে ভূতপ্রেত ও পুনর্জন্মবাদের ওপর বিশ্বাস। এর বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রাচীন কৌমসমাজে প্রচলিত নরবলির অনুরূপ। পূজার উৎসবে বহু প্রকারের দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়। চড়কগাছে ভক্ত্যা বা সন্ন্যাসীকে লোহার হুড়কা দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয়। তাঁর পিঠে, হাতে, পায়ে, জিহ্বায় এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে বাণ শলাকা বিদ্ধ করা হয়। কখনো কখনো জ্বলন্ত লোহার শলাকা তাঁর গায়ে ফুঁড়ে দেয়া হয়। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার আইন করে এ নিয়ম বন্ধ করলেও গ্রামের সাধারণ লোকের মধ্যে এখনো তা প্রচলিত আছে।
পূজার উদ্যোক্তা ভক্ত্যা বা সন্ন্যাসীরা চড়ক পূজার কয়েকদিন আগে থেকে কঠোর ব্রত ও সংযম পালন করেন। একজনকে সাজানো হয় হনুমানের মত লম্বা লেজ দিয়ে, তার মাথায় থাকে উজ্জ্বল লাল রঙের ফুল; স্থানবিশেষে রামায়ণ কাহিনির হনুমানের গন্ধমাদন পর্বত আনার দৃশ্য অভিনীত হয়, একে বলে ‘গিরি সন্ন্যাস’। এরপর সন্ন্যাসীরা মহাসমারোহে আমগাছ থেকে একাধিক ফলসমেত একটি শাখা ভেঙে আনেন, এর নাম ‘বাবর সন্ন্যাস’। চড়কপূজার আগের দিন নীলচণ্ডিকার পূজা হয় (যা মূলত নীলপূজা নামে পরিচিত), এদিন কয়েকজনের একটি দল সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। দলে থাকে একজন শিব ও দু’জন সখী। সখীদের পায়ে থাকে ঘুঙুর। তাদের সঙ্গে থাকে ঢোল-কাঁসরসহ বাদকদল। সখীরা গান ও বাজনার তালে তালে নাচে। এদেরকে দেল বা নীল পাগলের দল’ও বলা হয়। এরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে গাজনের গান গায় এবং নাচ-গান পরিবেশন করে। বিনিময়ে দান হিসেবে যা কিছু পাওয়া যায় তা দিয়ে হয় পূজা। এদিন রাতে ‘হাজরা পূজা’ হয় এবং শিবের উদ্দেশ্যে খিচুড়ি ও শোলমাছ নিবেদিত হয়। মাঝরাতে শিবের আরাধনার সময়ে দু’একজন সন্ন্যাসী প্রবলবেগে মাথা ঘুরিয়ে মন্ত্র বলতে বলতে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন; এই অবস্থাকে দেবতার ‘ভর’ বলা হয়। এসময় তাঁরা দর্শকমণ্ডলীর প্রশ্নের যা যা উত্তর দেয় তা অভ্রান্ত বলে সাধারণ বিশ্বাস করে।
চড়কের দিন সন্ন্যাসীরা বিশেষ বিশেষ ফল, ফুল নিয়ে বাদ্য সহকারে নানা ভঙ্গিমায় শিবপ্রণাম করে। এছাড়া, দেবতার অবিচল ভক্তি ও নিষ্ঠা প্রদর্শনের জন্য তারা ধারালো বঁটি, গাছের কাঁটার উপর ঝাঁপ দেন কিংবা পা’দুটি উপরে মাথা নিচের দিকে রেখে ঝুলে থাকেন। এগুলি যথাক্রমে ‘বঁটি-ঝাঁপ’, ‘কাঁটা-ঝাঁপ’ ও ‘ঝুল-ঝাঁপ’ নামে পরিচিত। আরো আত্মনির্যাতনের জন্য আড়াই থেকে চার-পাঁচ ইঞ্চি লম্বা একটি লৌহশলাকা সারাদিন জিভে বিদ্ধ করে রেখে সন্ধ্যার আগে পুকুরে গিয়ে সেটি খুলে ফেলে দেওয়া হয়, এর নাম ‘বাণ-সন্ন্যাস’। পিঠের দুদিকে চামড়া ভেদ করে একটি সরু বেত প্রবেশ করিয়ে দেওয়াকে বলে ‘বেত্র-সন্ন্যাস’। আর চড়ক গাছটি চড়কতলায় প্রোথিত করে তার মাথায় আরেকটি কাষ্ঠখণ্ড মধ্যস্থলে ছিদ্র করে স্থাপন করা হয়, যাতে চড়কগাছকে কেন্দ্র করে কাষ্ঠখণ্ডটি শূন্যে বৃত্তাকারে ঘুরতে পারে। এর একপ্রান্তের ঝোলানো দড়িতে একজন সন্ন্যাসী (আগেকার সময়ে সন্ন্যাসীরা পিঠের চামড়া ভেদ করে শিরদাঁড়াতে বঁড়শির মত বাঁকানো একটি লোহার কাঁটা গেঁথে ঝুলে থাকতেন) কোমরে গামছা বা কাপড় বেঁধে ঝুলে থাকেন, অপরপ্রান্তে কাষ্ঠখণ্ডটিকে চক্রাকারে চরকির মত ঘোরানো হয়; এই প্রক্রিয়াটির নাম ‘বড়শি সন্ন্যাস’।
সেকালে চড়ক উৎসবের গোটা উৎসবটাই শুরু হত কালীঘাটে। কলকাতা এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের গাজন সন্ন্যাসীরা ভোরবেলায় চলে যেতেন কালীস্থানে। এদের সঙ্গে থাকত বাদ্যযন্ত্র, অশ্লীল সঙ, সঙ্গীত, অভিনয় আর যথেষ্ট নানান ধরণের অঙ্গ ভঙ্গী। কালীঘটে বাণ ফুঁড়ে গাজনের দল বেরিয়ে পড়ত শহরের পথে পথে। মোটের উপর এই উৎসবের প্রাণকেন্দ্রই ছিল কালীঘাট।
অতীতের কালীঘাটে কেমন হত গাজন সন্ন্যাসীদের চড়ক উৎসব? আজ থেকে প্রায় ১৮৪ বছর আগে কথা। শহর কলকাতায় শ্রীমতী ফ্যানি পার্কস এসেছিলেন ১৮২২ সালের নভেম্বর মাসে। ইংল্যান্ড থেকে দেশভ্রমণে বেরিয়ে নানা দেশ ঘুরে শেষে এসেছিলেন ভারতবর্ষে। তখন এদেশে ইংরেজদের প্রথম ও প্রধান দর্শনীয় আকর্ষক স্থান ছিল কলকাতা। ‘কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে প্রসিদ্ধ গবেষক বিনয় ঘোষ লিখেছেন ফ্যানির অভিজ্ঞতার টইটম্বুর ভ্রমণ বৃত্তান্ত-এ (১৮২২-১৮২৮) কালীঘাটে চড়ক উৎসবে গাজন সন্ন্যাসীদের বিভৎস ও যন্ত্রণাদায়ক বর্ণনার কথা। এক জায়গায় ফ্যানি লিখেছেন –
“চড়ক পূজা।। একদিন ঠিক করলাম (চৈত্রসংক্রান্তির দিন) কালীঘাটে মন্দির ও জাগ্রত কালী দর্শন করতে যেতে হবে। চৌরঙ্গি থেকে প্রায় মাইল দেড়েক দক্ষিণে কালীঘাটের কালীমন্দির। ঘোড়াগাড়ি করে কালীঘাট যাত্রা করলাম সন্ধ্যাবেলা। পথে এক দৃশ্য দেখলাম, উৎসবের দৃশ্য অবিস্মরণীয়। দেখলাম হাজার হাজার লোক রাস্তায় ভিড় করে রয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিসের ভিড়’? শুনলাম, চড়ক পূজার উৎসব হচ্ছে। দীর্ঘ একটা কাষ্ঠদন্ডের মাথায় হুকবিদ্ধ হয়ে ঘুরপাক খাওয়া চড়ক পূজার প্রধান বৈশিষ্ট্য। কতরকমের লোক যে কত বিচিত্র বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে জড়ো হয়েছে সেখানে তার ঠিক নেই। তার মধ্যে সর্বপ্রথম স্বচক্ষে দেখলাম এদেশের বৈরাগী সাধুদের। সর্বাঙ্গে তাদের ভস্ম মাখা, মাথায় লম্বা লম্বা জটা, পরনে একটুকরো কাপড় জড়ানো, প্রায়-নগ্ন বলা চলে। একজন বৈরাগী তার শীর্ণ হাত দুটি মাথার উপর তুলে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে রয়েছে, অসাড় হয়ে গেছে হাত ও দেহ, পাখির মতোন আঙুলের ধারালো লম্বা লম্বা নখগুলি হাতের পিছন থেকে বিঁধে ফুঁড়ে বেড়িয়েছে ভিতরের তেলো দিয়ে। ভগবান বিষ্ণুর কাছে মানতের জন্য সে এই ভয়ংকর ক্লেশ স্বীকার করছে। নখগুলি প্রথমে বিদ্ধ হবার যন্ত্রণা হয় নিশ্চয়, কিন্তু পরে হাত অসাড় হয়ে গেলে আর কোন যন্ত্রণা থাকে না। এই শ্রেণীর আত্মপীড়নদক্ষ সাধুকে সকলে খুব পূণ্যবান মনে করে, কারণ ভগবানের পরম প্রিয়পাত্র না হলে এরকম কষ্টস্বীকার করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই দেখলাম সকলে ভক্তি-গদগদচিত্তে তার সাধুত্বের তারিফ করছে খুব।আরও কয়েকজন সাধু মাথার উপরে একহাত তুলে চক্ষু উলটে বসেছিল। একদল নীচজাতের হিন্দু বাহুর মাংসপেশী এফোঁড়-ওফোঁড় ছিদ্র করে তার ভিতর দিয়ে বাঁশের লাঠি ও নৌকাশলাকা পুরে ঢোলের বাজনার তালে তালে বীভৎস ভঙ্গিতে তাণ্ডবনৃত্য করছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ লৌহশলাকা দিয়ে জিব ফুঁড়ে বাহাদুরি দেখাচ্ছিল জনতার কাছে। কয়েকগজ দূরে তিনটি বড় বড় কাঠের খুঁটি মাটিতে পোঁতা ছিল। প্রায় তিরিশ ফুট লম্বা এক-একটি খুঁটি, তার মাথায় আড়ে একটি বা দুটি করে বাঁশ বাঁধা। যে খুঁটির মাথায় একটি বাঁশ বাঁধা তার একদিকে একটি লোক ঝুলে রয়েছে,আর একদিকের লম্বা দড়ি ধরে নিচের লোকজন খুঁটির চারিদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে এবং উপরে ঝুলন্ত লোকটিও তার ফলে ঘুরছে বন্ বন্ করে। যে-খুঁটির মাথায় দু’টি বাঁশ ক্রস করে বাঁধা আছে তাতে আরও বেশি লোক ঘুরছে। আশ্চর্য ব্যাপার হল, উপরের লোকগুলি হুকবিদ্ধ হয়ে ঝুলছে ও ঘুরছে, এবং তাদের বুকে ও পিঠে সেই হুকগুলি বিঁধে রয়েছে। উপরের লোকটি খুঁটির মাথায়, বাঁশের ডগায় ঘুরছে তো ঘুরছেই, আর নিচের লোকজন উন্মত্তের মতন তাদের পাক দিচ্ছে তো দিচ্ছেই। ঘোরার শেষ নেই, পাকেরও শেষ নেই। উপরে ঘুরছে যারা তারা বোধ হয় বেশি পুণ্যবান, কারণ একটি থলি ভর্তি করে ফুল-বাতাসা নিয়ে উপর থেকে তারা ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং নিচের লোকজন মহাউল্লাসে সেগুলি কুড়িয়ে নিচ্ছে দেবতার প্রসাদের মতন। কেউ কেউ বুকেপিঠে কাপড় না জড়িয়েই হুকবিদ্ধ হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিল। প্রচুর পরিমানে নেশা করে, গাঁজা-আফিম খেয়ে তাদের তাদের চোখেমুখের চেহারা পিশাচের মতন ভয়ংকর দেখাচ্ছিল।নীচজাতের হিন্দুরা শুনেছি চড়কপূজার অত্যন্ত ভক্ত। পূজা-উৎসবে যোগদানকারীদের মধ্যে তাদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি।
এরকম একটা পৈশাচিক ভয়াবহ উৎসব আর কোথাও দেখিনি। এই ধরনের উৎসবে দুর্ঘটনা ঘটাও স্বাভাবিক। চড়কপূজায় শতকরা তিন-চারজন মারাও লোক মারাও যায়। ধনীলোকেরা টাকাপয়সা দিয়ে গাজনের সন্ন্যাসীদের চড়কপাঠে চরকিপাক খাওয়ান পুণ্যার্জনের জন্য। এইভাবে প্রকসি দিয়েও নাকি পুণ্যলাভ করা যায়।উৎসবে ছ্যাকরা গাড়ি ভর্তি হয়ে বাইজীরাও এসেছিল অনেক। যেমন তাদের পোশাক তেমনি নাচ-গানের ভঙ্গি। যাঁর রুচি আছে তাঁর পক্ষে বরদাস্ত করা কঠিন। কিন্তু এই বাইজীনাচ দেখার জন্য বহু হিন্দু ভদ্রলোকের ভিড় হয়েছিল উৎসবে।”
১৮৩৩ সালের ২৭শে এপ্রিল ‘জ্ঞানাণ্বেষণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল চিৎপুরের রাস্তায় ঢাকের মহাশব্দের সঙ্গে বেরোনো বিশাল গাজনের সঙ-এর কথা। তবে দুর্নীতিগ্রস্ত লোকেদের ঠাট্টা তামাসা, প্রশাসনিক ও পুরসংস্থা প্রভৃতির দুর্নীতি, ধর্মীয় ও শিক্ষাজগতের অনাচার ইত্যাদিকে ভিত্তি করে বিচিত্র সমারোহে পরিকল্পিত নানান ধরণের গান বেঁধে গাইত উচ্চস্বরে। অধিকাংশ গানগুলি ছিল রীতিমতো অশ্রাব্য, অশ্লীল। এ ছাড়াও অতিরিক্ত মদ্যপান, শারীরিক পীড়ন ইত্যাদি বিষয়গুলি জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে থাকে, এমনটা ভেবেই হয়তো প্রতিবছর কালীঘাট থেকে বাণ ফুঁড়ে আসা সঙ ও সন্ন্যাসীদের উদ্দেশে “পোলিসের সুপারিটেন্ডেন্ট এফ ডবলিউ বর্ট, ৩ আপ্রিল ১৮৩৯, ২৫ চৈত্র ১২৪৫”, পথ পরিবর্তনের নির্দেশ ঘোষণা করেন এবং ৬ই এপ্রিল ১৮৩৯সালে একটি বিজ্ঞাপনও দেন সংবাদপত্রে –
“বিজ্ঞাপন। সম্বাদ দেওয়া যাইতেছে যে চড়ক পূজা সময় কাঁলীঘাট হইতে যে সন্ন্যাসিরা শহরের মধ্যে দিয়া আসিত তাহারা পূর্ব্ব ২ বৎসরের ন্যায় বর্ত্তমান বৎসরে চৌরঙ্গী ও কসাই টোলার রাস্তা দিয়া আসিতে পারিবে না কিন্তু ভবানীপুর হইতে শহরের মধ্যে আইলে ভবানীপুর হইতে সারকিউলর রোড অর্থাৎ বাহির রাস্তা দিয়া নং ৯ সেদয়ার ফাঁড়ি অর্থাৎ মুনসির বাজার এবং ৮ অর্থাৎ রাজা রামলোচনের বাজার গিয়া গমনপূর্ব্বক চিৎপুর পর্যন্ত্য পঁহুছিবেক তথায় পঁহুছিয়া তাহারা উত্তর দিগে স্ব২ বাটীতে চলিয়া যাইবে।”
মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহের (১৮৪০-১৮৭০) জন্মের অনেক আগেই চড়কপুজোর কদর্যতা নিয়ে সমকালীন পত্রিকাতে কিছু লেখালিখি হলেও এতটুকও হেলদোল হয়নি চড়কিদের প্রচলিত ধর্মাচরণে, প্রশাসনের প্রচেষ্টায়। এই উৎসবের উৎসটা যে সেকালের কালীঘাট ছিল তার প্রমাণ তো সিংহীমশাই-এর ‘হুতোম প্যাঁচার নকসা’ –
…”ক্রমে গির্জ্জের ঘড়িতে ঢং ঢং করে সাতটা বেজে গ্যাল। সহরে কানপাতা ভার। রাস্তায় লোকারণ্য, চারদিকে ঢাকের বাদ্যি, ধুনোর ধো, আর মদের দুর্গন্ধ। সন্ন্যাসীরা বাণ, দশলকি, সুতোশোন, সাপ, ছিপ ও বাঁশ ফুঁড়ে একেবারে মরিয়া হয়ে নাচতে নাচতে কালীঘাট থেকে আসচে।”…
১৮৬৩ মতান্তরে ১৮৬৫ সালের কথা। ছোটলাট বিডন রোধ করলেন এই নাটকীয় প্রথা। এক ইস্তহার জারি করে চড়কের প্রচলিত প্রথা ও মিছিল আইন অনুসারে দণ্ডনীয় বলে ঘোষণা করলেন তিনি। সেই থেকে গাজন সন্ন্যাসীরা চড়কগাছে পাক খেত পিঠে গামছা বেঁধে, কাঁটা ফুঁড়ে নয়। একইসঙ্গে এই উৎসবের মূলকেন্দ্র কালীঘাট ও ভৈরব নকুলেশ্বর মহাদেব মন্দির মুক্ত হল অমানবিক এক নারকীয় প্রথা থেকে।
এ যুগে আমরা টেলিভিশনে ‘কমেডি’ নাটক, সিনেমা দেখি। ‘সঙ’ শব্দটি পরিচিত হলেও সত্যিকার সঙ দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। তবে নিত্যদিনের কথাবার্তায় এখনো দরকারমতো বলে ফেলি, ‘সঙ সাজার দরকার নেই!’ পণ্ডিতদের মতে, মানুষের নাটকীয় ভাব প্রকাশের সবচেয়ে প্রাচীন ও সর্বজনীন মাধ্যম হলো সঙ। তারপর একসময় এই সঙ নাট্যকলায় যুক্ত হয়ে পড়ে। ভারতীয় ও মিসরীয় সভ্যতায় প্রাচীনকালেই সঙের প্রচলন ছিল। প্রাচীন গ্রিসেও ছিল, তবে গ্রিসের বিশেষত্ব ছিল সেখানে সঙদের অভিনয় ছিল দেবতা ও বীরদের জীবন সম্পর্কে। গ্রিকদের এ চর্চা রোমানরাও গ্রহণ করেছিল। তবে রোমকরা সেখানে কিছু নতুনত্ব এনেছিল। রোমান সঙরা তৎকালীন রীতিনীতি ও সামাজিক আচার অনুষ্ঠানকে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করতেন। রোমান সাম্রাজ্যে সঙদের চর্চা জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, তাই সঙবিদ্যা শেখানোর জন্য বিদ্যায়তনও স্থাপিত হয়েছিল। এশিয়ায় সঙের প্রচলন প্রসঙ্গে তিব্বতের কথা আলোচনা করা যায়, সেখানে চৈত্র মাসে মানুষ দেবতা ও দানবদের বেশ ধরে নাচ, গান, অভিনয় করত। স্বামী অভেদানন্দ লিখেছেন, ‘তাহারা পিশাচাশ্রিত বৃক্ষ, প্রস্তর, সর্প প্রভৃতি পূজা করিত এবং ভূতের বিকট মূর্তির মুখোশ পরিয়া দানাই নৃত্য করা এই পূজার প্রধান অঙ্গ ছিল।’
অন্যদিকে বাংলায় সঙ নিয়ে মাতামাতি হতো মূলত পূজার উৎসবকে কেন্দ্র করে। এ সময় সঙ বের হতো, উদ্দেশ্য ছিল মূলত মানুষকে বিনোদন দেয়া। চৈত্রসংক্রান্তিতে গাজনের দল পথে নামত ঢাক ও কাঁসি নিয়ে, বাদ্য বাজিয়ে তারা পরিবেশ মাতিয়ে তুলত, সঙ্গে থাকত সঙ। বাংলাদেশের সঙ প্রসঙ্গে গ্রন্থের লেখক সঙ সংস্কৃতির বিশিষ্ট গবেষক বীরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের বিভিন্ন পূজা-পার্বণে সঙ বের করার প্রথা বহুদিন থেকে চলে আসছে। সকলকে আনন্দ দেবার জন্যেই সেকালের মানুষ পূজা-পার্বণে সঙ বের করতেন। মুখ্যত চিত্তবিনোদনের জন্যেই সঙের সৃষ্টি হয়েছিল।’ আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘গৌড়-বঙ্গের প্রাচীন সংস্কৃতির এক অভিনব বিকাশ হইতেছে গত কয়েক শত বৎসর ধরিয়া প্রচলিত চিত্তবিনোদনের ধারা— ‘সঙ্(সং)’।
চৈত্রই শুধু নয়, বাংলায় বছরের বিভিন্ন সময়ই সঙদের দেখা যেত। পূজা-পার্বণ কিংবা বিয়েবাড়ি, নানা আমোদ-প্রমোদে সঙদের দেখা যেত। সেকালে ধনী ব্যক্তিদের বাড়িতে উৎসব-অনুষ্ঠানে গান-বাজনা, বাই নাচ প্রভৃতি আমোদ-প্রমোদ হতো, সেই সঙ্গে হাস্য-কৌতুকের জন্য থাকত সঙের আয়োজন। ১৮২৩ সালের ২০ ডিসেম্বরে সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সংবাদ এ রকম – ‘নতুন গ্রহ সঞ্চয়। মোং কলিকাতা ১১ দিসেম্বর ২৭ অগ্রহায়ণ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পরে শ্রীযুক্তবাবু দ্বারিকানাথ ঠাকুর স্বীয় নবীন বাটীতে অনেক দুই ভাগ্যবান সাহেব ও বিবীরদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া আনাইয়া চতুর্ব্বিধ ভোজনীয় দ্রব্য ভোজন করাইয়া পরিতৃপ্ত করিয়াছেন এবং ভোজনাবসানে ঐ ভবনে উত্তম গানে ও ইংগ্লণ্ডীয় বাদ্য শ্রবণে ও নৃত্য দর্শনে সাহেবগণে অত্যন্ত আমোদ করিয়াছিলেন। পরে ভাঁড়েরা নানা শং করিয়াছিল কিন্তু তাহার মধ্যে গো বেশ ধারণপূর্ব্বক ঘাস চর্ব্বণাদি করিল।’
সঙ নানা ধরনের বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে, কৌতুকপূর্ণ গান গেয়ে, ছড়া কেটে মানুষকে হাসাত। যাত্রার আসরেও সঙদের দেখা যেত। নাটকেও তাদের উপস্থিতি দেখা যেত। নাটকে সঙদের উপস্থিতি প্রসঙ্গে হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ বলেছেন, “বাঙ্গালা নাটক রচিত হইবার পূর্ব্বে যে যাত্রা প্রচলিত ছিল, তাহাতে রঙ্গমঞ্চের প্রয়োজন হইত না— ভূমিতেই ‘আসর’ রচনা করা হইত এবং দৃশ্যপটের ব্যবহার ছিল না। সাধারণত পৌরাণিক ঘটনাবলম্বনেই অভিনয়ের ‘পালা’ রচিত হইত। কিন্তু সকল শ্রেণীর লোকের মনোরঞ্জনের জন্য যাত্রা গাহনা হইত বলিয়া সময় সময় অকারণ হাস্যোদ্দীপন জন্য সং আনিতে হইত। সং আসরে আসিয়া যে অভিনয় করিত তাহা সকল সময় সুরুচিসম্মত হইত না এবং সে সময় সময় অবান্তর উক্তি করিত।”
যাত্রাপালা জমে না উঠলে আয়োজকরা দর্শকদের আকর্ষণ করতে মঞ্চে সঙ নামাতেন। এ সঙরা নানা অশালীন গান গাইত, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গিও করত। আঠারো কিংবা উনিশ শতকে কলকাতা শহর ও আশপাশে যেসব গান গাওয়া হতো, সেগুলো আজকের নৈতিকতার মানদণ্ডে অশ্লীলই শোনায়। এ নৈতিকতা, শ্লীলতার মানদণ্ড এ উপমহাদেশে আমদানি হয়েছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ রাজশক্তির হাত ধরে। বাইজি নাচ মূল মিশনারি পাদ্রি ও ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিতদের বিরোধিতায়ই বিলুপ্ত হয়। তত্কালীন ইংরেজ সাহেব ও মেমদের লেখা বিবরণী পড়লেই দেখা যাবে, তারা হিন্দু সমাজে প্রচলিত নাচ-গান-কথাকে অশ্লীল হিসেবে দেখছেন। ভিক্টোরিয়ান মোরালিটি স্থানীয় চর্চাকে নেতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করে। বহু অঞ্চলেই ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাবে স্থানীয় নীতিনৈতিকতা ধ্বংস হয়ে প্রভুদের দেখানো আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়। ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষও এর ব্যতিক্রম নয়। এক ব্যাপটিস্ট মিশনারি ডব্লিউ ওয়ার্ড ১৮১৮ সালে লিখেছিলেন, ‘The songs of the Hindoos, sung at religious festivals, and even by individuals on boats and in the streets are intolerably offensive to a modest person.’
যাত্রায় সঙদের প্রভাব সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় গিরিশচন্দ্র ঘোষের লেখায়, “থিয়েটারের প্রাদুর্ভাবের পূর্ব্বে কবি, হাফ্-আক্ড়া, পাঁচালী ও যাত্রার প্রাদুর্ভাব ছিল। হাফ-আকড়া, কবি ও পাঁচালীতে গালি-গালাজ চলিত এবং ঐ সকল গালি-গালাজ লইয়া সমাজে সকলে বিশেষ আনন্দ করিত। যাত্রায় বড় একটা কথাবার্তা ছিল না, দু-একটা কথার পর ‘তবে প্রকাশ করে বল দেখি?’ বলিয়া গান আরম্ভ হইত। সেই গানের কতক আদর ছিল, কিন্তু বিশেষ আদর সঙের। সঙ হালকা সুরে গাইত, অপেক্ষাকৃত ভারি অঙ্গের পালার সুর হইতে সঙের সুরের আদর অনেকের নিকট হইত। সঙ গালাগালি দিত। তাহা লোকের বিশেষ প্রিয় হইত। গালাগালির এত আদর ছিল যে, সংবাদপত্রের সম্পাদকে সম্পাদকে অতি অবক্তব্য ভাষায় গালি চলিত এবং ঐ সকল সংবাদপত্রেরই গ্রাহক অধিক হইত, যিনি গালাগালি দিতে সুনিপুণ হইতেন, আদর তাঁহার বেশী ছিল।”
কলকাতার জেলেপাড়ার সঙরা বেশ বিখ্যাত ছিল। জেলেপাড়ার সঙদের নিয়ে ১৯২৭ সালে অমৃত বাজার পত্রিকায় একটি প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিবেদনটির কিছু অংশ—
“Ring out the old
New year’s Procession Passed off Peacefully
The passing of the Bengalee New year in Calcutta on wednesday was marked by the annual pantomime procession popularly known as the `Jeliapara Sang’ and the `Charak Mela’ in the suburbs.”
কথায় বলে হাসির মার বড় মার। হাসি মস্করা, রঙ্গ রসিকতা, ব্যঙ্গকৌতুক এ সব কিছু লোক হাসানোর একটা নিরীহ পন্থা নয়। বিশেষ বিশেষ সামাজিক পরিস্থিতিতে এই আপাত-নিরীহ হাস্যকৌতুক কোনও কোনও মানুষের কাছে একটা প্রয়োজনীয় হাতিয়ার হয়ে ওঠে। উনিশ শতকে কলকাতার বাঙালি নাগরিকদের কাছে হাসি ছিল এমন একটা ‘মার’ এর হাতিয়ার। ‘Sociology of humour’ নিয়ে যাঁরা পড়াশুনো করেছেন তাঁদের অনেকে বলেন ব্যঙ্গকৌতুক আসলে দুর্বলের অস্ত্র। ক্ষমতাবান শত্রুকে কথার মারপ্যাঁচে বশীভূত করা, চারপাশের পরিবেশে অস্বস্তিকর অবস্থায় মোকাবিলা করতে গিয়ে হাসিঠাট্টা আর ব্যঙ্গ বিদ্রুপে নিজেকে সপ্রমাণ করা – এসব কমিকের উৎস। এ রঙ্গময় বঙ্গদেশে উনিশ শতকে সঙের মিছিলে এবং সঙের গানে রস পরিহাস ও কৌতুকে সমাজের অসঙ্গতিকে তুলে ধরা ছিল মুখ্য কথা। হাওড়ার কাসুন্দিয়া থেকে উনিশ শতকে যে সঙ বের হত তারা ছড়া কাটত এই বলে –
“সংসারেতে সাজার ওপর সাজেন যিনি যেথা,তারি ছবি দেখাই সবে সহজ ভাষায় সোজা।সমাজনীতি, ধর্মনীতি, শিক্ষানীতি আদি,বলতে গিয়ে কারো প্রাণে ব্যথা দিই যদি।ক্ষমা করবেন, সবার কাছে এই মোদের মিনতিসত্যের ভাষণ, সত্যের গানই মোদের সঙ-এর নীতি।”
এর উপর আবার প্রশ্ন উঠতে পারে সঙ তাহলে কি? বিভিন্ন পেশার নানা ধরনের মানুষের পোশাক পরে অঙ্গভঙ্গি সহযোগে গান, ছড়া কাটা এসব কিছু দিয়ে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের পরিহাস-উজ্জ্বল অনুকরণ হতে পারে সঙ। রাশিয়ান নাট্যকার হেরাসিম লেবেডফ্ যে দুখানি নাটক এদেশে অভিনয় করেন তার মধ্যে কাল্পনিক সঙ্বদল প্রকৃতপক্ষে সঙবদল বা পরিচ্ছদের পরিবর্তন অর্থাৎ ছদ্ম বেশ ধারণ। উৎসবে, পূজাপার্বণে এ দেশে সঙ বের করার প্রথা বহুদিনের। ‘হুতোম প্যাঁচার নক্শা’য় নানা কিসিমের সঙ এর বর্ণনা আছে —মাটির পুতুল আর জ্যান্ত সাজা সঙ থাকতো ঘেরা কাটরায় আর দরদালানে। নানা সঙের মধ্যে ‘বকা ধার্মিক’ বলে জ্যান্ত সঙের ধরনটি হুতোমের পছন্দসই হয়েছিল — ‘বকা ধার্মিকের শরীরটি মুচির কুকুরের মতো নাদুর — ভুঁড়িটি বিলাতি কুমড়োর মত – গলায় মালা …. চুলে ও গোঁপে কলপ দেওয়া … গত বৎসর আশী পেরিয়েছেন … কিন্তু প্রাণ হামাগুড়ি দিচ্ছে।’ পাতার পর পাতা জুড়ে নানা বিচিত্র সঙের ফিরিস্তি দিয়েছেন হুতোম অর্থাৎ কালীপ্রসন্ন সিংহ। হুতোমের লেখা পড়লে মনে হয় সেকালের কলকাতার সংস্কৃতি যেন সঙের রঙ ঢং-এ মেতে উঠেছে।
চৈত্র সংক্রান্তির দিনে সেকেলে কলকাতায় গাজনের দলের পথে পথে ঢাক ও কাঁসি বাজিয়ে ঘোরা এবং সঙ বার হওয়া ছিল স্বাভাবিক। তাদের শব্দভাণ্ডারে শিক্ষিত সমাজে ব্যবহৃত একশ ভাগ শব্দ ছিল না। তাই তথাকথিত ভদ্র রুচির মানুষ তাদের অশ্লীল আখ্যা দিল। অষ্টাদশ শতকে চড়ক উপলক্ষ্যে সন্ন্যাসী এবং সঙের মিছিলের একটা ছবি এঁকেছেন বিদেশী চিত্রকর স্যার চার্লস ডগলাস। ১৯২৬ সালে কলকাতার মিউনিসিপ্যাল গেজেটে তা ছাপা হয়েছে। যাত্রার আসরেতেও সঙের নাচগানের ব্যবস্থা থাকত। কবি ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছেলেবেলায় নিজে সঙ সেজে অভিনয় করতেন। জনপ্রিয়তার খাতিরে বাংলা শব্দভাণ্ডারে সঙ শব্দটি ঢুকে পড়েছে অনেকদিন। হাওড়ার শিবপুর, খুরুট, মেদিনীপুর, ঢাকা, হাওড়ার রাধাপুর, শ্রীরামপুর, কলকাতায় তালতলা, বেনেপুকুর, খিদিরপুর, কাঁশারীপাড়া আর জেলেপাড়া – এসব নানা জায়গা থেকে সঙ বের হত। জেলেপাড়ার সঙ ছিল খুব বিখ্যাত। কাঁসারী পাড়ার সঙের উৎসাহদাতা ছিলেন প্রখ্যাত ধনী তারকনাথ প্রামাণিক আর হিন্দু পেট্রিয়টের সম্পাদক কৃষ্ণদাস পাল। কাঁসারীপাড়ায় কাট্রাগাড়িতে সঙ ঘুরত। বাড়ির বারান্দায়, ছাদে ও জানালায় আবালবৃদ্ধবনিতা সঙের শোভাযাত্রা দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত। সে-সব দিনে কলকাতা হয়ে উঠত মিলন মেলার নামান্তর। গৃহস্থঘরে অতিথির জন্য তৈরি হত শরবত। থাকত পান তামাকের ব্যবস্থা। দর্শকের জন্য পথের উপর সামিয়ানা টাঙানো হত। নাট্যকার অভিনেতা রসরাজ অমৃতলাল বসু জেলেপাড়ার সঙের দলের জন্য গান রচনা করতেন। অমৃতলাল বসু মারা যাওয়ার পরে ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে রচনা হয়েছিল সঙের গান –
“এ বছরে কপাল পোড়াভেঙে গেল রসের ঘড়াতাই তো এবার সঙের ছড়াহয়নি তেমন মিঠে কড়া।”
সঙের মিছিল বার করত জেলে, কাঁসারী, মুচি, শ্রমজীবী মানুষের দল। ভোরবেলা শুরু হয়ে সায়াহ্নে শেষ হত শোভাযাত্রা। সে শোভাযাত্রায় থাকত মিলিটারি ব্যাণ্ডের নকল, দ্রাবিড় ব্রাহ্মণের দল, ধোবার কাপড় কাচা, ঘানিতে সর্ষের ঘুরপাক, মোসাহেব সর্বস্ব বাবুদের নানা ভড়ং, কৃষ্ণ আর গোয়ালিনীদের প্রেম। ভণ্ড সাধু ভক্তদের কাঁধে চেপে মন্ত্র জপে আর ইতিউতি চায়। সামাজিক প্রথা রীতিনীতি এসব নিয়ে ব্যঙ্গ হত সঙের গানে। কখনও নব্য আইনে বিয়ের প্রথা নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক শ্লেষ — সে মিছিলে বর প্যান্টালুন আর চাপকান পরা। হিন্দুস্থান নর্তকীর সাজে বুট পরা বউ এর হাতে ধরা মস্ত বড় বই। পুরোহিতের সামনে বর ঘোষণা করে সে হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান, জৈন, বৌদ্ধ কিছুই নয় কন্যাও তা শপথ নেয়। তারপর ‘আমেন’ উচ্চারণে বিবাহ শেষ।
ইংরেজ সরকার সঙের মিছিল, গান ও ছড়া রাজনৈতিক আন্দোলনমূলক বলে সন্দেহের চোখে দেখত। সঙের দলের সমালোচনার কুঠার ইংরেজ প্রশাসকদের চাটুকারদের বিরুদ্ধে সদাই ছিল উদ্যত। এদেরকে বিদ্রুপ করে গান বাঁধা হয়েছিল –
“ডাণ্ডা ধরে গাধা পিটলেঘোড়া কভু হয় নাধরে যখন কান মলা দেয়তখন বাঁকা থাকতে পারে না।”
তথাকথিত ইঙ্গবঙ্গ যুবককে নিয়ে লেখা সঙের গান –
“এখন ছেলেরা এক নতুন টাইপচোদ্দ না পেরতে পাকা রাইপমুখে আগুন ঢুকিয়ে পাইপএকমাত্র life ধারণ wife এর চরণ কর্ত্তে ধ্যানএরা নতুন অর্থ করেন গীতারভুল ধরেন পরম পিতারনৈলে কি তার trial বিনা in হয়।”
সঙের দল হাস্যকর অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে ছড়া বলতে শুরু করলে জনতার মধ্যে হাসির রোল উঠত। হাসির, হাসানোর নানা রঙ ঢং দেখিয়ে সঙ ছড়া কাটত –
“হাসি হাসব না তো কিহাসির বায়না নিয়েছিহাসি ষোল টাকা মণহাসি মাঝারি রকমহাসি বিবিয়ানা জানেহাসি গুড়ুক তামাক টানেহাসি প্যরা গুড়ের সেরাহাসি হুজুর করে জেরা।”
জমাদার ছিল খিদিরপুরের সঙের মুখ্য বিষয়। জমাদার এখানে সমাজের জঞ্জাল দূর করার প্রতীক। এদের লক্ষ্যভেদ ছিল অভ্রান্ত। সেকালে থিয়েটারে অভিনয়ে সঙ সেজে দর্শকদের মনোরঞ্জন করা হত। গোয়েন্দা বিভাগ সে সময়ে দুটো যাত্রার কথা উল্লেখ করেছিল ‘মহিষাসুর বধ’ এবং ‘মরুৎযজ্ঞ’। এদের রাষ্ট্রদ্রোহী সঙের অভিনয় পুলিশের নজরে এসেছিল। সঙের গানে আছে রাষ্ট্র চালানোর চিরন্তন গাথা –
“রাজ্য রথের চারটি চাকাসেপাই পুলিশ মন্ত্রী টাকাটাকার চাকা হলে ফাঁকারথখানিকে চলতি রাখাচলে না আর কোনমতে।”
ক্যাথরিন মেয়োর ‘মাদার ইণ্ডিয়া’ বইটিতে ভারতবর্ষের বিরুদ্ধে নানা কুৎসা করা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী পত্রিকার মতোই যোগ্য কড়া সমালোচনা করেছিল জেলেপাড়ার সঙের ছড়া –
“সাগর পারের নাগর ধরাস্বেচ্ছাচারিণীতারাই হল ভারত নারীরকেচ্ছাকারিণী”
বাংলার জাতীয়তাবাদী ভাবধারা – যা মূলত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে প্রথমে বিকশিত হয়েছিল – জেলে পাড়ার সঙ তাকে এড়িয়ে যায় নি। ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকা ১৪ই এপ্রিল ১৯৩০ সংখ্যায় লিখেছিল – ‘জেলেপাড়ার সঙ সম্প্রদায় জাতীয় ভাবের প্রচারের প্রচেষ্টা করিয়াছেন দেখিয়া সকলেই যারপরনাই সুখী হইয়াছেন।’ সেই জাতীয়তাবাদী অভিব্যক্তিই প্রকাশিত হয়েছিল স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের তিরোধানের পর জেলেপাড়ার সঙের গানে –
“হায়! হায়! আশুতোষের পুজোয় বসেদেখি আশু নাইকো দেশে ….বাংলার সেই শশাঙ্কে করলি রাহু গ্রাসঅসুরের দর্পচুরআশুতোষ যে মহাসুরতেজে মর্ত্যের ভবানীপুরকৈলাসে ভবানীপুরে করছেন এখন বাস”
এই সঙের দলে ছড়া লিখতেন দাদাঠাকুর অর্থাৎ নলিনীরঞ্জন পণ্ডিত। হার্ড ব্রাদার্স আর কুক কোম্পানীর মহিষে টানা ট্রাক গাড়িতে চাঁদোয়া আর ঝালর ঝুলিয়ে এদের সঙ বের হত। সঙের দল খালি পায়ে ঘুঙুর বেঁধে নাচতে নাচতে এগিয়ে যেত রোদতপ্ত পথে। তীর্থস্থানে লম্পট ও নেশাখোরদের উপদ্রব বাড়তে দেখে জেলেপাড়ার সঙ তীব্র কশাঘাত করতে ছাড়েনি। তাদের গানে ছিল –
“দেবতারা সব নিদ্রাগতনৈলে মানুষের কি সাহস এতGarden Party চলছে কতকালীঘাটের পীঠস্থানে।”
আবার ১৯১৭ খ্রীঃ চৈত্র সংক্রান্তির দিন জেলে পাড়ার সঙের দল গেয়েছিল একটি বিশেষ গান – ‘বিদ্যার মন্দিরে সিঁদ’ — কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশ্ন চুরির ঘটনা নিয়ে লেখা। এদেশে সঙের দল বিভিন্ন সম্প্রদায়কে সম্প্রীতির বাঁধনে বাঁধতে চেয়েছে বারবার। হিন্দু মুসলমান ফেরিওয়ালা বা দোকানদার, গাড়ির চালক বা মুসলিম কোচোয়ান, গায়ক ও বাদকের দল সামিল হত সঙের শোভাযাত্রায়। খিদিরপুর মনসাতলার সঙের মিছিলে স্থানীয় মুসলমানরা যোগ দিতেন। এদের একটি বিখ্যাত ছড়া ছিল –
“বছরের শেষে গাও ভাই হেসে হেসেস্বরাজের গান হয়ে এক প্রাণগোলামী আর সহে না”
হয়তো এসব গানের কাব্যমূল্য বেশি নয় কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে এভাবে সাধারণ মানুষ যে রাস্তায় না নেমে প্রতিবাদ করেছে তা সবচেয়ে বড় কথা, তবে কিছু স্বার্থান্ধ মানুষের চেষ্টায় তা সবসময়ে সার্থক হয়ে ওঠেনি।
লোকশিল্পীদের সামাজিক অবস্থান বিংশ শতকের সূচনায় পরিবর্তিত হচ্ছিল ক্রমশঃ। যুগের চাহিদা অনুযায়ী তাদের শিল্পে নানা উপাদানের অন্তর্গত হওয়া ছিল অবধারিত ব্যাপার। ১৮২৫ সালে ৫ই ফেব্রুয়ারী ‘সমাচার দর্পণ’ থেকে জানা যায় যে সে বছর সরস্বতী পূজার প্রতিমা বিসর্জনের দিন শোভাযাত্রায় সঙের মূল বক্তব্যটি ছিল অন্যায়কারী, ক্ষমতাবানের ঔদ্ধত্য দেখানোর বিরুদ্ধে সাধারণের প্রতিবাদ। এমনকি এই পত্রিকার খবর অনুযায়ী সঙের আয়োজককে পুলিশ গ্রেপ্তার করে আদালতে তুললে বিচারকর্তা তাকে বলেন যে তুমি তোমার দেবতার সামনে এ প্রকার কদর্য সঙ করেছ তা অতি মন্দ কর্ম। ‘বাইরে কোঁচার পত্তন ভিতরে ছুঁচোর কেত্তন’, ‘ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে’, ‘খ্যাঁদা পুত্রের নাম পদ্মলোচন’, ‘মদ খাওয়া বড়ো দায় জাত থাকার কি উপায়’ সঙ যাত্রার এসব নাম শুনলে বোঝা যায় বিদ্রুপের লক্ষ্যবস্তু ছিল কে বা কারা।
অষ্টাদশ শতকের শেষ থেকে উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে — দুর্ভিক্ষ, মহামারী, কৃষক বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ — কোলাহল মুখর নানা বিতর্কে সে সময়ে মুখর ছিল বাঙালি সমাজ। ভদ্রসমাজের নব অর্জিত গোঁড়া রুচিবোধ সঙের গানে অমার্জিত টীকা টিপ্পনী মেনে নিতে পারেনি বলে শিক্ষিত শ্রেণীর সম্পাদিত কাগজপত্রে তা বন্ধ করে দেবার দাবি উঠেছিল। এই সোচ্চার সংস্কৃতির জঙ্গী অভিব্যক্তি ছিল সঙ। অসহিষ্ণু অভিজাতবর্গ ইংরেজ শাসকদের ছত্রছায়ায় আইনের আশ্রয় নিয়ে সাধারণের বিনোদনের রাস্তাগুলি বন্ধ করে কৃত্রিমভাবে মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করলেন। কলকাতার রাস্তাঘাট থেকে ইতর শ্রেণীর এই সব উৎপাত তুলে দেবার সংকল্পে ১৮৭৩ খ্রীঃ ২০শে সেপ্টেম্বর টাউন হলে ভদ্রজন সমবেত হয়ে Society for the suppression of Public obscenity প্রতিষ্ঠা করে। এদের উদ্দেশ্য জনমানসের শুদ্ধতা রক্ষা করে পিনাল কোড এবং প্রিন্টিং অ্যাক্ট এর প্রয়োগে সরকারকে সাহায্য এবং দেশের নবসৃষ্ট সাহিত্যকে দূষিত করা যাবে না এই সংকল্প ঘোষণা করা। এর অন্তরালে লুকিয়ে আছে য়ুরোপীয় যুগের ভিক্টোরীয় রুচির প্রভাব। ‘নব্যভারত পত্রিকা’ লিখেছে যে — ‘কাঁসারীপাড়ার বাবু তারকনাথ প্রামাণিকের উৎসাহে কাঁসারীরা মহা উৎসাহে সঙের মিছিল বার করত। সেই সময় মহাত্মা বাবু কেশবচন্দ্র সেনের যত্নে কলিকাতার অনেকগুলি কৃতবিদ্য লোক ও খ্রীষ্টান পাদরী একটি অশ্লীলতা নিবারণী সভা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সভার অনুরোধে গভর্ণমেন্ট প্রকাশ্যপথে অশ্লীল সঙ্গীতাদি নিবারণোদ্দেশে দণ্ডবিধির প্রচার করায় ঐ মিছিল বন্ধ হইয়া যায়।’ ‘নব্য ভারত পত্রিকা’ আরো জানিয়েছে যে ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’র মতো সংবাদপত্র ঐ মিছিলকে বিদ্রুপ করতে ছাড়েননি। কাঁসারীপাড়ার সঙের মিছিল বন্ধ করার চেষ্টা করেন হগ্ সাহেব। সেদিন সঙের দল গান বেঁধেছিল —
“শহরে এক নূতন হুজুগ
উঠেছে রে ভাই
অশ্লীলতা শব্দ মোরা আগে শুনি নাই।
বৎসরান্তে একটি দিন
কাঁসারীরা যত
নেচেকুঁদে বেড়ায় সুখে
দেখে লোকে কত।
যদি ইহা এত মন্দ
মনে ভেবে থাকো,
নিজের মাগ্কে চাবি দিয়ে
বন্ধ করে রাখ।”
আবার ১৮৭৪ সালে কাঁসারী পাড়ার সঙদের বিরুদ্ধে যে অভিযান তাকে বলা যেতে পারে উনিশ শতকের বাংলা সংস্কৃতি জগতে দুই ভিন্নধর্মী ধারার সংঘাতের এক চরম অভিব্যক্তি। একদিকে অভিজাতদের শিল্পসাহিত্য অন্যদিকে নিম্নবর্গের গান বাজনা এই দুটি ধারা গত শতকে বিচিত্র গতিতে চলেছে। এক ধরনের অস্বস্তিকর সহাবস্থানে দুইপক্ষ নিজের পথ খুঁজে ফিরেছে বারবার। বিলীয়মান মোগল সাম্রাজ্যের দরবারী নাচগান, ধ্রুপদী সংগীত, লোকসংস্কৃতি আর নবাগত পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মধ্যে একটানা অসম টানাপোড়েন চলেছিল। নতুন শিক্ষিত ভদ্র সম্প্রদায় পাশ্চাত্যের প্রভাবজনিত নিজস্ব সাংস্কৃতিক রুচিতে টইটুম্বুর হয়ে রইলেন। অসহিষ্ণু অভিজাতবর্গ ইংরেজ শাসকদের ছত্রছায়ায় আইনের অস্ত্রে তথাকথিত ইতর শ্রেণীর বিনোদনের পথ রোধ করেছিলেন। সেকালে ‘বসন্তক’ পত্রিকা প্রশ্ন করেছিল — ‘এখানে সামান্য লোকের আমোদ আহ্লাদ ও উৎসব তো সকলি একে একে শেষ হইতেছে। এখানে যাত্রা নাই, পাঁচালী নাই, কবির তো কথাই নাই। সামান্য লোকেরা কি লইয়া থাকিবেক?’ ‘সামান্য লোকেরা’ বুঝেছিলেন যে সমাজের সমস্যাটা কোথায় – তাই তাঁরা গান গেয়েছেন ভদ্রলোকের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে –
“সস্তা দরে মস্ত নামকিনতে যত লোকএই সুযোগে তাদেরসবার ফুটে গেল চোখগরিবের মাথায় কাঁঠালভেঙে এরা ভাইইংরেজদের কাছে কেমনদেখাচ্ছে বড়াই।”(বসন্তক, ২য় পর্ব, ১০ সংখ্যা, ১৮৭৪)
‘এলোমেলো করে দে মা, লুটেপুটে খাই’ – নৈরাজ্যের এই অবস্থায় নিজস্ব ভঙ্গিতে, হাসি হুল্লোড়ে সঙের মতো লৌকিক সংস্কৃতিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন গরীবগুর্বোর দল। হাসির উপলক্ষ্য নির্বাচনে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম ছিল না। রক্ষণশীল সমাজের প্রতিনিধি ব্রাহ্মণের ভণ্ডামি বা বৈষ্ণবের লোলুপতা তাদের নিশানা আবার ‘ইয়ং বেঙ্গল’ নামধারী ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি যুবকরাও ছিল তাঁদের চাঁদমারি। স্ত্রী শিক্ষা, স্ত্রী স্বাধীনতা, দালাল, মাতাল, গুলিখোর সঙের গানে উপহাস বিদ্রুপের তালিকায় কেউ বাদ যায় নি। সঙ নামক এই লোকসংস্কৃতির মধ্যে একটা সর্বগ্রাসী cynicism এর হাস্যরসাত্মক অভিব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যায়। সঙের গান ছিল বাৎসরিক খতিয়ান। তৎকালীন বাঙালি সমাজে বছরভর যে সব ঘটনা, দৃশ্য বা কথা দাগ কেটেছে তা আলোকিত হত সঙের ছড়ায় আর গানে। এইভাবে সঙের গানের ভিতর দিয়ে আপনার মুখ আপনি দেখতে পেতেন বাঙালি সমাজ।
সঙের মিছিলের দিন কলকাতা উৎসবের নগরী হয়ে উঠত। অতিথির জন্য ঘরে ঘরে তৈরি হতো শরবত। সঙ্গে থাকত পান-তামাকের ব্যবস্থা। দর্শকের জন্য পথের ওপর শামিয়ানা টানানো হতো। নাট্যকার অভিনেতা রসরাজ অমৃতলাল বসু জেলেপাড়ার সঙের দলের জন্য গান রচনা করতেন। অমৃতলাল বসু মারা যাওয়ার পরে ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে (ইংরেজি ১৯৩০ সাল) রচনা হয়েছিল সঙের গান –
“এ বছরে কপাল পোড়াভেঙে গেল রসের ঘড়াতাই তো এবার সঙের ছড়াহয়নি তেমন মিঠে কড়া।”
সেকালে কলকাতায় বসবাসরত বিদেশীদের বিনোদনের জন্যও সঙের মঞ্চাভিনয়ের আয়োজন হতো। বিদেশীদেরও সঙের কার্যকলাপ উপভোগের প্রমাণ রয়েছে। ১৭৯২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় অনুষ্ঠিত এমন এক অনুষ্ঠানের বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়েছিল –
‘The 9th February 1792’
“Calcutta Theatre, the evening, the 9th of February 1792, will be performed a new pantomime called Mungo in Freedom, or Harlequin Fortunate, with amendment. Boxes 1 gold Mohur, Pit 12 Rupees, and gallery Six Rupees.”
কলকাতার নাট্য গবেষক শম্পা ভট্টাচার্য সঙের মিছিলের রূপ, গঠন ও চরিত্র সম্পর্কে লিখেছেন – “সঙের মিছিল বার করত জেলে, কাঁসারি, মুচি, শ্রমজীবী মানুষের দল। ভোরবেলা শুরু হয়ে সায়াহ্নে শেষ হতো শোভাযাত্রা। সে শোভাযাত্রায় থাকত মিলিটারি ব্যান্ডের নকল, দ্রাবিড় ব্রাহ্মণের দল, ধোবার কাপড় কাচা, ঘানিতে শর্ষের ঘুরপাক, মোসাহেবসর্বস্ব বাবুদের নানা ভড়ং, কৃষ্ণ আর গোয়ালিনীদের প্রেম। ভণ্ড সাধু ভক্তদের কাঁধে চেপে মন্ত্র জপে আর ইতিউতি চায়। সামাজিক প্রথা রীতিনীতি এসব নিয়ে ব্যঙ্গ হতো সঙের গানে। কখনো নব্য আইনে বিয়ের প্রথা নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক শ্লেষ, সে মিছিলে বর প্যান্টালুন আর চাপকান পরা। হিন্দুস্থান নর্তকীর সাজে বুট পরা বউ-এর হাতে ধরা মস্ত বড় বই। পুরোহিতের সামনে বর ঘোষণা করে সে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, জৈন, বৌদ্ধ কিছুই নয়, কন্যাও তা শপথ নেয়। তারপর ‘আমেন’ উচ্চারণে বিবাহ শেষ।”
জেলেপাড়ার সঙের চেহারা, ঢং, গানের কলি, কাঁসারীপাড়া খিদিরপুর-সহ অন্যান্য জায়গার সঙের থেকে অনেকটাই আলাদা। কোথাও জেলিয়াপাড়া কথার মারপ্যাঁচে আলাদা, কোথাও জেলিয়াপাড়ার নিজেদের বক্তব্য প্রকাশের রঙ-ঢঙে আলাদা। এই অঞ্চল তার স্পষ্টবাক বক্তব্যের জন্য কেড়ে নিয়েছিল সকলের নজর। এঁরা হিরণ্যকশিপু, গৌর-নিতাই সেজে, কিংবা নরসিংহের রূপ দেখিয়ে আবেগে কাঁদান না মানুষকে। এঁদের ঝোঁক ছিল সমাজের অনাচার আর দুর্নীতির ওপর কষাঘাতের দিকে। বাংলা ১৩২০ নাগাদ (ইংরেজি ১৯১৪ সাল) জেলেপাড়া সঙের আবির্ভাব। আর এই অঞ্চলের ‘বালকনাথ’ (শিব)-এর মন্দির ঘিরে চৈত্র সংক্রান্তির আগে থেকেই শুরু হত ‘মহলা’। লেখা হত পালা ও গান। ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়ঃ রূপচাঁদ পক্ষী, ‘রসরাজ’ অমৃতলাল বসু, দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্র পণ্ডিত, সজনীকান্ত দাস, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, কবিশেখর কালিদাস রায় সকলেই গান লিখেছিলেন জেলেপাড়ার সঙ-দের জন্য। তা ছাড়া স্থানীয় কবিরা তো ছিলেনই। সকলেরই উদ্দেশ্য ছিল সমাজ সমালোচনা। তেমন জেলেপাড়ার সঙদের গানের একটা কলিকে একটু বুঝিয়ে বলা যাক। কলিটি হল –
‘বিদ্যার মন্দিরে এ সিঁদ কেটেছে কোন চোরে সখীরা নেকী নাকি পড়লো ফাঁকিকেউ দেখেনি ঘুমের ঘোরেবিদ্যা সর্ব্ববিদ্যা অধিকারীদেবের প্রসাদে গুমোর গো ভারী…বিদ্যা নিত্য পূজে আশুতোষে।’
রসিকরা বুঝতে পেরেছিলেন এ গানের আড়ালে বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী থেকে শুরু করে স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সকলকেই ব্যঙ্গ করা হচ্ছে।
কলকাতার বিভিন্ন এলাকা থেকেই সঙের মিছিল বের হতো। উত্তর কলকাতার বারানসি ঘোষ স্ট্রিট থেকে যে সঙ বের হতো তার নাম ছিল ‘কাঁসারি পাড়ার সঙ’। কাঁসারি পাড়ার অধিবাসীরা নিজস্ব উদ্যোগ ও অর্থ ব্যয়ে সঙের মিছিল বের করত। সঙের মিছিল ছিল এক এলাহী কাণ্ড। মিছিলের মধ্যে হাস্যরসের নাটিকা পরিবেশন করা হতো। আর হতো নাচ-গান। পুরো চিত্রটি কল্পনা করে নিলে আধুনিক কার্নিভালের একটা আমেজ পাওয়া যায়। বোঝা যায় বাংলায়ও তার নিজস্ব কার্নিভালের প্রচলন ছিল। কাঁসারি পাড়ার সঙ বের হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় উদ্যোগটি ছিল তারকনাথ প্রামাণিকের। আরো একজনের নাম পাওয়া যায়, হিন্দু পেট্রিয়টের সম্পাদক কৃষ্ণদাস পাল। পঞ্চানন রায় কাব্যতীর্থ লিখেছেন, ‘সেকালে— কলিকাতার জেলেপাড়ার সংযাত্রা-উত্পত্তির বহু পূর্ব্বে,- প্রতি চৈত্র-সংক্রান্তির দিন কাঁসারীপাড়ার প্রসিদ্ধ সংযাত্রা বাহির হইত; এই সংযাত্রা-সমবায়ের প্রধান পরিচালক ছিলেন তারকনাথ (প্রামাণিক) ও কৃষ্ণদাস পাল মহাশয়। সংযাত্রা দেখিবার নিমিত্ত সাধারণের এরূপ আগ্রহ ছিল যে, সং বাহির হইবার বহু পূর্ব্ব হইতেই রাজপথের সম্মুখস্থ বারান্দাগুলি, দর্শনার্থী-জনসংঘ কর্ত্তৃক অধিকৃত হইয়া যাইত; ঐ সকল ভাড়া দিয়া গৃহের মালিকগণ প্রচুর অর্থ লাভ করিতেন। জনসমুদ্র উদগ্রীব হইয়া কৌতুক দেখিবার নিমিত্ত পথের উভয় পার্শ্বে অবস্থান করিত।’
কাঁসারি পাড়ার সঙ পথ চলত বিশেষভাবে নির্মিত ঘোড়ার গাড়িতে, এ গাড়ি ‘কাটরা গাড়ি’ নামে পরিচিত ছিল। এই ঘোড়ার গাড়িতেই নাটিকা অনুষ্ঠিত হতো। কাঁসারি পাড়ার সঙ মিছিলেও আঘাত হেনেছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নৈতিকতার দণ্ড। নব্যভারত পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে সে বিবরণী জানা যায় – ‘প্রায় ত্রিশ বৎসর পূর্ব্বে যদিও তখন বাণ ফোঁড়া প্রচলিত ছিল না, তত্রাচ কাঁসারী-পাড়ার বাবু তারকনাথ প্রামাণিকের উৎসাহে কাঁসারীরা মহাউৎসাহে সঙের মিছিল বাহির করিত। সেই সময় মহাত্মা বাবু কেশবচন্দ্র সেনের যত্নে কলিকাতার অনেকগুলি কৃতবিদ্য লোক ও খ্রীস্টান পাদরী একটি অশ্লীলতা নিবারণী সভা প্রতিষ্ঠিত করেন; এই সভার অনুরোধে গভর্ণমেন্ট প্রকাশ্য পথে অশ্লীল সঙ্গীতাদি নিবারণোদ্দেশে দণ্ডবিধির প্রচার করায় ঐ মিছিল বন্ধ হইয়া যায়।’
এ অশ্লীলতার বিতর্ক নিয়ে তখন কলকাতা সরব হয়ে উঠেছিল। অশ্লীলতার অজুহাতে সঙের মিছিল বন্ধ করার আরো তৎপরতার হদিস পাওয়া যায়। ১৮৭২-৭৩ সালের বসন্তকে লেখা হয়েছিল – ‘এক্ষণে সামান্য লোকের আমোদ-আহলাদ ও উৎসব তো সকলি একে একে শেষ হইতেছে। এক্ষণে যাত্রা নাই, পাঁচালী নাই, কবির তো কথাই নাই। সামান্য লোকেরা কি লইয়া থাকিবেন। কেবল ধান্যেশ্বরী। আর ছোবড়া টেনে কি দিনপাত হয়? সামান্য লোকের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে এ সভ্যতা দেখান কেন?’
উপরের মন্তব্যটিতে স্থানীয় সাধারণ মানুষের সঙ্গে ঔপনিবেশিক সভ্যতার দ্বন্দ্বের চিত্রটি উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। স্থানীয় ধনীরা বাবু সংস্কৃতিতে গা ভাসালেও নিম্নবর্গের জন্য হাজির হচ্ছিল নৈতিকতার নতুন নিষেধাজ্ঞা। বসন্তকে ক্ষুব্ধ স্বরেই প্রশ্ন তোলা হয়েছে, ‘কাঁসারী পাড়া দিয়া তো কাঁসারীদের সং বাহির হয়, সেখানে তো বাবু কৃষ্ণদাস পাল থাকেন, তিনি অসভ্য আর অশ্লীল?’
রসরাজ অমৃতলাল বসু লিখেছিলেন, ‘ছোট, মন্দ, অশ্লীল প্রভৃতি বলিয়া আমরা আমাদের কত জিনিসই না হারাইয়াছি ও হারাইতে বসিয়াছি। ছোটকে বড়, মন্দকে ভাল, অশ্লীলকে শ্লীল করিয়া লইতে যদি আমরা চেষ্টা করি, তাহা হইলে আমাদের অনেক জিনিস নিজস্ব থাকিয়া যায় এবং জগতের দৃষ্টিতে এত ক্ষুদ্র – এত হেয় হই না।’ তিনি আরো লেখেন, ‘সং ছোট নয়, হীন নয়, অশ্লীল নয়। সকল দেশে সকল সময়ই কোন-না-কোন রূপে সং লোক-সমাজে আত্মপ্রকাশ করে। তবে বাঙ্গালাদেশে কতকগুলি অশিক্ষিত, অমার্জ্জিত রুচি লোকের হস্তে পড়িয়া এবং সঙ্গে শিক্ষিত সুধীগণের সহানুভূতি না পাইয়া সং দিন দিন অবনত হইতেছিল।’ ঔপনিবেশিক শিক্ষা স্থানীয় শিক্ষিতদের রুচি বদলে দিয়েছিল। তারা আর স্থানীয় শিল্প নিয়ে আগ্রহী ছিলেন না। পরিণতিতে সঙের নেতি যাত্রা শুরু হয়েছিল। অমৃতলালের কথায় চিত্রটি পরিষ্কার দেখা যায়। প্রসঙ্গত বলা যায়, সঙের সেই পরিণতির সঙ্গে কেউ আজকের বাংলাদেশের যাত্রাপালার কিংবা পুতুলনাচের অবস্থা মিলিয়ে নিতে পারেন। বাংলার এ দুই শিল্প এখন অনেক জায়গায় অশ্লীল নাচ-গানের আসরে পরিণত হয়েছে।
ঢাকার জন্মাষ্টমীর মিছিল এখনো বেশ জাঁকের সঙ্গেই অনুষ্ঠিত হয়। এ মিছিলে একসময় সঙদের দেখা যেত। বৈষ্ণব উৎসবের মিছিলেও ঢাকার রাস্তায় সঙদের দেখা যেত। এসব মিছিলে হাতির উপস্থিতি দেখা যেত। বৈষ্ণব ভক্তদের মিছিলে দেখা যেত সোনা-রুপার চৌকি। এসব চৌকিতে উপবিষ্ট দেখা যেত দেব-দেবীদের। মিছিলের সঙ্গে সঙরা নেচে-গেয়ে ঢাকার বিভিন্ন রাস্তা অতিক্রম করত। সঙরা বন্দুক, তলোয়ার, বর্শা, নিশান, বল্লমধারী পদাতিক ও অন্যান্য সাজসজ্জা পরিধান করে মিছিলে যোগ দিত।
স্বদেশী আন্দোলনের সময় ঢাকার সঙরা ভারতীয় সেনাদের উদ্দেশে প্রেরণামূলক গান গাইত। ইসলামপুরে মিছিলের সঙ্গে সঙদের একটি গান ছিল এ রকম –
‘চলে যায় দিন ভেবে দেখ,এমন দিন আর পাব কোথায়।সাধের বেড়ি পরবো পায়,যাব সাধের জেলখানায়।’
সঙরা কেবল স্বদেশীদের প্রেরণা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেনি, তারা আন্দোলনকে ব্যর্থ করার জন্য ব্রিটিশ সরকারের তল্পিবাহক দেশীয়দের ভর্ত্সনা করেও গান গাইত। ইংরেজদের দালালদের উদ্দেশ সঙরা ঢাকার ইসলামপুরে গেয়েছিল—
“কতকগুলি পাষণ্ডগোলামগিরি বোঝে না,ঘরে গেলে পড়ে থাকে,মনের ধান্দা ছোটে না।তাতে বলে হিতবাণী,বলতে গেলে শোনে না,দণ্ডধারী গাধা পিটলে,ঘোড়া কভু হয় না।ধরে যখন কান মলা দেয়,তখন বাঁকা থাকতে পারে না।”
সঙরা যে কেবল লোক হাসানোতেই ব্যস্ত থাকত তা নয়। উপরের উদাহরণ থেকে সেটা স্পষ্ট। তাদের সামাজিক-রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় সাম্প্রদায়িক উসকানির বিরুদ্ধেও এ সঙরা সক্রিয় ছিল। অনেক নেতার কার্যক্রমের বিরুদ্ধে মানুষদের সচেতন করতে সঙরা প্রচারণা চালাত। অনেক জায়গায় স্থানীয়রাই হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি বজায় রাখতে সঙদের এনে গান গাওয়াতেন। সঙদের এসব গান শোনার জন্য সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ জড়ো হতো।
সে আমলে কলকাতা শহরে ঘোড়ার গাড়ির বেশির ভাগ চালক ও কোচোয়ান ছিল মুসলমান। সঙদের মিছিলে এরা ছিল অন্যতম দর্শক। সঙদের মিছিল ছিল নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষের মিলনের এক উপলক্ষ। তাই সঙদের মিছিল বন্ধ করতে অনেক সাম্প্রদায়িক নেতাই তত্পর ছিলেন। অনেক জায়গায় সঙদের মিছিলে মুসলিম গায়ক ও বাদকরা যোগ দিতেন। খিদিরপুরের সঙদের সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী একটি গান ছিল এ রকম –
“ও ভাই হিন্দু, ও ভাই মুসলমান,বিদেশীকে দূর করে আগে বাঁচা প্রাণ।স্বরাজ কেউ পাঠিয়ে দেবে নাকো জাহাজে ভরে,আনতে হবে হেঁচকা টানে সবার হাত ধরে।সবারে ডাকো— ভাই বলো, সবাই মোদের দেশবাসী,স্বরাজ এলে দুঃখ যাবে, ফুটবে মুখের হাসি।”
খিদিরপুরের সঙদের মুখে ছিল নিচের গানটি –
“এবার হাত পড়েছে পকেটে।ও ভাই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে সিঁধেল বোম্বেটে।।বিদেশী মাল হলো পয়মাল, বিকায় না প্রায় আর হাটে।বিদেশী নুন, চিনি , বসন, দূর কর ঝাঁটার চোটে।গোরার পায়ে তেল না দিয়ে, আপন বশে খাও খেটে।হিঁদু-মুসলমান, সব মিলে কোমরটা ভাই বাঁধো এঁটে।।দেশের মাতৃসেবক যারা, মোদের জন্যে জেল খাটে।এবার মরণ কামড় দিয়ে সবাই চেপে ধরো বয়কটে।।”
ঢাকার ইসলামপুরে সঙরা গেয়েছিল –
“হিন্দু-মুসলমান জাগ রে সমান, প্রাণে প্রাণে বেঁধে রাখ কষিয়া,ঘুম ভাঙ্গ দেশবাসী মিলিয়া,দেখ দেশের ধন কাহারা যাইতেছে লুটিয়া।”
গবেষকদের বিবরণী থেকে জানা যায়, বাংলার সঙরা মূলত ছিল খেটে খাওয়া নিম্নবর্গের মানুষ। তাদের কেউ উচ্চশিক্ষিত ছিল এমনও না। কিন্তু তার পরও উপরের গানগুলো তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতার সাক্ষ্য দেয়। শিক্ষিত সম্প্রদায়ের একটি অংশ সাম্প্রদায়িক বিভাজনে উসকানি দিলেও এ সঙরা পথে, ঘাটে তাদের গানে, ঢঙে মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সচেতন করেছে। বাংলার নিম্নবর্গের মানুষের রাজনৈতিক চেতনার ইতিহাসে এ সঙরা অবশ্যই বিশিষ্ট স্থান দখল করে থাকবে।
ভাষা ব্যবহারে সঙরা ছিল স্বাধীন, সৃষ্টিশীল। রঙ, রস, ব্যঙ্গের তীব্রতা বৃদ্ধি করতে সঙরা বাংলার সঙ্গে বিদেশী ভাষা মিশিয়ে গান তৈরি করত। ১৮৭০-এর দশকে এমন একটি গান ছিল –
“লেট মি গো ওরে দ্বারী, আই ভিজিট টু বংশীধারী।এসেছি ব্রজ হতে, আমি ব্রজের ব্রজনারী।।বেগ ইউ ডোর কিপর, লেট মি গেট,আই ওয়ান্ট দি ব্লক হেড,ফর হুম আওয়ার রাধে ডেড,আমি তারে সার্চ্চ করি।শ্রীমতী রাধার কেনা সারভেন্ট,এই দেখ আছে দাসখত এগ্রিমেন্ট,এখন করিব প্রেজেন্ট, ব্রজপুরে লব ধরি।”
যাত্রাগানেও বিভিন্ন ভাষার মিশ্রণ দেখা যেত। সঙ ও যাত্রাপালার গানে বাংলা-ইংরেজির মতো বাংলা-হিন্দি শব্দের মিশ্রণে তৈরি বাক্যও দেখা যেত। নিচের গানটিতে বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার মিলন দেখা যায়। গানটি সঙরা ব্যবহার করত –
“কাদের মল, তাদের লালা একদম মাটিমে মিল জানাজি।তুম বি জাগা, হাম বি জাগা, জাগা মল মল খাসা,রামনগর কি বসতি জাগা, জঙ্গল হোগা বাসা।।হরিনাম বুলি, শিক্ষাঝুলি, গোঁড়া হিন্দুয়ানি,গঙ্গাস্নান মে জেনানা দেখকে আড়ে আড়ে নজর হানি।ম্যারেজ কি বাজার, হুয়া বহুত ডিয়ার, রুপিয়া লেকে জুুলুম,লিস্ট দেখকে লেড়কিওয়ালার হোতা আক্কেলগুড়ুম।।”
ঢাকার মিছিলের একটি গান ছিল এ রকম –
“নাচাও ভাইয়া জানিনাচাও ভাইয়া জানিগাঁজা-সরাব পিওপিছু খাইও খয়নি,কমর হিলাকে নাচো,মুঁহসে কহো বাণী,মুঁহসে কহো বাণী।”
ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে তৈরি গানে সঙরা সেকালের নব্য ইংরেজি বাবুদের ব্যঙ্গ করতেন। সেই ইঙ্গবঙ্গ যুবকদের নিয়ে লেখা সঙের গান –
‘এখন ছেলেরা এক নতুন টাইপচোদ্দ না পেরতে পাকা রাইপমুখে আগুন ঢুকিয়ে পাইপএকমাত্র life ধারণ wife এর চরণ কর্ত্তে ধ্যানএরা নতুন অর্থ করেন গীতারভুল ধরেন পরম পিতারনৈলে কি তার trial বিনা in হয়।’
এতক্ষণ কথা হলো সঙ নামের জীবন্ত অভিনেতাদের নিয়ে। এদের পাশাপাশি ‘বসা সঙ’ নামে একটি বিষয় ছিল বাংলায়। ‘বসা সঙ’ মানে মাটির পুতুল। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে এ বসা সঙ বা পুতুলের বিরাট জনপ্রিয়তা ছিল। বিশেষত কলকাতায় জন্মাষ্টমী, ঝুলনযাত্রা, রাসযাত্রা ও চৈত্রসংক্রান্তিতে অনেক জায়গায় বসা সঙ বা পুতুল সাজানোর সাজ সাজ রব পড়ে যেত। মফস্বলে ধনী ও জমিদারদের বাড়ি রাস উৎসব বা পূজা উপলক্ষে পুতুল দিয়ে সাজানো হতো। ঢাকার রাস্তায় জন্মাষ্টমীর মিছিলে জীবন্ত সঙদের কথা আগেই আলোচনা করা হয়েছে। সেই মিছিলগুলোয় একটি বিশেষ আকর্ষণ থাকত চৌকি। এসব চৌকি প্রায় তিন তলার সমান উঁচু হতো। বাঁশ, কাগজ ও অন্যান্য জিনিস দিয়ে এ চৌকি তৈরি করা হতো। এ চৌকি প্রসঙ্গে যতীন্দ্রমোহন রায় লিখেছিলেন, ‘ইহার বিভিন্ন অংশগুলি খণ্ডিতাকারে সহরের নানা স্থানে বিভিন্ন কারিকরগণ দ্বারা নির্মিত হইলেও মিসিলের প্রায় ৪/৫ ঘণ্টা পূর্ব্বে একত্র করা হয় এবং সংযোজিত করা হইলে, উহা যে পৃথক পৃথক ব্যক্তিগণ দ্বারা নির্মিত হইয়াছে তাহা বুঝা যায় না।’
ঢাকা শহরে ঝুলনযাত্রা, রাসযাত্রা প্রভৃতি উপলক্ষে বিভিন্ন এলাকায় বসা সঙ বা পুতুল দিয়ে সাজানো হতো।
সঙদের চাচাতো ভাই বলা চলে ভাঁড়দের। ভাঁড় মানে আমাদের আজকের দুনিয়ার কমেডিয়ান। যে যুগে টেলিভিশন, রেডিও ছিল না, তখন মানুষকে হাসাত ভাঁড়। রাজা, জমিদার, ধনী পরিবারগুলোর সভা কিংবা বৈঠকখানায় ভাঁড়রা তাদের কেরামতি দেখাত। নানা ধরনের কিম্ভূত অঙ্গভঙ্গি, রসালো কথা, কৌতুক, হাস্যরসের গান গেয়ে ভাঁড়রা তাদের মালিকদের মনোরঞ্জন করত। রানী রাসমণি প্রসঙ্গে গোপালচন্দ্র রায় লিখেছেন, ‘রানী রাসমণি প্রতি বছরই মহা আড়ম্বরের সঙ্গে রথযাত্রা উৎসব করতেন। রথযাত্রার দিন রানী ঢাক, ঢোল, সানাই, কাড়া, নাকাড়া, বাঁশী, জগঝম্প প্রভৃতি কত রকমেরই না বাজনা আনাতেন। শুধু কি তাই, কীর্তন, বাউল, ভাঁড়ের দল প্রভৃতিও আনাতেন।’
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দরবারে গোপাল ভাঁড়ের কীর্তি তো বাংলায় কিংবদন্তি হয়ে আছে। ভাঁড় প্রসঙ্গে নগন্দ্রেনাথ বসু ‘বিশ্বকোষ’-এ লিখেছেন, “মুসলমান রাজাগণের সময়েও ভাঁড়ের আদর ছিল। এরূপ কথিত আছে যে, মোগলপতি তৈমুরলঙ্গ পুত্রশোকে বিহবল হইয়া দ্বাদশবর্ষকাল নিয়ত বিলাপ করিয়াছিলেন। সৈয়দ হোসেন নামক তাঁহার জনৈক পারিষদ আরবী ভাষায় একখানি সুললিত হাস্যোদ্দীপক গ্রন্থ রচনা করিয়া তাঁহার শোকাপনোদন করেন। তজ্জন্য তিনি মোগলরাজ কর্ত্তৃক ‘ভাঁড়’ উপাধিতে ভূষিত হইয়াছিলেন। এই সৈয়দ হোসেনই ভাঁড় সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। ক্রমে এই ভাঁড়গণ স্বতন্ত্র ব্যবসা করায় শাখা-জাতিরূপে পরিগণিত হয়। হোসেন সৈয়দ বংশীয় হইলেও, বর্ত্তমান মুসলমান ভাঁড়গণ সেখ বা মোগলবংশ সম্ভূত। শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায় ভেদে ইহাদের বিবাহ দিয়া থাকে। আচার ও ব্যবহারে ইহারা প্রায়ই মুসলমানের ন্যায়, তবে ইহাদের মধ্যে হিন্দু-আচারও দৃষ্ট হইয়া থাকে। ভাঁড় জাতি ঢেঁড় ও কাশ্মীরি এই দুই শাখায় বিভক্ত। অযোধ্যার নবাব নাসিরুদ্দিন কাশ্মীরি ভাঁড়দিগকে আনয়ন করেন।”
ভাঁড়দের শ্রেণী নিয়ে নগন্দ্রেনাথ বসু বিশদ লিখেছেন, ‘বর্ত্তমান সময়ে হিন্দু ভাঁড়গণ কৈথেলা (কাপিষ্ঠলী), ব্রাহ্মণিয়া কামার, উজহার, বন্থেলা, গুজর, নোনিয়া, কড়া, পিতরহঙ্গর, বরহা, নখটিয়া ও শাহপুরী এবং মুসলমান ভাঁড়গণ বরষা, ভন্দেলা, বুড়দিয়া, দেশী গাওবাণী, হমলপুরী, হর্থাজরেহা, জবোয়া, কৈথলা, কায়স্থ, কাশীবালা, কশ্মীরি, কাঠিয়া, কতিলা, কব্বাল, খাখারিয়া, ক্ষত্রী, ক্ষেতি, মোথরা, মুসলমানি, নকল, নৌমসালিক, পাঠান, পাটুয়া, পুরবিয়া, রাবত, সাদিকি, সেখ, তারাকিয়া প্রভৃতি শ্রেণীতে বিভক্ত।”
তবে এখন প্রকৃত সঙদের দেখা পাওয়া প্রায় দুস্কর হয়ে পড়েছে, এখন চারপাশে যাদের সঙ বলে ভ্রম হয় তাঁরা আসলে ছদ্মবেশী সঙ। মতলববাজ সঙ।
(তথ্যসূত্র:
১- কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত, শ্রী বিনয় ঘোষ।
২- বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা, শ্রী বিনয় ঘোষ।
৩- বঙ্গভূমি ও বাঙালির ইতিহাস, ড. নীতিশ সেনগুপ্ত।
৪- হুতোম প্যাঁচার নকশা, সমাজ কুচিত্র পল্লীগ্রামস্থ বাবুদের দুর্গোৎসব, শ্রী কালীপ্রসন্ন সিংহ।
৫- বাংলাদেশের সঙ প্রসঙ্গে, বীরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়।
৬- উইকিপিডিয়া।
★ বিশেষ কৃতজ্ঞতা – শ্রীমতী শম্পা ভট্টাচার্য।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত