বাংলাসাহিত্যের এক দিকপাল শ্রী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সাহত্যিচর্চার জীবনের শুরুতে বীরভূমের লাভপুরে বসে সাহিত্যচর্চা করতেন। কিন্তু একদিন তারাশঙ্করের সঙ্গে দেখা হল বিখ্যাত চিত্রশিল্পী যামিনী রায়ের। আমরা মেয়েদের চোখের সৌন্দর্য বোঝাতে বলি – ‘পটলচেরা চোখ’, সেই পটলচেরা চোখ সর্বপ্রথম যিনি তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন- সেই পটুয়া যামিনী রায়ের। প্রথম পরিচয়েই যামিনী রায় তারাশঙ্করকে বলেছিলেন – ‘ভায়া, বীরভূমে কেন? চলে আসুন কলকাতায়। শ্মশান না হলে কিন্তু শব সাধনা হয় না, জানেন তো? প্রত্যেক সাধনায় সাধনাপীঠের প্রয়োজন হয়। এ যুগে কলকাতাই হল বাংলার সাহিত্যশিল্পের সাধনপীঠ। এখানে আসুন, কষ্ট করুন, একবেলা খেয়ে থাকুন। তবেই তো পাবেন।’ সেদিন যামিনী রায়ের সে কথা তারাশঙ্করের আদৌ মনঃপূত হয়নি। তারপর পাকচক্রে তাঁকে কলকাতাতেই কিন্তু থিতু হতে হয়েছিল।
টানা চোখের গ্রামীণ মনীষা তিনি। শতাব্দী ঊর্ধ্ব বিশ্বচিত্রকলার ইতিহাসে পরিচিত এক লোকচিত্রশিল্পী তিনি। গ্রাম্য নয়, গ্রাম-অনুগত এক আবহমান সারল্য চেতনা যাঁর, তিনি যামিনী রায়। যে সময়ে তিনি শিল্পচর্চায় ব্রতী হয়েছিলেন তখন পরাধীন ভারতে এক দিকে ইউরোপীয় আকাদেমিক শৈলী ও অন্য দিকে দেশীয় পুরাণ ও মহাকাব্যিক ‘মিথ’-এর প্রবাহমান ধারা। সেই দু’টি ধারায় নিজেকে ভাসিয়ে না দিয়ে যামিনী রায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন দৈনন্দিন গ্রামদর্শনে। বাঁকুড়া জেলার বেলেতোড় গ্রামের মুক্তমন কিশোর অকাতরে প্রত্যক্ষ করেছিলেন পটুয়াপাড়ার হাতের কাজ, আলপনার নকশা আর গেরস্থালির কাঁথার বুনন। আর রঙ? হিসেবে ভুল করেননি যামিনীবাবু। প্রকৃতির অজস্র উপাদানকে কাজে লাগিয়েছিলেন রঙের উৎস হিসেবে।
যে শিল্পী নিজেকে স্বতন্ত্র রেখেছেন, নিজের প্রতিভাকে পণ্য করে নয়, কোনো পরসংস্কৃতির চর্চা করে নয়, বরং স্বদেশের প্রত্যন্ত অবহেলিত লোকসংস্কৃতিকে তুলির আঁচড়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি দিয়েছেন, তিনিই পটুয়া যামিনী রায়। শুধুমাত্র দেশপ্রেমের টানে, নিজস্বতাকে ধরে রাখার অভিপ্রায়ে তিনি পটচিত্রের একটি আন্তর্জাতিক মান ঠিক করে দিয়ে গেছেন।
বিশ্ববরেণ্য শিল্পী যামিনী রায় ১৮৮৭ সালের ১১ই এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বেলিয়াতোড় গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা রমতরণ রায়। ছোট থেকেই যামিনী রায়ের মধ্যে ছবি আঁকার শিল্পীসত্ত্বা দেখা যায়। শৈশবে ঘরের দেয়ালে, মেঝেতে কিংবা হাতের কাছে যা-ই পেতেন, তাতেই পুতুল, হাতি, বাঘ, পাখি ইত্যাদি এঁকে গেছেন নিজের মনে। গ্রামে দুর্গাপূজোর সময় নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দৌড়ে যেতেন ঠাকুর গড়া দেখতে। নিজের প্রতিভাকে দমিয়ে না রেখে ১৬ বছর বয়সেই কলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই ১৯১৪ সালে ফাইন আর্টে ডিপ্লোমা করেন। তিনি চারটি পুত্রসন্তান ও একটি কন্যাসন্তানের জনক।
ব্রিটিশ-শাসিত ভারতবর্ষে আর্ট স্কুলে ইউরোপীয় অ্যাকাডেমিক রীতিতেই চিত্রকলায় শিক্ষা গ্রহণ করেন তিনি। আর্ট স্কুলের বিখ্যাত শিল্পীদের সান্নিধ্যে এসে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের উভয় শিল্পের কলাকৌশলের সাথে পরিচিত হন। পাশ্চাত্য রীতির চিত্রকলা তাকে আকৃষ্ট করে এবং ফলস্বরূপ তিনি তাতে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দেন। পাশ্চাত্যের বিখ্যাত পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পী পল সেজান, ভ্যান গগ, পাবলো পিকাসো ও গগ্যাঁর প্রভাব দেখা যায় তাঁর চিত্রকলায়।
পোট্রেইট, ল্যান্ডস্কেপ, তৈলচিত্র ছিল তার স্টাইল ও মাধ্যম। এছাড়াও ক্লাসিক্যাল ন্যুড পেইন্টিংয়ে তাঁর হাত ছিল প্রশংসনীয়। নিজস্ব ঢঙে তিনি এঁকে গিয়েছেন তাঁর মতো করে। ছাত্রাবস্থায় তিনি শিক্ষকদের নজরে আসেন। কলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলের তৎকালীন অধ্যক্ষ, ভারতের আধুনিক চিত্রকলার অগ্রপথিক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় শিষ্য হয়ে উঠছিলেন তিনি দিনে দিনে। হঠাৎই তিনি পাশ্চাত্য শিল্পে আগ্রহ হারাতে থাকেন, যেন হাঁপিয়ে উঠছেন পরসংসস্কৃতি চর্চায়। এরপর তাঁর আঁকার বৈশিষ্ট্য, ধরন, বিষয়বস্তু, তুলির ব্যবহার ক্রমেই বদলাতে থাকে।
প্রথমেই বলেছি, শিল্পীজীবনের প্রারম্ভে ইউরোপীয় ছবির আদলেই ছবি এঁকেছেন যামিনী রায়। তিনি পাশ্চাত্যের ইমপ্রেশনিস্ট ধারার ল্যান্ডস্কেপ নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন। পাশ্চাত্যের বিখ্যাত শিল্পীদের অনুকরণে নিজের ঢঙে শিল্পচর্চা করেছেন।
তখন তার অংকনশৈলীই ছিল যেন বিলেতি মুডের। পাশ্চাত্য চিত্রকলায় তিনি মুগ্ধ হলেও মন সন্তুষ্ট ছিল না। কিছু একটা অনুপস্থিত ছিল সেই ছবিগুলোর মধ্যে, যা যামিনী রায়কে ভাবিয়ে তুলতে লাগলো। আর তা হলো নিজস্বতা, স্বকীয়তা, দেশপ্রীতি। ছবিতে অনুপস্থিত ছিলো দেশীয় সংস্কৃতি, স্বদেশের মানুষ, তাদের জীবনাচার ও প্রকৃতি। যা কিছু তাঁর আপন, যেখানে তাঁর বাস, পরিবেশ, সেসবের কোনো উপাদানই উপস্থিত ছিল না পাশ্চাত্য চিত্রে। আর তাই প্রান্তিক জায়গা থেকে শিল্পের লোকায়ত ধারাই শিল্পীকে আকৃষ্ট করলো সবথেকে বেশি। মাটির টানে ঘরে ফিরে গেলেন যামিনী রায়। চিত্রকলার কেবল ভারতীয় বৈশিষ্ট্যই নয়, খাঁটি কলকাতাইয়া কালীঘাটের পটের আঙ্গিক হয়ে উঠলো তাঁর চর্চার প্রধান উপজীব্য। কলকাতার কালীঘাটের পটশিল্পীদের চিত্রে তিনি আকৃষ্ট হলেন।
কালীঘাট চিত্রকলা, অর্থাৎ ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা শহরে কালীঘাটের কালীমন্দিরের সন্নিহিত এলাকার মন্দিরকে কেন্দ্র করে হাট-বাজার গড়ে উঠেছিলো। কালীমন্দিরে যে তীর্থযাত্রীরা আসতেন, ফেরার পথে স্মারক হিসেবে স্মৃতিচিহ্নমূলক বস্তু সঙ্গে নিয়ে যেতেন। কালীঘাটের কালীমন্দিরের সাথে সংযুক্ত থাকার কারণে স্মারক হিসেবে কালীঘাট চিত্রকলার উদ্ভব ঘটেছিল। চিত্রকলার বিষয় ছিল পৌরাণিক, ধর্মীয় অথবা পশুপাখি জাতীয় গ্রামীণ চিত্র। এগুলোই স্থানীয়রা নিজস্ব রঙে-ঢঙে আঁকতেন, যা কালীঘাট চিত্রকলা নামে বিখ্যাত ছিল। এমন করে শুধু কালীঘাট নয়, জন্মস্থান বেলিয়াতোড়, ওড়িষ্যা, প্রাচীন গুজরাট, মেদিনীপুর ঝাড়গ্রাম থেকেও প্রচুর পট সংগ্রহ করেন যামিনী রায়।
এরপর বেঙ্গল স্কুল ও প্রচলিত পশ্চিমা ধারার বিপরীতে গিয়ে সম্পূর্ণ নতুন এক শিল্পধারার জন্ম দেন তিনি। পটুয়াদের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য তৈরি করলেন পটচিত্রের। দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ এই শিল্পী স্বদেশের লোকায়ত শিল্পকে বেছে নিলেন জঁনরা হিসেবে। দৈনন্দিন গ্রাম্য জীবনের সহজ স্বাভাবিক দিকটায় ঝুঁকে পড়লেন। গ্রামীণ জীবন-জীবিকা, লাঙল হাতে চাষী, কীর্তন গায়ক, কিশোরী কন্যাদের হাসি, ঘরোয়া বধূ, বাঁশীবাদক ক্লান্ত পথিক, নৃত্যরত তরুণীদ্বয়, বাঘ, মাছ, বিড়াল, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রভৃতি হলো তাঁর অঙ্কনের বিষয়াদি। পটচিত্রের উপাদানে আরও রসদ যুগিয়েছে প্রিয় ধর্মকাহিনীগুলো। যেমন- রামায়ণ কথা, চৈতন্যের জীবনী, ক্রুশবিদ্ধ যীশুর জীবন, রাধা-কৃষ্ণ, জগন্নাথ-বলরাম ইত্যাদি। যামিনী রায়ের আঁকিয়ের পটপরিবর্তনের বিষয়টিতে শিল্প বিশ্লেষক ড. অশোক ভট্টাচার্য্য মূল্যবান মন্তব্য করেছেন,
“তিনি একজন জাত পটুয়ার মতো গুণগত উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে ছবির সংখ্যাগত আধিক্যের দিকেও নজর দিয়েছেন।”
বেলিয়াতোড় গ্রামের আশেপাশেই ছিল সাঁওতাল আদিবাসীদের বসবাস। যামিনী রায় ১৯২১ থেকে ১৯২৪-এর মধ্যকার সময়ে নতুন এক গবেষণা চালালেন সাঁওতাল আদিবাসীদের নিয়ে। তাঁদের জীবনাচারকে তিনি তুলির রঙে নতুন করে দেখবেন বলে ঠিক করলেন। সেখানে স্থান পেলো সাঁওতাল নারীদের নাচ, পরিবার, জীবনযাপনের দৃশ্যসহ দৈনন্দিন জীবনের রূপ।
এবার দেখা যাক তাঁর আঁকার কৌশল। বেশ ক’টি ছবি খেয়াল করলে দেখা যাবে, তিনি চোখের কাজে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। লম্বা বড় সরু নয়নের আধিক্য যেকোনো ছবিতে। সেই চোখ হোক পুরুষের, বিড়ালের অথবা সুনয়না যুবতীর, উপেক্ষা করার উপায় নেই। মোটা দাগে স্পষ্ট ও সপ্রতিভ হয়ে ওঠে সাঁওতাল পটচিত্রগুলো। তাঁর ছবিতে সাবজেক্টই প্রধান, পশ্চাতপট নয়।
রঙের ব্যবহার যামিনী রায়কে সবচেয়ে বেশি পৃথক করেছে সকল আঁকিয়ে থেকে। উজ্জ্বল রঙে ফুটে থাকা তাঁর চিত্রগুলো যেন কোনো উৎসবের আমেজ বয়ে আনে। পটুয়াদের মতো তিনিও মেটে রঙে ছবি এঁকেছেন। একটি তথ্য না দিলেই নয় যে, স্বদেশপ্রেমিক শিল্পী যামিনী রায় তাঁর পটচিত্রে শুধুমাত্র দেশজ রঙই ব্যবহার করেছেন। তিনি তার চিত্রে দেশজ উপাদান, যেমন- বিভিন্ন বর্ণের মাটি, ভূষোকালি, খড়িমাটি, বিভিন্ন গাছগাছালি, লতাপাতার রস থেকে আহরিত রং ব্যবহার করতেন। তাঁর সকল চিত্র যেন জীবন্ত হয়ে উঠতো দেশীয় উপাদানে আর রঙে। তিনি সবকিছুতেই দেশীয়ই উপাদানের সাহায্য নিয়েছিলেন, যাতে ধনী-নির্ধন সবার কাছে অনায়াসেই পৌঁছুতে পারেন। তিনি প্রচুর ছবি এঁকেছেন সাধারণের জন্য। খুবই স্বল্পমূল্য ও সহজলভ্যও ছিল চিত্রগুলো।
তাঁর আঁকা বিখ্যাত ছবির মধ্যে রয়েছে ‘সাঁওতাল মা ও ছেলে’, ‘চাষির মুখ’, ‘পূজারিণী মেয়ে’, ‘কীর্তন’, ‘বাউল’, ‘গণেশ জননী’, ‘তিন কন্যা’, ‘যিশুখ্রিষ্ট’, ‘কনে ও তার দুই সঙ্গী’ ও ‘ক্রন্দসী মাছের সাথে দুই বেড়াল’।
গতানুগতিক শিক্ষা লাভ করেও শেষমেষ এসকল ছবি এঁকেছেন, কেননা এখানে মাটি আর নাড়ির যোগ আছে। যামিনী রায়ের ছবি আদ্যন্ত ভারতীয় কৃষক-কুমোর সাংস্কৃতিক পরিবেশ থেকে উঠে এসেছেন, যেখানে না আছে যন্ত্রজীবনের কোলাহল, না নগরজীবনের জটিলতা। আছে তো শুধু নিজের মানুষ, মাটির গন্ধ, শান্তি, স্বাধীনতা আর অফুরান আনন্দ। তাঁর এই প্রথাবিরোধী চিত্রাঙ্কনের ফলস্বরূপ –
১) গ্রামজীবনের সরলতা উঠে এসেছে।
২) সমাজের বিস্তৃত অংশের মধ্যে লোকচিত্রকলা প্রবেশ করেছে।
৩) ভারতীয় চিত্রকলার নিজস্ব পরিচিতি সমাদৃত হয়েছে।
৪) আন্তর্জাতিক পরিচিতি পেয়েছে।
রায়ের কাজ শুধু নিজ দেশেই খ্যাতি লাভ করেনি মাত্র। সারাবিশ্বে তাঁর শিল্পকর্ম ছড়িয়ে পড়েছিল। সুদূর আমেরিকা, ব্রিটেন, প্যারিস ও ইউরোপে তাঁর কাজ পৌঁছেছিলো। ১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্ট্রিটে যামিনী রায়ের প্রথম চিত্র প্রদর্শনী হয়। সে সময় ‘পরিচয়’ নামক কলকাতার এক ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকায় তাঁর শিল্পের আলোচনা হওয়ার ফলে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। এছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন মার্কিন সৈনিক ও অফিসারবৃন্দ ভারত সফরে আসেন, যামিনী রায়ের নয়নাভিরাম চিত্র দেখে মুগ্ধ হন তাঁরা। অনেক চড়া দামে তাঁর ছবি ক্রয় করেন এসব সফরকারী, যার ফলে তাঁর ছবি দ্রুত প্রসার লাভ করে। অতঃপর ১৯৪৬ সালে লন্ডন ও ১৯৫৩ সালে নিউ ইয়র্কে তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়। এছাড়া আরও অনেক দেশি-বিদেশি প্রদর্শনীতে, গ্যালারিতে তাঁর ছবি পাওয়া যাবে। ভিক্টোরিয়া ও আলবার্ট মিউজিয়ামসহ আরও বেশ কিছু বিখ্যাত জায়গায় সংরক্ষিত আছে তাঁর চিত্রকর্ম।
যামিনী রায় রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-শিল্পকর্ম দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তাই দেখা যায়, যামিনী রায়ই একজন আধুনিক শিল্পী, যিনি রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা বিষয়ে লিখিতভাবে প্রথম প্রতিবেদন রেখেছেন। এই লেখা বুদ্ধদেব বসু-সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকার রবীন্দ্র সংখ্যায় (আষাঢ়, ১৩৪৮) প্রকাশিত হয়। কবিতা পত্রিকায় যামিনী রায় প্রকাশিত ‘রবীন্দ্রনাথের ছবি’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি পড়ে বড় আনন্দ পেয়েছিলেন বলে জানা যায়।
তিরিশের দশকের শেষে নন্দলাল কলাভবনের এক সভায় রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে মুখে মুখে আলোচনা করেছিলেন, ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের সঙ্গে। এমন আলোচনা সভা শান্তিনিকেতনে প্রায়ই আয়োজিত হতো, আজকের আধুনিক পঠন-পাঠনের কেতাদুরস্ত মতে, আভিধানিক প্রতিশব্দে যাকে ভূষিত করতে পারি ‘ডিসকোর্স’, ‘ইন্টারাকশন’ ইত্যাদি শব্দমালায়। রবিঠাকুরের ‘ইস্কুলে’ গোড়া থেকেই এ-জাতীয় সভা বা ‘ডিসকাসন কর্নার’-এর প্রচলন ছিল। আমরা সকলেই জানি, বিশের দশকের শুরুতে কলাভবন প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই রবীন্দ্রনাথ শিল্প-ঐতিহাসিক স্টেলা ক্রামরিশকে আমন্ত্রণ করে আনিয়েছিলেন, কলাভবনের ছাত্র ও শিক্ষকদের আধুনিক শিল্পকলার বিষয়ে ওয়াকিবহাল করতে। বিনোদবিহারীর লেখা থেকে জানা যায়, স্টেলা কীভাবে গথিক শিল্পের ইতিহাস থেকে আধুনিক যুগের শিল্প-আন্দোলন কিউবিজম পর্যন্ত বিস্তৃত শিল্পের প্রেক্ষাপটটিকে দক্ষতার সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। সম্ভবত তিরিশের দশকের শেষ পর্বের এক সভায় স্বয়ং নন্দলাল ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট-আর্ট’ শিরোনামে একটি মূল্যবান রচনা পাঠ ও আলোচনা করেন, যা আমাদের অবাক করতে পারে। তবে রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় তাঁর ছবি নিয়ে নন্দলালের আলোচনা করার ব্যাপারটি একটু স্বতন্ত্র। আর হয়তো সেদিক থেকে বিচার করলে নন্দলালই আমাদের দেশে প্রথম চিত্রকর, যিনি রবীন্দ্র-চিত্রকলার আলোচক বা ব্যাখ্যাতা হিসেবে দেখা দিয়েছেন। এখানে মনে রাখা দরকার, সময়ের বিচারে ‘রবিকা’র ছবির বিষয়ে অবনীন্দ্রনাথের বিখ্যাত আলোচনাটি ঘটেছে এর পরের পর্যায়ে। আর নন্দলালের সেই মুখের কথার নোট অবলম্বনে অনেক পরে রচিত হয়েছে ‘গুরুদেবের ছবি’ নামক প্রবন্ধ, যা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছিল রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে পুলিনবিহারী সেন-সম্পাদিত রবীন্দ্রায়ণ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে।
তবে ইতিহাসের বিচারে একজন ওয়ার্কিং-আর্টিস্ট, একজন আধুনিক শিল্পী হিসেবে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা বিষয়ে লিখিতভাবে প্রথম প্রতিবেদন রেখেছেন বোধকরি যামিনী রায়। এই লেখা বুদ্ধদেব বসু-সম্পাদিত কবিতা পত্রিকার রবীন্দ্র সংখ্যায় (আষাঢ়, ১৩৪৮) প্রকাশিত হয়। এবং রচনার অপর একটি পাঠ, বলা যায় রচনাটির চুম্বক বা সারসংক্ষেপ সজনীকান্তের ‘শনিবারের চিঠি’র রবীন্দ্র সংখ্যা, আশ্বিন ১৩৪৮-এ প্রকাশিত। এখানে বলে রাখা ভালো, ১৯৩২ সালে কলকাতার চৌরঙ্গী আর্ট স্কুলে, মুকুল দে-আয়োজিত রবীন্দ্র চিত্র-প্রদর্শনীর ক্যাটালগে মুদ্রিত মুকুলের ইংরেজি লেখাটি অবশ্য এক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
কবিতা পত্রিকায় প্রকাশিত ‘রবীন্দ্রনাথের ছবি’ শীর্ষক যামিনী রায়ের রচনাটি পড়ে ‘বড় আনন্দ’ পেয়েছিলেন স্বয়ং কবি, চিঠি লিখে যামিনীকে জানিয়েছিলেন সে-কথা। ২৫শে মে, ১৯৪১ সালের সেই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
‘তোমাদের মত গুণীর সাক্ষ্য আমার পক্ষে পরম আশ্বাসের বিষয়।… আমার স্বদেশের লোকেরা আমার চিত্রশিল্পকে যে ক্ষীণভাবে প্রশংসার আভাস দিয়ে থাকেন আমি সেজন্য তাদের দোষ দিই নে। আমি জানি চিত্র দর্শনের যে-অভিজ্ঞতা থাকলে নিজের বিচারশক্তিকে কর্তৃত্বের সঙ্গে প্রচার করা যায়, আমাদের দেশে তার কোনো ভূমিকাই হয়নি। সুতরাং চিত্রসৃষ্টির গূঢ় তাৎপর্য বুঝতে পারে না বলেই মুরুব্বিয়ানা করে সমালোচকের আসন বিনা বিতর্কে অধিকার করে বসে। সেজন্য এদেশে আমাদের রচনা অনেক দিন পর্যন্ত অপরিচিত থাকবে। আমাদের পরিচয় জনতার বাইরে, তোমাদের নিভৃত অন্তরের মধ্যে। আমার সৌভাগ্য, বিদায় নেবার পূর্বেই নানা সংশয় এবং অবজ্ঞার ভিতরে আমি সেই স্বীকৃতি লাভ করে যেতে পারলুম, এর চেয়ে পুরস্কার এই আবৃতদৃষ্টির দেশে আর কিছু হতে পারে না।’
আধুনিক শিল্পকলায় অনভিজ্ঞ স্বদেশবাসীর প্রতি রবীন্দ্রনাথের মনের ভাব বোঝাতে উদ্ধৃতি একটু দীর্ঘ হলো বইকি! এ চিঠির প্রতিটি অক্ষরে ধরা আছে তাঁর চিত্রীসত্তার এক সুতীব্র অভিমান, যা দীর্ঘকাল তিনি মনের মধ্যে বহন করে বেরিয়েছেন, এমনকি তাঁর ঘনিষ্ঠবৃত্তের কাছেও। সেইটিই যেন এখানে ফেটে পড়েছে সত্যকার শিল্পী ও প্রকৃত আর্টের সমজদার এক অনুজ শিল্পীর লেখনীর জবাবে।
স্নেহভাজন যামিনী রায়কে রবীন্দ্রনাথ আর একটি অসাধারণ চিঠি লিখেছিলেন, যেখানে আধুনিক দৃশ্যকলার একেবারে গোড়ার কথাটি নিঃসংকোচে ঘোষণা করেছিলেন তিনি। সে-চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
‘ছবি কি – এ প্রশ্নের উত্তর এই যে – সে একটি নিশ্চিত প্রত্যক্ষ অস্তিত্বের সাক্ষী। তার ঘোষণা যতই স্পষ্ট হয়, যতই সে হয় একান্ত, ততই সে হয় ভালো। তার ভালো-মন্দের আর কোনো যাচাই হতে পারে না। আর যা কিছু – সে অবান্তর – অর্থাৎ যদি সে কোনো নৈতিক বাণী আনে, তা উপরি দান।’
রবীন্দ্রনাথের এই বহুপঠিত, বহুচর্চিত চিঠি আমাদের সকলেরই জানা, তবু ভিস্যুয়াল-আর্ট প্রসঙ্গে তাঁর এই আধুনিক ভাবনা আজকেও আমাদের আশ্চর্য করে। রবীন্দ্র-চিত্রকলা বিষয়ে যামিনীর প্রবন্ধ ও উত্তরে রবীন্দ্রনাথের চিঠির মধ্যে দিয়ে সেই সময়ের অন্যতম দুই আধুনিক শিল্পীর মুক্ত ভাবনার আদান-প্রদানের ছবি আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
‘শনিবারের চিঠি’তে প্রকাশিত ‘চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথ’ শিরোনামে যামিনী রায়ের সংক্ষিপ্ত লেখাটি যেন আরো টান টান ঋজুভঙ্গিতে লেখা। শুধুই একতরফা প্রশংসা নয়, রবীন্দ্রচিত্রের নানান দোষ-গুণ প্রসঙ্গেও খোলামেলা সেই লেখার একটু উদাহরণ দেওয়া যাক –
‘(১) রবীন্দ্রনাথ ছবি এঁকেছেন খাঁটি ইউরোপীয় পদ্ধতিতে, সুতরাং তাঁর ছবি বোঝবার যাঁরা চেষ্টা করবেন, তাঁদের পাশ্চাত্য চিত্রশিল্পের ক্রমবিকাশ জানতে হবে। (২) ইউরোপীয় পদ্ধতি অনুসরণ করলেও তাঁর সম্বন্ধে একটি অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, শিল্প-ইতিহাসের পরপর স্তরগুলি সম্বন্ধে তাঁর অভিজ্ঞতা ছিল না, অথচ ছবিগুলি দেখলে বোঝবার উপায় নেই যে তিনি অনভিজ্ঞ ছিলেন, তাঁর কল্পনার অসামান্য ছন্দোময় শক্তিতে তিনি রেখা ও রঙের ব্যবহার আশ্চর্যরকমে আয়ত্ত করেছিলেন। এই নিয়মমাফিক শিক্ষার অভাবহেতু কোন কোন ক্ষেত্রে পতন ঘটেছিল তাঁর। যাঁরা তাঁর চিত্র-সংগ্রহ প্রকাশ করেছেন, এই দিকে তাঁরা সজাগ থাকলে ভাল হত। আশ্চর্য সক্ষমতার সঙ্গে অক্ষমতার মিলন দৃষ্টিকটু। সম্পূর্ণ কল্পনা থেকে আঁকা অবাস্তব ছবির মধ্যে এখানে ওখানে রিয়ালিস্টিক ছোঁয়াচ লাগাতে রসাভাস হয়েছে।’
লেখাটির শেষ কয়েকটি লাইন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ভেবে দেখলে চল্লিশের দশকের সূচনায় বলা সেই সব কথা আজকের দিনেও প্রায় সমানভাবে প্রযোজ্য। যামিনী রায় সে-রচনাটির শেষে লিখেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের ছবি সম্বন্ধে যথোপযুক্ত আলোচনা এখনও হয় নি। সে কাজ করতে হলে ইউরোপীয় শিল্প সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ব্যক্তির প্রয়োজন। যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিন অন্ধভক্তি এবং অকারণ বিরূপতা এই দুয়ের মধ্যে শিল্পী রবীন্দ্রনাথকে দোল খেতে হবে।’
এ-কথাগুলো কি আজকেও সমান তাৎপর্যপূর্ণ নয়?
দীর্ঘকাল রবীন্দ্র-চিত্রকলা প্রসঙ্গে আলোচনায় একধরনের একপেশে অন্তঃসারশূন্য মন্তব্য আমাদের নজরে পড়ে। তাঁর ছবির অন্যতম প্রধান ভর যে আধুনিক ইয়োরোপীয় শিল্পের পটভূমিতে প্রোথিত এবং বিচিত্রভাবে বিস্তৃত, এ-কথা আমরা স্বীকার করতে পারিনি অনেকদিন। গেরুয়া জোব্বায় শোভিত ‘গুরুদেবে’র তকমা-আঁটা রবীন্দ্রনাথ যে আধুনিক পশ্চিম থেকে তাঁর শেষবেলার ফসলের অনেকটা ভাবনা ও রসদ সংগ্রহ করেছিলেন – তা বুঝতে অথবা বুঝলেও বলতে আমাদের কলম দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছে। আমরা ভুলে যাই, সবকিছু ছাপিয়ে তাঁর দুর্মর শিল্পীসত্তার রবীন্দ্ররসে জারিত সমগ্র সৃষ্টিকর্ম ঘিরে আছেন যে রবীন্দ্রনাথ, তিনি আমাদের দ্বিধাদ্বন্দ্বের ওপারে। তবে যামিনীর দুটি রচনাই পাশাপাশি রেখে তলিয়ে বিচার করলে মনে হয়, দ্বিতীয় লেখাটি যেন একটু বেশি সমালোচনাধর্মী। এ লেখাটি রবীন্দ্রনাথ দেখে থাকলেও কোনো মন্তব্য প্রকাশ করেছিলেন কিনা জানা নেই। তথ্যের বিচারে যামিনীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের দুটি চিঠিই শনিবারের চিঠিতে প্রকাশিত প্রবন্ধের আগে লিখিত। তাই দ্বিতীয় লেখাটি অর্থাৎ একটু বেশি সমালোচনাধর্মী রচনাটির প্রতি কবির কোনো প্রতিক্রিয়া আমাদের কাছে এসে পৌঁছয় না। আগেও বলেছি, যামিনী রায়ের প্রবন্ধ এবং রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলো আমাদের বিশেষভাবে পরিচিত, একাধিকবার মুদ্রিত হয়েছে এগুলো। কিন্তু আমাদের অনেকেরই জানা নেই যামিনী রায়ের একটি চিঠির কথা – যা তিনি কবিকে লিখেছিলেন প্রথম প্রবন্ধটি রচনার প্রেক্ষাপটে। কলকাতার বাগবাজারের আনন্দ চ্যাটার্জি লেনের বাড়ি থেকে ২৩ মে ১৯৪১ সালের সেই চিঠিতে ‘অত্যন্ত সংকোচের সঙ্গে’ যামিনী রায় রবীন্দ্রনাথকে লিখছেন –
‘আপনার ছবি নিয়ে সম্প্রতি কিছু বলতে হয়েছিল। আপনার ওপর শ্রদ্ধা নিয়ে তাঁরা আমার কাছে এসেছিলেন আপনার ছবি সম্বন্ধে কিছু জানাতে। আমার মনে হয় আমি ঠিকমত তাঁদের জানাতে পারি নাই, তাঁদের পক্ষেও মুস্কিল, আমি আপনার চিত্রশিল্পকে যেভাবে গ্রহণ করেছি, অল্প সময়ের মধ্যে তাঁদিকে তা বুঝিয়ে দোব।
আপনার ছবি – আমার ছবি আঁকবার কাজে সাহায্য পেতে যেভাবে দেখতে হয় তা অন্যকে, বিশেষ করে যাঁরা ছবি আঁকেন না বা ওভাবে ভাবিত নন তাঁদিকে কথা দিয়ে বুঝান অসম্ভব মনে করি, তবু এইটুকু মনে সান্ত্বনা তাঁরা আপনার ছবির ওপর শ্রদ্ধাশীল, এইটুকু মনে হয়েছিল বোলেই আমি কিছু বলবার চেষ্টা কোরেছিলাম।’
এ চিঠিতে ফুটে উঠেছে যামিনীর এক বিনীত শিল্পীসত্তা। তিনি নিজে চিত্রী ও শিল্পরসিক হলেও ভাষার মাধ্যমে রবীন্দ্র-চিত্রকলার মর্মকথাটি ঠিকমতো প্রকাশ করতে পেরেছিলেন কিনা – এই ভাবনা তাঁকে উদ্বিগ্ন করেছিল। তাই স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখে নিজের অসমর্থতার কথা জানিয়েছিলেন।
কিন্তু সে-বিষয় বাদ দিয়ে যামিনীর চিঠির শেষ বাক্যটির শুরুর দিকে তাকালে একটু আশ্চর্য লাগে। বাক্যটি শুরু হয়েছে এভাবে – ‘আপনার ছবি – আমার ছবি আঁকবার কাজে সাহায্য পেতে যেভাবে দেখতে হয়’ ইত্যাদি, অর্থাৎ যামিনী রায়, রবীন্দ্রনাথের ছবির মধ্যে খুঁজে পান তাঁর নিজের ছবি আঁকার রসদ। কী সেই রসদ? রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা ঠিক কীভাবে ‘সাহায্য’ করেছে যামিনীর মতো চিত্রীকে? যামিনীর ভাষায় রবীন্দ্রনাথের ছবির সেই কী ‘সতেজ শিড়দাঁড়া’ – যামিনীর মতে যা ‘শৌখিন ভারতীয় শিল্পের’ বিরুদ্ধে রবিঠাকুরের ছবির তীব্র জেহাদ!
কবি বিষ্ণু দে-র লেখা থেকে জানা যায়, তথাকথিত পাশ্চাত্য ভাবনার ছবি থেকে লোকায়ত শিল্পের দিকে সরে আসার মুহূর্তে, যামিনীর মনের অসহায় দোলাচলের গভীর সংকটকালে রবীন্দ্রনাথের একটি লেখা তাঁকে কী আশ্চর্যরকম আলোর পথ দেখিয়েছিল, সে-লেখাটির নাম ‘তপোবন’। বিষ্ণু দে জানিয়েছেন, যামিনীর ব্যক্তিগত বইয়ের সংগ্রহে থাকা সেই প্রবন্ধের কয়েকটি জায়গায় পেনসিল দিয়ে যামিনী লিখে রেখেছেন – ‘আমার মনের কথা আজ লিখায় পড়লাম।’ অর্থাৎ শুধুই ছবিতে নয়, যামিনী রায়ের শিল্পীজীবনের দ্বন্দ্ব-সংকটের দুর্যোগে নির্ধারিত পথের নিশানা দেখিয়েছেন সেই রবীন্দ্রনাথ। এমনকি ছবির আধুনিক সংজ্ঞা হিসেবে যামিনী রায় যে-কথা বলেন, সে-কথার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা, এমনকি তাঁর ভাষার আদলও সুস্পষ্ট ফুটে ওঠে। যামিনীকে লেখা সেই শেষ চিঠিটিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, তার কাছে ‘ছবি’র অর্থ হলো ‘সে একটি নিশ্চিত প্রত্যক্ষ অস্তিত্বের সাক্ষী। তাঁর ঘোষণা যতই স্পষ্ট হয়, যতই সে হয় একান্ত, ততই সে হয় ভালো। তাঁর ভালো-মন্দের আর কোনোরকম যাচাই হতে পারে না।’ আবার বুদ্ধদেব বসুর কাছে সাক্ষাৎকার পর্বে, চিত্রকলা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অত্যন্ত আধুনিক মত ঘোষণা করেছেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘ছবিটা ছবিই, তার বেশি কিছু নয়, তার কমও নয়। … ভারতীয়, অজন্তীয়, ওসব কিছু না।’ পরে যামিনী রায়ের কণ্ঠেও সেই একই সুর, প্রায় সেই একই কথার প্রতিধ্বনি যখন শুনতে পাই, তখন দেখি, রবীন্দ্রনাথের ভাবনার প্রগাঢ় ছায়ায় যামিনী কীভাবে আবৃত রেখেছিলেন নিজেকে! ছবি প্রসঙ্গে যামিনীও বলেছেন – ‘ছবি ছবিই। ছবি মানুষের রচিত। মানুষের রচিত সবকিছুরই মধ্যে তার ধর্ম্ম, তার চরিত্র দৈনন্দিন জীবনের ও চিন্তার, সমস্ত কিছুরই পরিচয় পাওয়া যায়।’ এখানে আমরাও অবাক হয়ে লক্ষ করি, অগ্রজের ভাবনা কীভাবে ধীরে অনুজের মধ্যে অনুরণিত হয়ে ওঠে! জানি না, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে এমনভাবে কতজনের কাছে রবীন্দ্রনাথ নিজের অজান্তেই হয়ে উঠেছেন নিভৃত আশ্রয়, চলার পথে অগ্রপথিক; অন্ধকারে পথ চেনাতে হাতে তুলে নিয়েছিলেন আলোর মশাল।
…. “একটা টেবিলে সেই তিন চার ঘণ্টা চারমিনার ঠোঁটে জ্বলত
কখনো বিষ্ণু দে, কখনো যামিনী রায় এই নিয়ে তর্কটা চলত” …
মান্না দে’র বিখ্যাত ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ গানের বেশ পরিচিত দু’টি লাইন। কলকাতার সেই প্রিয় কফি হাউজে বন্ধুদের আড্ডার বিষয় হতো কখনো বিষ্ণু দে, কখনো যামিনী রায়। তারা দুজন ছিলেন দীর্ঘ এবং আমৃত্যু বন্ধু। ১৯২৮ বা ’২৯ সালে বিষ্ণু দে প্রথম যামিনী রায়ের আনন্দ চ্যাটার্জী লেনের বাগবাজার বাড়িতে যান অজয় সেনের সাথে চিত্র প্রদর্শনী দেখতে। এরপর থেকে তিনি নিয়মিত দর্শক হয়েছিলেন শিল্পীর। যামিনী রায়ও হরহামেশা আড্ডা দিতে যেতেন বিষ্ণু দে’র দক্ষিণ কলকাতার ভাড়া বাড়িতে। সেই আড্ডায় আরও সঙ্গী হতেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। আড্ডার তর্ক-বিতর্কেও তুলি-কলম দিয়ে ছবি আঁকতেন শিল্পী যামিনী রায়।
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যামিনী রায়কে নিয়ে ‘যামিনী রয় অ্যান্ড দি ট্র্যাডিশন অফ পেইন্টিং ইন বেঙ্গল’ নামে ইংরেজিতে একটি বই লেখেন ১৯৩৯ সালে। এছাড়াও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজি ভাষায় একটি সুবিশাল প্রবন্ধ লিখেছিলেন তাঁকে নিয়ে। সেই রচনা বিষ্ণু দে বঙ্গানুবাদ করে সাহিত্য পত্রিকায় ছাপার জন্য প্ররোচনা দিতেন। বিষ্ণু দে-ও তাঁর প্রিয় বন্ধুকে নিয়ে প্রচুর গদ্য-পদ্য রচনা করেছেন। যেমন- ১৯৫৯-এর ২১ জুন কবি বিষ্ণু দে ‘তাই তো তোমাকে চাই’ কবিতায় শিল্পী যামিনী রায়কে নিয়ে লিখেছেন নিম্নের পংক্তিগুলি,
“একটিই ছবি দেখি, রঙের রেখার দুর্নিবার একটি বিস্তার
মুগ্ধ হয়ে দেখি এই কয়দিন, অথচ যামিনীদার
প্রত্যহের আসনের এ শুধু একটি নির্মাণ একটি প্রকাশ
হাজার হাজার রূপধ্যানের মালার একটি পলক
যেখানে অন্তত গোটা দেশ আর কাল, একখানি আবির্ভাব”
যামিনী রায়ও প্রায় তার আঁকা ছবি উপহার দিতেন বিষ্ণু দেকে। কবিবন্ধু বিষ্ণুর বইয়ের প্রচ্ছদও এঁকে দিয়েছেন যামিনী। তাঁরা নিয়ম করে চিঠি আদান-প্রদান করতেন। শেষ বয়সে যখন তাঁরা প্রতিবেশী, তখন প্রায় প্রত্যহ আসা-যাওয়া চলতো। দুজন একসাথে ধূমপান করতেন এবং অন্তরঙ্গ আলাপে ডুবে থাকতেন। বয়সে ২২ বছরের ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও তাঁদের বন্ধুত্ব ছিল সমবয়স্কদের মতোই।
১৯৩৪ সালে যামিনী রায় তাঁর আঁকা একটি চিত্রকর্মের জন্য ‘ভাইসরয় স্বর্ণপদক’ পান। ভারতীয় সরকার থেকে ১৯৫৫ সালে তিনি ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি লাভ করেন। যামিনী রায়ই সর্বপ্রথম চারুশিল্পের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মাননা, ‘ললিতকলা একাডেমি পুরস্কার’ পান ১৯৫৫ সালে। ১৯৫৬ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ‘ডি-লিট’ ডিগ্রি দেয়। বিশ্বনন্দিত এই শিল্পীর জন্মস্থান বাঁকুড়া জেলার বেলিয়াতোড়ে ১৯৮৬ সালের ডিসেম্বর মাসে যামিনী রায় কলেজ স্থাপিত হয়। ভারতীয় আধুনিক শিল্পে অগ্রণী ভূমিকা পালন করায় তাঁর নামেই নামাঙ্কিত করা হয়েছে কলেজটি। ১৯৭২ সালের ২৪শে এপ্রিল যামিনী রায় পরলোকগমন করেন।
বাঙালির বাঙালিত্ব তুলে ধরতে মাছ-মিষ্টি-দই এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাশাপাশি রয়েছে যামিনী রায়ের নাম। তাঁর পটচিত্রে উঠে এসেছে ষোল আনা বাঙালিয়ানা। যামিনী রায় ছিলেন আর দশজনের চেয়ে আলাদা, কারণ তিনি তাঁর পটুয়াশৈলীর কারণে নিজের বিশেষত্ব অটুট রেখেছেন। শোনা যায়, প্রতি বছর দূর্গাপূজোয় কোনো না কোনো মণ্ডপের নকশা তৈরি করা হয় যামিনী রায়ের স্টাইল অনুসরণ করে। আশি থেকে নব্বইয়ের দশকে কলকাতার ঘরে ঘরে স্থান পেতো যামিনী রায়ের শিল্পকর্ম। তাঁর ছবি ঘরে থাকা মানে বলা হতো, “এই বাড়ির লোকের রুচি আছে বটে”!
সাধেই কি বুদ্ধদেব বসু লিখে গিয়েছেন –
“আমরা সবাই প্রতিভারে করে পণ্য
ভাবালু আত্মকরুণায় আছি মগ্ন
আমাদের পাপের নিজের জীবনে জীর্ণ
করলে, যামিনী রায়
… পুঁথি ফেলে তুমি তাকালে আপন গোপন মর্মতলে
ফিরে গেলে তুমি মাটিতে, আকাশে, জলে
স্বপ্ন লালসে অলস আমরা তোমার পুণ্যবলে
ধন্য যামিনী রায়”
(তথ্যসূত্র:
১- সাধক-শিল্পী যামিনী রায়, লীলাময় মুখোপাধ্যায়, বাংলার আভাষ।
২- যামিনী রায়: শ্রদ্ধ্যার্ঘ, প্রণব বিশ্বাস, সুতানটি বইমেলা।
৩- Urban Patua: The Art of Jamini Roy, Sona Datta, Marg Pubns (২০১০)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত