করোনা মোকাবিলায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে গোটা দেশ জুড়ে ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেই মতই এখন লকডাউনে স্তব্ধ গোটা দেশ। এরই মধ্যে এবার এই লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। সাধারণ মানুষ এই লকডাউন চায় কি? এই প্রশ্ন তুলে অমর্ত্য জানান, সাধারণ মানুষের কথা শোনা জরুরি। সমাজের আসল চেহারাটা পরিষ্কার থাকলেই করোনা মোকাবিলা সম্ভব। পাশাপাশি তাঁর পরামর্শ, সরকারি গুদামে মজুত করা চাল-ডাল-গম এখন বিলিয়ে দেওয়া হোক জনসাধারণের মধ্যে। অন্তত এই লকডাউনের দিনগুলিতে যাতে খাবার জোটে তাঁদের।
সম্প্রতি একটি সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলে মতামত রাখতে গিয়ে এই নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন, করোনা আতঙ্ক কোনও যুদ্ধ পরিস্থিতি নয়। এই লড়াই কিছু মানুষের কাছে দু’বেলা ভাতের সন্ধানের লড়াই। তাঁদের লড়াইয়ে সহযোগী হয়ে উঠতে পারলেই করোনা মোকাবিলা সম্ভব। তাঁদের কী সমস্যা, তাঁরা কী বলতে চাইছেন, কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এগুলো জানা খুব জরুরি। অন্তত গণতন্ত্রের স্বার্থে। অমর্ত্য সেনের মতে, এই ধরনের সামাজিক বিপর্যয়ের মোকাবিলার ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের ভূমিকা খুব জরুরি হয়ে পড়ে।
অমর্ত্য সেন লিখেছেন– ‘ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখা যাবে, ব্রিটিশ শাসনে দেশে প্রায়ই মন্বন্তর দেখা দিত। খেতে না পেয়ে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। স্বাধীনতার পর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেতেই আর ভয়াবহ মন্বন্তরের পরিস্থিতি তৈরি হয়নি দেশে। বাংলায় শেষবার ১৯৪৩ সালে মন্বন্তর দেখা দিয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনকালে। তখন আমি ছোট। সবই নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেছি। ১৯৪৭–র পর দেশে খাদ্যসঙ্কট দেখা দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী ছিল না। কারণ গণতন্ত্রের কারণে মন্বন্তর বা মহামারীর পরিস্থিতিতে সরকারের ওপর সবসময়ে একটা চাপ কাজ করে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় সরকার। কারণ তখন সরকারের মাথায় এটাই ঘোরে, পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে না পারলে মানুষ খেপে যাবে। প্রভাব পড়বে ভোটে।’
তিনি এ কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘তবে শুধুই ভোট দিয়ে গণতন্ত্র রক্ষা সম্ভব নয়। নির্বাচন আসবে। যাবে। ইস্যু বদলে যাবে বা বদলে দেওয়া হবে। ১৯৮৩ সালে ব্রিটেনের নির্বাচনেও তাই-ই হয়েছিল। ১৯৮২ সাল নাগাদ এটা নিশ্চিত ছিল, পরের নির্বাচনে হারছেন ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার। ফকল্যান্ড যুদ্ধের পরই সব রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে গিয়েছিল। ১৯৮৩ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতায় ফিরেছিলেন থ্যাচার। তাছাড়াও, আমাদের ভোটব্যবস্থার যা নিয়ম, তাতেও সরকারের ওপর যথেষ্ট পরিমাণে চাপ তৈরি হয় না। কারণ মানুষই ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রয়োগ করে পরোক্ষভাবে সরকার তৈরি করে।’
অমর্ত্যের মতে, ‘এই ধরনের সামাজিক বিপর্যয় কোনও যুদ্ধ নয়, যেখানে সরকারের কথাই শেষ কথা। বরং এই পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে জনসাধারণের অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি জরুরি। আলাপ-আলোচনা জরুরি। জনসাধারণের কথা শুনলেই সরকার বুঝবে, এই মুহূর্তে ঠিক কী করা উচিত! সেরকমই করোনার মতো অতিমারীর ক্ষেত্রেও এমন ব্যবস্থা প্রযোজ্য। যদিও এই ধরনের পরিস্থিতিতে সরকারকে লকডাউনের মতো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তেও যাতে সাধারণ মানুষের সায় থাকে, সেই দিকটিও বিবেচনা করা জরুরি।’
তাঁর স্পষ্ট কথা, ‘করোনার সংক্রমণ রুখতে দেশে লকডাউন জরুরি ছিল। কিন্তু তার পাশাপাশি এটাও বাস্তব যে, এই ঘোষণার পর লাখ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। খেতে পাচ্ছেন না। খাবার কেনার সামর্থ্য নেই কারণ রোজগার নেই। এই পরিস্থিতিতে অনাহার, খাদ্যসঙ্কট, এমনকী মন্বন্তরের পরিস্থিতি তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। এই পরিস্থিতিতে তাদের সাহায্যার্থে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে সরকারকে। ফুড কর্পোরেশনের গুদামে প্রায় ছ’কোটি টনের কাছাকাছি চাল–গম পড়ে রয়েছে। এখন সেগুলিও গরিবের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া যেতে পারে।’