গড়িয়াহাটের মোড়ে বিশাল পোস্টার। আর তাতে পদ্মফুলের মাঝে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের হাসিমুখের ছবি। তবে কি কলকাতা পুরসভায় বিজেপি’র মেয়র পদপ্রার্থী একদা তৃণমূলের অন্যতম সেনাপতি তথা কলকাতার প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়? অবশেষে কি সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরছেন তিনি? কয়েক সপ্তাহ আগে শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদ্মফুলের ব্যানারে তাঁর ওই ছবি দেখে যখন এমনই সব প্রশ্ন উঠছিল, তখনও চুপ ছিলেন তিনি। খোদ রাজ্য বিজেপির তরফ থেকে কলকাতার প্রাক্তন মেয়রের কাছে বার বারই বার্তা পৌঁছলেও, তাতে সাড়া দিচ্ছিলেন না শোভন। কিন্তু এবার শোভনের খাসতালুকের দায়িত্ব তৃণমূল হাঁকডাক করে রত্না চট্টোপাধ্যায়ের হাতে তুলে দিতেই পরিস্থিতি বদলানোর ইঙ্গিত মিলতে শুরু করল। দীর্ঘ নিষ্ক্রিয়তা কাটিয়ে তৎপরতা শুরু হল শোভন শিবিরে। গত দু’দিনে বিজেপির কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে বেশ কয়েক বার শোভনদের যোগাযোগ হয়েছে বলে খবর।
প্রসঙ্গত, দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) বি এল সন্তোষের উপস্থিতিতে রবিবার কলকাতায় খুব বড় সাংগঠনিক বৈঠক সেরেছে রাজ্য বিজেপি। সেই বৈঠকে শোভন চট্টোপাধ্যায়কেও ডাকা হয়েছিল বলে জানা গিয়েছে। কিন্তু ২০১৯-এর ২০ অগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত বিজেপির কোনও মঞ্চেই যেমন শোভনকে দেখা যায়নি, তেমন এই বৈঠকেও তিনি গরহাজিরই ছিলেন। ২০১৯-এর অক্টোবরে এবং ২০২০-র মার্চে কলকাতায় অমিত শাহের কর্মসূচীতে ডাক পেয়েও শোভন যখন হাজির হননি, তখন এই সাংগঠনিক বৈঠকে যোগ দেবেন, এমন আশা বিজেপি নেতৃত্বেরও খুব একটা ছিল না। কিন্তু তার পরেও শোভনকে যে ডাকা হল বৈঠকে, তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এখনও যে শোভনের বিষয়ে বিজেপি হাল ছেড়ে দেয়নি, সেটাই স্পষ্ট হচ্ছে বলে বিশ্লেষকদের মত।
অন্যদিকে, শোভন যে চাপে পড়েই এ বার নিষ্ক্রিয়তার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারেন, তা-ও কিন্তু রবিবার কিছুটা স্পষ্ট হয়েছে। বিজেপি সূত্রের খবর, দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং রাজ্য নেতৃত্বের তরফ থেকে একাধিক নেতা গত দু’দিনে শোভন-বৈশাখীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তাতে শোভনদের সাড়া আগের চেয়ে ইতিবাচক বলেই বিজেপি সূত্রের খবর। উল্লেখ্য, স্ত্রী রত্না চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা চলছে শোভনের। রত্নার সঙ্গে থাকবেন না বলে নিজের পর্ণশ্রীর বাড়ি ছেড়ে গোলপার্কের এক বহুতলে এসে উঠেছেন তিনি। আর তৃণমূল ছাড়ার পর থেকে তাঁর ওয়ার্ডে (১৩১) রত্নার গুরুত্ব যে ভাবে বাড়ানো হচ্ছিল, তাতে তাঁর পক্ষে তৃণমূলে ফেরা যে আর সম্ভব নয়, সে ইঙ্গিত কলকাতার প্রাক্তন মেয়র নানা ভাবে দিচ্ছিলেন।
কিন্তু তৃণমূল নেতৃত্ব সে সব কথায় যে কান দেননি, তা পুরভোটের মুখে এসে আরও স্পষ্ট হয়ে গেল। শুধু ১৩১ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্ব নয়, শোভন যে আসনের বিধায়ক, সেই বেহালা পূর্ব বিধানসভা আসনের পর্যবেক্ষক নিযুক্ত করে রত্নাকে এ বার আরও বড় দায়িত্ব তৃণমূল দিয়ে দিল। পুরভোটে যে রত্না প্রার্থী হচ্ছেন, তা-ও প্রায় নিশ্চিত। ইতিমধ্যে রত্নাকে পাশে নিয়ে তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সাংবাদিক সম্মেলনও করেন। তৃণমূলের সঙ্গে শোভনের দূরত্ব যতই বাড়ুক, মাঝখানে সেতু হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন পার্থই। বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরেও ভাইফোঁটা নিতে মমতার বাড়িতে শোভন ছুটে গিয়েছিলেন, সে কথা ঠিক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে শোভনের যোগাযোগের একটা সূত্র ক্ষীণ ভাবে হলেও যে টিকে ছিল, তা-ও তৃণমূল সূত্রেই জানা যাচ্ছিল। তবে শোভনের সঙ্গে মূল যোগাযোগটা তৃণমূলের তরফে রাখছিলেন দলের মহাসচিবই।
কিন্তু শনিবার সেই পার্থই বেহালা পূর্বে রত্নাকে পাশে নিয়ে দলীয় কর্মসূচী পালন করেন। শুধু তাই নয়। রত্নাকে পাশে নিয়ে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে ‘এলাকার বিধায়ক’কে (শোভনকে) ‘নিষ্ক্রিয়’ আখ্যাও দিয়েছেন। আর এই কারণেই যে রত্না চট্টোপাধ্যায়কে দায়িত্ব দিতে হল, সে কথাও স্পষ্ট জানিয়েছেন। শোভনের আপত্তি রয়েছে জেনেও রত্নার জন্য দলের অন্দরে জায়গা যে ক্রমশ বাড়ানো হল, তাতে শোভনকে ‘অবজ্ঞা’র বার্তা দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। আর এর ফায়দা তুলতে শনিবার থেকে বিজেপির কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতারা দফায় দফায় শোভন-বৈশাখীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেছেন বলে খবর। ‘ভুল বোঝাবুঝি’ কিছু থাকলে মিটিয়ে নেওয়া যেতেই পারে, এমন বার্তাও শোভন শিবিরে পৌঁছয় বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বের তরফ থেকে। ফলে পুরনো দলে ফেরার সম্ভাবনা প্রায় বন্ধ হতে এবার বিজেপিতে ‘সক্রিয়’ হওয়া ছাড়া আর কোনও পথই খোলা নেই শোভনের সামনে।