আমাদের সকলের হৃদয়ে বেঁচে-বর্তে একজন সুপ্ত ঈশ্বর থাকেন, তিনিই ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। কেন? আমাদের চারপাশের চতুর বাঙালিদের দেখুন আর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে নিয়ে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র কথিত মহাবাণীটি স্মরণ করুন – ‘এত বড় প্রতিভা ইয়ার্কিতেই ফুরাইয়া গেলো।’ বাস্তব সত্যিটা হল, ‘আত্মঘাতী বাঙালী’ টার প্রতিভার প্রায় সবটুকুই ফাঁকিবাজি, চতুরতা আর ইয়ার্কিতেই শেষ করে ভবলীলা সাঙ্গ করে। মরার সময় অধিকাংশ বাঙালি জানতেও পারেন না, যে বুক পকেটে জোনাকি জ্বলতো, তার নিচে একটি বিশাল হৃদয় নিয়েও তিনি জন্মেছিলেন। এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের, ‘এ কিন্তু ভক্তের স্তুতি নহে—এ বাপের উপর বেটার অভিমান।’
‘কাতর কিঙ্কর আমি, তোমার সন্তান।
আমার জনক তুমি, সবার প্রধান।।
বার বার ডাকিতেছি, কোথা ভগবান্।
একবার তাহে তুমি, নাহি দাও কান ।।
সর্বদিকে সর্বলোকে, কত কথা কয়।
শ্রবণে সে সব রব, প্রবেশ না হয় ।।
হায় হায় কব কায়, মটিল কি জ্বালা।
জগতের পিতা হোয়ে, তুমি হলে কালা ।।
মনে সাধ কথা কই, নিকটে আনিয়া।
অধীর হ’লেম ভেবে, বধির জানিয়া ।।’
আমরা জানি, বাংলাসাহিত্যে আধুনিক যুগের সূত্রপাত হয় উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে। এই যুগের প্রথম কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। তাঁর হাত ধরেই মধ্যযুগের গণ্ডি পেড়িয়ে বাংলা কবিতা আধুনিকতার পথে নাগরিক রূপ পেয়েছিল। তিনি ‘গুপ্ত কবি’ নামেও সমধিক পরিচিত। তাঁর ছদ্মনাম ‘ভ্রমণকারী বন্ধু’। এছাড়া তিনি ‘সংবাদ প্রভাকর’সহ (বা ‘সম্বাদ প্রভাকর’) বহুবিধ পত্র-পত্রিকা সম্পাদনা করে কবি-সাহিত্যিকদের উৎসাহ প্রদানের জন্য সমসাময়িককালে তিনি ‘কবিগুরু’ হিসাবে আখ্যায়িত হয়েছেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো তাঁর পরবর্তী সাহিত্যিকরা ঈশ্বর গুপ্তকে ‘গুরু’পদে বরণ করেছিলেন। সামাজিক ও ব্যঙ্গ কবিতাগুলোর জন্য ঈশ্বর গুপ্তের সর্বাধিক খ্যাতি। তাঁর রঙ্গরসপ্রবণতা ও লঘু চপলভঙ্গি কবিতাগুলোকে উৎকর্ষ দান করেছে। তাঁর কবিতায় স্বদেশ, স্বভাষা ও ধর্মের প্রতি গভীর ভালবাসা ফুটে ওঠে।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সমালোচকদের মতে, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যুগসন্ধির কবি হিসেবে পরিচিত, কারণ তিনি সমকালের সামাজিক ও ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে কবিতা রচনা করলেও তাঁর ভাষা, ছন্দ ও অলঙ্কার ছিল মধ্যযুগীয়। মঙ্গলকাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্রের সাহিত্যাদর্শ যখন লুপ্ত হয়ে আসছিল, তখন তিনি বিভিন্ন বিষয় অবলম্বনে খন্ডকবিতা রচনার আদর্শ প্রবর্তন করেন। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপই ছিল তাঁর রচনার বিশেষত্ব। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের এ ভঙ্গি তিনি আয়ত্ত করেছিলেন কবিয়ালদের নিকট থেকে। ব্যঙ্গের মাধ্যমে অনেক গুরু বিষয়ও তিনি সহজভাবে প্রকাশ করতেন। আমরা তাঁর কবিতায় ব্যঙ্গবিদ্রূপের বিষয়টি প্রবলভাবে লক্ষ্য করি। একদিকে আধুনিকতার প্রতি অনুরাগ অন্যদিকে প্রাচীন সংস্কারের প্রতি দুর্বলতা কবির দ্বৈতসত্তার বিষয়টিকে অনেক সময় প্রশ্নবিদ্ধ করে। তারপরও কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত আধুনিক চিন্তাকেই গ্রহণ করে কাব্যসাধনায় বিভিন্ন বিষয়কে কবিতার উপাদান করেছেন। তাঁর দেশপ্রেম এবং নীতিমূলক কবিতাগুলোই অধিক জনপ্রিয় ছিল।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত রচিত ‘মানুষ কে’ কবিতাটির দিকে নজর দেওয়া যাক। এখানে প্রকৃত মানুষ্যত্বের বিভিন্ন দিক নিয়ে কবি তাঁর কবিতাটিকে অলংকৃত করেছেন। যার ভেতর দিয়ে মানব জীবনের বিভিন্ন চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। সেটি পাঠ করা যাক।–
‘মানুষ কে?
নিয়ত মানসধামে একরূপ ভাব।
জগতের সুখ-দুখে সুখ দুখ লাভ
পরপীড়া পরিহার, পূর্ণ পরিতোষ,
সদানন্দে পরিপূর্ণ স্বভাবের কোষ
নাহি চায় আপনার পরিবার সুখ।
রাজ্যের কুশলকার্যে সদা হাস্যমুখ
কেবল পরের হিতে প্রেম লাভ যার
মানুষ তারেই বলি মানুষ কে আর?’
এবারে কবির ‘কে’ কবিতাটিও পাঠ করা যাক –
‘বল দেখি এ জগতে ধার্মিক কে হয়,
সর্বজীবে দয়া যার, ধার্মিক সে হয়।
বল দেখি এ জগতে সুখী বলি কারে,
সতত আরোগী যেই, সুখী বলি তারে।
বল দেখি এ জগতে বিজ্ঞ বলি কারে,
হিতাহিত বোধ যার, বিজ্ঞ বলি তারে।
বল দেখি এ জগতে ধীর বলি কারে,
বিপদে যে স্থির থাকে, ধীর বলি তারে।
বল দেখি এ জগতে মূর্খ বলি কারে,
নিজ কার্য নষ্ট করে, মূর্খ বলি তারে।
বল দেখি এ জগতে সাধু বলি কারে,
পরের যে ভালো করে, সাধু বলি তারে।
বল দেখি এ জগতে জ্ঞানী বলি কারে,
নিজ বোধ আছে যার, জ্ঞানী বলি তারে।
বল দেখি এ জগতে সার বলি কারে,
ঈশ্বরের ভক্ত যেই, সার বলি তারে।’
বর্তমান সময়ে এক আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বের সাক্ষী হয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের। এ দ্বন্দ্বের তখন-এখন নেই। ওই শতকের পারেও যা, এই শতকের পারেও তা। ঈশ্বর গুপ্তের সাক্ষ্যের দ্বন্দ্বটি গত শতকের সত্তরের দশকের। পাকিস্তান অভিযোগ করেছিল, ‘ভারত ফারাক্কায় খাল কাটার ফলে পূর্ববঙ্গের পদ্মা-নদীতে জল নেই’। গুরুতর অভিযোগ। তো সেই সময়ের জনপ্রিয় গণমাধ্যম রেডিয়োয় ‘খবর’ হয়েছিল। ১৯৭০ সালের ২৩শে এপ্রিল আকাশবাণীর রাত ১০টার ‘সংবাদ পরিক্রমা’য় উপস্থাপক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলেন। পাকিস্তানের অভিযোগ যে মিথ্যে তা প্রমাণে ভারত সরকার একটি ভ্রমণ কাহিনিকে নথি হিসেবে পেশ করল। বইটির নাম, ‘ভ্রমণকারি বন্ধুর পত্র’। লেখক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। বইয়ের অংশবিশেষ দেখিয়ে ভারত দাবি করল, পদ্মা আজ (১৯৭০) শুকিয়ে যায়নি। ঈশ্বর গুপ্ত ১২৬১ বঙ্গাব্দেই পদ্মা পারাপারের সময়ে নদীর দুরবস্থা দেখেছিলেন।
মৃত্যুর শতাধিক বছর পরে দেশকে সঙ্কট থেকে উদ্ধার করেছিলেন ‘গুপ্ত কবি’। কী ভাবে তিনি সাক্ষী হলেন? তার একটা গল্প আছে। এই সাক্ষ্যদানের মাত্র বছর সাতেক আগে তিনি নিজেই উজ্জ্বল উদ্ধার হয়েছিলেন। ঘুরতে ভালবাসতেন ঈশ্বরচন্দ্র। দুর্গাপুজোর পরে জলপথে পাড়ি দিতেন বিভিন্ন জায়গায়। সেই সব ভ্রমণকথা শুধু সফরনামা ছিল না। ছিল ইতিহাস, প্রকৃতি আর জীবনচরিতের মিশেল। যেখানে যেতেন, লোকজনের সঙ্গে ভাব জমাতেন। উচ্চবিত্ত থেকে নদীর পারে ক্রীড়ারত শিশু, সকলেই ছিল তাঁর আগ্রহের বিষয়। তখন তিনি বেশ নামী। উচ্চবিত্তরা পরিচয় পেয়ে তাঁকে ডেকে নিয়ে গিয়ে সমাদর করতেন। আর নদীর পারে খেলা করা শিশুদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে তাদের বাড়িতে হাজির হতেন স্বয়ং। ছেলেপুলেদের বাড়িতে কোনও আনাজ ফলে থাকলে চেয়ে নিতেন। লাউ, কুমড়ো, যা-ই হোক না কেন, দ্বিধাহীন ভাবে চাইতেন। আবার ছোট ছোট ছেলেদের কাছে ডেকে গানও শুনতেন। ১২৬১ সালে অগ্রহায়ণ থেকে চৈত্র পর্যন্ত ‘গুপ্ত কবি’ উত্তর ও পূর্ববঙ্গ সফর করেছিলেন জলপথেই। সেই ভ্রমণকথা প্রকাশিত হত ‘সংবাদ প্রভাকর’এ। লেখাগুলি হয়তো হারিয়েই যেত। কিন্তু অধ্যাপক মোহনলাল মিত্র লেখাগুলি উদ্ধার করে ১৯৬৩ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন। এই বই বছর সাতেক পরে ভারতের সঙ্কটমোচন করে।
সফরের সময়ে যিনি পথে ও পথের প্রান্তে জীবন খোঁজেন, তিনি জীবনরসিক নিশ্চয়ই। সেই রসের সন্ধান তিনি দিয়েছেন জীবনভর। লোক হাসাতে পারতেন ঈশ্বর গুপ্ত। কথায়, বক্তৃতায়, লেখায়। ছোটবেলা থেকেই সম্ভবত এই হাসির অস্ত্রে শান দিতে দিতে এগিয়েছেন। অন্তত দু’টি ঘটনা তাঁর সেই গুণেরই সাক্ষ্য দিচ্ছে। প্রথম ঘটনার সময়ে তাঁর বয়স মাত্র তিন বছর। উত্তর ২৪ পরগনার কাঁচরাপাড়া থেকে কলকাতার জোড়াসাঁকোয় মামার বাড়িতে এসেছেন তখন। এসে পড়লেন অসুখে। কলকাতা নিয়ে তখন তাঁর বিরক্তি ছিল। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, মশা-মাছির উপদ্রব। তাতেই নাকি তিতিবিরক্ত হয়ে বছর তিনেকের ঈশ্বর আবৃত্তি করতে থাকেন, ‘রেতে মশা দিনে মাছি/এই তাড়য়ে কলকেতায় আছি’। তিন বছরের মস্তিষ্কই প্রবাদের মতো পঙ্ক্তির জন্ম দিয়েছিল।
দ্বিতীয় ঘটনার সময়ে ঈশ্বর গুপ্তের বয়স পাঁচ বছর। ডাকাবুকো ছিলেন সেই বয়সেই। কালীপুজোর দিনে কোথাও একটা নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছিলেন। রাস্তায় ঘোর অন্ধকারে তাঁর ঘাড়ে এসে পড়ে কোনও একজন ঈশ্বরের পরিচয় জিজ্ঞেস করেন। তিনি উত্তর দেন, ‘আমি ঈশ্বর’। ঘাড়ে পড়া ব্যক্তির দ্বিতীয় প্রশ্ন, একলা এই অমাবস্যার অন্ধকারে কোথায় যাচ্ছে এইটুকু বাচ্চা? ঈশ্বরের জবাব, ‘ঠাকুর মশায়ের বাড়ী লুচি আনিতে’। এই যে হাজির-জবাব, সব পরিস্থিতি পেষণে রস নিষ্কাষণ— এ তাঁর সৃষ্টিতে প্রচুর মেলে। বঙ্কিমচন্দ্রের কথায়, ‘ইয়ার্কি’র প্রবণতা। তিনি রস বিনা একদণ্ড থাকতে পারতেন না। সে সোমরসই হোক বা কাব্যরস। হ্যাঁ, গুপ্তকবির পানদোষ ছিল। শোনা যায়, সুরাপান করলেই নাকি তাঁর কাব্যপ্রতিভা প্রগলভ হত। সুরাসক্তির কথা নিজেই স্বীকার করেছেন এক কবিতায়, ‘পাত্র হোয়ে পাত্র পেয়ে ঢোলে মারি কাটি/ঝোলমাখা মাছ নিয়া চাটি দিয়া চাটি’।
‘ইয়ার্কি’র এই প্রবণতাই কি ‘গুপ্ত কবি’কে ‘পাষণ্ড পীড়ন’ পত্রিকা প্রকাশে মনে খোঁচা দিচ্ছিল? তার আগে কিন্তু সম্পাদক এবং সাংবাদিক ঈশ্বরচন্দ্র অনেক ভারী ভারী কাজ করে ফেলেছেন। ‘সংবাদ প্রভাকর’ তখন প্রতিষ্ঠিত কাগজ। প্রতিষ্ঠিত বললে কম বলা হবে। এখনকার ভাষায় ‘ভাইরাল’। প্রভাকরের জনপ্রিয়তার বর্ণনা দিয়েছেন শিবনাথ শাস্ত্রী। প্রভাকর পড়ার জন্য বাংলাদেশের মানুষ তখন পাগল হয়ে উঠেছিলেন। ‘প্রভাকর বাহির হইলে বিক্রেতাগণ রাস্তার মোড়ে দাঁড়াইয়া ঐ সকল কবিতা পাঠ করিত’ এবং নিমেষের মধ্যে কাগজ বিক্রি হয়ে যেত। জনপ্রিয় কবির ভক্তকুল তৈরি হয়েছিল। কবিতার জগতে নতুন পা ফেলা সারস্বতেরা জেনে বা না জেনে ঈশ্বর গুপ্তের ‘ছাঁচে’ ঢেলে কবিতা লিখতেন। ‘বঙ্গ-সাহিত্যে এক নবযুগের’ সূচনা করে ফেলেছিলেন তিনি। তৈরি হয়েছিল তাঁর অনুসারী ‘কবি-সম্প্রদায়’। জেলা শহরের এক প্রায় লেখাপড়া না জানা তরুণ কলকাতার বিদ্বজ্জনসভায় নিজের প্রতিভায় ঠাঁই করে নিয়েছেন। হয়ে গিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের অংশ।
তবুও তিনি ‘পাষণ্ড পীড়ন’ প্রকাশ করলেন। কিন্তু ‘পাষণ্ড পীড়ন’ ভদ্রসমাজের কাছে হয়ে দাঁড়াল উৎপীড়ন। বাঙালি ভদ্রজনের কান, গাল লাল করে দিল। করতে চেয়েছিলেন ব্যঙ্গ পত্রিকা। লক্ষ্য ছিল ‘সংবাদ প্রভাকর’ ও তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের রসাল জবাব দেওয়া। কিন্তু পত্রিকা হয়ে দাঁড়াল গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশের ‘সম্বাদ রসরাজ’ পত্রিকার বিরুদ্ধে ‘লড়াই ক্ষ্যাপা’। গৌরীশঙ্কর মানে গুড়গুড়ে ভট্টাচার্যের সঙ্গে কিন্তু এক সময়ে ঈশ্বর গুপ্তের বন্ধুত্ব ছিল। গৌরীশঙ্কর ‘সংবাদ প্রভাকর’কে সাহায্য করতেন। গৌরীশঙ্করেরও একটি পত্রিকা ছিল ‘সংবাদ ভাস্কর’। কিন্তু ‘পাষণ্ড পীড়ন’ প্রকাশের পরে যে শব্দযুদ্ধ শুরু হল, তার অশালীন আওয়াজে সাহিত্য সংসারে কান পাতা দায় হল। সেই সময়ে কবির লড়াইয়ের আসর বসত উৎসবে, অনুষ্ঠানে। আর সেই লড়াই অনেক সময়েই হয়ে উঠত আদিরসের জমাটি আসর। সেই আসরই যেন উঠে এল ছাপা পত্রিকার পাতায়।
দুই পত্রিকা এবং তাদের কবির লড়াইকে বঙ্কিমচন্দ্র বা শিবনাথ শাস্ত্রী কেউই স্বীকৃতি দেননি। ১২৫৪ সালে ‘পাষণ্ড পীড়ন’ বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধের কারণ? সীতানাথ ঘোষ নামে এক ব্যক্তি ‘পাষণ্ড পীড়ন’-এর মাস্ট হেড চুরি করে নিয়ে পালান। পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ হয়ে যাওয়াকে শিবনাথ শাস্ত্রী ‘সুখের বিষয়’ বলেছেন। আর বঙ্কিমচন্দ্রের ধারণা, ‘দুই পত্রের অশ্লীলতায় জ্বালাতন’ হয়ে জেমস লং সাহেব অশ্লীলতা আটকাতে আইনের দরকার বলে প্রচার করতে থাকেন। এবং সফল হন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এত ‘কদর্য’ কবির লড়াইয়ের পরেও দু’জনের ব্যক্তিগত সম্পর্কে সৌজন্যের অভাব হয়নি। গৌরীশঙ্কর গুরুতর অসুস্থ হলে ঈশ্বর গুপ্ত তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন। ঈশ্বর গুপ্তের মৃত্যুর সময়ে গৌরীশঙ্কর ছিলেন গুরুতর অসুস্থ। তিনি দেখতে যেতে পারেননি। কিন্তু মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পরে নিজের পত্রিকা ‘সংবাদ ভাস্কর’এ লিখেছিলেন, সুস্থ হলে ‘সংবাদ প্রভাকর’ সম্পাদকের ‘মৃত্যুশোক’ নিজে লিখবেন।
পরবর্তী কালের একটি ঘটনা। ব্যঙ্গ পত্রিকার শলাকার ধার সংক্রান্ত কাহিনি। কিছুটা মিল রয়েছে গুপ্ত-গুড়গুড়ে সংবাদের সঙ্গে। মিল না থাকলেও রসাস্বাদনে বাধা নেই… অধিকন্তু ন দোষায়। এক সময়ে সজনীকান্ত দাসের ‘শনিবারের চিঠি’র সমালোচনায় বহু বিদ্বজ্জন বিদ্ধ হয়েছিলেন। ছাড় পাননি জীবনানন্দ দাশ, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তবে ‘শনিবারের চিঠি’ অশ্লীলতা দোষে দুষ্ট ছিল না। ঘটনাটির সাক্ষী শিবনারায়ণ রায়। সজনীকান্ত তখন অসুস্থ। একদিন দেখা করতে গিয়েছিলেন শিবনারায়ণ রায়। বাকিটা তাঁর জবানিতেই শোনা যাক, ‘সজনীকান্ত হঠাৎ আমার হাতদুটি চেপে বললেন, শুনেছি বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে আপনার বিশেষ প্রীতির সম্পর্ক আছে। যৌবনে শনিবারের চিঠিতে তাঁকে এবং আরও অনেককে বিস্তর আঘাত করেছি। অনেকেই আমাকে ক্ষমা করেছেন। আমার এখন যাবার সময় হয়েছে। আপনি কি তাঁকে দেখা হলে বলবেন আমি তাঁর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী’। শিবনারায়ণ রায় সজনীকান্তের অনুরোধ যথাস্থানে পৌঁছে দিয়েছিলেন। কিন্তু শুনে বুদ্ধদেব বসুর বক্তব্য ছিল, ‘বুড়ো…ঢং দেখে বাঁচি না। মরার আগে হরিনাম’। ওই শূন্যস্থানে ছিল সাংঘাতিক এক শব্দ-বোমা। যার আওয়াজে শিবনারায়ণ রায়ও চমকিত হয়েছিলেন।
ঈশ্বর গুপ্ত ১২১৮ বঙ্গাব্দের ২৫ ফাল্গুন (৬ মার্চ ১৮১২) পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা জেলার কাঞ্চনপল্লী বা কাঁচড়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রপিতামহ নিধিরাম ছিলেন একজন সুবিখ্যাত কবিরাজ এবং তাঁর পিতা হরিনারায়ণ দাশগুপ্ত প্রথমদিকে আয়ুর্বেদিক বা কবিরাজি চিকিৎসা করতেন; পরে শেয়ালডাঙ্গার কুঠিবাড়িতে চাকরি করেন। তাঁর মায়ের নাম শ্রীমতি দেবী। তাঁর বয়স যখন দশ তখন তাঁর মা পরলোকগমন করেন। পিতা দ্বিতীয় বিয়ে করলে এর পর থেকে তিনি কলকাতার জোড়াসাঁকোতে মামার বাড়ীতে বাস করতে শুরু করেন।
‘সংবাদ প্রভাকর’ সম্পাদনা এবং ‘পাষণ্ড পীড়ন’ প্রকাশের বৈপরীত্য গুপ্ত কবির জীবন জুড়ে। ছোটবেলায় অত্যন্ত উদ্ধত ও অবাধ্য ছিলেন। যা খুশি তা-ই করতেন। ইচ্ছে হলে পাঠশালায় যেতেন। না হলে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো। তিনি কী রকম অবাধ্য ছিলেন? তা হলে তাঁর বাবার বিয়ের ঘটনাটা বলা যেতে পারে। ঈশ্বর গুপ্তের বয়স তখন মাত্র ১০ বছর। মায়ের মৃত্যু হল। কিছু দিনের মধ্যেই বাবা হরিনারায়ণ আবার বিয়ে করলেন। কিন্তু বিয়ে করার পরে বাড়ি না এসে শ্বশুরবাড়ি থেকে সোজা কাজে চলে গেলেন। নববধূ একা এলেন কাঁচরাপাড়ার বাড়িতে। গুপ্ত কবির সৎ ঠাকুমা নববধূকে বরণ করে নিচ্ছিলেন। হ্যাঁ, তাঁর ঠাকুরদারও দু’টি বিয়ে। প্রথম পক্ষ তখন প্রয়াত। কিন্তু সৎ মাকে দেখে রেগে গেলেন বালক ঈশ্বর। সৎ মায়ের দিকে একগাছা রুল ছুড়ে মারলেন। তবে সেই রুল বিমাতার গায়ে লাগেনি। গিয়ে গেঁথে এক কলাগাছে।
তার পরের ঘটনা আরও সাংঘাতিক এবং অবমাননাকর। রুল ছোড়ায় সফল না হয়ে একটা ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করেছিলেন। কিন্তু পরিত্রাণ পাননি। জেঠামশাই দরজা ভেঙে ঈশ্বরচন্দ্রকে জুতো পেটা করেন। কিন্তু তাতেও উদ্ধত ঈশ্বরকে বশে আনা যায়নি। ঠাকুরদা সান্ত্বনা দিতে এসেছিলেন মা হারা ছোট ছেলেটিকে। বলেছিলেন, ‘তোদের মা নেই। মা হল। তোদের দেখবে।’ ঈশ্বর ঠাকুরদার মুখের উপরে বলে দিল, ‘হাঁ! তুমি আর একটা বিয়ে করে যেমন বাবাকে দেখছ, বাবা আমাদের তেমনই দেখবেন’। সময়ের সঙ্গে বিস্তর বদল হয়েছিল এই উদ্ধত ঈশ্বরচন্দ্রের। প্রায় প্রথাগত শিক্ষাহীন এক তরুণ কলকাতার বুধমণ্ডলীতে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন তখন। সেই সময়ের ঈশ্বর গুপ্ত পুরো অন্য মানুষ। সদাহাস্যময়। আর মুখ খুললেই ইঙ্গিতপূর্ণ রসকথা। ছেলে-বুড়ো সকলের সঙ্গে সমান ব্যবহার করতেন। শত্রুরাও নাকি তাঁর ব্যবহারে ‘মুগ্ধ হইত’।
ছোটবেলায় পাঠশালাবিমুখ হওয়ায় পড়াশোনাও খুব বেশি এগোয়নি। কিন্তু তখন থেকেই মুখে মুখে কবিতা বানাতে পারতেন। বাল্যকালের সেই মুখে মুখে কবিতা রচনার অভ্যেস আর রসকথার প্রবাহ মিলেমিশেই বোধহয় তৈরি করেছিল তাঁর হাসি-মজার কবিতাগুলি। গুপ্ত কবি কাব্যরস যন্ত্রে কী নিষ্কাষণ করেননি? যন্ত্রে ঢুকিয়ে দিলেন ‘পাঁটা’। বেরিয়ে এল নির্যাস, ‘রসভরা রসময় রসের ছাগল।/তোমার কারণে আমি হয়েছি পাগল’। দীর্ঘ কবিতা। সেই পাঁঠা-প্রেমাবলির এক জায়গায় লেখা, ‘মজাদাতা অজা তোর কি লিখিব যশ?/যত চুসী তত খুসী হাড়ে হাড়ে রস’। কাব্যযন্ত্রে ঢুকল ‘এণ্ডাওয়ালা তপ্স্যামাছ’। বেরিয়ে এল স্ফূর্তি, ‘প্রাণে নাহি দেরি সয় কাঁটা আঁশ বাছা।/ইচ্ছা করে একেবারে গালে দিক কাঁচা’। বা ‘ভেজে খাই ঝোলে দিই কিংবা দিই ঝালে।/উদর পবিত্র হয় দিবামাত্র গালে’। কবিতায় বর্ণনা করেছেন ‘প্রণয়ের প্রথম চুম্বন’এর রসাস্বাদন! সে কেমন? ‘রসনায় রসবারি খরস্রোতে বয়/শিহরে সর্ব্বাঙ্গ ভঙ্গ দেয় লজ্জাভয়’। চুম্বনের ফল? কিংবা চুম্বনের আকর্ষণের বিপদ? ‘মুনীনাঞ্চ মতিভ্রম এই স্থলে ঘটে।/নতুবা অযুক্তি হেন কি কারণ ঘটে’। এ সবই বঙ্কিম কথিত, ‘ইয়ার্কি’র ফল।
মাত্র ১৫ বৎসর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় গৌরহরি মল্লিকের কন্যা দুর্গামণি দেবী রেবার সঙ্গে। ঈশ্বর গুপ্তের সারাজীবন মোটেই সুখের হয়নি৷ ‘ঈশ্বরগুপ্ত, সাংবাদিক কবি ও গদ্যশিল্পী’তে ড. রেণুপদ ঘোষ লিখেছেন, “তাঁর সেই ব্যর্থ দাম্পত্যজীবনের দুঃখ বা গ্লানির মত অসুস্থতা থেকে ‘সংবাদ প্রভাকর’-ই ঈশ্বর গুপ্তকে মুক্তির নাসিংহোমের নির্ভুল ঠিকানা দিতে পেরেছিল৷’’
আসলে জীবনটাকেই তিনি ব্যঙ্গের দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। সমাজকেও। সেই ভাবনা লেখাতেও স্পষ্ট করে গিয়েছেন। তাঁর মতে, দেশখানা বড়ই রঙ্গে ভরা। শুধু একে অপরকে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা। কাষ্ঠ হাসি, মিছা কান্নায় কার্যসিদ্ধির চেষ্টা।
ঈশ্বর গুপ্ত ভন্ড বা মেকির বড় শত্রু ছিলেন। মেকি মানুষের শত্রু এবং মেকি ধর্মের শত্রু। লোভী পরদ্বেষী অথচ ‘হবিষ্যাশী’ ভণ্ডের ধর্ম তিনি গ্রহণ করেননি। ভণ্ডের ধর্মকে ধর্ম বলে তিনি জানতেন না। তিনি মানতেন ‘ধর্ম ঈশ্বরানুরাগে, আহার ত্যাগে নহে’। যে ধর্মে ঈশ্বরানুরাগ ছেড়ে ‘পানাহারত্যাগকে ধর্মের স্থানে খাড়া করিতে চাহিত—তিনি তাহার শত্রু।’ ঈশ্বর গুপ্ত জীবন যাপনে কথায় যা, কাজেও তাই ছিলেন। “মাতৃসম মাতৃভাষা” যেমন বলছেন, তেমনি ঈশ্বর গুপ্তের দেশপ্রেমও ছিলো তীব্র ও বিশুদ্ধ। যেমন কয়েক ছত্র পাঠ করলেই বুঝতে সহজ হবে কবির স্বদেশানুরাগ –
‘ভ্রাতৃভাব ভাবি মনে, দেখ দেশবাসিগণে,
প্রেমপূর্ণ নয়ন মেলিয়া।
কতরূপ স্নেহ করি, দেশের কুকুর ধরি,
বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া।’
জীবনের মতো রচনাতেও কিন্তু ঈশ্বর গুপ্তের বৈপরীত্য আছে। তাঁর সৃষ্টিমালায় কিন্তু একজন গুপ্ত কবিকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেক ঈশ্বরচন্দ্র সেখানে ছড়িয়ে রয়েছেন। একদল তাঁর কবিতার উদাহরণ দেখিয়ে বলতেই পারেন, ঈশ্বর গুপ্ত ছিলেন ব্রিটিশদের স্তাবক। তাই তিনি ইংল্যান্ডেশ্বরীর স্তুতিতে লিখেছিলেন, ‘তুমি মা কল্পতরু আমরা সব পোষা গরু/ শিখিনি শিং বাঁকানো/কেবল খাবো খোল বিচালি ঘাস’। কিছু দিন আগেই আমাদের দেশে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব জেগেছিল। পুলওয়ামা-বালাকোট পর্বে। বাগযুদ্ধ চলছিল শাসক বনাম বিরোধী দলের। মানবিকতা, ভাবাদর্শ বনাম আনুগত্য এবং ‘দেশভক্তি’র। যুদ্ধের সময় সমাজের অগ্রগণ্যদের মতবাদ গুরুত্বপূর্ণ। ঈশ্বরচন্দ্র মতামত জানিয়েছিলেন কবিতায়। কিন্তু তাতে শাসক ইংরেজের প্রতি আনুগত্যই প্রকাশ পেয়েছে। দ্বিতীয় শিখ যুদ্ধ নিয়ে তাঁর মত, ‘পেটে খেলে পিঠে সয় এই বাক্য ধর।/রাজার সাহায্য হেতু রণসজ্জা পর’। সিপাই বিদ্রোহের অন্যতম নেতা নানাসাহেবকেও একটি কবিতায় ব্যঙ্গ করেছিলেন, ‘আগেতে দেখেছ ঘুঘু, শেষে দেখ ফাঁদ’।
কিন্তু এই ঈশ্বর গুপ্তই তো সরকারি চাকরিতে দেশি ও বিলিতি কর্মচারীদের বেতন বৈষম্য নিয়ে সরকারি নীতির তুলোধনা করেন। কড়া সম্পাদকীয় লেখেন। তাঁর সময়ে কর্মদক্ষ দেশীয় কর্মী পেতেন একশো টাকা। আর ইংরেজরা এক হাজার টাকা। শুধু তা-ই নয়, কাজের ভুল হলে শাস্তির মাত্রাতেও ছিল বৈষম্য। একই রকম ভুলের জন্য ইংরেজ কর্মীদের এক টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হত। কিন্তু এদেশীয় কর্মী হলে তাঁর শাস্তি এক জেলা থেকে অন্য জেলায় বদলি। ‘গুপ্ত কবি’ দেশের মানুষকে ভালবাসতেন না? তা হলে কেন ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর পাতায় ফি বছর দামোদর নদের বন্যায় বাসিন্দাদের কষ্ট নিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন? দেশের বেশির ভাগ মানুষ কৃষিজীবী। তাই সরকারকে প্রস্তাব দেবেন, কৃষিবিদ্যা শিক্ষার বিদ্যালয় গড়ে তোলার!
রচনায় বৈচিত্র থাকলেও ঈশ্বর গুপ্ত কবি হিসেবেই পরিচিত। তাঁর কবিতার সংখ্যা যেমন অগণিত, তেমনি বিষয়ের বৈচিত্রও কম নয়। বঙ্কিমচন্দ্র, ঈশ্বর গুপ্তের কবিতাগুলোকে বিষয়ানুযায়ী কয়টি ভাগে বিভক্ত করেছিলেন –
১) পারমার্থিক ও নৈতিক বিষয়ক কবিতা,
২) সামাজিক ও ব্যঙ্গপ্রধান কবিতা,
৩) রসাত্মক কবিতা,
৪) যুদ্ধ বিষয়ক কবিতা,
৫) ঋতুবর্ণনা প্রধান কবিতা,
৬) বিবিধ বিষয়ক কবিতা,
৭) শকুন্তলার কাহিনী নিয়ে রচিত কবিতা,
৮) সারদা-মঙ্গল বা উমা-মেনকার প্রসঙ্গে কবিতা,
৯) কাব্যকানন,
১০) রসলহরী ও
১১) কবিতাগুচ্ছ।’
শৈশবে লেখাপড়ায় অমনোযোগী হওয়ার কারণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশিদূর এগোয়নি, তবে অসাধারণ মেধা ও স্মৃতিশক্তির অধিকারী ঈশ্বরচন্দ্র নিজ চেষ্টায় বাংলা, সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষা শেখেন এবং বেদান্তদর্শনে পারদর্শিতা লাভ করেন। সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশের প্রেরণায় এবং বন্ধু যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুরের আনুকূল্যে ১৮৩১ সালের ২৮শে জানুয়ারি তিনি সাপ্তাহিক সংবাদ প্রভাকর প্রকাশ করেন। অর্থসংকটের কারণে মাঝে চার বছর বন্ধ থাকার পর ১৮৩৬ সালের ১০ই আগস্ট সপ্তাহে তিন সংখ্যা হিসেবে পত্রিকাটি আবার প্রকাশিত হতে থাকে। তাঁর সুযোগ্য সম্পাদনায় পত্রিকার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেলে ১৮৩৯ সালের ১৪ই জুন থেকে এটি দৈনিক পত্রে রূপান্তরিত হয়। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি তিনি সংবাদ রত্নাবলী পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেন। ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে সাপ্তাহিক পাষণ্ড পত্রিকার সঙ্গে সম্পাদক হিসাবে সংযুক্ত। পরবতী বৎসর তিনি সংবাদ সাধুরঞ্জন পত্রিকার দায়িত্বভার পালন করেন। তিনি গ্রাম গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন এবং কবিগান বাঁধতেন। প্রায় বারো বৎসর গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে তিনি প্রাচীন কবিদের তথ্য সংগ্রহ করে জীবনী রচনা করেছেন।
কিছু বিষয়ে ঈশ্বরচন্দ্রের গোঁড়ামি ছিল। বিশেষ করে মহিলাদের বিষয়ে। বিদ্যাসাগর এবং বিধবাবিবাহ প্রচলনের বিরুদ্ধে ছিলেন। ‘বিধবা-বিবাহ’ কবিতায় তাঁর কিছু পঙ্ক্তি ব্যঙ্গের মাত্রা ছাড়িয়ে অশালীনতার দিকে ঢলেছে। স্ত্রী শিক্ষা বিষয়েও তিনি ছিলেন প্রাচীনপন্থী। তাই লেখেন, ‘আগে মেয়েগুলো ছিল ভাল/ ব্রত ধর্ম কোর্তো সবে।/একা বেথুন এসে শেষ করেছে/ আর কি তাদের তেমন পাবে?/যত ছুঁড়ীগুলো তুড়ী মেরে/কেতাব হাতে নিচ্চে যবে/তখন এ বি শিখে/বিবি সেজে/বিলাতী বোল কবেই কবে’। ব্যক্তিজীবনেও স্ত্রীর প্রতি রূঢ় ছিলেন ঈশ্বর গুপ্ত। পনেরো বছর বয়সে গুপ্তিপাড়ার গৌরহরি মল্লিকের মেয়ে দুর্গামণির সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু ঈশ্বর গুপ্ত স্ত্রীর সঙ্গে কোনও দিন কথা বলতেন না। কারণ দুর্গামণি কুৎসিত। হাবাগোবা। তবে এর পিছনে নাকি প্রণয়ঘটিত কাহিনিও ছিল। ‘গুপ্ত কবি’ নাকি কাঁচরাপাড়ার কোনও ধনী পরিবারের অপরূপাতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু তাঁর বাবা ছেলের মনোবাঞ্ছা পূরণ করেননি। দুর্গামণির সঙ্গে বিয়ে দেন। আর দুর্গামণি হন তাঁর অবহেলার শিকার।
আধুনিক বাংলার সমাজ গঠনে সংবাদ প্রভাকরের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঈশ্বরচন্দ্র প্রথমে নব্যবঙ্গ আন্দোলনের বিরুদ্ধে রক্ষণশীলদের পক্ষভুক্ত ছিলেন। তিনি হিন্দু কলেজের শিক্ষাপদ্ধতিরও বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু নবপর্যায়ে সংবাদ প্রভাকর সম্পাদনার সময় থেকে তাঁর মনোভাবের পরিবর্তন হতে থাকে। তিনি দেশের প্রগতিশীল ভাবধারার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন। হিন্দু থিয়ফিলানথ্রফিক সভা এবং তত্ত্ববোধিনী সভায় তিনি বক্তৃতাও করতেন। প্রথম দিকে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলনের বিরোধিতা করে এ বিষয়ে নানা ব্যঙ্গ কবিতা রচনা করলেও পরে স্ত্রীশিক্ষার সমর্থন, ধর্মসভার বিরোধিতা, দেশের বৈজ্ঞানিক ও বাণিজ্যিক উন্নয়ন প্রচেষ্টা এবং দরিদ্র জনগণের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে উদার মনোভাবের পরিচয় দেন। এমনকি তিনি অক্ষতযোনি বিধবার বিবাহেও আর আপত্তি করেননি।
ঈশ্বর গুপ্তকে এমন অনেক দিক দিয়ে বিচার করা যায়। তারই একটি হল তাঁর দেখার চোখ। বাংলা সাংবাদিকতার শুরুর সময়েই তিনি এমন কিছু বিষয় নিয়ে লিখেছিলেন, যা নিয়ে আজও কথায় লাঠালাঠি চলে। এই দু’টি পঙ্ক্তি, ‘শুনে জিনিসের দর গায়ে আসে জ্বর/ছুটে যাই ঘর বাড়ী ফেলে’। আজই কোনও কবি লিখেছেন বললে কি ভুল হবে? বাজারের অগ্নিমূল্য তো এখন রোজকারের খবর। আর ধর্ম নিয়ে টানাপড়েন? কিছু বলার অপেক্ষা রাখে! শাসকের কোনও ধর্মের প্রতি পক্ষপাত থাকবে না, এটা ধর্মান্ধ ছাড়া সকলেরই দাবি। ১৮৫৩ সালে সেই দাবিই তুলেছিলেন ঈশ্বর গুপ্ত। এক লেখায় জানিয়েছিলেন, রাজকোষের অর্থ দিয়ে ‘পাদ্রীদের প্রতিপালন’ অত্যন্ত অন্যায় কাজ।
স্বদেশ ও স্বসমাজের প্রতি ঈশ্বরচন্দ্রের অনুরাগ ছিল অত্যন্ত নিবিড়। তিনি বাংলা ভাষার উন্নয়নের জন্য যে আন্দোলন করেছেন তা আজ স্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি সবসময় ইংরেজি প্রভাব বর্জিত খাঁটি বাংলা শব্দ ব্যবহার করতেন। ভাষা ও ছন্দের ওপর তাঁর বিস্ময়কর অধিকারের প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর বোধেন্দুবিকাশ (১৮৬৩) নাটকে।
ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালির ‘বুলি’ আর মাতৃভাষা বাংলার দ্বন্দ্ব এখনও শোনা যায়। ঈশ্বর গুপ্তের সময়েও শোনা যেত। তাই নতুন প্রজন্মকে তাঁর কটাক্ষ, ‘যত কালের যুবো যেন সুবো/ইংরেজী কয় বাঁকা ভাবে’। শুধু কি তাই? বাঙালি নব প্রজন্ম বিলাতি কায়দায় রপ্ত হবে, ‘সব কাঁটা চামচে ধোরবে শেষে/পিঁড়ি পেতে আর কি খাবে?’ দেশি বনাম বিলিতি টানাপড়েন দীর্ঘদিনের। বাঙালির অনুকরণ প্রবণতা শ্লেষের খোরাক হয়েছে বারবার। ঈশ্বর গুপ্তেরই শিষ্য বঙ্কিমচন্দ্র পরে লিখবেন বিখ্যাত ‘বাবু’ চরিত। উনিশ শতকে বাবু কারা? যাদের ‘চর্ম্ম কোমল হইলেও সাগরপার-নির্ম্মিত দ্রব্যবিশেষের প্রহারসহিষ্ণু’ তারা বাবু। আর
কারা বাবু? ‘যাঁহার স্নানকালে তৈলে ঘৃণা, আহারকালে আপন অঙ্গুলিকে ঘৃণা এবং কথোপকথনকালে মাতৃভাষাকে ঘৃণা তিনিই বাবু’। আবার মুজতবা আলীর ‘ইঙ্গ-ভারতীয় কথোপকথন’ পড়ুন। সেই হাতে খাওয়া বনাম কাঁটা-চামচ। তবে অন্য আঙ্গিকে। আলী সাহেবের রম্যরচনাটি দু’টি চরিত্রের কথোপকথন। একজন বিদেশি আর অন্যজন ভারতীয়। বিদেশিকে ভারতীয় বলছেন, ‘ভারতবর্ষ তোমাদের পাল্লায় পড়িয়া দিন দিন এমনি অসভ্য হইয়া পড়িতেছে যে, ভারতীয়রাও ছুরি কাঁটা ধরিতে শিখিবার চেষ্টা করিতেছে’। ব্যঙ্গের সলতে জ্বালিয়েছিলেন গুপ্ত কবি। তা কিন্তু আজও জ্বলছে।
ঈশ্বর গুপ্তের ব্যঙ্গদর্শী চোখ বা মন তখনই ধরে ফেলেছিল, দুর্গাপুজো লড়াকু বাঙালির আর এক রণক্ষেত্র। তাই বোধহয় তিনি লিখেছিলেন, ‘তোমরা মাথা কুটাকুটি করিয়া দুর্গোৎসব কর’। এখনও প্রতি শারদীয়ায় ‘হাজার হাতের দুর্গা’, পঞ্চাশ ফুটের প্রতিমার বিজ্ঞাপন কি সেই মাথা ‘কুটাকুটি’র পরম্পরা?
ঈশ্বরচন্দ্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি হলো ভারতচন্দ্র রায়, রামপ্রসাদ সেন, নিধুগুপ্ত, হরু ঠাকুর ও কয়েকজন কবিয়ালের লুপ্তপ্রায় জীবনী উদ্ধার করে প্রকাশ করা। পরবর্তীকালের বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ লেখকের জন্য একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করার কৃতিত্বও তাঁর। যদিও ঈশ্বরচন্দ্রের কাব্যরীতি পরবর্তীকালের বাংলা সাহিত্যে আর অনুসৃত হয়নি, তথাপি এ কথা স্বীকার্য যে, ভবিষ্যৎ বাংলা সাহিত্যের জন্য তাঁর গঠনমূলক চিন্তাভাবনা ও আদর্শ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
ঈশ্বচন্দ্র গুপ্ত ছোটবেলা থেকেই মুখে মুখে কবিতা রচনা করতেন এবং কবিয়ালদের গান বেঁধে দিতেন। সমসাময়িক ঘটনাকে ব্যঙ্গ করে তিনি অসংখ্য খন্ডকবিতা সংবাদ প্রভাকরে প্রকাশ করেন। উনিশ শতকের প্রথম ভাগের এ কবি স্বদেশমূলক যেসব কবিতা রচনা করেছেন তার জন্যও তিনি বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
ঈশ্বরচন্দ্র সংবাদ প্রভাকর ছাড়াও সংবাদ রত্নাবলী, পাষন্ডপীড়ন ও সংবাদ সাধুরঞ্জন পত্রিকাও সম্পাদনা করেন। তিনি রামপ্রসাদ সেন রচিত কালীকীর্তন (১৮৩৩) ও প্রবোধ প্রভাকর (১৮৫৮) সম্পাদনা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর রচিত হিতপ্রভাকর (১৮৬১) ও বোধেন্দুবিকাশ (১৮৬৩) প্রকাশিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তর কবিতা সংগ্রহ (১৮৮৫) এবং সত্যনারায়ণ ব্রতকথা (১৯১৩)।
বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘সংবাদ প্রভাকর’ বিষয়ে কিছু না লিখলে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বিষয়ে সবটা বলা হয় না । ‘সংবাদ প্রভাকর’ প্রথম প্রকাশের তারিখ ১৮৩১ সালের ২৮শে জানুয়ারি, শুক্রবার (১৬ই মাঘ, ১২৩৭ বঙ্গাব্দ)। প্রকাশক ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। পত্রিকাটি প্রকাশে পাথুরিয়া ঘাটার যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুরের ভূমিকা ও সহযোগিতা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ ও অপরিহার্য। তাঁর মৃত্যুর কারণে ১৮৩২ সালের ২৫শে মে প্রকাশিত ৬৯তম সংখ্যার পর পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। তাঁর মৃত্যুর চার বছর পর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত পুনরায় সংবাদ প্রভাকর প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৮৩৬ সালের ১০ই আগস্ট থেকে পত্রিকাটি বারত্রয়িক রূপে প্রকাশিত হতে থাকে। পুনরায় পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবার পত্রিকা প্রকাশে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ করে। ১৮৩৯ সালের ১৪ই জুন সংবাদ প্রভাকর বাংলায় প্রকাশিত সর্বপ্রথম দৈনিক পত্রিকারূপে আবির্ভূত হয়। ১৮৫৩ সাল থেকে পত্রিকাটির মাসিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়। মাসিক সংবাদ প্রভাকরে ঈশ্বরচন্দ্র প্রাচীন বাংলার ‘কবিয়াল’ ও গীতিকারদের জীবনী ও কর্মগাথা সংগ্রহ ও প্রকাশ করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই রামচন্দ্র গুপ্ত সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদক নিযুক্ত হন।
ঈশ্বর গুপ্তের ভাবনা আর এক বিষয়ে কালজয়ী। আগে ঘটনাটি বলা যাক। ১২৫৭ সাল। নববর্ষে তিনি নতুন একটি অনুষ্ঠান শুরু করলেন। নিজের ‘যন্ত্রালয়’-এ ওই দিন একটি সভার আয়োজন করলেন। প্রতি বছর পয়লা বৈশাখ সভা হত। সেই সভায় কলকাতা এবং জেলার সম্ভ্রান্ত মানুষ, বিদ্বান ও ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ জানালেন। কী হত সেই সভায়? ঈশ্বরচন্দ্র প্রবন্ধ, কবিতা পড়তেন। পরের দিকে তাঁর ছাত্রদের মধ্যে যাঁরা ভাল লিখতেন, তাঁদের লেখা সভায় পাঠ করার সুযোগ দিতেন। যাঁর লেখা ভাল হত তাঁকে নগদ পুরস্কার দিতেন। এই সভায় সভাপতিত্ব করেছেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো ব্যক্তিত্ব। সভাশেষে আমন্ত্রিত চার-পাঁচশো লোকের মহাভোজের আয়োজন থাকত।
কলকাতার বইপাড়ায় নববর্ষ পালন হয়। সাহিত্যপাঠ, ভোজনও পালনীয় রীতি সেখানে। এই রীতির ভগীরথ কি ‘গুপ্ত কবি’!
বলা হয়ে থাকে, তাঁর কবি প্রতিভা কিছুটা ‘সাংবাদিক’ ধরনের।কিন্তু বাংলা সাহিত্যে তাঁর চিরস্থায়ী আসন লাভ সম্ভব হয়েছে কারণ একদিকে মধ্যযুগের দেবমাহাত্ম্য ব্যঞ্জক বিষয় থেকে বাংলা কবিতাকে মুক্ত করে তিনি যেমন অনায়াসে ‘পাঁঠা’, ‘আনারস’, ‘তোপসে মাছ’ ইত্যাদি বিষয় অবলম্বনে কবিতা লেখেন; তাঁর কবিতায় উঠে আসে সমসাময়িক রাজনইতিক,সামাজিক ঘটনাবলির চিত্ররূপ তাঁর নিজের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে। তৎকালীন কবিওয়ালা দের জিম্মা থেকে বাংলা কবিতাকে তিনি নাগরিক বৈদগ্ধ ও মার্জিত রুচির আলোয় নিয়ে আসেন। সাংবাদিক রূপেও ঊনবিংশ শতকের এই আধুনিক মানুষটি যথাযোগ্য কৃতিত্বের সাক্ষর রেখেছেন।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের একটি প্রিয় কাব্যকৌশল ‘যমক’ (একই বর্ণসমষ্টি একাধিকবার একাধিক অর্থে প্রয়োগ করা) বিষয়ে সামান্য ধারনা নেওয়া যাক। কতগুলো নমুনা –
১) “অতনু শাসনে তনু তনু অনুদিন” (১ম তনু = দেহ, ২য় তনু = কৃশ)
২) “ভাবে নাহি ভাবি ভাবি” (১ম ভাবি = ভাবনা করি, ২য় ভাবি = ভবিষ্যৎ)
৩) “আনা দরে আনা যায় কত আনারস” (১ম আনা = টাকার ১/১৬ অংশ, ২য় আনা = আনয়ন করা)
৪) “প্রকাশিয়া প্রভাকর শুভ দিন দিন” (১ম দিন = দিবস, ২য় দিন = প্রদান করুন)
৫) “মিথ্যার কাননে কভু ভ্রমে নাহি ভ্রমে” (১ম ভ্রমে = ভুলে, ২য় ভ্রমে = ভ্রমণ করে)
৬) “দুহিতা আনিয়া যদি না দেহ, নিশ্চয় আমি ত্যাজিব দেহ” (১ম দেহ = প্রদান কর, ২য় দেহ = শরীর)
৭) “ওরে ভণ্ড হাতে দণ্ড এ কেমন রোগ।
দণ্ডে দণ্ডে নিজ দণ্ডে দণ্ড কর ভোগ।।”
(অর্থঃ দণ্ডে দণ্ডে = সময়ে সময়ে, নিজ দণ্ডে = নিজের ডাণ্ডায়, দণ্ড = শাস্তি)
৮) “কয় মাস খাও মাস উদর ভরিয়া।” (অর্থঃ ১ম মাস = ৩০ দিন, ২য় মাস = মাংস)
৯) “চিত্রকরে চিত্র করে করে তুলি তুলি।” (অর্থঃ চিত্রকরে = চিত্রকর + ৭মী বিভক্তি। চিত্র করে = ছবি আঁকে। করে = হাতে। ১ম তুলি = উত্তোলন করে, ২য় তুলি = আঁকার কাঠি)
১০) সেতার অনেক আছে, সে তার ত নাই। (অর্থঃ সেতার = বাদ্যযন্ত্রবিশেষ, সে তার = সেই তন্ত্র)
১১) তানপুরা আছে মাত্র, তান পুরা নাই। (অর্থঃ তানপুরা = বাদ্যযন্ত্রবিশেষ, তান পুরা = সম্পূর্ণ তান)
ব্যঙ্গ অনেক সময় বিদ্বেষপ্রসূত হলেও ঈশ্বর গুপ্ত ছিলেন ব্যতিক্রম। সমালোচকদের কেউ বলছেন, ‘স্থূল কথা, ঈশ্বর গুপ্ত Realist এবং ঈশ্বর গুপ্ত Satirist। ইহা তাঁহার সাম্রাজ্য, এবং ইহাতে তিনি বাঙ্গালা সাহিত্যে অদ্বিতীয়। … ঈশ্বর গুপ্তের ব্যঙ্গে কিছুমাত্র বিদ্বেষ নাই। শত্রুতা করিয়া তিনি কাহাকেও গালি দেন না। কাহারও অনিষ্ট কামনা করিয়া কাহাকেও গালি দেন না। মেকির উপর রাগ আছে বটে, তা ছাড়া সবটাই রঙ্গ, সবটা আনন্দ। কেবল ঘোর ইয়ারকি। গৌরীশঙ্করকে গালি দিবার সময়েও রাগ করিয়া গালি দেন না। সেটা কেবল জিগীষা — ব্রাহ্মণকে কুভাষার পরাজয় করিতে হইবে এই জিদ।’
সাহিত্যবোদ্ধাগণ তাই বলছেন, ‘তবে ইহা স্বীকার করিতে হয়, যে ঈশ্বর গুপ্ত মেকির উপর গালিগালাজ করিতেন। মেকির উপর যথার্থ রাগ ছিল। মেকি বাবুরা তাঁহার কাছে গালি খাইতেন, মেকি সাহেবেরা গালি খাইতেন, মেকি ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা “নস্যলোসা দধি চোসার” দল, গালি খাইতেন। হিন্দুর ছেলে মেকি খ্রীষ্টীয়ান হইতে চলিল দেখিয়া তাঁহার রাগ সহ্য হইত না। … অনেক সময়ে ঈশ্বর গুপ্তের অশ্লীলতা এই ক্রোধসম্ভূত। অশ্লীলতা ঈশ্বর গুপ্তের কবিতার একটি প্রধান দোষ। উহা বাদ দিতে গিয়া ঈশ্বর গুপ্তকে Bowdlerize করিতে গিয়া, আমরা তাঁহার কবিতাকে নিস্তেজ করিয়া ফেলিয়াছি। যিনি কাব্যরসে যথার্থ রসিক, তিনি আমাদিগকে নিন্দা করিবেন। কিন্তু এখনকার বাঙ্গালা লেখক বা পাঠকের যেরূপ অবস্থা তাহাতে কোনরূপেই অশ্লীলতার বিন্দুমাত্র রাখিতে পারি না। ইহাও জানি যে, ঈশ্বর গুপ্তের অশ্লীলতা, প্রকৃত অশ্লীলতা নহে। যাহা ইন্দ্রিয়াদির উদ্দীপনার্থ বা গ্রন্থকারের হৃদয়স্থিত কদর্যভাবের অভিব্যক্তি জন্য লিখিত হয়, তাহাই অশ্লীলতা। তাহা পবিত্র সভ্যভাষায় লিখিত হইলেও অশ্লীল। আর যাহার উদ্দেশ্য সেরূপ নহে, কেবল পাপকে তিরস্কৃত বা উপহসিত করা যাহার উদ্দেশ্য, তাহার ভাষা রুচি এবং সভ্যতার বিরুদ্ধ হইলেও অশ্লীল নহে। ঋষিরাও এরূপ ভাষা ব্যবহার করিতেন। সেকালের বাঙ্গালীদিগের ইহা এক প্রকার স্বভাবসিদ্ধ ছিল। আমি এমন অনেক দেখিয়াছি। অশীতিপর বৃদ্ধ, ধর্মাত্মা, আজন্ম সংযতেন্দ্রিয় সভ্য, সুশীল, সজ্জন, এমন সকল লোকও, কুকাজ দেখিয়াই রাগিলেই “বদ্জোবান” আরম্ভ করিতেন। তখনকার রাগ প্রকাশের ভাষাই অশ্লীল ছিল। ফলে সে সময়ে ধর্মাত্মা এবং অধর্মাত্মা উভয়কেই অশ্লীলতায় সুপটু দেখিতাম—প্রভেদ এই দেখিতাম, যিনি রাগের বশীভূত হইয়া অশ্লীল, তিনি ধর্মাত্মা। যিনি ইন্দ্রিয়ান্তরের বশে অশ্লীল তিনি পাপাত্মা, সৌভাগ্যক্রমে সেরূপ সামাজিক অবস্থা ক্রমে ক্রমে বিলুপ্ত হইতেছে।’
ঈশ্বরচন্দ্রের কবিতায় অশ্লীলতা বিষয়ে সমালোচকগণ লিখছেন, ‘ঈশ্বর গুপ্ত সংসারকে সমাজকে, স্বীয় বাহুবলে পরাস্ত করিয়া, তাহার নিকট হইতে ধন, যশ, সম্মান আদায় করিয়া লইলেন। কিন্তু অত্যাচারজনিত যে ক্রোধ তাহা মিটিল না। জ্যেঠা মহাশয়ের জুতা তিনি সমাজের জন্য তুলিয়া রাখিয়াছিলেন। এখন সমাজকে পদতলে পাইয়া বিলক্ষণ উত্তম মধ্যম দিতে লাগিলেন। সেকেলে বাঙ্গালীর ক্রোধ কদর্যের উপর কদর্য ভাষাতেই অভিব্যক্ত হইত। বোধ হয় ইহাদের মনে হইত, বিশুদ্ধ পবিত্র কথা, দেব দেবদ্বিজাদি প্রভৃতি যে বিশুদ্ধ ও পবিত্র তাহারই ব্যবহার্য — যে দুরাত্মা, তাহার জন্য এই কদর্য ভাষা। এইরূপে ঈশ্বরচন্দ্রের কবিতায় অশ্লীলতা আসিয়া পড়িয়াছে। আমরা ইহাও স্বীকার করি যে, তাহা ছাড়া অন্যবিধ অশ্লীলতাও তাঁহার কবিতায় আছে। কেবল রঙ্গদারির জন্যে শুধু ইয়ারকির জন্য এক আধটু অশ্লীলতাও আছে। কিন্তু দেশ কাল বিবেচনা করিলে, তাহার জন্য ঈশ্বরচন্দ্রের অপরাধ ক্ষমা করা যায়। সে কালে অশ্লীলতা ভিন্ন কথার আমোদ ছিল না। যে ব্যঙ্গ অশ্লীল নহে, তাহা সরস বলিয়া গণ্য হইত না। যে কথা অশ্লীল নহে, তাহা সতেজ বলিয়া গণ্য হইত না। যে গালি অশ্লীল নহে, তাহা কেহ গালি বলিয়া গণ্য করিত না। তখনকার সকল কাব্যই অশ্লীল। চোর, কবি, চোরপঞ্চাশৎ দুই পক্ষে অর্থ খাটাইয়া লিখিবেন—বিদ্যাপক্ষে এবং কালীপক্ষে — দুই পক্ষে সমান অশ্লীল। তখন পূজা পার্বণ অশ্লীল — উৎসবগুলি অশ্লীল —দুর্গোৎসবের নবমীর রাত্র বিখ্যাত ব্যাপার। যাত্রার সঙ অশ্লীল হইলেই লোকরঞ্জক হইত। পাঁচালি হাফআকড়াই অশ্লীলতার জন্যই রচিত। ঈশ্বর গুপ্ত সেই বাতাসের জীবন প্রাপ্ত ও বর্ধিত। অতএব ঈশ্বর গুপ্তকে আমরা অনায়াসে একটুখানি মার্জনা করিতে পারি।’
এ বিষয়ে আরো লিখছেন, ‘ঈশ্বরচন্দ্রের জীবনীতে আমরা অবগত হইয়াছি যে, একজন অশিক্ষিত যুবা কলিকাতায় আসিয়া সাহিত্য ও সমাজে আধিপত্য সংস্থাপন করিল। কি শক্তিতে? তাহাও দেখিতে পাই —নিজ প্রতিভা গুণে। কিন্তু ইহা দেখিতে পাই যে, প্রতিভানুযায়ী ফল ফলে নাই। প্রভাকর মেঘাচ্ছন্ন। সে মেঘ কোথা হইতে আসিল? বিশুদ্ধ রুচির অভাবে। এখন ইহা এক প্রকার স্বাভাবিক নিয়ম যে, প্রতিভা ও সুরুচি পরস্পর সখী—প্রতিভার অনুগামিনী সুরুচি। ঈশ্বর গুপ্তের বেলা তাহা ঘটে নাই নাই কেন? এখানে দেশ, কাল পাত্র বুঝিয়া দেখিতে হইবে। তাই আমি দেশের রুচি বুঝাইলাম, কালের রুচি বুঝাইলাম, এবং পাত্রের রুচি বুঝাইলাম। বুঝাইলাম যে পাত্রের রুচির অভাবের কারণ,
(১) পুস্তকদত্ত সুশিক্ষার অল্পতা,
(২) মাতার পবিত্র সংসর্গের অভাব,
(৩) সহধর্মিণী, অর্থাৎ যাঁহার সঙ্গে একত্রে ধর্ম শিক্ষা করি, তাঁহার পবিত্র সংসর্গের অভাব,
(৪) সমাজের অত্যাচার এবং তজ্জনিত সমাজের উপর কবির জাতক্রোধ।
যে মেঘে প্রভাকরের তেজোহ্রাস করিয়াছিল এই সকল উপাদানে তাহার জন্ম। স্থূল তাৎপর্য এই যে, ঈশ্বরচন্দ্র যখন অশ্লীল তখন কুরুচির বশীভূত হইয়াই অশ্লীল, ভারতচন্দ্রাদির ন্যায় কোথাও কুপ্রবৃত্তির বশীভূত হইয়া অশ্লীল নহেন। তাই দর্পণতলস্থ প্রতিবিম্বের সাহায্যে প্রতিবিম্বধারী সত্তাকে বুঝাইবার জন্য আমরা ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের অশ্লীলতা দোষ এত সবিস্তারে সমালোচনা করিলাম। ব্যাপারটা রুচিকর নহে।’
বাংলার দুই জন সাধক, আমাদের বড় নিকট আপনজন, দুই জনই কবি। এক রামপ্রসাদ সেন, আর এক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। তাঁরা কেউই বৈষ্ণব ছিলেন না, ঈশ্বরকে প্রভু, সখা, পুত্র, বা কান্তভাবে দেখেননি। তাই বলা হয় – ‘রামপ্রসাদ ঈশ্বরকে সাক্ষাৎ মাতৃভাবে দেখিয়া ভক্তি সাধিত করিয়াছিলেন — ঈশ্বরচন্দ্র পিতৃভাবে। রামপ্রসাদের মাতৃপ্রেমে আর ঈশ্বরচন্দ্রের পিতৃপ্রেমে ভেদ বড় অল্প।’ যেমনটি তিনি লিখছেন –
‘তুমি হে ঈশ্বর গুপ্ত ব্যাপ্ত ত্রিসংসার।
আমি হে ঈশ্বর গুপ্ত কুমার তোমার।।
পিতৃ নামে নাম পেয়ে, উপাধি পেয়েছি।
জন্মভূমি জননীর কোলেতে বসেছি ।।
তুমি গুপ্ত আমি গুপ্ত, গুপ্ত কিছু নয়।
তবে কেন গুপ্ত ভাবে ভাব গুপ্ত রয়?’
সামাজিক ও ব্যঙ্গকবিতাগুলোর জন্যও ঈশ্বরগুপ্তের সর্বাধিক খ্যাতি। তাঁর রঙ্গরসপ্রবণতা ও লঘু চপলভঙ্গি কবিতাগুলোকে উৎকর্ষ দান করেছে। সে আমলে ইংরেজি শিক্ষাসভ্যতার সংস্পর্শে বাঙালির সমাজ ও জীবনে যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল ঈশ্বরগুপ্ত তাঁকে কবিতার উপজীব্য করেছেন। যেখানেই সামাজিক অনাচার, চারিত্রিক দৈন্য ও আদর্শহীনতা দেখেছেন সেখানেই তীব্র ব্যঙ্গ করেছেন। ইংরেজদের আচার আচরণকে এ দেশের জন্য অকল্যাণকর মনে করে ইংরেজিয়ানা প্রীতির ব্যঙ্গ করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাঁর ‘ইংরেজি নববর্ষ’ কবিতায় –
‘গোরার দঙ্গলে গিয়া কথা কহ হেসে।
ঠেস মেরে বস গিয়া বিবিদের ঘেঁসে॥
রাঙ্গামুখ দেখে বাবা টেনে লও হ্যাম।
ডোন্ট ক্যার হিন্দুয়ানী ড্যাম ড্যাম ড্যাম॥
পিঁড়ি পেতে ঝুরো লুসে মিছে ধরি নেম।
মিসে নাহি মিস খায় কিসে হবে ফেম?
শাড়িপরা এলোচুল আমাদের মেম।
বেলাক নেটিভ লেডি শেম্ শেম্ শেম্ ॥’ (সংক্ষেপিত)
আমরা জানি, এ অঞ্চলে পূর্বে জ্ঞানীমাত্রকেই কবি বলা হতো। শাস্ত্রবেত্তারা সকলেই ছিলেন “কবি”। তাঁরা ছিলেন নমস্য। সেই নমস্য কবিকে নিয়ে, ‘ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত’ নামক কবিতায় মধুকবি মাইকেলের তাই আক্ষেপ ছিলো, ‘নাহি কি কেহ তব বান্ধবের দলে, তব চিন্তা-ভস্মরাশি কুড়ায়ে যতনে। স্নেহ-শিল্পে গড়ি মঠ, রাখে তার তলে’। মানতেই হবে, সঠিক অর্থে তিনি যুগস্রষ্টা নন।
যুগের আজ্ঞাবহ মাত্র। তাঁর স্নেহধন্য বঙ্কিমের উক্তি, “তিনি সুশিক্ষিত হইলে, তাহার যে প্রতিভা ছিল, তাহার বিহীত প্রয়োগ হইলে, তাহার কবিত্ব, কার্য এবং সমাজের উপর আপত্য অনেক বেশি হইতো। বাংলা সাহিত্যও অনেক দূর অগ্রসর হইতো। তার ছিল মার্জিত রুচির অভাব এবং উচ্চ লক্ষ্যের অভাব। … দুঃখ যে একটা প্রতিভা ইয়ারকিতেই ফুরাইল।” প্রসঙ্গত বঙ্কিমের লেখনীশক্তির উন্মেষ ঘটেছিল ঈশ্বর গুপ্তেরই উৎসাহে। শিবনাথ শাস্ত্রী যথার্থই লিখেছেন, “তাহার অনুসরণে শিষ্য-প্রশিষ্য-শাখা-প্রশাখা সমন্বিত এক কবি সমপ্রদায়ের সৃষ্টি হয়। বঙ্কিম তার ভিতর সর্বাপেক্ষা বিদগ্ধ এবং সর্বাপেক্ষা খ্যাতিমান। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য জগতে প্রতিষ্ঠার জন্যই ঈশ্বর গুপ্ত সাহিত্য জগতে অমর হয়ে থাকবেন তার দোষত্রুটি সব নিয়েই। আলোচিত-সমালোচিত ‘কবি’ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে আবারো জানাই শ্রদ্ধা।
(তথ্যসূত্র:
১- ঈশ্বর গুপ্ত রচনাবলী, সম্পাদক: শান্তিকুমার দাশগুপ্ত ও হরিবন্ধু মুখটী।
২- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘ঈশ্বরগুপ্তের কবিতাসংগ্রহ— ভূমিকা’।
৩- ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন-বঙ্গসমাজ’, শিবনাথ শাস্ত্রী।
৪- ‘ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের নির্বাচিত রচনাবলী’, সম্পাদনা: বাঁধন সেনগুপ্ত।
৫- ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, ড. অমৃতলাল বালা, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ (২০১০)।
৬- ঈশ্বর গুপ্ত : জীবন ও সাহিত্য, ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায়, প্রজ্ঞা বিকাশ (২০১৩)।
৭- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩১শে জানুয়ারি ২০২০ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত