অ্যান্ড্রু রবিনসন বলেছিলেন, “chakravarti recalls Chaplin to his best. Instead of moustache, he has a pair of eyes as bulbous as a frog’s which he opens wide with every emotion known to man”.
হাওড়া থেকে তুলসী চক্রবর্তী হামেশাই হেঁটে আসতেন টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়ায়। উদ্দেশ্য ছিল পথ চলতি মানুষ আর তাদের জীবন ও ম্যানারিজম কাছ থেকে দেখা। এই দেখাটাই তাঁর অভিব্যক্তিতে অবয়ব পেত সিনেমার পর্দায়, নাটকের মঞ্চে। চ্যাপলিন যেমন ছিলেন একজন কমপ্লিট অভিনেতা, তুলসী চক্রবর্তীও ছিলেন তেমনই একজন।
অথচ জীবনে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পাননি তুলসী চক্রবর্তী। পাওনা হিসেবে ছিল অপমান, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা আর শুধুই মিথ্যে প্রতিশ্রুতি।
একসময় সার্কাসের এই প্রাক্তন কর্মী একটি শটের আগে মেকআপ রুমে মেকআপ করতে গিয়ে দেখলেন মেকআপ ম্যান দায়সারা গোছের মেকআপ করছে। যখন তুলসী বাবুর মেকআপ নেবার পালা এল তখন “মেকআপ টা একটু ভালো করে করে দে বাবা” বলায় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে মেকআপ ম্যান জানিয়েছিল, “ইঃ! মেকআপ করবে মেকআপ? কি এমন চরিত্র করেন যে মেকআপ করবেন? যান যান ..”।
‘পথের পাঁচালি’তে প্রসন্ন গুরুমশাই এর চরিত্র করার সময়ই সত্যজিৎ রায়ের নজরে পড়েন তুলসী চক্রবর্তী। পরে সত্যজিৎ রায় যখন তাকে মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন ‘পরশ পাথর’ এ হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিলেন আনন্দে।
শুটিং এর সময় লোকেশন এ তার জন্য গাড়ী পাঠিয়ে দিতেন সত্যজিৎ রায় বিস্মিত তুলসী চক্রবর্তী বারংবার ড্রাইভার কে বলতেন – “বাবা আমি গাড়ী চেপে শুটিং করতে যাচ্ছি .. এ যে আমার বিশ্বাসই হচ্ছেনা”।
সত্যজিৎ রায় একটি অমোঘ কথা বলেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী সম্বন্ধে। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন – “তুলসী চক্রবর্তী র অভিনয়ের কদর এই পোড়া দেশে কেউ করে না তবে আমেরিকায় জন্মালে উনি নিশ্চিত অস্কার পেতেন”। যদিও পরশ পাথরের জন্য সত্যজিৎ রায় তাঁকে প্রতিদিন একশো টাকা পারিশ্রমিক এর প্রস্তাব দিলে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেছিলেন, “ওরে বাবা! আমি এত টাকা পাওয়ার যোগ্য নই। আর সিনেমা পাড়ায় যদি রটে যায় আমি রোজ একশো টাকা নিচ্ছি আমি আর কাজ পাব না মানিক বাবু”।
প্রবল দারিদ্র্যের সঙ্গে আজীবন লড়াই করলেও মুখের হাসি ছিল অনাবিল। অনুপকুমার কে ছেলে বলতেন তুলসী চক্রবর্তী প্রবল শীতে একবার অনুপকুমার তুলসী চক্রবর্তীকে একটি কোট কিনে দেওয়ায় অনুপকুমার কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী।
যাঁকে সারাজীবন পর্দায় হাস্যরস পরিবেশন করে যেতে
হয়েছে অথচ তাঁর কপালে বিধাতা ‘হাসি’ লেখার আগে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তুলসী চক্রবর্তীকে নিয়ে লিখলে শেষ হবে না।
সত্যজিতের মতে তিনি যদি হলিউডে অভিনয় করতেন, নির্দ্বিধায় অস্কার পেতেন। তাইতো মানিক বাবু তাঁকে ভারতের মরিস শিভালিয়র মানতেন। তিনি তুলসী চক্রবর্তী। অনবদ্য একজন অভিনেতা, সাংঘাতিক ভাবে বাঙলার কীর্তণ, যাত্রা,থিয়েটার বা অর্কেস্ট্রার দেশোয়ালি গন্ধ লেগেছিল তাঁর অভিনয়ে। তিনিই বোধহয় টলিউডের চার্লি চ্যাপলিন।
কৃষ্ণনগরে জন্ম, বাবা ছিলেন রেলের কর্মচারী তাই ছোটবেলায় ছুটে বেড়িয়েছেন বাঙলার এ গ্রাম-সেগ্রাম। হঠাৎ করে বাবা মারা যাওয়ার পর চাকরীর খোঁজে চলে আসেন কোলকাতায়, জোড়াসাঁকোয় জেঠুর বাড়িতে চলে আসেন। গান জানতেন, গিরিশ পার্কের কাছে এক ব্যায়ামাগারে শরীরচর্চাও শুরু করেন। জেঠুর ছিল অর্কেস্ট্রার দল,সেখানে শ্যামা সঙ্গীত গাইতেন কিন্তু জেঠু নিজের দল ছেড়ে স্টার থিয়েটারে যোগ দেওয়ার পর তুলসী চক্রবর্তী কাজ নিলেন মদের দোকানে। সেও বেশীদিন টিকলো না। পড়াশুনা বিশেষ জানতেন না তাই চাকরী মিলল না। ভাগ্যন্বেষণে পাড়ি দিয়েছিলেন বার্মাতেও। যে জাহাজে করে তিনি যাচ্ছিলেন বার্মা,তাতে ছিল এক সার্কাসের দল। ভিড়ে গেলেন তাদের সাথে। ক্লাউন সাজতেন সার্কাসে। সেইটিই বোধহয় কমেডিয়ান হয়ে ওঠার এপিলগ।
এই সার্কাসের জোকার থেকে টলিউডের আইকনিক কমেডিয়ান হয়ে ওঠার গল্পে অনেকগুলো স্তর আছে। কখনো স্ট্র্যাগল, কখনো কম্প্লিমেন্ট,কখনো মধ্যবিত্তভ্যালুজের দীপ্তি — সব মিলিয়ে এই কাহিনী মেলোড্রামাটিক, ট্রাজেডিক আর কোথাও বিস্মৃতির।
সার্কাস ছেড়ে চলে আসার কারণ জিজ্ঞাস করলে বলতেন,‘শরীর থেকে জন্তু জানোয়ারের গন্ধ বেরচ্ছে দেখে চলে এলুম।’ ফিরে এলেন। চিৎপুরের ছাপাখানায় কাজ নিলেন। সেই ছাপাখানায় থিয়েটারের হ্যান্ডবিল ছাপার সময় আলাপ হল তৎকালিন স্টার থিয়েটারের মালিক অপরেশ বাবুর সাথে। উনার উৎসাহেই শিখলেন তবলা,পাখোয়াজ, ঢোল এমনকি নাচও। অপরেশ মুখার্জিই তালিম দিলেন টপ্পা গানের। চারভাগের একভাগ মাস মাইনেতেই ছাপাখানার কাজ ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে তিনি যোগ দিলেন স্টার থিয়েটারে। প্রথম স্টেজে অভিনয় দুর্গেশনন্দিনীতে,১৯২০তে। সেই থেকে শুরু। ১৯৬০এ শেষ মঞ্চে অভিনয় করেন শ্রেয়শী নাটকে। প্রথমে স্টার,পরে মদনমোহন থিয়েটার, প্রায় চল্লিশ বছরের থিয়েটার জীবনে ৪২টি নাটকে অভিনয় করেছেন তুলসী চক্রবর্তী।
অসম্ভব ভার্সাটাইল ছিলেন। খোল বাজিয়ে কীর্তন গাইতেন,দরকারে তবলা বাজিয়েছেন নির্ধারিত তবলচির অনুপস্থিতিতে, নিজের গলায় ছবিতে গান গেয়েছেন আবার কবিতে তাঁকে নাচেতেও সাবলীল দেখিয়েছে। ১৯৩২ প্রথম সিনেমায় এলেন পূনর্জন্মে। পরবর্তীতে অভিনয় করেছেন দাপটের সাথে। সে উত্তম কুমারই হোক বা ছবি বিশ্বাস, সৌমিত্র বা জহর গাঙ্গুলী, সুচিত্রা বা মলিনা দেবী সবার সঙ্গেই তিনি ছিলেন সপ্রতিভ। সাড়ে চুয়াত্তরের মেস মালিক তাঁকে ছাড়া ভাবাই যায় না। বরাবরই পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করলেও নিজেকে আলাদা করে চিনিয়ে দিতেন অভিনয়ের গুনে। কেউ প্রশংসা করলে বলতেন, “আমি একটু চোখ–কান খোলা রাখি, আর সব ধরনের মানুষ দেখে বেরাই। এবার চরিত্র মত তাদের তুলে ধরি। যেখানে যে লাগে আর কি!এই চরিত্র করার জন্য ভাল অভিনয় করার দরকার হয় না কি? তোমার চারপাশে এরা ঘুরে বেরাচ্ছে, একটাকে তুলে এনে নিজের কাঁধে ভর করাও।’’ পরিবেশ থেকে শিখে নেওয়া যে নিছক পাভলভের প্রতিবর্ত ক্রিয়া নয়,এক নিখুঁত,মন ছুঁয়ে যাওয়া অভিব্যক্তি তা প্রমাণ করে গেছেন তাঁর অভিনিত চরিত্র গুলোতে, মেস মালিক বা বৈষ্ণব, টোলের পন্ডিত বা মুদি, কেরাণী বা হোটেলের ম্যানেজার — যে চরিত্রেই অভিনয় করেছেন,কেবল মুগ্ধতা দিয়েছেন। হাসতে বাধ্য করেছেন তবুও একবারের জন্যও ভাঁড় মনে হয়নি।
পরশপাথর’-এ তিনিই প্রোটাগনিস্ট! পরশুরামের পরেশ দত্তকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী। পরশপাথর ছবি রিলিজের সময় কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। বলতেন “এইবারে আমি নির্ঘাৎ পাগল হয়ে যাব। বড় বড় হোর্ডিংয়ে ইয়া বড় বড় মুখ আমার। জীবনে তো কখনও এত বড় বড় মুখ হোর্ডিংয়ে দেখিনি। এর আগে যাও বা দু-চারবার হয়েছে, তা সে সব মুখ তো দুরবিন দিয়ে খুঁজে বার করতে হত। এ আমি কী হনু রে!’’ সত্যিই তিনি হনু তাঁর মুখেই মানায় হলদে সবুজ ওরাং ওটাং মন্তর।
সাহিত্যিক শংকর তাঁর ‘মানব সাগর তীরে’বইতে লিখেছেন,‘যদি তুলসী চক্রবর্তী, রবি ঘোষ, নৃপতি চ্যাটার্জির মতো অভিনেতা বিদেশে জন্মাতেন, তা হলে তাঁদের স্মরণে এক-একটি সরণি থাকত।’ অথচ এই বঙ্গদেশে তিনি উপেক্ষিত রয়ে গেলেন। হাওড়ার কৈলাস বসু লেনের ঘুপচি বাড়িতে দারিদ্র্যকে প্রতিবেশী করে বেঁচে ছিলেন,পরোপকারী এই মানুষটি। ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসে চলাফেরা করতেন। নিজের বাড়িটাও দান করে দিয়েছিলেন এলাকার পুরোহিতদের জন্য। যেদিন চলে গেলেন হৈচৈ হয়নি,ভীড় উপচানো শোভাযাত্রাও হয়নি। কিন্তু ভালোবাসা উপচে পড়েছে।
পরশপাথর ছিলেই নিজেই। যা ছুঁয়েছেন সোনা হয়েছে। উনাকে ছাড়া হয়ত হতোই না পরশপাথর। যিনি ৩১৬টি বাংলা ও ২৩টি মত হিন্দী সিনেমা করেছেন আর দর্জি তাঁর পাঞ্জাবির মাপ নিতে আসছে নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য ভেবে তিনি আপ্লুত হয়ে বলছেন, ‘’উফ! এ আমি কখনও ভাবতেও পারিনি!’’
আমরাও ভাবতে পারিনি, চ্যাপলিনের জীবনের সাথে কিভাবে গোল্লা গোল্লা চোখ, ফতুয়া পড়া মানুষটির দর্শণ। দুঃখকে কেমন নিজস্ব মননের অনুঘটকে জারিত করে, এমন অসামন্য সব কাজ, সহজ কমেডির ভাষায় যিনি লিখতে পারেন তিনি অবশ্যই তুলসী চক্রবর্তী, টলিউডের পরশপাথর।
এত গুণ সত্বেও তিনি নিজেকে তুলনা করতেন বাড়ির হেঁশেলের হলুদ হিসাবে। তাকে না পেলে সত্যজিৎ রায় যে ‘পরশপাথর’ বানাতে পারতেন না, তা তাঁর অন্তিমজীবনেও স্পষ্ট করে বলে গেছেন। প্রবাদপ্রতিম সেই ব্যক্তিত্ব তুলসী চক্রবর্তী। উত্তমকুমার অভিনীত প্রায় তিন ডজন সিনেমায় চুটিয়ে অভিনয় করেছেন তিনি। যদিও ‘পরশপাথর’ ছাড়া আর সে ভাবে কোনও সিনেমায় মুখ্য চরিত্র পাননি। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘চাওয়া পাওয়া’, ‘একটি রাত’ ইত্যাদি ছবিতে কোথাও তিনি মেস মালিক, কোথাও হোটেল মালিক, কোথাও বাসরাইখানা-ধর্মশালার মালিক হলেও সবকটি চরিত্রে তার স্বকীয়তা বজায় রেখেছেন। একমাত্র সত্যজিৎ রায়ই বোধহয়তাঁর অভিনয় প্রতিভা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। পরশুরামের কলম থেকে বেরনো পরেশ দত্তকে ছবিতে অবলীলায় জীবন্ত করে তুলেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী।
জ্যাঠামশাইয়ের হাত ধরে যে বালকটি একদা ঢুকেছিল থিয়েটার পাড়ায়, পরবর্তীকালে সেই বালকই হয়ে উঠল এক স্বনামধন্য অভিনেতা। তুলসী চক্রবর্তী নামটা শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে দুটি সিনেমা। তার একটি সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশপাথর’, অপরটি নির্মল দে পরিচালিত ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। অথচ বহু বহু ছবিতে তিনি ছোট বড় মাঝারি নানা চরিত্রে কত বিচিত্র রকমের অভিনয় করে গিয়েছেন। এই মানুষটি কিন্তু স্টেজ পাগল মানুষ ছিলেন। ১৯৫৫ সাল থেকে টানা জীবদ্দশায় স্টার থিয়েটারেই ছিলেন। তবে ছোটবেলা থেকেই বহু স্টেজে কাজ করেছেন। অভিনয় জীবনের শুরুতেই গোল বাঁধালেন। তখন ‘দুর্গেশনন্দিনী’ স্টেজ হচ্ছে। হকিমের চরিত্রাভিনেতা অনুপস্থিত থাকায় থিয়েটারের কর্তা-ব্যক্তিরা তুলসীকে বললেন, ‘কি হে ছোকরা! খুব তো উইংস-এর ধারে বসে মন দিয়ে অভিনয় দেখো, হকিমের পার্টটা করতে পারবে?’ তুলসী সাহসের সঙ্গে বললেন ‘পারব’। সেদিন নবাব ও দলনী বেগমের ভূমিকায় অভিনয় করছিলেন পালিতসাহেব ও তারাসুন্দরী। হকিমের মুখের সংলাপ ছিল, ‘আর চিন্তা নাই বেগম সাহেবা, নবাব সাহেব এ যাত্রায় রক্ষা পেয়েছেন।’ কিন্তু তুলসী চক্রবর্তী বললেন, ‘আর রক্ষা নাই বেগম সাহেবা, নবাব সাহেব এ যাত্রায় চিন্তা পেয়েছেন।’ সংলাপ শেষ হতে না হতেই দর্শকদের সে কী হাসির রোল। তারাসুন্দরী সিন-থেকে বেরিয়ে এসেই বললেন, ‘দুটো কথাই যদি গোছ করে বলতে পারবে না, তো এখানে এসেছ কী জন্যে?’
ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে নিজেকে গড়ে তুললেন তুলসী চক্রবর্তী। শেষ জীবনে হাওড়ায় ছোটখাট একটা বাড়ি কিনেছিলেন। ছিলেন নিঃসন্তান। স্ত্রী এবং বড় ভাইয়ের বিধবা স্ত্রী এই নিয়ে তাঁর ছোট সংসার। আর বাড়িতে রয়েছে নারায়ণ শিলা। এই গৃহদেবতার নিত্য পূজা হতো সাড়ম্বরে। নিজে নিয়মিত বাজার করতেন। একদিন তুলসী চক্রবর্তী যথারীতি স্টার থিয়েটারের লবিতে আসর জমিয়ে বসেছেন। সেখানে তখন হাজির হলেন বাংলা রঙ্গমঞ্চের বিখ্যাত নাট্যকার ও নাট্যনির্দেশক দেবনারায়ণ গুপ্ত। তিনি তুলসীবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী বাজার করলেন তুলসীদা?’ তুলসী চক্রবর্তী বললেন, ‘আর বোল না ভাই। বড্ড হয়রানি হতে হয়েছে ফুল কিনতে গিয়ে। কোনও ফুলের দোকানেই আজ কর্তাপাতা নেই।’ দেবনারায়ণ বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, ‘কর্তাপাতা? এমন নাম তো শুনিনি।’ তুলসী চক্রবর্তী বলেই চলেছেন, ‘কর্তাপাতা না হলে কি নারায়ণের পূজা হয়?’ সবাই যখন মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে তখন তুলসী চক্রবর্তীর পাশে বসা আরেক স্বনামধন্য নট জহর গঙ্গোপাধ্যায় এই রহস্যের সমাধান করলেন। বললেন, ‘ওর বউ তো তুলসী কথাটা উচ্চারণ করতে পারে না, তাই বলে কর্তাপাতা। আমাদের কাছে সেই কথাটা কেমন কায়দা করে জানিয়ে দিলে দেখছেন তো?’ এমন রসিক মানুষ ছিলেন তুলসী চক্রবর্তী।
তুলসী চক্রবর্তী সবাইকে আপন করতে পারতেন বলে, কম বয়সিরা প্রায়ই তাঁকে সম্বোধন করত ‘দাদু’ বলে। দেবনারায়ণ গুপ্ত একদিন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওরা আপনার কীরকম নাতি?’ তুলসী চক্রবর্তীর উত্তর, ‘ভাইপো ভাইঝি ভাগ্নে ভাগ্নী এদেরই ছেলেপুলে হবে বোধহয়।’ দেবনারায়ণবাবু বললেন, ‘বোধহয়’? তুলসী চক্রবর্তী বুঝিয়ে দিলেন, ‘ওদের মা-বাপকে কোনওদিন দেখিনি। জানিনেও। ওরা দাদু বললে আমিও ওদের নাতি পাতালাম।’ পাশেই বসা ছিলেন বিখ্যাত কৌতুক অভিনেতা শ্যাম লাহা। তাঁর বিরাট বপুর জন্য দর্শকেরা তাঁকে এক নামে চেনে। শ্যাম লাহা বললেন, ‘আমাকেই দেখুন না। জাত নয়, জ্ঞাত নয়, অথচ আমার ওপর ওঁর কী টান।’ তুলসী চক্রবর্তী বাধা দিয়ে বললেন, ‘স্নেহ তো দূরের কথা, ওকে আমি এড়িয়ে চলতে চাই। সব জায়গায় বলে বেড়াচ্ছে ওকে নাকি আমি পুষ্যি নেব বলেছি।’ একটু থেমে আবার বললেন, ‘ওকে পুষ্যি নেওয়া মানে ডাইনির কোলে পুত্র সমর্পণ করা। ওকে পুষ্যি নিয়ে বশে আনতে হলে ভীম ভবানীর মতো লোকের দরকার।’ তুলসী চক্রবর্তীর কথায় সবাই সম্মিলিত হাসিতে যোগ দিলেন। এখানেই শেষ নয়।
তুলসী চক্রবর্তী শ্যাম লাহার বিরুদ্ধে বলেই চলেছেন, ‘হাওড়া থেকে বাসে যাতায়াত করি, শীতকালে বড় কষ্ট হয়। তাই ভাবলাম একটা ভালো কাপড়ের লং কোট তৈরি করাই। সেই কথা শুনে হুয়া (শ্যাম লাহার ডাক নাম) বললে, আমার ওপর ভার দিন, সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সে কথায় কান দিইনি। কারণ আমার কোট তৈরি করার নামে এমন একটা কোট বানিয়ে আনত যা হুয়ার গায়ের জন্য ঠিক, আমার জন্য নয়। তাই সাত-পাঁচ ভেবে অন্য ব্যবস্থা করেছি।’
এই সব কথাবার্তার ফাঁকে এলেন অনুপকুমার। বললেন, ‘জ্যাঠামশাই আসুন।’ অনুপকুমারের বাবা বিখ্যাত গায়ক অভিনেতা ধীরেন দাসের সঙ্গে তুলসী চক্রবর্তী যেহেতু মঞ্চে ও পর্দায় অনেকদিন কাজ করেছেন বলে অনুপকুমার জ্যাঠামশাই বলে ডাকতেন তুলসী চক্রবর্তীকে। তুলসী চক্রবর্তীকে নিয়ে অনুপকুমার ওয়েটিং রুমে গেলেন। তুলসী চক্রবর্তীর গায়ে পরিয়ে দিলেন নতুন গরম কাপড়ের লং কোট। লবিতে এসে সবাইকে তুলসী চক্রবর্তী দেখালেন অনুপকুমারের দেওয়া লং কোট। বললেন, ‘অনুপ আমার ভাইপো। আমার বাপধন। কাপড়ের নমুনা এনে, দর্জি ডেকে, সব ব্যবস্থা করে দিল, ভগবান ওর ভালো করুন। ওর বাড়বাড়ন্ত হোক। ও শুধু লোক দেখিয়ে জ্যাঠা বলে ডাকে না। সত্যি ও ছেলের কাজ করেছে। অনুপ থাকতে আবার আমার ছেলের ভাবনা।’
এই কথাগুলি বলার মধ্য দিয়ে নিঃসন্তান তুলসী চক্রবর্তীর চোখেমুখে যে পরিতৃপ্তি ছড়িয়ে পড়েছিল, উইংস-এর আড়ালে লবিতে উপস্থিত সকলের চোখেই তা ধরা পড়েছিল। তুলসী চক্রবর্তী স্টারের লবিতে যখন জমিয়ে রাখতেন আসর, তখন কেউ কেউ তাঁর কাছে জানতে চাইতেন যে তিনি কেন সস্ত্রীক তীর্থ ভ্রমণে বছরে একবার করে বেরিয়ে পড়েন না। তার উত্তরে তাঁর নির্মল হাসিভরা মুখে বলতেন, ‘যে থিয়েটারে একদা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের পায়ের ধুলো পড়েছিল, এই স্টারে স্বামী বিবেকানন্দ, ভগিনী নিবেদিতা, বেলুড় মঠের প্রণম্য সন্ন্যাসীরা, গিরিশচন্দ্র ঘোষ এসে গেছেন, তার থেকে বড় তীর্থ আর কিছু হতে পারে? এই স্টেজই আমার পুণ্য তীর্থ। তুলসী চক্রবর্তীর ভক্তি মিশ্রিত কণ্ঠস্বর উপস্থিত সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল, তা বলাই বাহুল্য।
এই মানুষটিকে নিয়ে আগেই অনেক কিছু করা যেতে পারতো, ভাবা যেতে পারতো, তাকে তার যোগ্য আসনে বসানো যেতে পারতো কিন্তু সে সব কিছুই হয়ে ওঠেনি। আসলে এই ‘ধন’ কে চেনা হয়তো এক সাচ্চা জহুড়ির কাজ, যার কোনো গুণই, কোনো স্বাভাবিক মানুষের নেই। কেউ চিনতে পারেনি এই মানুষটিকে। তবে মানুষটিকে যিনি এক কথায় চিনে ছিলেন তিনি হলে সত্যজিৎ রায়। তিনি তুলসী চক্রবর্তী-এর নামে বলতে গিয়ে বলেছেন “তুলসী চক্রবর্তীর মতো অভিনেতার কদর এই পোড়া দেশে কেউ করবে না কিন্তু তিনি যদি আমেরিকাতে জন্মাতেন নির্ঘাত অস্কার পেতেন”।
আসলে তার গুণের কদর করার মতো গুণী লোক সেকাল একাল কোনো কালেই ছিলোনা। আমরা ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ দেখেছি, ‘পথের পাঁচালী’ দেখেছি, মনে আঁচর কেটে গেছে বলে সিনেমাগুলোকে মনে রেখেছি, কিন্তু কতজন মনে রেখেছি, তুলসী চক্রবর্তীর মতন তাবড় তাবড় অভিনেতা কে? বাঙালি মানেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায়, বাঙালি মানেই উত্তম কুমার! কিন্তু হায়! সেই বাঙালি বেমালুম ভুলে গেছে ছবি বিশ্বাস, তুলসী চক্রবর্তীর মতো শিল্পীদের! কতজন মনে রেখেছেন তুলসী চক্রবর্তীর মতন অভিনেতাদের। যারা প্রাণপাত করে, নিরলস পরিশ্রম আর অসম্ভব নিষ্ঠা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দিয়ে পর্দায় জীবন্ত করে তুলেছেন প্রতিটি চরিত্রকে?
আগেও বলেছি যদি তুলসী চক্রবর্তী কে সঠিক ভাবে কেউ চিনে থাকতে পারেন তবে তা একমাত্র সত্যজিৎ রায়। তিনি যখন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী লেখাটি পড়ছিলেন এবং তার সাথে মিলিয়ে চরিত্রগুলিকে জীবন্ত রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন তখন চোখ বুজে তুলসী চক্রবর্তী কেই বেছে নিয়েছিলেন প্রসন্ন গুরু মশাইয়ের জীবন্ত প্রতিমূর্তি হিসেবে। যারা প্রসন্ন গুরুমশাইয়ের চরিত্র নিয়ে অবগত, তারা পর্দায় তুলসী চক্রবর্তী কে প্রসন্ন গুরুমশাই ভেবে নিতে একদমই হোঁচট খাননি। উল্টে তাঁকেই তারাই প্রসন্ন গুরুমশাই হিসেবে পুরোপুরিভাবে এঁকে নিয়েছিলেন তাদের মনে। এমনই ছিল তুলসী চক্রবর্তী-এর অভিনয়। তিনি এমনই দক্ষ অভিনেতা ছিলেন যে তাকে ছবি বিশ্বাস বেশ সমঝে চলতেন। সেই ছবি বিশ্বাস যিনি কিনা কোনদিনও শুটিং করার সময় স্ক্রিপ্ট মুখস্ত করতেন না শুধু একবার চোখ বুলিয়ে নিতেন এবং তারপরেই দুর্ধর্ষ অ্যাকশন! কিন্তু সহ-অভিনেতা যেদিন তুলসী চক্রবর্তী থাকতেন সেইদিন তাঁকে কোমর বেঁধে নামতে হতো। তাঁর কথা অনুযায়ী তিনি বলতেন “কি জানি কি প্যাঁচ তুলসী কষবে”! ছবি বিশ্বাস খুব ভালো করে জানতেন যে সহ-অভিনেতা যখন তুলসী চক্রবর্তী তখন অভিনয়টা ও করতে হবে বাজি রেখে, টক্কর দেওয়ার মতো।
তুলসী চক্রবর্তীর মতো এক বড় মাপের শিল্পী কে কিভাবে দিনের পর দিন এক চরম অবহেলার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে তার উদাহরন আমরা পাই বিভু ভট্টাচার্যে্র এক স্মৃতি চারণ থেকে। সেখানে বিভু ভট্টাচার্য্য বলেছেন একদিন শুটিং চলছে ইস্ট ইন্ডিয়া শুটিং ফ্লোরে তুলসী চক্রবর্তী তখন বিভু ভট্টাচার্যকে এসে জিজ্ঞেস করলেন “তোকে কি গাড়ি দেওয়া হয়েছে বাড়ি যাওয়ার জন্য?” বিভু ভট্টাচার্য্য তার উত্তরে হ্যাঁ বলেন। তারপর তুলসী চক্রবর্তী সারাদিন ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে থাকেন সেখানে, যাতে তাঁর বাড়ি ফেরত যাওয়ার টাকা যদি বেঁচে যায় তবে তাঁর পরিবারের জন্য খুব উপকার হবে। মানুষটি প্রাপ্য সম্মান পাওয়া তো দূর, প্রাপ্য পারিশ্রমিক টুকুও পেতেন না। তাঁর তুলনায় তাঁর থেকে ছোট মাপের শিল্পীর সবধরণের সুযোগ সুবিধা পেতেন এবং পারিশ্রমিকও পেতেন কয়েকশো গুন বেশি। বিভু ভট্টাচার্যকে সেই সময় দিন প্রতি ৭৫ টাকা করে দেওয়া হতো আর তুলসী চক্রবর্তী কে দেওয়া হতো মাত্র ১৫ টাকা আর বাড়তি সুযোগ সুবিধাতো দূরের কথা।
এই পারিশ্রমিক নিয়ে কথা বলতে গেলে মনে পড়ে যখন সত্যজিৎ রায় ‘পরশপাথর’ এর মুখ্য চরিত্রটির প্রস্তাব রাখেন তুলসী চক্রবর্তীর কাছে তখন নিষ্পাপ শিশু হৃদয় খুশিতে ডগমগ হয়ে বলেছিলেন “দেখো দেখো..এতদিনে আমি জাতে উঠলাম” তাঁর এই বাক্যের পেছনে না জানি কতটা ক্ষোভ, দুঃখ, কষ্ট আর না পাওয়ার অভিমান জমে ছিল কে জানে! সেই সময় এই কাজের জন্য সত্যজিৎ রায় তুলসী চক্রবর্তীকে দিন প্রতি ১০০ টাকা দেওয়ার কথা বলেন, তা শুনে তুলসী চক্রবর্তী তাঁর উত্তরটি যা দেন তা নিখাদ ভালো মনের মানুষ না হলে কখনোই মুখে তুলে বলতে পারতে না। তিনি সে প্রস্তাব কে কিছু না ভেবেই ফিরিয়ে দেন তার কথা অনুযায়ী তিনি দিন প্রতি ১০০ টাকার বিনিময়ে কাজ করছেন এটা যদি কেউ জানতে পারে তবে কেউ তাকে তারপর আর কাজ দেবে না। কতটা দক্ষ বাস্তবিক চিন্তা ভাবনা হলে এইভাবে কেউ ভাবতে পারেন। তাঁর সব চাহিদাই ছিল পরিমিত শুধু অভিনয় প্রতি ভালোবাসা ও অনুরাগ ছিল সীমাহীন! সেই সময়ে যারা ‘পরশপাথর’ তার অভিনয় গুণ মুগ্ধ হয়ে তাকে যখন কিছু বলতেন তখন তার উত্তরে তিনি বলতেন – “এই চরিত্রে অভিনয় করতে গেলে আবার অভিনয় করতে হয় নাকি, এইতো চারপাশে সবাই ঘুরে বেড়াচ্ছে শুধু এদেরকে তুলে এনে নিজের কাঁধে ভর করাও”।
সত্যি, একজন দক্ষ অভিনেতার পক্ষেই সম্ভব এইভাবে অভিনয় কে এইভাবে ব্যক্ত করা। এটা বোধহয় তুলসী চক্রবর্তী বলেই পেরেছেন। তাঁর বিষয়ে বলতে গিয়ে মহানায়ক উত্তম কুমার বলতেন “তুলসী দার মতো অভিনয় তো কোনোদিনই করতে পারবেনা, ওনার মতো জীবন্ত হয়ে ওঠা আমার দ্বারা হবেনা। ওনাকে প্রনাম জানানোর মতো একটাই পথ আছে- পরিচালক প্রযোজকদের বলে যখনই কাজ পাই তুলসী দা কে ডেকে নিই। উনি থাকলে সীন টা দারুন ভাবে উঠে যায় ওনার ঋণ তো কোনোদিন শোধ করতে পারবনা, যেভাবে যেটুকু পারি সাহায্য করি”। তুলসী চক্রবর্তী বলতেন তিনি হলেন হেঁসেল বাড়ির হলুদ, যেখানে সেখানে কাজে লাগে যায়।
এহেন দক্ষ অভিনেতা, বাস্তব সম্পর্কে বিচক্ষণ এবং শিশু সুলভ মনের মানুষ যখন বেঁচে ছিলেন তখন তো তার গুণের কদর, মান, যশ খ্যাতি কোনোটাই পাননি তাঁর মৃত্যুর পর ও চিত্রটি পাল্টায়নি। চোখ খোলেনি কারুর। তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে করা হয়নি কিছুই। মানুষটির শেষ সময় কেটেছে ভীষণ অর্থকষ্টে এবং অনাহারে। অর্থাভাব এতটাই ছিল যে তাঁর বিধবা স্ত্রীয়ের জন্য রেখে যেতে পারেননি কিছুই। বলতে গেলে আরো কথা বলা যায়। তবে সেকথা খুব একটা মধুর নয়, তা শুনতে শুনতে চোখ দিয়ে কখন জল গড়িয়ে পড়বে আপনি হয়তো টের ও পাবেন না। বলেছিলাম না এই মানুষটি সম্পর্কে যতটা বলা যায় ততটাই কম।
একবার এক সিনেমার শুটিং–এ অনাহুতের মত হাজির হয়ে বৈষ্ণব সাজার অনুমতি পেয়েছিলেন তুলসী চক্রবর্তী। বৈষ্ণব সেজে শ্রীখোল হাতে পরিচালকের সামনে যেতেই পরিচালক তাকে একেবারে সামনের সারিতে দাঁড় করিয়ে দিলেন। তুলসী চক্রবর্তী শট দিলেন-খোল বাজাচ্ছেন, মুখে হরিনাম, চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে। পরিচালক এত খুশি হলেন যে দেড় মিনিটের শট তিনি চার মিনিট নিলেন এবং সিনেমায়ও রাখলেন। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বড় দড়ের অভিনেতা তিনি। আরেকবার এক মুদির চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তুলসী চক্রবর্তীকে নেওয়া হলে তাকে ডাকতে লোক যায় এবং ট্যাক্সিভাড়াও দেওয়া হয়। কিন্তু তুলসী চক্রবর্তী সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন, তার বক্তব্য তিনি ট্রামে-বাসে যাতায়াত করেন। পরেরদিন একবেলা কাজ করে যখন উত্তমকুমারের কথা মত তাঁকে তিনশো টাকা দেওয়া হয় তখনও তিনি তা নিতে অস্বীকার করেন। কারণ তখন তার রেট ছিল ডেলি একশো পঁচিশ টাকা।
১৯৫৩ সালের কথা, মুক্তি পেল নির্মল দে পরিচালিত ‘সাড়ে ৭৪’। চারদিকে সাড়া পড়ে গেল, ছবিটির মাধ্যমে এক নতুন জুটি এসেছে পর্দায়। বয়স্করা মজেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী আর মলিনা দেবীতে। তাদের দাবি, নায়ক-নায়িকা তো তুলসী-মলিনা। নতুন জুটি উত্তম-সুচিত্রা তো আসলে সাইড রোলে! টানা আট সপ্তাহ বক্স অফিসে চলল এই ছবি। তাঁর কণ্ঠে ”কই, কোথায় গেলে গো?” সংলাপ ছড়িয়ে পড়েছিল সকলের মুখে মুখে। প্রথাগত স্বীকৃতি হয়ত পাননি কিন্তু তাঁর অভিনয় ক্ষমতায় স্বল্প পরিসরে উপস্থিতিতেও দর্শকমন জয় করেছেন।
অভিনয় জীবনে সবথেকে বেশি আনন্দ পেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশপাথর’-এ অভিনয় করে। দর্জি তাঁর পাঞ্জাবির মাপ নিতে আসছে নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য, তিনি আপ্লুত হয়ে বলছেন, “উফ! এ আমি কখনও ভাবতেও পারিনি!” সারাজীবনে ৩১৬ টি বাংলা ও ২৩ টি মত হিন্দী সিনেমা করলেও দারিদ্র ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে বেশ অসুস্থ হয়ে পরেন। পয়সাও ছিল না চিকিৎসার জন্য। এমনকি নিজের বাড়িও দান করেছিলেন এলাকার দরিদ্র পুরোহিতদের জন্য। তাঁর মৃত্যুর পর সরকারের তরফ থেকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোরও কোনও বন্দোবস্ত ছিল না তখন। স্ত্রী উষারাণী দেবী দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন একমুঠো খাবারের জন্য। দারিদ্রের কারণে স্বামীর সবকটি মেডেল বিক্রী করতেও বাধ্য হয়েছিলেন। অভিনয় জীবনে অধিকাংশ কমেডিয়ানের চরিত্রে অভিনয় করলেও বাঙালি দর্শকের অন্তরে চিরকালের জন্য অমর হয়ে থাকবেন অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তী।
(তথ্যসূত্র:
১- Bengali Cinema: ‘An Other Nation’ (Routledge Contemporary South Asia Series), Sharmistha Gooptu, Routledge (২০১০)।
২- Bengali Cinema, Sharmistha Gooptu, Lotus (২০১০)।
৩- বর্তমান পত্রিকা, ৩১শে আগস্ট ২০১৯ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত