কখনও কখনও চেনা জায়গাকে অচেনা দেখায়। অচেনা মনে হয় চেনা মানুষকে। দাঙ্গা তেমনই একটা সময়। আজ সকালে হঠাৎ বাবরি মসজিদ ভাঙার পর কলকাতার বেনিয়াপুকুরে আমার একটা ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল। আমার এক আলোকচিত্রী বন্ধু প্রয়াত কে কে রায়ের সঙ্গে হাঁটছিলাম সেই এলাকার উত্তেজনাপ্রবণ একটা রাস্তা দিয়ে। শুনশান রাস্তা, লোকজন বাড়ির থেকে বেরোচ্ছে না, চেনা জমজমাট মহল্লায় যেন দম আটকে আসার মত একটা নিস্তব্ধতা। পাশাপাশি বাড়িতে বাস করা মানুষগুলি কেমন যেন একে অপরের অচেনা হয়ে গেছে। হঠাৎ গলির মধ্যে একটা বাড়ি থেকে ভেসে এল বাচ্চা মেয়ের গলার আওয়াজ – জেঠু, জেঠু। একটু এগোতেই দেখলাম একটা জানালায় দাঁড়িয়ে আছে তার দাদু ও দিদিমা সহ একটি শিশু। বৃদ্ধ জানালেন তারা কেউ বাড়ির থেকে বেরোতে পারছেন না। বাড়িতে কোন খাবার নেই। বেনিয়াপুকুরে সব দোকান বন্ধ, আমরা তাদের জন্য ডালহৌসি এলাকার একটা দোকান খুলিয়ে কিছু বিস্কুট, কেক কিনে এনে দিয়েছিলাম। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা মানুষ ও পরিস্থিতিকে এমনই বদলে দেয়।
বাংলার মানুষ কিন্তু কোন কালেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সমর্থন করেননি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এরাজ্য বারবার বঞ্চিত হলেও সাম্প্রদায়িকতায় আমরা কোনদিন নিজেদের মুক্তি খুঁজিনি। এখানকার রাজনৈতিক দলগুলিও বরাবর এব্যাপারে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে। রাজ্যের গণমাধ্যমগুলিও এ নিয়ে সবসময় সজাগ। উত্তেজনা ছড়ায় এমন ছবি ও খবর এখানে ছাপা বা দেখানো হয় না। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টাকে কঠোর হাতে প্রতিহত করেন। প্রশাসনিক গাফিলতি ও পরিকল্পিত প্রচার ও উস্কানিতে দিল্লির মত পরিস্থিতি তাই এখানে তৈরি হয় না। প্রশাসকদের সবসময় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠতে হয়। দিল্লিতে শাসকরা সে কাজটাই করেননি।
সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আমাদের অনেকের বহু ভুল ধারণাও রয়েছে। বিশেষ করে এরাজ্যের সরকারি বামপন্থীদের। সেকুলারিজম বা ধর্ম নিরপেক্ষতা বলতে এরা বোঝেন ধর্মহীনতা। ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে কিন্তু ধর্মহীনতা নয়। আসলে তা হল, প্রতিটি মানুষের ধর্মাচরণের স্বাধীনতায় বিশ্বাস। কোন বিশেষ ধর্মের প্রতি অবজ্ঞা বা অশ্রদ্ধা নয়। এটা মেনে চললেই সব মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় থাকে।
গান্ধীর মত মানুষ যাকে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ সবচাইতে বেশি বিশ্বাস করতেন তিনি কিন্তু তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে কখনোই কোন লুকোচুরি করেননি। প্রকাশ্যেই তিনি নিজেকে হিন্দু বলে ঘোষণা করেছেন। তাঁর প্রতি মুসলমানদের বিশ্বাস কিন্তু তাতে টাল খায়নি। কারণ প্রকৃত ধার্মিকরা অন্যের ধর্মবিশ্বাসকে সবসময় সন্মান করে। মেকি বামপন্থীরা এটা বুঝতে চান না। সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা বলতে তারা মনে করেন কোন বিশেষ সম্প্রদায়কে তোল্লাই দেওয়া। তাই তারা কারও বিশ্বাসই অর্জন করতে পারেন না।
গান্ধীজি তাঁর জীবন দিয়ে এই ধর্ম পালন করেছেন। সাম্প্রদায়িকতা তাঁকে স্পর্শ করেনি। আজকের ধর্মান্ধতার রাজনীতিতে তাই তিনি অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন বলে আমার মনে হয়। সব সম্প্রদায়ের মানুষ বিশ্বাস করে কাছে আসতে পারে এমন মানুষের সংখ্যা আজকের রাজনীতিতে বড় কম। মোদি-অমিতরা সেই ভরসার জায়গাটাই নষ্ট করে দিয়েছেন। আজকের রাজনীতিতে তাই গান্ধী আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত