একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা দিবস পালনে যখন মাতোয়ারা গোটা বাংলাদেশ, ঠিক তখন একরাশ অভিমান আর না বলা কষ্ট বুকে নিয়েই দিন কাটাচ্ছেন প্রথম ভাষা শহীদের পরিবার। বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তৈরি করে দেওয়া দুটি আধা-পাকা ঘরে দিন কাটানো রফিকউদ্দিনের পরিজনরা শুধু ভাবেন, এতটা বঞ্চনা প্রাপ্য ছিল কী? কোনও সদুত্তর নেই।
ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর উপজেলার পারিল গ্রামে (অধুনা রফিক নগর হিসেবেই পরিচিত) জন্মেছিলেন রফিকউদ্দিন আহমেদ। ভাষা আন্দোলন নিয়ে উত্তাল যখন গোটা দেশ, ঠিক তখনই রফিকের বিয়ে ঠিক হয়েছিল প্রতিবেশি রাহেলা খানম পানুর সঙ্গে। কিন্তু বিয়ের পিঁড়িতে বসার সৌভাগ্য হয়নি তাঁর।
২১ ফেব্রুয়ারি বিয়ের কেনাকাটার জন্য ঢাকার বাসভবন থেকে বের হন রফিক। বিয়ের কেনাকাটা বাদ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আয়োজিত ছাত্র-জনতার মিছিলে যোগ দেন তিনি। সেই মিছিল লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। রাজপথেই লুটিয়ে পড়েছিলেন রফিক। তরুণ যুবকের বুকের তাজা রক্তে ভেসে গিয়েছিল রাজপথ।
রফিকউদ্দিন আহমদের স্মৃতি রক্ষার্থে ২০০৬ সালে তাঁর জন্মভূমি পারিল গ্রামের নাম পরিবর্তন করে রফিক নগর করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দা তথা প্রাক্তন সেনা আধিকারিক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মজিবুল ইসলাম খান পাশার দান করা জমির উপরে ২০০৮ সালে নির্মাণ করা হয় ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর। কিন্তু সেই জাদুঘরে শহীদ রফিকের দুটি ছবি ও কিছু বই ছাড়া স্মৃতিবিজড়িত কিছুই নেই। তাঁর ব্যবহৃত চেয়ার টেবিল, পাঞ্জাবি, লুঙ্গি এবং নিজ হাতে তৈরি নকশা করা রুমালসহ বহু জিনিসের ঠাঁই মেলেনি জাদুঘরে। এমনকি রফিকের মরণোত্তর একুশে পদকটিও। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দিনদিন জৌলুস হারাচ্ছে। চত্বরজুড়ে লাগানো সব ফুল গাছ মরে গিয়েছে শুধু পরিচর্যার অভাবে।
প্রথম ভাষা শহিদের বাড়ি ও স্মৃতি জাদুঘরের দুরবস্থার কথা মেনে নিয়েছেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মাজেদ খান। তাঁর কথায়, ‘আগে দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা রফিকের ভিটে ও স্মৃতি জাদুঘর দেকতে আসতেন। কিন্তু রাত্রিযাপনের কোনও সুযোগ না থাকায় ভিড় দিন দিন কমছে।’
আজ থেকে ৬৮ বছর আগে ১৯৫২ সালের আজকের দিনটিতেই পাক শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ঢাকার রাজপথ কাঁপিয়েছিলেন সালাম-বরকত-রফিক জব্বাররা। বুকের তাজা রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত করে বিরল ইতিহাস তৈরি করেছিলেন দামাল ছেলেরা। তাঁদের দেখানো পথেই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ৯ কোটি বাঙালি। একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই গোটা দেশ বীর ভাষা সৈনিকদের স্মরণে মেতে ওঠে। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানে দেশের আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। কিন্তু ভাষা শহীদরা কি সত্যিই যোগ্য সম্মান পেয়েছেন? উত্তর সত্যিই জানা নেই।