দোলের দিন নবদ্বীপের মহাপ্রভু মন্দিরের উৎসব বড় মায়াময়। প্রতিদিন তিনি দেবতা। কেবল একদিন তিনি প্রিয়। সারা বছর তিনি আপামর ভক্তের ধামেশ্বর গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু, ‘রাধাকৃষ্ণের মিলিত তনু’ শ্রীচৈতন্য। কিন্তু ফাল্গুনি পূর্ণিমার দিনে তিনি সে সব কিছুই নন। জগন্নাথ পত্নী শচীর কোল আলো করা সদ্যজাত শিশু নিমাই। পরনে লাল চেলি, হাতে চুষিকাঠি। চারপাশে ছড়ানো ঝিনুক-বাটি, ঝুমঝুমি। ভক্তিতে নয়, সেদিন অপত্য স্নেহে সিক্ত তিনি।
পণ্ডিতেরা বলেন, ১৪৮৬ সালের দোল পূর্ণিমার সন্ধ্যায় জন্ম নিলেন গোরাচাঁদ। সেই স্মৃতিকে স্মরণে রাখতে বৈষ্ণবসমাজ দোল পূর্ণিমাকে বদলে দিলেন গৌরপূর্ণিমায়। চৈতন্যজন্মের প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর পরেও চৈতন্যধামে দোলের দিন তাই শুধুই মহাপ্রভুর আবির্ভাব উৎসব। মহাপ্রভুর মন্দিরে, জন্মস্থানে এদিন আবির কুমকুম নয়, প্রস্তুত থাকে সুগন্ধি অভিষেক বারি, পঞ্চামৃত। দোলপূর্ণিমার সন্ধ্যায় আকাশে চাঁদ উঠলেই বেজে ওঠে শতেক শাঁখ, ঘণ্টা, মৃদঙ্গ, মন্দিরা। শুরু হয়ে যায় মহাভিষেক। চৈতন্য বিগ্রহের প্রতীক হিসেবে জগন্নাথ মিশ্রের গৃহে পূজিত ‘রাজরাজেশ্বর’ শিলাকে ১০৮ ঘড়া জলে স্নান করানোর পর ষোড়শোপচারে হয় অভিষেক বা অন্য ‘জাতকর্ম’। গৌরাঙ্গদেবকে পরানো হয় শিশুর চেলি। সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় কীর্তন থেকে আরতির সুর। নাটমন্দিরের নহবত খানার সানাই আলাপ জমায় বসন্ত রাগে। রাত যত গড়ায় নাটমন্দিরের হোরিকীর্তনের লয় ততই ঘন হয়ে আসে।
পরদিন অন্নপ্রাশন। ফুলমালায় সাজানো দক্ষিণদুয়ারি সিংহদরজার উপরে নহবতখানা। সানাইয়ে ‘বৃন্দাবনী সারং’। রাগের আলাপের রেশ ধরে উৎসবের সুর ছড়িয়ে পড়েছে মহাপ্রভু পাড়ার ঘরে ঘরে। নাটমন্দিরে উত্তরমুখী গরুড় স্তম্ভের নীচে পদাবলী কীর্তনের সুর। আর গর্ভমন্দিরের বন্ধ দরজার সামনে জড়ো হওয়া হাজার হাজার ভক্ত কন্ঠ মিলিয়ে গাইছেন, “জয় শচীনন্দন জয় গৌরহরি। বিষ্ণুপ্রিয়া প্রাণনাথ নদিয়াবিহারী।”
লালচেলিতে শিশু সাজে ধামেশ্বর মহাপ্রভুর দুর্লভ দর্শনে ভক্তেরা আসেন শিশুর খেলনা নিয়ে। খাদ্য তালিকায়, তরকারি থেকে মিষ্টি সবই ৫৬ রকম করে। রূপোর থালা বাটি গ্লাসে থরে থরে সাজানো সে সব। প্রায় দু’কুইন্ট্যাল অন্ন চূড়ো করে সাজানো। চারপাশে ভিড় করে আছেন হাজারো মানুষ। খাদ্যের সুঘ্রাণ, ধূপের সুগন্ধের সঙ্গে মিশে গেছে আরতির কীর্তনের সুর।
নব বসন্তে মহাপ্রভুর আরতির পদ “ভালি গোরাচাঁদের আরতি বাণী’ সুর বদলে গাওয়া হচ্ছে বসন্ত রাগে। তিনি এলেই তো বসন্ত আসে।
কস্তূরী-চন্দন-অগুরু-ধূপের গন্ধে ম’ম’ করছে নাটমন্দির। সাদা পর্দা দিয়ে ঘেরা নাটমন্দিরের প্রশস্ত চত্বরে একে একে সাজানো হচ্ছে ছাপ্পান্ন ভোগ। নামে ছাপ্পান্ন ভোগ হলেও অন্ন, পরমান্ন, পুষ্পান্ন, মিষ্টান্ন, তরি- তরকারি,ভাজা, পুরি, নিমকি, চাটনি সব মিলিয়ে পদের সংখ্যা কয়েকশো। আর হবে নাই বা কেন? স্বয়ং চৈতন্য মহাপ্রভুর অন্নপ্রাশন বলে কথা। তাই এই রাজসূয় আয়োজন নবদ্বীপের মহাপ্রভু বাড়িতে। এই মন্দিরেই বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী সেবিত মহাপ্রভুর শ্রীবিগ্রহের সেবা পুজো হয়ে আসছে কয়েকশো বছর ধরে। একমাত্র এই মন্দিরেই মহাপ্রভুর অন্নপ্রাশন উৎসব পালন করে থাকেন সেবাইত গোস্বামীরা। তাঁরাই বহন করে চলেছেন বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর উত্তরাধিকার। পুরুষানুক্রমে গোস্বামীরা এই উৎসব পালন করে আসছেন।
তবে বহু প্রাচীন এই অন্নপ্রাশন উৎসবের শুরু ঠিক কবে থেকে, তা নিয়ে কোন পাথুরে প্রমাণ নেই। যেমন জানা যায় না, কী ভাবে নবদ্বীপে চৈতন্যদেবের আবির্ভাব তিথি আন্তর্জাতিক উৎসবে বদলে গেল। ইতিহাস বলে, প্রধানত পশ্চিম ভারতের উৎসব ‘হোলি’ বঙ্গদেশে এসেছিল সেন রাজাদের আমলে। আদতে পশ্চিমী দোল বা হোলি ছিল বিষ্ণুকেন্দ্রিক উৎসব। কিন্তু গীতগোবিন্দের কবি জয়দেবের হাত ধরে তাতে শ্রীকৃষ্ণের প্রবেশ। তারপর থেকে ধীরে ধীরে হোলি রূপান্তরিত হয়েছে শ্রীকৃষ্ণের দোলে। পরবর্তীতে চৈতন্যদেব দোলকে নতুন ভাবে সাজালেন। নৃত্য, গীত, কীর্তন, পদযাত্রায় উৎসবের ছোঁয়া লাগল দোলে। আবির, কুমকুমে দোল হয়ে উঠল রঙের উৎসব। ১৮ শতকের শেষ এবং উনিশ শতকের গোড়ার দিকে দোল হয়ে উঠল সেকালের বড়লোকদের উৎসব। উদ্দাম আমোদে তাঁরা দোলে মেতে উঠতেন। ইংরেজদের পলাশি জয়ের পর নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র অত্যন্ত ক্ষমতাবান হয়ে উঠলেন। তিনি একের পর এক উৎসব প্রচলন করলেন বঙ্গদেশে। কিন্তু চৈতন্যবিরোধী কৃষ্ণচন্দ্র সে ভাবে দোলকে গুরুত্ব দিলেন না। বরং পৃথক ভাবে প্রচলন করলেন বারোদোলের। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চৈতন্য অনুরাগী বৈষ্ণব ভক্তদের তৎপরতা এবং উদ্যোগে দোল পূর্ণিমা তিথিতে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব উৎসব পালনের ঝোঁক বাড়ল। দোলপূর্ণিমা হয়ে উঠল গৌরপূর্ণিমা।
গত শতকের সাতের দশক এই চৈতন্যকেন্দ্রিক দোল উৎসবের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। নবদ্বীপের গঙ্গার পূর্ব পাড়ে মায়াপুরে গড়ে উঠল সাগর পাড়ের বিদেশি বৈষ্ণব ভক্তদের মঠ। বিদেশিদের বিপুল অর্থ এবং নিখুঁত পরিকল্পনায় পঞ্চাশ বছরেরও কম সময়ে মায়াপুর নবদ্বীপের দোল তথা চৈতন্যদেবের আবির্ভাব উৎসবকে আন্তর্জাতিক মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে।
তবে মহাপ্রভু বাড়ীর উৎসবে আড়ম্বরের ছোঁয়া লাগে একশো বছর আগে শচীনন্দন গোস্বামীর সময়ে। মহাপ্রভুর সেবাইত গোস্বামীদের মতে অন্নপ্রাশনের দিন তিনি আর যুগাবতার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নন। তিনি ওই দিন জগন্নাথ মিশ্র ও শচীদেবীর কোল আলো করা আদরের ধন নিমাই বা বিশ্বম্ভর। আর তাই নিমাইয়ের অন্নপ্রাশনে ঝিনুক-বাটি থেকে ঝুমঝুমি, চুষিকাঠি থেকে খেলনা বাদ থাকে না কিছুই। চৈতন্যদেবের জীবৎকালেই বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী বংশীবদন ঠাকুরের সহায়তায় নবদ্বীপে নিজগৃহে নির্মাণ করিয়ে ছিলেন এই বিগ্রহ। অনিন্দ্য সুন্দর এই বিগ্রহকে সেদিন পড়ানো হয় লাল চেলি, পায়ে মল।
এই অন্নপ্রাশন উৎসবের আর এক নাম “জগন্নাথ উৎসব”।
গোস্বামীরা জানান তাঁরা ছাড়া ভু-ভারতে আর কেউ মহাপ্রভুকে অন্নপ্রাশন দেওয়ার অধিকারী নন। থরে থরে সাজানো ভোগের আগে মহাপ্রভুর নামকরণ, চূড়াকরন সবই হয়। তবে প্রতীকী ভাবে। দাদামশাই নাম রেখেছিলেন বিশ্বম্ভর। এদিনও প্রতীকী নামকরন করা হয়। তারপর ভোগ নিবেদন। অন্নপ্রাশনের দিনে মহাপ্রভুকে অন্নব্যঞ্জন পরিবেশন করা হয় মহামূল্য পাত্রে। রূপো, তামা, কাঁসা এবং পেতল এই চার ধরনের পাত্রে সাজানো হয় পদগুলি। রূপোর চারটি করে থালা, বাটি, রেকাবি এবং গ্লাসে নিবেদন করা হয় অন্নব্যঞ্জন। হাত ধোয়ার ডাবর, গাড়ু, ধূপদানি, কোষাকুষি সবই এদিন রূপোর। আর ঝুমঝুমি, চুষিকাঠি, মল—এ সব সোনার।
বর্তমানে মহাপ্রভুর অন্নপ্রাশনের মেনুতে থাকে হাজারো পদ। তরকারি, ডাল, শুক্তো, ভাজা, পোস্ত, শাক এবং চাটনি থাকবে সাত রকমের। সঙ্গে মহাপ্রভুর প্রিয় থোড়, মোচা, কচুর শাক, বেগুনপাতুরী, ছানার রসা (ডালনা), ধোকার ডালনা, লাউ, চালকুমড়ো থাকবেই। পোস্ত দিয়ে যত রকমের পদ সম্ভব, এমন কি ছানার পোস্ত। কুল, তেঁতুল,আম, আমড়ার টক। তবে মহাপ্রভুর ভোগে নিষিদ্ধ টম্যাটো, পুঁইশাক এবং মুসুরডাল।
বিশ্বম্ভরকে অবতার বলে প্রথম স্বীকার করেছিলেন বিষ্ণুপ্রিয়া। মুরারি গুপ্তের মতে, তার পর থেকেই বিশ্বম্ভরের ঈশ্বরাবেশ আরও প্রকট হচ্ছে। তিনি সিংহাসনে চড়ে বসলেন। অভিষেকও হল। অদ্বৈত পুরুষসূক্ত পড়লেন, নিত্যানন্দ ধরলেন ছত্র। কিন্তু সে সবই সন্ন্যাসের আগের ঘটনা। সন্ন্যাসের পরে ঈশ্বরের সঙ্গে তুলনার প্রসঙ্গ উঠলে চৈতন্য লজ্জা পেতেন, রেগে যেতেন। একবার বলেছেন, ‘‘যেই মূঢ় কহে জীব ঈশ্বর হয় সম। সেই ত পাষণ্ডী হয়…।’’ কিন্তু নবদ্বীপ-শান্তিপুর সে কথা মানেনি। সন্ন্যাসের পরপরই নীলাচলে বাসুদেব সার্বভৌমের কাছে গোপীনাথ আচার্য চৈতন্যের পরিচয় দিলেন ‘পরম ঈশ্বর’ বলে। প্রবাদপ্রতিম নৈয়ায়িক সার্বভৌম মানতে চাননি— ‘‘অনুমান প্রমাণ নহে ঈশ্বরতত্ত্ব জ্ঞানে।’’ পরে অভিভূত সার্বভৌম চৈতন্যের অজ্ঞাতে তাঁর পরিচয় দিচ্ছেন “তেঁহ ঈশ্বর স্বতন্ত্র। সাক্ষাৎ কৃষ্ণ তেঁহো”। এই ‘ঈশ্বর স্বতন্ত্র’ সম্বোধনটি বৃন্দাবনে বসে লেখা চৈতন্যচরিতামৃতে বারবার মিলছে। চৈতন্য নিজেও সেখানে বলেছেন, ‘ঈশ্বর হয় পরম স্বতন্ত্র।’ চৈতন্যচরিতামৃতে ‘স্বতন্ত্র ঈশ্বর’ ও ‘ভগবান স্বতন্ত্র’ও রয়েছে। ‘স্বতন্ত্র’ শব্দটির মিল সনাতন ‘কাষ্ঠযন্ত্র’ দিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু সার্বভৌম এবং রায় রামানন্দের উক্তিতে দেওয়া হয়েছে ‘নয় পরতন্ত্র’ দিয়ে। এতে একটি সর্বব্যাপক ও স্বাধীন অস্তিত্বের চিন্তাশৃঙ্খলা নির্মাণ করা হয়। যাঁদের সঙ্গে চৈতন্যের নীলাচলে যাওয়ার পরে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, তাঁদের যে সেই শৃঙ্খলা বেশ প্রিয় ছিল, তা বোঝা যায়, অনেক পরে লেখা ‘ভক্তিরত্নাকর’-এ নবদ্বীপের মিশ্র পরিবারের পরিচারক ঈশানের কথা থেকেও। গ্রন্থকার নরহরি চক্রবর্তী বৃন্দাবনের লোক। তার উপরে যে হেতু শ্রীনিবাস সদ্য বৃন্দাবন থেকে ফিরেছেন, তাই তাঁর কাছে ঈশান পর্যন্ত প্রিয় বিশ্বম্ভরকে ‘স্বতন্ত্র ঈশ্বর’ বলে পরিচয় দিচ্ছেন।
কিন্তু বাংলা তাঁকে ছোট থেকে বড় হতে দেখেছে। সন্ন্যাসের আগে নবদ্বীপে বিশ্বম্ভরের নাম যখন ছড়িয়ে পড়ে, পরে লেখা ‘গৌরপদতরঙ্গিণী’-র একটি পদে রয়েছে, নিত্যানন্দ তখন ‘সাঙাত’-কে দেখতে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। বৃন্দাবনে বসে কৃষ্ণদাসও বলেছেন, “শ্রীচৈতন্য সেই কৃষ্ণ নিত্যানন্দ রাম।” এই ‘রাম’ বলরাম। তবে অযোধ্যাপতি রামের একটি শৃঙ্খলাও তৈরি হয় চরিতকাব্যে। রামের প্রভাব যেখানে, সেখানে চৈতন্যের ষড়ভুজ মূর্তি দেখছেন ভক্তরা, যার দু’টি হাত দাশরথির। নিত্যানন্দ বিশ্বম্ভরের সেই রূপ দেখেছেন। সার্বভৌমও দেখেছেন বলে কৃষ্ণদাসও মনে করেছেন, কিন্তু চৈতন্য শাখার কবিকর্ণপুরের মহাকাব্যে সার্বভৌম চতুর্ভুজ মূর্তিই দেখেন, তাতে রাম নেই। মনে রাখা দরকার, নিত্যানন্দ অযোধ্যা গিয়েছিলেন। চৈতন্য যাননি। তবে তিনি সেতুবন্ধে গিয়েছিলেন। আর কৃষ্ণদাসের ধারণা, নিত্যানন্দ ছিলেন এক জন্মে লক্ষ্মণ, আর এক জন্মে বলরাম— যাঁরা রাম ও কৃষ্ণের তাত্ত্বিক অংশভাক হলেও সাহিত্যে স্বাধীন চরিত্র, যাঁরা দুই মহাকাব্যে রাম ও কৃষ্ণের বিরোধিতা কখনও কখনও করেছেন।
নিত্যানন্দও বাংলা সাহিত্যে তেমনই এক চরিত্র হয়ে ওঠেন। অনেকের বিশ্বাস, প্রথম চৈতন্যমূর্তি তৈরি করিয়েছিলেন বিষ্ণুপ্রিয়া। কিন্তু দ্বিতীয় মূর্তিটি থেকেই গৌরনিতাইয়ের যুগল বিগ্রহের কথা উঠছে। ‘ভক্তিরত্নাকর’-এ ঈশান শ্রীনিবাসকে গৌরীদাসের তৈরি যে গৌরনিতাই মূর্তির কথা বলছেন, তার কাঠ নেওয়া হয়েছিল বিশ্বম্ভরের বাড়ির নিমগাছ থেকেই। পরে ফাল্গুন পৌর্ণমাসীতে গৌরীদাসের দাদা সূর্যদাসের কন্যা, নিত্যানন্দের স্ত্রী জাহ্নবার উপস্থিতিতে শ্রীনিবাস খেতরিতে যে ছয় বিগ্রহের অভিষেক করেন, তাঁরা হলেন গৌরাঙ্গ, বল্লবীকান্ত, ব্রজমোহন, কৃষ্ণ, রাধাকান্ত ও রাধারমণ। সেখানে ছিলেন নিত্যানন্দের কৃপাধন্য নরোত্তমও। আবার ‘পদকল্পতরু’-তে গৌরীদাসের একটি বিখ্যাত পদে রয়েছে, নিত্যানন্দ রাজা। বিশ্বম্ভর, অদ্বৈত, গদাধর হাটের পসারিয়া। তবে ‘ভক্তিচন্দ্রিকাপটল’-এ গৌরাঙ্গ পূজাবিধিতে চৈতন্য একা, তাঁর দু’পাশে আপ্লুত বাসুদেব দত্ত ও শিবানন্দ সেন। ষটকোণের বহির্ভাগে নিত্যানন্দ, অদ্বৈতাদি।
বিশ্বম্ভর-চৈতন্যের সঙ্গে নিত্যানন্দের সম্পর্ক তাই ভক্ত-কবিদের চিন্তায় বার বার বদলেছে। চৈতন্যচরিতগুলিতে নিত্যানন্দের বড় অংশ থাকলেও, তাঁর আলাদা জীবনী কিন্তু তেমন ভাবে রচিত হয়নি। স্বয়ং সুকুমার সেনের তত্ত্বাবধানে ১৯৭৫ সালে নিত্যানন্দের জীবন নিয়ে সেই গবেষণার পরেও তা গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেননি গোপালচন্দ্র পাত্র। তাঁর প্রয়াণের পরে গ্রন্থপ্রকাশে উদ্যোগী হন তাঁর কন্যা কবিতা প্রধান। তাঁকে সহায়তা করেছিলেন সুচেতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গ্রন্থটি নিত্যানন্দ সম্পর্কে তথ্যের আকর।
প্রথম দুই অধ্যায়ে নিত্যানন্দের জন্ম, পরিবার, বিশ্বম্ভরের সঙ্গে বিখ্যাত পত্রালাপ, সাক্ষাৎ, তীর্থ পর্যটনের রীতিমতো খুঁটিনাটি এবং নবদ্বীপবাসের বিবরণ। নানা তর্ক রয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই। গোপালবাবু চেষ্টা করেছেন, সব পক্ষেই তথ্য দিতে। তবে এর পরে চৈতন্যের নীলাচলযাত্রা। আর সেখানেই নিত্যানন্দজীবনীকারের বড় পরীক্ষা। চৈতন্যের দণ্ড নিত্যানন্দ ভাঙলেন কমলপুরে। আঠারনালায় গিয়ে সেই দণ্ডের খোঁজ করলেন চৈতন্য। তখন নিত্যানন্দ নবদ্বীপ-শান্তিপুরের যে বিশ্বম্ভর-চৈতন্যকে দেখেছেন, তাঁর স্মৃতিকেই অস্ত্র করে একটি কাহিনি বললেন। এটি একটি সাহিত্য প্রকরণ। চৈতন্যও সম্ভবত তা অনুমান করেছিলেন। যাত্রাপথে একা হয়ে গেলেন। সেই বুঝি তাঁর ‘পরম ঈশ্বর’ থেকে ‘ঈশ্বর স্বতন্ত্র’ হওয়ার পথে যাত্রা শুরু।
নিত্যানন্দের কথাতেই বৃন্দাবনদাস চৈতন্যচরিত লেখেন। তিনিই জানাচ্ছেন, নিত্যানন্দকে চৈতন্য বার বার পুরী যেতে নিষেধ করেছিলেন। আর কৃষ্ণদাসও লিখছেন, নিত্যানন্দ ‘‘তাঁর আজ্ঞা ভাঙ্গে তাঁর সঙ্গের কারণে।’’ ১৫১৪ সালে রথের আগে আগে নিত্যানন্দ আবার নীলাচলে গিয়ে একা বসেছিলেন। চৈতন্যই সেখানে গেলেন। কিন্তু “ঈশ্বরে পরমেশ্বরে হইল কী কথা…” তা কেউ জানলেন না। ‘চৈতন্যভাগবত’-এ চৈতন্য সেখানে নিত্যানন্দকে ‘ঈশ্বর অনন্ত’ বলে সম্বোধন করছেন। বৃন্দাবনদাসের বক্তব্য, “নিত্যানন্দ চৈতন্যে যখন দেখা হয়। প্রায় আর কেহ নাহি থাকে সেসময়।।” কেন? বৃন্দাবনদাস চৈতন্যকেই দায়ী করছেন— “চৈতন্যের ইচ্ছায় কেহ না থাকে তখনে।।” কৃষ্ণদাসও লিখছেন, একবার “কিবা যুক্তি কৈল দোঁহে কেহ নাহি জানে” এবং ‘‘কিবা যুক্তি করে নিত্য নিভৃতে বসিয়া।’’ কিন্তু কী কথা হত, তার নানা “অনুমান পাছে করিল ভক্তগণে।” এই অনুমানের দু’টো পথ। এক, চৈতন্য নিজে কোন চরিতকাব্যে কখন কী করছেন, অন্যদের কী বলছেন, নতুন কোন শৃঙ্খলা তৈরি করতে চাইছেন, তা দেখে দেখে এগোনো। আর একটি হল, নিত্যানন্দকে তিনি যা যা বলেছেন বলে লেখা হয়েছে, নিভৃতে সে সবই আবার বলেছেন এমনটাই ধরে নেওয়া। নিত্যানন্দভক্তেরা দ্বিতীয় পথটি নিয়েছেন। আর সে ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, চৈতন্য নিত্যানন্দকে বলছেন, “তুমিও থাকিলা যদি মুনিধর্ম করি। আপন উদ্দাম ভাব সব পরিহরি।। তবে মূর্খ নীচ যত পতিত সংসার। বোল দেখি আর কেবা করিবা উদ্ধার।।” তাই চৈতন্যই নিত্যানন্দকে বিবাহের আদেশ দিয়েছিলেন, এমন মতও প্রচলিত। মনে করা হয়, অলঙ্কার ধারণ নিয়ে ভক্তদের চাঞ্চল্যের পরে তার ব্যাখ্যাও নিত্যানন্দ চৈতন্যকে সন্তোষজনক ভাবে দিতে পেরেছিলেন। গোপালবাবুও এই সিদ্ধান্তই মেনেছেন। তবু প্রশ্ন যে মেটেনি, তা গোপালবাবুও উল্লেখ করেছেন। জাহ্নবাশিষ্য নিত্যানন্দদাসের ‘প্রেমবিলাস’-এ পর্যন্ত নিত্যানন্দের বিবাহের সমালোচনা রয়েছে। এমনকি, নিত্যানন্দ-বিরোধীদের উদ্দেশে বৃন্দাবনকেও লিখতে হয়েছে, ‘‘এত পরিহারেও যে পাপী নিন্দা করে। তবে লাথি মারোঁ তার শিরের উপরে।।’’
দূরে নীলাচলে চৈতন্য তখন ভাষার ক্ষেত্রে সম্ভবত মত পরিবর্তন করছিলেন। তাঁর প্রত্যক্ষ প্রভাবে যে কাব্য-স্মৃতি তার পরে রচিত হয়, তার ভাষা সংস্কৃত। সারা ভারতের কথা ভাবছেন। সেখানে কৃষ্ণদাসের কাব্যে সনাতনকে চৈতন্য বলেছেন, ‘‘বহু শিষ্য না করিবে। বহুগ্রন্থকলাভ্যাস ব্যাখ্যান বর্জিবে।।’’ একই সঙ্গে আরও যেন অন্তর্মুখীও হয়ে উঠছেন।
কিন্তু নবদ্বীপ চৈতন্যের চেয়ে বিশ্বম্ভরকেই যেন বেশি আঁকড়ে রেখেছিল। আর সেখানে দক্ষিণবঙ্গে বিকল্প বিশ্বম্ভরই যেন হয়ে উঠছিলেন নিত্যানন্দ। বাংলায় গৌরহরি কীর্তনে আকাশ মথিত করলেন। পদাবলি উজ্জ্বল হল তাঁরও প্রভাবে। তাঁরও অভিষেক হল। তাঁর ঈশ্বরাবেশ আরও প্রকট হল। তাঁর দ্বাদশ গোপালে দু’জন বৈদ্য, একজন বৈশ্য। নিত্যানন্দ ‘গেলা বৌদ্ধের ভবনে’ও। জাতের বিচার করা হল না তাঁর দধিচিড়া ভোজে। রেমুনায় ক্ষীরভাগ করা থেকেই সম্ভবত যে চিন্তার সূচনা।
পরে তাই বুঝি মনোহরশাহি কীর্তনে লেখা হল, ‘‘গৌর দিলি দিতি পারে একলা নিতাই।’’ সেই বুঝি কারণ, চৈতন্যের মত থাক বা না থাক, বিগ্রহপুজোও শুরু করলেন নিত্যানন্দ। সনিত্যানন্দ ঊর্ধ্ববাহু গৌরের বিগ্রহের রূপও অনেক বেশি করে বিশ্বম্ভরের। কিছু দিন পরে যে চৈতন্যকে দেখা যাচ্ছে, তাঁর পরনে তো কেবল কৌপীন, ‘তদুপরি বহির্বস্ত্রমরুণং’ বা অরুণ রঙের বহির্বস্ত্র। আর রূপ সাক্ষী, জল খাওয়ার জন্য একটি নারকোলের খোল বাঁধা থাকত কোমরে। বিষ্ণুপ্রিয়ার বিগ্রহটিও বাঙালি ঘরের ধুতি পরা মূর্তিই হলেও, তার হাত দু’টি সম্ভবত সামনে প্রসারিত ছিল। এখন নবদ্বীপে বিষ্ণুপ্রিয়াসেবিত বিগ্রহটি তেমনই। গোড়ার দিকে হাত নীচে রাখা রূপই কল্পনা করা হয়েছিল। কালনার মূর্তিটিরও হাত নীচে। পরে ঊর্ধ্ববাহু রূপটি ছবি ও মূর্তিতে বিখ্যাত হয়ে যায়।
সাহিত্য প্রকরণের প্রতি অনুরাগী নিত্যানন্দ নিজেও সাহিত্যের চরিত্র হয়ে উঠছিলেন। জাহ্নবা ও বীরভদ্রও। তাতেই আরও কঠিন পরীক্ষার সামনে পড়েন নিত্যানন্দের জীবনীকার। চৈতন্যের শেষ জীবনে নিত্যানন্দের সঙ্গে আর কথা হচ্ছে কি না, তার তেমন খোঁজ মিলছে না। আর বাংলায় নিত্যানন্দের বিরোধিতার পাশাপাশি পানিহাটি, আড়িয়াদহ, খড়দহ থেকে তখন ছড়িয়ে পড়ছে তাঁর পুজোও। জাহ্নবা ও বীরভদ্রও পূজ্য। এক সময় এমনকি লেখা হল, স্বয়ং বৃন্দাবনের “গোপীনাথ জাহ্নবার বস্ত্র আকর্ষিয়া। বসাইলা আপনার বামপার্শ্বে লইয়া।।” আবার ‘প্রেমবিলাস’ মতে, জাহ্নবাই মদনমোহনের পাশে রাধা বিগ্রহ স্থাপন করেছিলেন। ভক্তি ও কাহিনির এই জাল ছড়িয়ে রয়েছে কয়েক শতক জোড়া বাংলা সাহিত্যে।
ভরা জ্যৈষ্ঠ। সমুদ্রের বালি আগুনের মতো তেতে। প্রভুর ডাক শুনে তার উপর দিয়েই ছুটছেন সনাতন। তাঁর প্রভু জানেন, ‘‘তপ্ত বালুকায় তোমার পায়ে হৈল ব্রণ।’’ কিন্তু ‘‘চলিতে না পার কেমনে হইল সহন।।’’ সনাতন জানালেন, কষ্ট তিনি বুঝতেও পারেননি। জড়িয়ে ধরলেন তাঁর প্রভু আর তাতে সনাতনের শরীরের ‘‘কণ্ডুরসা প্রভুর শ্রীঅঙ্গে লাগিল।’’ আর এর পরেও সনাতনের পরীক্ষা শেষ হল না।
চৈতন্যচরিতে প্রথমে রূপ ও পরে সনাতনের শিক্ষার এই যে বিবরণ রয়েছে, তা থেকে জ্ঞানপীঠ নবদ্বীপের বিদ্যাচর্চার রীতি-প্রথার আভাস পাওয়া যায়। রূপের শিক্ষা শুরু হয় রামকেলিতে এক জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তিতে। সনাতনের কাশীতে, এক মকর সংক্রান্তির পরে। সংক্রান্তি, নদী-সন্ধি তাঁর জীবনে বার বার এসেছে।
বৃন্দাবন যাওয়ার পথে কাশী গিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। মধ্যাহ্নে, এত ঘাট থাকতে, স্নান করলেন শ্মশানঘাট মণিকর্ণিকায়। স্মর্তব্য, তাঁর পূর্বাশ্রমের নামের সঙ্গে কার্ষ্ণ সম্পর্ক খুব কম। তাঁরই একটি নাম ছিল বিশ্বম্ভর। এমনকি, মায়ের নাম শচী, পিতার একটি নাম পুরন্দর, মাতামহের নীলাম্বর, মাসির সর্বজয়া ও মেসোমশায়ের চন্দ্রশেখর। সেই তিনি স্নানান্তে প্রথমে বিশ্বেশ্বরের কাছে যান, তারপরে বিন্দুমাধবে। কিছু দিন পরে গেলেন বৃন্দাবনে। রঘুনাথদাস গোস্বামীর সাক্ষ্য থেকে অনুমান করা যায়, ‘‘প্রকাণ্ড শরীর শুদ্ধ কাঞ্চন-বরণ আজানুলম্বিত ভুজ কমল-নয়ন’’ সেই সন্ন্যাসীর পোশাক বলতে ছিল কৌপীন আর অরুণ বর্ণের বহিঃবস্ত্র। ভিড় তো হবেই। সেই ভিড় ঠেলে প্রয়াগে এসে মকর সংক্রান্তিতে স্নান করলেন। শরীর ক্লান্ত। তবু ‘‘রূপগোসাঞিরে শিক্ষা দেন শক্তি সঞ্চারিয়া।।’’ কৃষ্ণভক্তি, ভক্তিতত্ত্ব এবং রসতত্ত্বের প্রান্ত পর্যন্ত উজাড় করে দিলেন রূপকে— ‘‘প্রভু কহে শুন রূপ ভক্তিরসের লক্ষণ। সূত্ররূপ কহি বিস্তার না যায় বর্ণন।’’
চরিতকাব্যে তখন বার বার বলা হচ্ছে, চৈতন্য তাঁর মত গ্রন্থে বাঁধতে চাইছেন। অনুমান করা যায়, ভক্তিতত্ত্বের যে রূপ মনে তৈরি রয়েছে, তার যে একটি তাত্ত্বিক প্রকাশ দরকার, তার যে ব্যাখ্যা প্রয়োজন, সেই ব্যাখ্যা প্রমাণ-সাপেক্ষ ও সেই প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত মানদণ্ডে স্বীকৃত হতে হবে, তা নবদ্বীপের সন্তান চৈতন্য তখন মনে করছিলেন। প্রয়াগে দশ দিন ধরে রূপের কাছে সেই ভাবনার একটি সূচিই যেন তাই তিনি স্থির করলেন।
এই যে আগে সূচি তৈরি করে নেওয়া, এই হল নবদ্বীপের অভ্রান্ত স্বাক্ষর। চিন্তা-শৃঙ্খলা সূচিতে বিন্যস্ত করার পরে পাঠবস্তু ও গ্রন্থকর্তাও বিন্যস্ত করলেন। কাশীতে ফিরলেন। কবিকর্ণপূরের শ্রীচৈতন্যচন্দ্রোদয়-এর মতে, সনাতনের সঙ্গে চৈতন্যের দেখা হয়েছে একেবারে কাশীতেই। সেখানেই দু’মাস ধরে সনাতন পাঠ পেলেন। তাঁর পাঠবস্তু যে পৃথক, তার একটি উদাহরণ, কৃষ্ণদাসের বিবরণ মতো, প্রয়াগে রূপকে যে প্রায় সওয়াশো লাইন বলেছিলেন, তার মধ্যে ‘রস’ শব্দটি আলাদা করে বা যুক্ত ভাবে মোটামুটি কুড়ি বার উল্লেখ করেছেন। সনাতনের ক্ষেত্রে মোটামুটি প্রথম ছ’শো লাইনে শব্দটি এসেছে মাত্র বার দু’য়েক।
তখন প্রপাতের মতো তাঁর একটির পর একটি মত আছড়ে পড়ছে। চিন্তার প্রচণ্ড ও মধুর সংঘাত তাতে ধরা পড়ছে। এক বার বলছেন ‘আমি ত বাউল’, তাই ‘আন কহিতে আর’ বলেন। অর্থাৎ, চিন্তাশৃঙ্খলার বিপর্যয় ঘটাতে পারে এমন অবস্থাকে তিনি চিহ্নিত করতে চাইছেন, হয়তো একই সঙ্গে নতুন শৃঙ্খলা রচনাও করছেন। কৃষ্ণমাধুর্যের বিবরণ দিচ্ছেন, ‘‘যেই স্মিত জ্যোৎস্নাভার মধুর হৈতে সুমধুর তাতে হৈতে সুমধুর তাতে হৈতে অতি সুমধুর।’’ কিন্তু সনাতন এর পরে যখন সেই প্রসঙ্গ তুলছেন যে, বাসুদেব সার্বভৌমের কাছে তিনি একটি শ্লোকের আঠারোটি ব্যাখ্যা করেছিলেন, সেই শ্লোকটিরই এ বার একষট্টি রকম ব্যাখ্যা দিলেন তাঁকে। এই যে একটি শ্লোকের এত রকম ব্যাখ্যা, তাতে তো বিদ্যাশর্তের নানা শৃঙ্খলা মেনেও নিচ্ছেন চৈতন্য। আবার পরক্ষণেই অনায়াসে ভেঙে দিচ্ছেন শর্ত সমূহ। বলছেন, কৃষ্ণের বাঁশির ‘ধ্বনি বড় উদ্ধত’। কতটা উদ্ধত? বলছেন, ‘‘লোকধর্ম লজ্জাভয় সব জ্ঞান লুপ্ত হয় ঐছে নাচায় সব নারীগণে।।’’ কিন্তু আবার, যখন সনাতনকে বললেন, ‘‘ভক্তিস্মৃতি-শাস্ত্র করি করিহ প্রচার’’, অর্থাৎ সরাসরি বই লিখতেই নির্দেশ, তখন লোকধর্মের কথা এতটাই কঠিন ভাবে বলছেন— ‘‘সর্বত্র প্রমাণ দিবে পুরাণবচন। শ্রীমূর্তি বিষ্ণুমন্দির চরণ-লক্ষণ।। সামান্য সদাচার আর বৈষ্ণব আচার। কর্তব্য অকর্তব্য স্মার্ত ব্যবহার।।’’ যে নির্দেশ পরে মানা হল হরিভক্তিবিলাস-এ। কী ভাবে দাঁত মাজতে হবে, তারও নির্দেশ রয়েছে সেখানে। কিন্তু কেন পুরাণ? কেন ষড়দর্শন, বেদ নয়? সে তর্ক তোলা থাক, কিন্তু বার বার কৃষ্ণের সঙ্গে সূর্যের তুলনা যে তিনি করছেন, তা থেকে বোঝা যায়, সংহিতা ও উপনিষদে অবগাহন করেছেন।
সনাতনের শরীরও খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল চৈতন্যের কাছে। বলছেন, ‘‘মুঞি যে শিক্ষাইনু তোরে স্ফূরুক সকল। এই তোমার বল হৈতে হবে মোর বল।’’ তাই আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রয়োজন। নীলাচলে সনাতনকে চৈতন্য ছাড়তে চাইলেন না— ‘‘প্রভু কহে তোমার দেহ মোর নিজ ধন।… তোমার শরীর মোর প্রধান সাধন। এ শরীরে সাধিব আমি বহু প্রয়োজন।।’’ হরিদাসও সনাতনকে বললেন, ‘‘তোমার দেহ কহে প্রভু মোর নিজধন। তোমা সম ভাগ্যবান নাহি কোনজন।’’ সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সনাতন দায়িত্ব পেলেন ‘‘ভক্ত ভক্তি কৃষ্ণপ্রেম তত্ত্বের নির্ধার’’ রচনার।
নবদ্বীপের এই পাঠ প্রক্রিয়া শুধু চিন্তার বহুত্বকে স্বীকারই করে না, সংঘাতকালীন পর্বেও এই যে তা শৃঙ্খলা বিচারে সমর্থ ও চরিত্র ধরে রেখেই পরস্পরে লীন, তা বিশ্ববিদ্যালয়প্রতিম।
ধর্মের বেড়াজাল ভেঙে সাম্যের ধারণার প্রতিষ্ঠা
পিতা জগন্নাথ মিশ্রের শাস্ত্রচর্চা ও জ্ঞান অর্জনের অসীম গুণ যে পুত্র বিশ্বম্ভর পেয়েছিলেন, তা তিনি অতি অল্প বয়সেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তৎকালীন সময়ের দিগ্বিজয়ী তার্কিক পণ্ডিত কেশব কাশ্মিরীকে তর্কশাস্ত্রে পরাজিত করার মাধ্যমে।
মধ্যযুগীয় রাঢ় বঙ্গভূমির ঐতিহাসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব বাংলার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায়। বাংলা তথা ভারতের নবজাগরণের ক্ষেত্রে নদের নিমাইয়ের গুরুত্ব ও প্রভাব ছিল অপরিসীম। একদিকে মুসলিম শাসন, অন্যদিকে ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু সমাজের জাতপাত প্রথার প্রবল বাধ্যবাধকতা— এই দুইয়ের মাঝে পড়ে তৎকালীন বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ঐক্য এবং ধর্মীয় কাঠামো ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। ঠিক এই সময়েই (শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর লেখা শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থের প্রামাণ্য তারিখ অনুযায়ী) ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের ফাল্গুনী দোল পূর্ণিমা তিথির সন্ধ্যায় নবদ্বীপে জগন্নাথ মিশ্র ও শচী দেবীর গৃহে বাঙালি সমাজের ত্রাতা রূপে যুগপুরুষ শ্রীগৌরাঙ্গ দেব আবির্ভূত হন। তাঁর আবির্ভাব বাংলা তথা বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতিতে অভূতপূর্ব পরিবর্তন নিয়ে আসে। পূর্ববঙ্গের শ্রীহট্টের আদি বাসিন্দা জগন্নাথ মিশ্রের সংস্কৃত ও শাস্ত্রচর্চার আগ্রহের কারণে নবদ্বীপে আগমন ও বসতি স্থাপন এবং পরবর্তী কালে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব নবদ্বীপকে সারা ভারতের শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় মানবতাবাদ চর্চার কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। এর পরবর্তী অর্ধ শতাব্দী কাল চৈতন্য মানবতাবাদের প্রবল প্রভাবে আপামর বাঙালি সমাজ ভেসে গিয়েছিল ভাবতন্মতার গভীর সাগরে। বাংলা সাহিত্য ও ধর্ম নব প্রাণের স্পন্দনে জেগে উঠেছিল, নতুন করে লেখা হয়েছিল বাংলার ইতিহাস। যাকে চৈতন্য রেনেসাঁ বললেও অত্যুক্তি করা হয় না।
পিতা জগন্নাথ মিশ্রের শাস্ত্রচর্চা ও জ্ঞান অর্জনের অসীম গুণ যে পুত্র বিশ্বম্ভর পেয়েছিলেন, তা তিনি অতি অল্প বয়সেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তৎকালীন সময়ের দিগ্বিজয়ী তার্কিক পণ্ডিত কেশব কাশ্মিরীকে তর্কশাস্ত্রে পরাজিত করার মাধ্যমে। পিতৃ পিণ্ডদান উপলক্ষে তাঁর গয়া গমন এবং সেখানে ঈশ্বরপুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও গোপাল মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ নিমাইয়ের জীবনে বিস্ময়কর পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। নবদ্বীপে তিনি ফিরে এসেছিলেন ঠিকই, কিন্তু শিক্ষাভিমানি পণ্ডিত থেকে কৃষ্ণভাবময় ভক্ত রূপে তার মনোজগতের অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন দেখে অদ্বৈত আচার্যের নেতৃত্বাধীন নবদ্বীপের বৈষ্ণব সমাজ অত্যন্ত চমকিত হন। টোল চতুষ্পাঠী ছেড়ে হরিভক্তদের নিয়ে তিনি কৃষ্ণ নামসংকীর্তনে মেতে ওঠেন। কঠোর বৈরাগ্য সাধনের প্ররোচনায় কাটোয়ার কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষিত হন, সংসারধর্ম ত্যাগ করে শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য নাম ধারণ করেন। হিন্দুধর্মের জাতিভেদ উপেক্ষা করে সমাজের তথাকথিত নিন্ম বর্গের মানুষদের বুকে জড়িয়ে ধরে আপন করে নেন। হিন্দু -অহিন্দু, পণ্ডিত-মূর্খ, উচ্চ-নিচ ভেদাভেদ না করে হরিবোল ও কীর্তনের মাধ্যমে ভক্তিধর্ম প্রচার শুরু করেন। এই ধর্ম আন্দোলন চৈতন্য বৈষ্ণবধর্ম বা গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম নামে পরিচিতি পায়।
চৈতন্য প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুসলিম যবন হরিদাস বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেন। মহাপ্রভু যখন প্রবল হরিনাম আন্দোলন শুরু করেছেন কিছু গোঁড়া ব্রাহ্মণ ধর্ম ভয়ে ভীত হয়ে নবদ্বীপের শাসক চাঁদ কাজীর কাছে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। কাজী উচ্চস্বরে নাম-সংকীর্তনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য সেই নির্দেশ অমান্য করে সংকীর্তন চালিয়ে যেতে থাকেন। সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভারতে প্রথম আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা এখান থেকেই হয়েছিল। কাজীর আইন অমান্য করে লক্ষ লক্ষ ভক্ত সহযোগে বিশাল শোভাযাত্রা শ্রীচৈতন্যের নেতৃত্বে নবদ্বীপের রাজপথে হরিনাম সংকীর্তন করতে করতে কাজীর বাড়ির দিকে এগিয়ে আসে। ভীতসন্ত্রস্ত কাজী শ্রীচৈতন্যের আশ্বাস পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলে দু’জনের মধ্যে হিন্দু শাস্ত্র ও কোরান সম্পর্কে আলোচনা হয়। শুধু তাই নয়, সেই সময়ে জগাই-মাধাইকেও কৃষ্ণ নাম দ্বারা উদ্ধার করেন। পতিতপাবন শ্রীচৈতন্যের ভক্তি ডোরে বাঁধা পড়ে বাঙালি জাতি যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। তার কীর্তনের গীতপ্রবাহ বহুধাবিভক্ত বাঙালির ধর্মকারার প্রাচীরে আঘাত হানে, ভক্তির এক অভিন্ন ধারায় মিলিয়ে দেয় বৃহত্তর বাঙালি জনসমাজকে। ভক্তি মার্গের প্রতি আকৃষ্ট মানুষ ভক্তিগীতের অভিন্ন মিছিলে অংশগ্রহণের ফলে কীর্তন একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। শ্রীচৈতন্যের নগর সংকীর্তন বৈষ্ণবদের কাছে একটি অবশ্য পালনীয় ধর্মীয় কর্ম হিসেবে পরিগণিত হয়। ঢোল, করতাল মৃদঙ্গ, মন্দিরা সহযোগে নৃত্যগীত ও কৃষ্ণভক্তি মিছিলে নবদ্বীপের পথঘাট মুখরিত হয়ে ওঠে। এই পন্থায় সমাজের সব ধর্মের মানুষ গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের কীর্তন মিছিলের সদস্যে পরিণত হয়ে উঠেছিল অচিরেই।
ভারতের অন্য কোনও ভক্তি সংগীতে এই অভিনব মাধ্যমের উপস্থিতি ছিল না শ্রীচৈতন্যের দর্শনের বাহ্যিক প্রকাশ ছিল এই নগর সংকীর্তন। ঈশ্বর প্রেমের ভিত্তিভূমি ছাড়া মানবপ্রীতি দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না— এই উদারবাদী চেতনার মূল ভিত্তিকে সম্বল করে তৎকালীন ধর্মের তীব্র বেড়াজালকে চূর্ণ করে দিয়ে সাম্যের ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব। চৈতন্যের ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন সমাজের বেশির ভাগ পিছিয়ে পড়া নিঃসহায় মানুষ। তথাকথিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির পিছনে সমাজের বিত্তবান শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা থাকলেও চৈতন্যদেব তেমন কোনও সহযোগিতা লাভ করেননি। বরং তিনি ছিলেন সে সময়কার সমাজপতি ব্রাহ্মণ্য ধর্মের রক্ষক ও ধনী বিষয়ভোগীদের চক্ষুশূল। চৈতন্যের মানবতাবাদ প্রচারকে তারা কখনওই ভাল চোখে দেখেনি, প্রতি পদে পদে তারা চৈতন্যের চলার পথকে কণ্টকাকীর্ণ করে তুলতে সর্ব সচেষ্ট ছিলেন। সমাজপতিরা নিম্ন শ্রেণির অন্ত্যজ মানুষদের অস্পৃশ্য করে রাখার কৌশল অবলম্বন করতেন। কোনও রকম ধর্মাচরণের সুযোগ অস্পৃশ্যরা পাওয়ার অধিকারী ছিলেন না। কিন্তু শ্রীচৈতন্যের নাম সংকীর্তন দীর্ঘদিনের অবহেলিত শূদ্র জনগোষ্ঠীকে কৃষ্ণ নামে আপ্লুত হতে সাহায্য করেছিল।
ফলে ধর্মীয় নেতৃত্বকারী উচ্চবর্ণের সমাজপতিরা শ্রীচৈতন্যের প্রতি প্রবল ক্ষুব্ধ হন। চৈতন্যদেব যে একজন উঁচু স্তরের সমাজ সংস্কারক ছিলেন, তাতে দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই। বাংলার নৃপতিতিলক গৌড়াধীশ আলাউদ্দিন হুসেন শাহের সময় কালে চৈতনের আবির্ভাব। শক্তিশালী ও উদারচেতনা সম্পন্ন হুসেন শাহের আমলে বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নব দিগন্ত উন্মোচিত হয়। কিন্তু আভিজাত্যের অহংকার ও রক্ষণশীলতার গোঁড়ামি ভেঙে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা বেরিয়ে আসতে পারেননি। শ্রীচৈতন্য বুঝতে পেরেছিলেন, হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন একটা সার্বিক ধর্মীয়-সামাজিক আন্দোলন। যা জাত্যাভিমানের প্রাচীর চূর্ণ করে দিয়ে মানবিকতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হতে শিক্ষা দেবে। তার নব্য বৈষ্ণব দর্শন সেই ভাব বিপ্লব নিয়ে উপস্থিত হল।
তিনি ব্রাহ্মণ থেকে শুরু করে নিম্ন বর্ণের মানুষদের এক পঙ্ক্তিতে এনে দাঁড় করিয়েছিলেন, যা ছিল এক সমাজবিপ্লব। মহাপ্রভু তাঁর গীত প্রবাহের দ্বারা মানবতার স্বরূপ উন্মোচন করে হিন্দু সমাজ ও ধর্মীয় কাঠামোকে টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। মহামিলনের এই ক্ষেত্র ভূমিকে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করতে চৈতন্যদেব জাত্যাভিমানের দেওয়াল ভেঙে দিতে পেরেছিলেন সহজ ভাবেই। সর্বজনীন আদর্শের অনুগত তাঁর ধর্মের ভিত্তি ভূমি ছিল জীবে দয়া। সমস্ত সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে যে ভাবে তিনি অস্পৃশ্যতা বর্জনের আহ্বান জানান, সে কালের পক্ষে তা ছিল রীতিমতো বৈপ্লবিক। তাঁর মানবতাবাদ যদিও ধর্মীয় মানবতাবাদ, তবু তার ধারা বেয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় নবজাগরণ ও মানবতাবাদ বিকশিত হতে দেখা যায়। বাংলার এই ইতিহাসকে আমরা যেন ভুলে না যাই।
পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা অসাধারণ দু’টি পারিভাষিক শব্দ তৈরি করেছেন চৈতন্য মহাপ্রভুকে বোঝানোর জন্য। তাঁকে বলেছেন ‘কালচারাল স্পেশালিস্ট’, ‘কালচারাল মিডিয়েটর’। প্রথম শুনলে অবোধ লাগে বটে, কিন্তু তটস্থ হয়ে বিচার করলে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন চৈতন্য মহাপ্রভু। আমাদের দেশে ধর্মের দুটো ধারা আছে। একটা সেই বেদ-উপনিষদের ব্রাহ্মণ্য ধারা, যেটা একটি বিরাট দার্শনিকতা ও ততোধিক বিরাট এক আচার-আড়ম্বর ধারণ করে আছে। আর দ্বিতীয়টা হল পৌরাণিক ধারা, যা বেদ-উপনিষদকে হৃদয়ে ধারণ করেও মানুষের কাছাকাছি আসা এক লৌকিক ধারার প্রবর্তন করেছে, তারই অবশেষ ফল কিন্তু আমাদের মঙ্গলকাব্যগুলি।
আমাদের দেশে বেদ-উপনিষদের শ্রুতিপ্রামাণ্য এতটাই মূল্যবান যে, কোনও ধর্ম এবং কোনও ধর্মীয় সম্প্রদায়ই বেদ-উপনিষদের ভিত্তি ছাড়া গ্রাহ্য হত না। কিন্তু, এই যে বেদবেদান্ত আর ন্যায়-বৈশেষিকের চর্চা, যা চৈতন্য মহাপ্রভুর সমকালীন নবদ্বীপকে ভারতবর্ষের অক্সফোর্ড করে তুলেছিল, সেটা চৈতন্য-সমকালের সামাজিক পুরুষদের পরম ঈপ্সিত এক প্রচারও বটে ‘নবদ্বীপে পঢ়িলে সেহ বিদ্যারস পায়।’ চৈতন্য মহাপ্রভুও এই ন্যায়-বেদান্তের পরিবেশেই জন্মেছেন। সার্বভৌম ভট্টাচার্যের মতো ন্যায়-বেদান্তী যদি তাঁর জ্যেষ্ঠ সমকালীন হন, তাঁর কনিষ্ঠ সমকালীন সেখানে রঘুনাথ শিরোমণি। কিন্তু চৈতন্য মহাপ্রভু বেদবেদান্তের দিকেও গেলেন না, ন্যায়-বৈশেষিকের পদার্থ-পরমাণু-বিচারের মধ্যেও গেলেন না। পড়াশুনো যতটুকু করলেন, তা ব্যাকরণ নিয়ে, কিন্তু জীবনের চর্চার ক্ষেত্রে যেটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, সেটা হল ধর্ম, এবং তাও এমন এক ধর্ম, যা ব্রাহ্মণ্য-ধর্মের মধুরতর ফল আর লোকধর্মের উচ্চতর পরিশীলিত মূল।
যা দাঁড়াল, তাতে এও এক ‘মঝ্ঝিম পন্থাঃ’। চৈতন্য মহাপ্রভু দ্বৈতাদ্বৈত বেদান্তের অনির্বচনীয় ব্রহ্মকে এতটুকুও অস্বীকার করলেন না, কিন্তু প্রধানত দার্শনিকের চরম-গম্য সেই তত্ত্বের একটা মধুর স্বরূপ তৈরি করলেন কৃষ্ণের মধ্যে। ‘সত্য জ্ঞান এবং অনন্ত’ রসমূর্তি ধারণ করার ফলে ঈশ্বর যেন এক অদ্ভুত শিহরণে মানুষের স্পর্শযোগ্য দর্শনযোগ্য ভূমিকায় নেমে এলেন। ও দিকে মেধা, বিদ্যা, দার্শনিক এবং বৈরাগ্যের সাধনে যাঁকে অনেক কষ্টে ‘আমিই তিনি, কিংবা তিনিই আমি’ বলে জ্ঞানমার্গে ধ্যান করতে হত, চৈতন্য ভক্তিমার্গ আর আত্মনিবেদনের বশীকরণ তৈরি করলেন সেই ঈশ্বরকে বেঁধে ফেলার জন্য। ঈশ্বরকেই বুঝতে হল, একক, একাকিত্ব ও সর্বময়ত্বের চেয়ে মানুষের আপন রসস্বরূপে লীলায়িত হওয়ার আস্বাদন অনেক বেশি। জ্ঞানগম্যতার মোহ কাটিয়ে ‘রসো বৈ সঃ’ যখন মানুষের দাস্যে, সখ্যে, বাৎসল্যে মধুর রসে ধরা দেন, তখন অদ্বৈতের ব্রহ্ম সগুণ, সবিশেষ হয়ে সমস্ত কল্যাণগুণে মানুষের ভক্তির বিষয় হয়ে ওঠেন। আসলে লৌকিক দেবতার আশ্রয়ে মনসা, বিষহরি আর মঙ্গলচণ্ডীর উপাসনায় যে লৌকিক ভক্তি আর লৌকিক যুক্তি ছিল ‘লিটল ট্র্যাডিশন’-এর ব্যাপার এবং ব্যবহার, সেটাকে মহাপ্রভু চৈতন্য উন্নীত করলেন জ্ঞানের উপরিস্তরে, আর অদ্বৈত ব্রহ্মানুসন্ধানের সাধন যে জ্ঞান, সেই জ্ঞানকে তিনি নামিত করলেন কৃষ্ণানুশীলনের কর্মপন্থায় শ্রবণ, কীর্তন, অর্চন, বন্দন, আত্মনিবেদনের মধ্যে। শুষ্ক জ্ঞান হয়ে উঠল রস। ‘গ্রেট ট্রাডিশন’ আর ‘লিটল ট্রাডিশন’-এর মাঝখানে দাঁড়িয়ে দার্শনিক আর সাধারণ মানুষকে তিনি একত্তর করে দিলেন। পড়াশুনোর জায়গায় বেদান্ত পড়তে বললেন না, বললেন ভাগবত পুরাণ পড়তে। এটাই নাকি তাঁর ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য।
প্রাজ্ঞ পণ্ডিত প্রয়াত হীরেন মুখোপাধ্যায় এক বার বলেছিলেন: বাংলার রেনেসাঁস ব্যাপারটা চৈতন্যের আমলেই প্রথম খোঁজা উচিত। সত্যি বলতে কী, চৈতন্য মহাপ্রভুকে কেন্দ্র করে যে বিশাল সাহিত্য, শিল্প এবং সামাজিক উদারতার পথ তৈরি হয়েছিল, তা দ্বিতীয় বার উদ্যাপিত হয়েছে ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর বাংলায়। এ প্রসঙ্গে অন্য সময়ে আসতে হবে। তবে শুধু তাঁর ধর্মান্দোলনের কথা যদি বলি, তা হলে দেখা যাবে, চৈতন্য এবং চৈতন্য-পার্ষদরা অন্তর্হিত হলে এক সময় যেমন শ্রীনিবাস আচার্য প্রভু, শ্যামানন্দ প্রভু এবং নরোত্তম দাস ঠাকুর সেই আন্দোলনের স্তিমিত প্রদীপ উসকে দেন, ঠিক তেমনই এই বিংশ শতাব্দীর দুই-তিন দশকে তাঁর ভাবনাগুলি আবারও যখন বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাচ্ছিল, তখন আরও এক বার তার পুনর্জাগরণ তৈরি হল, কিন্তু পণ্ডিত গবেষকেরা তার ইতিহাস রচনা করতে ভুলেই গেলেন।
লক্ষণীয়, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের এই আন্দোলনও কিন্তু দু’টি ধারায় তৈরি হয়েছিল। এখানে ‘অ্যাক্টিভিটি’ যে ধারা, সেখানে প্রথম নাম আসবে এখনকার গৌড়ীয় মঠ-মিশনগুলির প্রতিষ্ঠাতা প্রাণপুরুষ ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী মহাশয়ের। প্রসিদ্ধ ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের পুত্র এবং শিষ্য এই মহাপুরুষ বাগবাজার গৌড়ীয় মঠ থেকে তাঁর প্রচার শুরু করেন। দিকে দিকে শাখা মঠগুলি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে দুষ্প্রাপ্য ভক্তিগ্রন্থগুলিও সেখান থেকে বেরোতে থাকে। দেশে-প্রদেশে গৌড়ীয় মঠ প্রতিষ্ঠা করে ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী বিপুল কর্মশক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন। নবদ্বীপের প্রায় প্রতিস্থানে মায়াপুরকে নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাগবাজার গৌড়ীয় মঠে লুপ্ত-প্রাচীন গৌড়ীয় গ্রন্থগুলির প্রকাশও আরম্ভ হয়েছিল। মঠের প্রতিস্থানে বিশালধী পণ্ডিতরা ছিলেন, অ্যাক্টিভিস্টের জায়গাতেও ছিলেন বিশিষ্টজনেরা, যাঁদের কথা গবেষকোচিত চেতনায় কেউ সে ভাবে ভাবলেনই না এখনও।
বর্তমানে ভিড়ে-ঠাসা তীর্থযাত্রায় বা ঘরের নিশ্চিত আরামে বসে দূরদর্শনের পর্দায়, যে ভাবেই বাঙালি আজ পুরীর রথ দর্শন করুক, সেই মুহূর্তে তাদের মনে পড়ে শ্রীচৈতন্যের নাম। সন্ন্যাস নেওয়ার অল্প দিন পরে, ১৫১০ সালে পুরীতে প্রথম বার পৌঁছে মহাপ্রভু ভাবে বিভোর, জড়িয়ে ধরতে গিয়েছেন দারুবিগ্রহ। সফল হননি। তাঁর স্বেদকম্পিত শরীর, আনন্দাশ্রু, রাগানুরাগা ভক্তির আবেশ ও নৃত্য কোনওটারই মর্ম সে দিন বুঝতে পারেননি মন্দিরের কর্মীরা। প্রায় উন্মাদ ভেবে তাঁকে সে দিন থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। জগন্নাথ মন্দিরের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শ্রীচৈতন্য এবং তাঁর ভক্তদের অনিশ্চিত সম্পর্কের সেটাই শুরু। জীবনের ২৪টা বছর শ্রীচৈতন্য কেন পুরীতেই ব্যয় করলেন, তা নিয়ে আজও ইতিহাসবিদদের মধ্যে হরেক মত ও পাল্টা মত। ২৪ বছরের মধ্যে প্রথম ৬ বছর অবশ্য তিনি বৃন্দাবনসহ উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারত সফরের জন্য পুরীকেই কেন্দ্র করেছিলেন। সেখান থেকেই নানা দিকে যাতায়াত করেছিলেন। মায়ের সঙ্গে শেষ বার দেখা করে আসার পর পুরীতে টানা ১৮ বছর বাস করেছেন, ১৫৩৩ সালে সেখানেই রহস্যজনক ভাবে বৈকুন্ঠে লীন হয়ে গেলেন।
পাঁচ শতাব্দী পিছনে ফিরে আজ যদি আমরা জানতে চাই, মহাপ্রভু সে দিন রথ, উল্টোরথের উৎসবে কোন কাজে ব্যস্ত ছিলেন, কতগুলি তথ্য জরুরি। ১১৩৫ সালে রাজা অনন্তবর্মন চোড়গঙ্গা শবর ও স্থানীয় উপজাতিদের কাষ্ঠনির্মিত দেবমূর্তিটিকে ওড়িশার প্রধান দেবতা তথা পুরুষোত্তম হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন। ভেদাভেদ দূর করে সবাইকে এক ছাতার নীচে আনার পক্ষে সেটি ছিল চমকপ্রদ এক সামাজিক প্রকল্প। এর আগে ২৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই এলাকাতেই কলিঙ্গ যুদ্ধ, তার কয়েক বছর পরই সম্রাট অশোক চমকপ্রদ সেই সিদ্ধান্ত নিলেন। বেশির ভাগ প্রজা যে অনুশাসন মানে, সেই বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে তাকে দিলেন রাজ-স্বীকৃতি। ৩২৫ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে আর এক জন প্রায় একই রকম মাস্টারস্ট্রোক খেললেন। রোমান সম্রাট কনস্ট্যানটাইন তাঁর রাজ্যে নিপীড়িত খ্রিস্টান জনতার ধর্মকে দিলেন স্বীকৃতি। নিম্নবর্ণের প্রজাদের পূজিত দারুব্রহ্মকে স্বীকৃতি দিয়ে অনন্তবর্মন যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন, তা বোঝা যাবে ওড়িশার প্রতিবেশি রাজ্য, এই বাংলার দিকে চোখ ফেরালেই। ৭১২ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধুপ্রদেশে মুসলিমদের জয়ের সত্তর বছরের মধ্যে বাংলা প্রায় বিনা যুদ্ধে চলে গেল সুলতানি শাসনে, প্রজারা অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করলেন। ওড়িশা প্রায় ৩২ বার মুসলিম হামলায় আক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু শাসকেরা সেখানে কোনও দিন হিন্দুসমাজকে বিনষ্ট করতে সক্ষম হননি। ব্রাহ্মণদের অত্যাচার ও নানা কারণে তৎকালীন বাংলার প্রায় ৬৫ শতাংশ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করলেন। অথচ, ওই সময়েই ওড়িশায় দুই শতাংশের বেশি হিন্দু ধর্মান্তরিত হলেন না। কারণ, সেখানে নীচুতলা থেকে ওপরতলা অবধি যাবতীয় হিন্দুর উপাস্য এক জনই। পুরুষোত্তম জগন্নাথ স্বয়ং!
অনেক ঐতিহাসিকের মত, মুসলিম শাসনের বাংলা বা বৃন্দাবনের থেকেও এই হিন্দু রাজ্যটিতে শ্রীচৈতন্য অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন, পুরীর রাজা প্রতাপ রুদ্রদেব তাঁর শিষ্যত্বও নিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল’ উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন, চৈতন্য রাজাকে মুসলিম শাসনাধীন গৌড়বঙ্গ আক্রমণ থেকে বিরত করেছিলেন। যুদ্ধে প্রাণহত্যা ও ক্ষয়ক্ষতি তাঁর অপছন্দ ছিল। আবার, কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর ‘চৈতন্যচরিতামৃত‘-র মধ্যলীলা পর্যায়ে জানিয়েছেন, রাজা প্রতাপ রুদ্রদেব কী ভাবে নিজে এক বার চৈতন্য ও তাঁর সঙ্গীদের রথযাত্রায় অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাঁড়িয়েছিলেন। জগন্নাথ মন্দিরের ক্ষমতাবান দ্বৈতাপতিদের সেখানে মদমত্ত মাতঙ্গের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের মনোভঙ্গিটি কৃষ্ণদাসে চমৎকার প্রকাশিত। বিশাল দারুমূর্তিগুলি কী ভাবে রেশমি দড়িতে বেঁধে দ্বৈতারা মন্দিরের বাইরে নিয়ে আসছেন, পুরু মাদুরের উপর দিয়ে সেগুলি রথে নিয়ে তুলছেন, সেই বর্ণনাও চরিতামৃতে আছে। রাজা যে ভাবে সোনার হাতলওয়ালা ঝাঁটা নিয়ে জগন্নাথদেবের পথ পরিষ্কার করেন, সারা রাস্তায় সুগন্ধি চন্দনজল ছেটানো দেখে মহাপ্রভুও চমৎকৃত হয়েছিলেন। চরিতামৃত আরও জানিয়েছে, সোনায় মোড়া তিনটি রথ সুমেরু পর্বতের চেয়েও উঁচু। রথ এগোয়, প্রচুর পিতলের ঘণ্টা বাজতে থাকে। রঙিন রেশমি কাপড় ও কাচের ঝলকানিতে সমবেত দর্শনার্থীদের চোখ ধাঁধিয়ে য়ায়। বৈষ্ণব সাধু ও কীর্তনীয়ারা পথে যমুনাপুলিনের মতো সাদা বালি ছড়িয়ে দেন। সম্ভবত, মধ্যযুগে বর্ষার কর্দমাক্ত, পিচ্ছিল পথে বিশাল রথ টানা সুবিধের ব্যাপার ছিল না বলেই এই বালুকাসিঞ্চন। বালির আরও একটা কাজ ছিল। রথ টানতে গিয়ে বর্ষার রাস্তায় লোকে ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যেত না।
শ্রীচৈতন্য কী ভাবে তাঁর ভক্তদের এই রথযাত্রায় একত্র করে নিজেকে মাল্যচন্দনে বিভূষিত করতেন, তার বর্ণনাও দিয়ে দিয়েছেন কৃষ্ণদাস। অদ্বৈত আচার্য ও নিত্যানন্দ এই দৃশ্যে প্রথম থেকেই ভাবোন্মাদ হয়ে যেতেন, কিন্তু মহাপ্রভু নিজে স্বরূপ দামোদর আর শ্রীবৎস ঠাকুরের সংকীর্তন দলের দিকে হেঁটে পৌঁছে যেতেন। তাঁদেরকেও মালা, চন্দনে সাজিয়ে দিতেন। প্রতিটি সঙ্কীর্তন দলকে মহাপ্রভু নিজে পরিদর্শন করতেন, নিত্যানন্দ, অদ্বৈত, হরিদাসরা কে কী ভাবে নাচে নেতৃত্ব দেবেন সিদ্ধান্ত নিতেন। সঙ্কীর্তন আর নামগানে কী ভাবে দলনেতার সঙ্গে সুর মেলাতে হবে, সেটিও বলে দিতেন। ডিটেইলের প্রতি এই সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ দৃষ্টি বুঝিয়ে দেয়, চৈতন্যের মতো নেতা সব বিষয়ে সজাগ। তাঁর ম্যনেজমেন্ট স্টাইল, পরিকল্পনা সবই রথ, উল্টোরথের দিনগুলিতে প্রকট। সঙ্কীর্তনে যোগ দিতে কুলীনগ্রাম থেকে এক দল ভক্ত এসেছেন, চৈতন্য রামানন্দ এবং সত্যরাজকে তাঁদের নেতৃত্ব গিতে বললেন, যাতে কোথাও তাল কেটে না যায়। শ্রীখন্ড থেকে আর একটি দল এল, নরহরি ও রঘুনাথের দায়িত্বে তাঁদের সঁপে দেওযা হল। শ্রীক্ষেত্র তখন চৈতন্যের প্রতি ভয়ে-ভক্তিতে আপ্লুত, গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের ছোট্ট দলটি রথযাত্রার প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হাজির। জগন্নাথের রথের সামনে অদ্বৈত আচার্য ‘হরি বোল’ ধ্বনিতে মাতিয়ে দেন, শ্রীচৈতন্য নৃত্যের আবেশে লাফিয়ে ওঠেন। এক বার সে রকম করতে গিয়ে পড়েও গেলেন, কিন্তু পরক্ষণেই মাটিতে গড়িয়ে গেলেন, কিছুক্ষণ পরে ফের স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে। মহাপ্রভুর সাফল্যের কারণ তাই শুধু রাগানুরাগা ভক্তি, অতীন্দ্রিয় কৃষ্ণপ্রেমে খুঁজলে হবে না। নেতৃত্বদানের খুঁটিনাটিও দেখতে হবে।
রথের শহরে, জগন্নাথ-কাহিনিতে শ্রীচৈতন্যের সবচেয়ে বড় অবদান কী? চৈতন্য বারংবার বলেছেন, পুরীর এই নীলমাধবই স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ, তিনি তাঁরই আরাধনা করেন। চৈতন্য পুরীতে বলেন, তিনি শুধু শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্মের ভক্ত, কোনও জাত বা সম্প্রদায়ে বিশ্বাসী নন। গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের ‘চণ্ডাল চণ্ডাল নহে যদি কৃষ্ণ বলে’ দর্শনের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে আছে মহাপ্রভুর এই পুরীদর্শন। সেই দর্শনের সঙ্গে বৃন্দাবনের রাধাকৃষ্ণ মেটিফ মিলেমিশে ওড়িশার পরিচিত জগন্নাথ-পুরুষোত্তম-ত্রৈলোক্যমোহন বিগ্রহের ভাবমূর্তিতে এল অন্য মাত্রা। এই ভাবমূর্তিটি নিয়ে বিভিন্ন বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে দড়ি টানাটানি ছিল। চৈতন্য অন্যদের হারিয়ে জিতে গেলেন, কারণ তিনি পুরীতে থেকেই কাজগুলি করেছিলেন। ষোড়শ শতকের গোড়াতেও পুরীতে শৈব ও শাক্তরা বৈষ্ণবদের যথেষ্ট বেগ দিত, প্রতাপ রুদ্রদেবের মতো রাজাকে ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে হত।
আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। পুরীবাসে চৈতন্যের প্রধান শিষ্যরা, যেমন রামানন্দ, শ্যামানন্দ, বলদেব বিদ্যাভূষণ কেউই ব্রাহ্মণ নন। পুরীর তৎকালীন ব্রাহ্মণ পান্ডা ও পুরোহিতেরা সারা বছর এই শূদ্রদের জগন্নাথ দর্শনের বিপক্ষে। শবরদের জগন্নাথ তখন ব্রাহ্মণদের একচ্ছত্র আধিপত্যে। মন্দিরের পুরোহিতেরা বিধান দিলেন, জগন্নাথদেব বছরে এক বারই মানুষের দরবারে বেরোতে পারবেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ্যধর্মের সব জারিজুরি একটা জায়গায় হার মানতে বাধ্য হল। শ্রীচৈতন্য ও তাঁর শিষ্যদের নগর সঙ্কীর্তন। গাঁধীজির সত্যাগ্রহ যেমন বহু পরে আপামর জনসাধারণকে উদ্দীপ্ত করেছিল, জগন্নাথধামে শ্রীচৈতন্যের কীর্তিও সে রকম। পুরীতে এই পদক্ষেপগুলি নিয়েই শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম গৌড়বঙ্গের ছোট্ট মানচিত্র ছাপিয়ে গেল, সারা দেশে হয়ে উঠল স্বীকৃত এক ধর্মদর্শন।
রহস্যজনক ভাবে পুরী থেকে তিনি হারিয়ে গেলেন। অচ্যুতানন্দ দাস, দিনকর দাস, ঈশ্বরদাসের মতো লব্ঝপ্রতিষ্ঠ টীকাকারেরা বারংবার বলেছেন, নীলমাধব বিগ্রহে মিশে গিয়েছে তাঁর শরীর, কিন্তু সে নিয়ে হরেক সন্দেহ আর বিতর্ক। মনে রাখতে হবে, মহাপ্রভু, সুভাষচন্দ্রের মতো নেতার রহস্যময় অন্তর্ধান নিয়ে অযথা তর্কাতর্কি শুধুই উত্তাপ ছড়ায়, প্রজ্ঞার আলো কিছু থাকে না।
(তথ্যসূত্র:
১- পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য, ড.শান্তিকুমের দাশগুপ্ত ও নির্মলনারায়ণ গুপ্ত, রত্নাবলী।
২- করুণাবতার শ্রী নিত্যানন্দ প্রভু, গোপাল চন্দ্র পাত্র, ঋত প্রকাশন (২০১৯)।
৩- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৬ই সেপ্টেম্বর ২০১৩, ২১শে মার্চ ২০১৬, ৩০শে জুন ২০১৯, ২৪শে জুন ২০১৮, ২০শে মার্চ ২০১৯, ২রা জুলাই ২০১৭ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত