ভারতে আসার পর মোদি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানিয়ে বলবেন – কেমছো ট্রাম্প? মানে কেমন আছেন ট্রাম্প? সে তিনি জিজ্ঞেস করতেই পারেন কিন্তু তিনি কি তার দেশকে সেকথা জিজ্ঞাসা করার সৎসাহস দেখাবেন? বলবেন – কেমছো ভারত? গোটা দেশবাসীকে একথা জিজ্ঞেস করার সৎসাহস বা শিরদাঁড়া তার কোনটাই নেই। তাই শর্টকাট রাস্তা হিসেবে দেশের গরিবি ঢাকতে আমেদাবাদে মার্কিন প্রেসিডেন্টের যাত্রাপথে পাঁচিল তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যেন পাঁচিল তুলে দেশের দারিদ্র্ ঢাকা যাবে। এ যেন দেশে গরিব নেই একথা প্রমাণ করতে গরিবদের অদৃশ্য করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত! এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, বিজেপির রাজনীতিটাই এমন। এই গরিব বিরোধী, জনবিরোধী রাজনীতিতে বিশ্বাসীরাই দেশে এনআরসি, ক্যা চালু করার মত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ভাগ করতে পারে ধর্মের নামে দেশ।

আমি বড় হয়েছি একটা নিম্নবিত্ত পরিবারে। অতিথি এলে তাদের বিরাটভাবে অভ্যর্থনা জানানোর সুযোগ আমাদের ছিল না। আমরা নিজেদের গরিবি ঢাকার চেষ্টাও করতাম না। শুধু দেখতাম কেউ আসার কথা থাকলে মা বিছানার মলিন চাদরটা বদলে দিয়ে একটা নতুন চাদর পাততেন, আর কিছু ঢাকার চেষ্টা সেখানে ছিল না। আমাদের দেশের ঐতিহ্যে অতিথি তো দেবতা। তা দেবতার কাছে মানুষ মিথ্যা কথা বলবে কেন? গরিব মানুষদের প্রতি ঘৃণা ও অবজ্ঞার এক নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করলেন মোদি। এই হৃদয়হীন মানসিকতা থেকেই গরিবদের বাদ দিয়ে শুধুমাত্র তাদের আশীর্বাদধন্য পেটোয়া ব্যবসায়ী আর কর্পোরেটদের লুটেপুটে খাওয়ার ভারত বানাতে চাইছেন তারা।
এনআরসি, ক্যা করার সময় তারা বলছেন শুধু বিদেশীদেরই তারা দেশ থেকে তাড়াবেন। এখন তো দেখা যাচ্ছে প্রয়োজনে যে কোন মানুষকে তারা গায়েব করে পাঁচিল দিয়ে ঢেকে দিতে পারেন। গরিবি ঢাকতে যাদের বাড়ির সামনে পাঁচিল উঠছে তারা কিন্তু বিজেপির ভাষায় বহিরাগত নয়। অথচ প্রয়োজনে তাদের অদৃশ্য করে দিতে বিজেপির বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের ভাবনা ছাড়া আর সবকিছুকেই তারা তাদের রামরাজত্বে অদৃশ্য করে দিতে চাইছেন।
ট্রাম্প ও আমেরিকা নিয়ে অত আদিখ্যেতা দেখানোর কিছু নেই। সারা পৃথিবীর গরিব দেশগুলির বেশিরভাগ মানুষই আমেরিকা বিরোধী। আমার নিজেরও কোন আমেরিকা প্রেম নেই। বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক শোষণ ও রাজনৈতিক অপশাসন কায়েম করা তাদের বৈশিষ্ট। ভিয়েতনাম থেকে ভেনিজুয়েলা এর অজস্র উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। এমনকি ভয়াবহ দূষণ আক্রান্ত পৃথিবীকে দূষিত করার দায়ও গরিব দেশগুলির উপর চাপিয়ে দিতে চাইছেন তারা। তাই এমন দেশের প্রেসিডেন্ট আসা নিয়ে এত উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করার মত কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। খোদ নিজের দেশে ট্রাম্প ব্যাপক সমালোচনার শিকার। আগামি নির্বাচনে তিনি থাকবেন কিনা সে নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেছে। সে দেশের বেশিরভাগ মানুষই তার কথা ও কাজকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। রতনে রতন চেনার মত মোদি চিনেছেন ট্রাম্পকে। বলা হচ্ছে আমেরিকা ও ভারতের ঘনিষ্ট বন্ধুত্বের উদযাপন উপলক্ষে এই সফর। আমার প্রশ্ন, মোদির এই ঘনিষ্ট বন্ধুত্বে ভারতের ঠিক কি কি উপকার হয়েছে তা মোদি পরিষ্কার করে জানান। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার একদা প্রবল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বামদলগুলি মোদির এই মার্কিন প্রেম নিয়ে কোন রা কাটছেন না।
ট্রাম্পের সফরকে ঘিরে এত হইচই একটা চূড়ান্ত দেখনদারি। মোদি যা বলেন তা তিনি নিজেই বিশ্বাস করেন না। সবরমতি আশ্রমে গান্ধীর আবাস হৃদয়কুঞ্জে ট্রাম্পকে মোদি নিয়ে যাবেন। মোদির কী নিজেরই কোন হৃদয় আছে? থাকলে ধর্মের নামে দেশের মানুষকে ভাগ করা, মুসলমানদের দেশ থেকে তাড়ানোর জিগির তুলতেন না তিনি। এ সফর যেন দুদেশের দুটি জনবিরোধী ব্যর্থ মানুষের যুগল মিলন। পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে একটা ব্র্যান্ড তৈরি করার ব্যর্থ চেষ্টা ছাড়া ট্রাম্পের সফরকে আর কোনভাবেই ব্যাখ্যা করা যাবে না। তবে একটা জিনিস বোধহয় মোদি ভুলে গেছেন অন্যায় অবিচারকে কোন মিথ্যার পাঁচিল তুলে ঢাকা যায়না। পাঁচিলের ওপাশে থাকা মানুষগুলি যদি বিদেশী অতিথিদের সামনে এসে দাঁড়ায় তাহলেই তারা বুঝতে পারবেন ভারত কেমন আছে?
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত