২০০ জন সাংসদ, কেন্দ্রের ৭০ জন মন্ত্রী, বিজেপি শাসিত একাধিক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তা সত্ত্বেও কেজরি ঝড়ে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে গেরুয়া। একথা এখন দিনের আলোর মত স্পষ্ট যে কাজ করছে না মোদী ম্যাজিক। তাই প্রচারে দাপট দেখালেও দিল্লীতে মুখ ঠিক করতে পারেনি বিজেপি, যার জেরেই দিল্লী হাতছাড়া হল মোদী-শাহের। ‘নামপে’ ভোট নাকি ‘কামপে’? কার্যত এই একটা প্রশ্নই ঘায়েল করে দিল বিজেপিকে।
এই ভোটের কিছু দিন আগে থেকে দিল্লীতে একটা প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছিল প্রায় স্লোগানের প্রাবল্যে। স্লোগান না বলে ক্যাচলাইনও বলা যেতে পারে। প্রশ্নটা হল— দাম কাকে দেবেন? ‘নাম’কে, না ‘কাম’কে? ‘নাম’ অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদী। তাঁর নামেই নাকি সব সম্ভব (মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়)! আর ‘কাম’ মানে অরবিন্দ কেজরিওয়াল। কারণ নিজের নামে নয়, আম আদমি পার্টির নামে নয়, গোটা প্রচার পর্বটায় শুধু ‘কাম’-এর (কাজ) নামে ভোট চেয়ে গিয়েছেন তিনি। গত পাঁচ বছরে দিল্লিতে যা কিছু করেছে তাঁর সরকার, তা ভোটে জেতার জন্য যথেষ্ট বলে বিশ্বাস ছিল কেজরিওয়াল। তাঁর এই বিশ্বাস যে মিথ্যা নয়, তার প্রমাণ আজকের ভোটের ফলাফল।
গত পাঁচ বছরে নিজেদের সরকারের কাজের খতিয়ান নিয়ে আপ কর্মীরা যখন থেকে ভোটারদের দরজায় দরজায় যেতে শুরু করলেন, তখন থেকেই এই স্লোগান সুলভ প্রশ্নটা সামনে উঠে আসতে শুরু করে। নিখরচায় বিদ্যুৎ, সরকারি খরচে স্বাস্থ্য পরিষেবা, বিনামূল্যে জল, বিনামূল্যে সরকারি বাসে মহিলাদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করা— এ সব কথাই বার বার ভোটারদের সামনে গিয়ে বলছিল আপ। আর তার পরেই প্রশ্ন তুলছিল, এই সব ‘কাজ’ দেখে জনতা ভোট দেবেন? নাকি কারও ‘নাম’ দেখে ভোট দেবেন? মানুষ আস্থা রাখলেন কাজেই।
২০১৫ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগেই আপ সুপ্রিমো নেতা তথা দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ, রোজ ৭০০ লিটার পর্যন্ত জল বিনামূল্যে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবেন। সে প্রতিশ্রুতি তিনি রেখেছেন। এ ছাড়া স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে তাঁর ‘মহল্লা ক্লিনিক’ প্রকল্প কেন্দ্রের ‘আয়ুষ্মান ভারত’কে প্রায় টেক্কা দিয়ে গিয়েছে বলে আপের দাবি। এ বারের প্রচার পর্বে নিজের ভাষণগুলোয় তিনি বার বারই সে কথা দিল্লীবাসীদের মনে করিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘যাঁরা ভোট চাইতে আসবেন, তাঁদের জিজ্ঞাসা করুন যে, তাঁদের রাজ্যে সাধারণ মানুষ কি এই সুবিধা পান?’’ নাম না করলেও নিশানা যে অমিত শাহ, স্পষ্ট করে না বললেও প্রশ্ন যে মোদীর নিজের রাজ্য গুজরাতে বিদ্যুতের দাম নিয়ে, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হয়নি।
সিএএ, এনআরসি, শাহিন বাগের মতো বিষয় নিয়ে সুর ক্রমশ চড়াতে চড়াতে কেজরিওয়ালকে বিজেপি বড়সড় চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেও মুখ্যমন্ত্রী পদের জন্য অরবিন্দের বিকল্প মুখ হিসেবে নিজেদের শিবির থেকে কাউকে তুলে ধরতে পারেনি। ভরসা রেখেছিল সেই একটাই নামে— নরেন্দ্র মোদী। আর সেখানেই অনেকে পাল্টা প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছিলেন— বিজেপি যদি জেতে, তা হলে মোদী কি প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী হতে আসবেন? যদি না আসতে পারেন, তা হলে মোদীর নামে ভোট চাওয়া কেন?
শাহিনবাগের সিএএ বিরোধী আন্দোলন বুমেরাং হয়ে ধরা দিয়েছে বিজেপির কাছে। অনুমান করা হচ্ছিল শাহিনবাগকে হাতিয়ার করে দিল্লীর মন জয় করবে গেরুয়া বাহিনী। চলছিলও তাই। বিজেপির সমস্ত নেতাদের মুখে মুখে ফিরছিল শাহিনবাগ কথা, গুলি মারা থেকে, জঙ্গী- শাহিনবাগকে দেশদ্রোহী তকমা দিতে কার্পন্য করেননি কোনও বিজেপি নেতা। সেখানেই শাহিনবাগকে নিজের থেকে বহু দূরে রেখেছিলেন কেজরওয়াল। উল্টে কেন্দ্রকে বলেছিলেন ক্ষমতা তাদের হাতে পারলে খালি করাক শাহিনবাগ। এদিকে শাহিনবাগকে হাতিয়ার করে বিজেপি যে ভোট যুদ্ধে নেমেছে তা টের পেয়েছিল দিল্লীর মানুষ। তারই ফল বোধহয় মিলল এদিন।