“আমি কোন সময়েই একটা সাধারণ পুতু-পুতু মার্কা গল্প বলি না- যে একটি ছেলে একটি মেয়ে প্রেমে পড়েছে, প্রথমে মিলতে পারছে না, তাই দুঃখ পাচ্ছে, পরে মিলে গেল বা একজন পটল তুলল-এমন বস্তাপচা সাজানো গল্প লিখে বা ছবি করে নির্বোধ দর্শকদের খুব হাসিয়ে বা কাঁদিয়ে ঐ গল্পের মধ্যে involve করিয়ে দিলাম, দু’মিনিটেই তারা ছবির কথা ভুলে গেল, খুব খুশি হয়ে বাড়ি গিয়ে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল- এর মধ্যে আমি নেই।
আমি প্রতি মুহূর্তে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে বোঝব it is not an imaginary story, বা আমি আপনাকে সস্তা আনন্দ দিতে আসিনি। প্রতি মুহূর্তে আপনাকে hammer করে বোঝাব যে যা দেখছেন তা একটা কল্পিত ঘটনা, কিন্তু এর মধ্যে দিয়ে যেটা বোঝাতে চাইছি আমার সেই thesis-টা বুঝুন, সেটা সম্পূর্ণ সত্যি। সেটার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করানোর জন্যই আমি আপনাকে alienate করব প্রতি মুহূর্তে।
যদি আপনি সচেতন হয়ে ওঠেন, ছবি দেখে বেরিয়ে এসে বাইরের সেই সামাজিক বাধা বা দুর্নীতি বদলানোর কাজে লিপ্ত হয়ে ওঠেন, আমার protest-কে যদি আপনার মধ্যে চারিয়ে দিতে পারি, তবেই শিল্পী হিসেবে আমার সার্থকতা।…
চলচ্চিত্রশিল্পে আমি বলে নয়, যাঁরা পৃথিবীর সবচেয়ে serious শিল্পী এবং আমার বাংলাদেশেও যারা serious কাজ করেন, যাদের নাম-টাম আপনারা শুনেছেন-টুনেছেন, প্রত্যেকেই একজনের দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং সেই ব্যক্তিটি হচ্ছেন সের্গেই আইজেনস্টাইন। আইজেনস্টাইন না-থাকলে আমরা কাজ-কম্মর ‘ক’ও শিখতাম না। উনি আমাদের বাবা। আমাদের পিতা। তাঁর লেখা, তাঁর thesis এবং তাঁর ছবি- এগুলো ছোটবেলায় আমাদেরকে পাগল করেছিল। এবং তখন ওগুলো আসত না। বহু কষ্টে লুকিয়ে-লুকিয়ে নিয়ে আসা হত। এই আইজেনস্টাইন… সত্যজিৎ রায়কেও আপনারা জিজ্ঞেস করতে পারেন, he will admit, that he is the father of us. আর(তাঁর থেকেই) আমরা ছবি কাটতে শিখেছি… filmmaking-এ ওটা একটা ব্যাপার। তারপর পুদভকিন সাহেব। পুদভকিন এসেছিলেন ১৯৪৯ সালে। তখন আমার সৌভাগ্য হয়েছিল পার্টির তরফ থেকে… পার্টি আমাকে চাপিয়ে দিল যে পুদভকিন-এর একটু পিছনে-পিছনে ঘোরো। এই পুদভকিন একটা কথা আমাকে বলে দিয়েছিলেন সে দিন, সেটা আমার শিক্ষার basis. সেটা হচ্ছে যে film is not made. Filmmaking কথাটা বাজে কথা। Film is built. Brick to brick যে-রকম ভাবে একটা বাড়ি তৈরি হয়, film তেমনই shot by shot কেটে-কেটে তৈরি হয়। It is built, it’s not made. এই দু’জন ব্যক্তি, তারপর কার্ল ড্রেয়ার। কার্ল ড্রেয়ার-এর ছবি আমি অনেকে দিন আগে পুনায় দেখেছিলাম। ‘The Passion of Joan of Arc’ এই ছবি দেখে আমার মস্তিষ্ক খারাপ হয়ে গেছল। আর আমাকে গুরুজন বলে মানতে হলে একটু মানতে হয়ে বুনুয়েল সাহেবকে। লুইস বুনুয়েল। এঁরা ক’জন আমার সত্যিকারের গুরু, plus মিজোগুচি। এঁর ‘Ugetsu Monogatari’ দেখে আমি staggered… মানে….মাথা-ফাতা খারাপ হয়ে গেছল। একেই বলে ছবি! ছবি কী, এই ক’টা লোক থেকে আমি পেয়েছি।”
‘অভিযান’ দেখতে গিয়েছেন সত্যজিতের অনুরোধে। মাঝপথেই উঠে পড়লেন। প্রকাশ্যেই সত্যজিৎকে গালিগালাজ করতে শুরু করলেন। কেন মেজাজ হারিয়েছিলেন? মদ্যপান করে একদিন তুষার তালুকদারকে বলেছিলেন তার উত্তর, ‘‘মৃণাল ছবিটি দেখে এসে বলল, ঋত্বিক ছবিটি দেখে এসো। তুমি দেখবে মানিকবাবু বহু জায়গায় অযান্ত্রিক-এর প্রায় হুবহু কপি করেছেন। আমি ইন্দিরাতে ছবিটি দেখতে গিয়ে দেখলাম, সত্যিই তাই! অসংখ্য ফ্রেম এক্কেবারে হুবহু এক। মাঝপথে খেপে গিয়ে উঠে পড়লাম। কারণ আমার মনে হল, ছবিটা কিছুই দাঁড়ায়নি।’’ অথচ, নিজের ‘অযান্ত্রিক’ রিলিজ হওয়ার পর তার বিজ্ঞাপনে লেখা থাকত সত্যজিৎ রায় উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন! যখন সত্যজিতের ‘অশনি সঙ্কেত’ রিলিজ করল, তখনও!
ঋত্বিক হাসপাতালে। ঠিক করলেন উৎপল দত্তর ‘ব্যারিকেড’ দেখতে যাবেন। হঠাৎ করেই মত বদলে দেখলেন ‘অশনি সঙ্কেত।’ সেবারও হল থেকে বেরিয়ে হতাশ! বললেন, ‘‘অশনি সঙ্কট দেখিয়ে কেন আমার মতো অসুস্থ লোককে আরও সঙ্কটে ফেললে। মানিকবাবু চূড়ান্ত ধেড়িয়েছেন। শেষ দৃশ্যটা মনে করো, সেখানে মন্বন্তরের কোপে পড়া হাজার হাজার ভুখা মানুষের মিছিল দিয়ে ছবি শেষ হয়েছে, তাই তো?’’ ঋত্বিক মনে করতেন, গল্পের মতোই শেষটা হওয়া দরকার ছিল।বলেছিলেন, ‘‘মৃত্যুর মিছিল নয়, নতুন জীবনের সৃষ্টি। এইটাই শেষ কথা।’’ নিজেও সব ছবির শেষে তেমন ইঙ্গিতই দিয়েছিলেন।
এর মানে এই নয়, মানিকের সঙ্গে ঝগড়া ছিল ঋত্বিকের। ৬৫-তে সত্যজিতের সুপারিশেই তাঁর পুণের ফিল্ম ইনস্টিটিউটে কাজ হয়। শোনা যেত, সারা কলকাতা ঘুরে ঋত্বিক লেক রোডে সত্যজিতের বাড়ি দেখিয়ে দিতেন ট্যাক্সিওয়ালাকে। আর বাইরে দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসতেন। ড্রাইভারকে কেবল জিজ্ঞেস করতেন, ‘‘কত?’’ সত্যজিৎ মিটিয়ে দিতেন বিল! জানলায় এসে দাঁড়াবেন চিরচেনা সওয়ারিকে দেখতে, ততক্ষণে ঢোলা পঞ্জাবি, কাঁধে ব্যাগ ভবা হাওয়া! স্মৃতি থেকে সত্যজিৎ জানিয়েছিলেন, ঋত্বিকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হওয়ার আগে থেকেই চিনতেন। সেটা ‘ছিন্নমূল’ ছবির সুবাদে। ফিল্ম সোসাইটির একটা মিটিং-এ প্রথম আলাপ হয়। স্মৃতি থেকে তিনি বলছেন, ‘‘সে সময় বোম্বেতে বিমল রায়ের সঙ্গে কাজ করছে, বিমল রায়ের ছবির চিত্রনাট্য লিখছে। তার কিছু আগে ‘পথের পাঁচালী’ ছবিটি মুক্তি পেয়েছে, সে ছবি দেখেছে এবং দেখে তাঁর খুবই বেশিরকম ভালো লেগেছিল। সে-কথা সে প্রাণ খুলে আমার কাছে বলে। কিন্তু আমার কাছে যে-জিনিসটি সব চাইতে ভালো লেগেছিল সেটা সে যে ভাবে ছবিটাকে বিশ্লেষণ করেছিল, তার কয়েকটা দৃশ্যকে, সেটা থেকে আমার মনে হয়েছিল, ঋত্বিক যদি ছবি করে তাহলে সে খুব ভালোই ছবি করবে।’’
সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’ দেখে কয়েকটি দৃশ্যের সমালোচনাও করেছিলেন ঋত্বিক। তাঁর মনে হয়েছিল, ‘‘দুর্গা মারা যাওয়ার আগের ঝড়বৃষ্টির দৃশ্য, সেটা বেশ কাঁচা। দুর্গার মৃত্যুর খবরে হরিহর বা সর্বজয়ার প্রতিক্রিয়াও ঠিকমতো ফোটেনি।’’ তুষার তালুকদারকে তার কারণ বলতে গিয়ে ঋত্বিক বলছেন, ‘‘অভিনয়ের দুর্বলতাকে ছাপিয়ে গিয়েছে দক্ষিণা ঠাকুরের তারসানাইয়ের সুর।’’
সত্যজিৎ তাঁকে নিয়ে বলতে গিয়ে বলছেন, ‘‘আমরা যারা প্রায় গত চল্লিশ বছর ধরে ছবি দেখছি, তাদের মধ্যে তো প্রায় ত্রিশটা বছর কেটেছে হলিউডের ছবি দেখে, কেন-না কলকাতায় তার বাইরে কিছু দেখবার সুযোগ ছিল না সে সময়টা। উনিশো ত্রিশ বা পঁচিশ থেকে শুরু করে প্রায় পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বা ষাট অবধি আমরা হলিউডের বাইরে খুব বেশি ছবি দেখতে পারিনি।… কিন্তু ঋত্বিক এক রহস্যময় কারণে সম্পূর্ণ সে-প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল, তাঁর মধ্যে হলিউডের কোনও ছাপ নেই। … ঋত্বিক মনে-প্রাণে বাঙালি পরিচালক ছিল, বাঙালি শিল্পী ছিল, আমার থেকেও অনেক বেশি বাঙালি। আমার কাছে সেইটেই তাঁর বড়ো পরিচয় এবং সেইটেই তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান এবং লক্ষণীয় বৈশিষ্ট।’’
ঋত্বিকের স্মরণসভায় সভাপতি ছিলেন সত্যজিৎ রায়।শোকসন্তপ্ত সরলা মেমোরিয়াল হল। মঞ্চে মৃণাল সেন, বিজন ভট্টাচার্য। ছিলেন কবি পূর্ণেন্দুও। লিখছেন, ‘‘সভাপতি শেষ করলেন তাঁর ভাষণ। দর্শক বা শ্রোতা নিস্পন্দ। এ বার তিনি পাঠ করবেন একটি শোকপ্রস্তাব। পাঞ্জাবির পকেট ঘাঁটছেন চশমার জন্যে। তখন চোখে পড়ল, তাঁর চোখের প্রান্তে একবিন্দু গোপন অশ্রু!’’
ঋত্বিক ঘটক – সত্যজিৎ রায় – মৃণাল সেন … বলা চলে বাংলা চলচ্চিত্রের ব্রহ্মা – বিষ্ণু – মহেশ্বর। একই বৃত্তে কর্মরত ছিলেন তিনজন। ছিল আলোচনা ও সমালোচনা। ছিল বৈরিতা। তা সত্বেও ছিল বন্ধুত্ব।
মৃণাল সেন থেকে দুই বছরের বড় ছিলেন শ্রী সত্যজিৎ রায় (১৯২১ – ১৯৯২), আর ঋত্বিক ঘটক (১৯২৫ – ১৯৭৬) ছিলেন আড়াই বছরের ছোট। একজনকে সম্মান করতেন, অন্যজন ছিলেন বন্ধু। কিন্তু দুজনের সঙ্গেই ছিলো সম্পর্ক। চলচ্চিত্রের সূত্রে। দুজনের সঙ্গেই চলতো বাহাস। ছবি নিয়ে। ছবির ভাষা নিয়ে। তবে ঋত্বিক বন্ধু বলে ওর সঙ্গে ঝগড়াঝাটিও হতো। আরো হতো রাজনৈতিক আলাপ। পরিকল্পনা হতো কি করে তাঁরা লুকিয়ে কাকদ্বীপে চলে যাবেন; তারপর সেখানে পুলিশের নজর এড়িয়ে, গেরিলা কায়দায় ১৬ মিলিমিটারে চলচ্চিত্র বানাবেন। এরপর তাঁরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে সেই ছবি দেখাবেন। সত্যজিতের সঙ্গে অবশ্য সেসব আলাপ জমতো না। সত্যজিৎ এমনিতেই ছিলেন রাজনীতি থেকে দূরে থাকা মানুষ।
মহৎ শিল্পীর ক্ষেত্রে প্রশস্তির পাশাপাশি প্রশ্ন থাকা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় ঋত্বিক ঘটকের নাম। বিভূতিভূষণের উপন্যাস থেকে সত্যজিতের করা চলচ্চিত্রত্রয়ী নিয়ে প্রশ্ন ছিলো ঋত্বিকেরও। ঋত্বিক নিজেও একজন মহৎ শিল্পী। তিনি চেয়েছিলেন সত্যজিতের অপু বিভূতিভূষণের ছক মেনে গ্রামেই ফিরে যাক, কিন্তু সত্যজিতের অপু গ্রামে ফিরে যায়নি, কলকাতামুখী হয়েছে। মৃণাল এখানে ঋত্বিকের সমালোচনা করেছেন। বলেছেন, ‘ঋত্বিক সম্ভবত সত্যজিতের নাগরিক মননটুকু তেমনভাবে ধরতে পারেননি, পারলে বোধ হয় মানিকবাবুর ছবিতে অপুর বদলটা মেনে নিতে পারতেন।’ এই জায়গায় ঋত্বিকের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, মৃণাল যদি ঋত্বিকের শেকড়ে ফিরে যাওয়ার মননটা ধরতে পারতেন, তাহলে হয় তো ওপরের বাক্যগুলো ভিন্নভাবে বলতেন।
বয়সে মৃণালের ছোট হলেও বন্ধু ছিলেন ঋত্বিক। যথেষ্ট সম্মান করতেন মৃণাল, ভালোও বাসতেন। কারণ তিনি জানতেন গণমানুষের কাছে গণমানুষের শিল্পকে পৌঁছে দিতে ঋত্বিক ছিলেন ‘দুঃসাহসী’ ও সবচেয়ে ‘বেপরোয়া’। সিনেমাকে বিপ্লবের সঙ্গে জড়িয়ে চলতে শিখেছিলেন ঋত্বিক। মৃণালও। বলছেন, ‘ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি অচঞ্চল বিশ্বাস রেখে সে দিন থেকেই আমরা অন্তঃস্বারশূণ্য দেশজ সিনেমাকে তীব্রভাবে ঘৃণা করতে শিখেছিলাম, নতুন একটা ফ্রন্ট গড়ার জন্য মুখিয়ে উঠেছিলাম প্যারাডাইস কাফের ভাঙা চেয়ার-টেবিলে ঠাসা ঐ ছোট্ট ঘরে, যে ফ্রন্টে বিপ্লব আর সিনেমা হাত ধরাধরি করে চলবে। এই প্রাণচঞ্চল আসরগুলোয় যার গলা সবচেয়ে উঁচু পর্দায় বাঁধা ছিল সে হল ঋত্বিক। ঋত্বিক ছিল আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেপরোয়া। কোন কিছুকেই তোয়াক্কা করত না ঋত্বিক, আগু পিছু ভাবার মতো ধৈর্য ছিল না।’
তারা ঠিক করলেন স্টুডিয়োর অস্বচ্ছল কর্মী ও কলাকুশলীদের নিয়ে একটি সক্রিয় ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তুলবেন। কর্মীদের বাড়ি বাড়ি যাওয়া, তাদের সাথে কলা বলা ও বোঝানো, রাজনৈতিক এই অভিযানেও ঋত্বিক ছিলেন প্রথম কাতারে। গণআন্দোলনের জোয়ারে পশ্চিমবঙ্গ যখন ফুসছে, তখনও ঋত্বিক ও মৃণালরা কিছু করার জন্য টগবগ করে ফুটছেন। জনতার সংগ্রামের পাশাপাশি তখন কৃষক-মজদুর-মধ্যবিত্তের লড়াই থামাতে মরিয়া শাসকগোষ্ঠী। কাকদ্বীপ এলাকায় গুলি চালিয়েছে পুলিশ। মারা যায় কৃষকরমণী গর্ভবতী অহল্যা। মৃণাল ও ঋত্বিকদেরই আরেক সহযোদ্ধা সলিল চৌধুরী তখন রচনা করেছিলেন কালজয়ী কবিতা ‘শপথ’। শপথ ঠিকই নিয়েছিলেন তাঁরা। ঠিক করেছিলেন পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে তাঁরা কাকদ্বীপে যাবেন। সেখানে গিয়ে ষোল মিলিমিটারে নির্বাক ছবি তুলবেন। এরপর কলকাতায় ফিরে ছবি ধোলাই ও সম্পাদনা করে গ্রামে গ্রামে সেই ছবি দেখাবেন, লুকিয়ে লুকিয়ে। চিত্রনাট্য লিখলেন মৃণাল। সলিল নাম দিলেন ‘জমির লড়াই’। আর ঋত্বিক জোগাড় করলেন একটি ভাঙা ক্যামেরা। শেষ পর্যন্ত কাকদ্বীপে যাওয়া হয়নি ঠিকই। জোগাড় করা ক্যামেরাটি চালানো শিখে নিয়েছিলেন ঋত্বিক। জানতেন এই ক্যামেরাই হবে তাঁর হাতিয়ার। সিনেমা ও বিপ্লবের সহচর ঋত্বিকের সঙ্গে প্রচুর ঝগড়াও করেছেন মৃণাল। বলছেন, ‘ঝগড়া করেছি, মতান্তর ঘটেছে, মনান্তর ভয়ংকর চেহারা নিয়েছে এক এক সময়ে, আবার সময় আর ঘটনার মধ্য দিয়ে মিশে গিয়েছি আগের মতোই, এক সঙ্গে চলেছি।’
ঋত্বিকের প্রথম ছবি ‘নাগরিক’ দেখে খুশি হতে পারেননি মৃণাল। কিন্তু দ্বিতীয় ছবি ‘অযান্ত্রিক’ ভীষণ ভালো লাগে তাঁর, প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘একটি অসাধারণ ছবি এবং ভীষণ ভাল ও মৌলিক ছবি। সম্ভবত তাঁর ছোট্ট জীবনে তুলনারহিত। এ-ছবির কাহিনী একটি ভাঙা মোটরগাড়ি এবং এ-মোটরগাড়ির সঙ্গে এক রাগী ড্রাইভারের ভালবাসা-যন্ত্রণার কাহিনী। সবকিছু বলা হয়েছে ভারী সুন্দরভাবে, নিটোলভাবে। এই গাড়িটিতে বসে কিছু যাত্রী যখন নিজের নিজের কাহিনী বলছে ঋত্বিকের ক্যামেরা এদের কথা, এদের মুখ অবয়ব ছুঁয়ে ছুঁয়ে অন্য আর-একটি গল্প বলে দেয়, যে গল্পে আদিবাসীদের পালাপার্বনের কথা বলা হয়। এরা সবাই খুব শক্তিশালী কিন্তু এদের ভেতরে একটা সহজাত বেপরোয়া মনোভাব কাজ করে। হয়তো ঋত্বিক নিজের ভেতর নিজেই লড়াই করত। বেপরোয়া ভাবটা তাঁর চরিত্রের মধ্যেও ছিল, যে জন্য এ-ছবিটিতে সেটিও ফুটে উঠেছে। যাই হোক, দর্শককুল ছবিটির অকুণ্ঠ প্রশংসা করলেন, এমনকী কেউ কেউ বললেন—ছবিটি সত্যজিতের যে কোনও ছবির চাইতেও উচ্চমানের ছবি।’
মৃণালের ছবি নিয়ে ঋত্বিকের প্রতিক্রিয়ার কথাও আমরা জানতে পারি মৃণালেরই বয়ানে। ১৯৭৫ সালের ২৪ ডিসেম্বর তিনি সকাল সকাল উপস্থিত হন মৃণালের বাড়ি। অসুস্থ ছিলেন ভীষণ। মৃণালের স্ত্রী গীতা ঋত্বিককে দেখে চমকে ওঠেন। একদম রোগা হয়ে গেছেন। গীতাকে ঋত্বিক বললেন, ‘আর মদ খাবো না’। একটু পর আবারো বললেন, ‘আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না’। গীতা বললেন, ‘মদ না ছাড়লে কী করে বাঁচবেন আপনি?’ উদাস দৃষ্টিতে ঋত্বিক পুনরাবৃত্তি করেছিলেন, ‘আমি আর মদ খাবো না’। এরপর হুট করেই বললেন, ‘গীতা, মৃণাল খুব ভালমানুষ। কিন্তু ওর ‘ভুবন সোম’, ফুঃ!’
ঋত্বিক এমনই ছিলেন। মৃণাল জানতেন তিনি ছিলেন মহৎ শিল্পী। সব সময়েই ‘নিজের ছবিতে মহৎ সত্যকে খুঁজে বার করতে সচেষ্ট’ থাকতেন তিনি। মৃণাল লিখছেন, ‘ঋত্বিক বলত, আমি সেই ভাষার কথা খুঁজি যে ভাষায় কথা কম, যে ভাষা জানায় বোঝায়, এবং এমন এক পরিবেশে পৌঁছে দেয় যা ‘আর্কিটাইপাল ইমেজ’ হিসেবে পরিচিত।’ এই প্রতিমা ঘুরেফিরে এসেছে ঋত্বিকের ছবিতে। নিজেও যে দ্রুত প্রতীমায় পরিণত হবেন, রক্তমাংসের মানুষ থাকবেন না,সেটা যেন আগেভাগেই বুঝতে পেরেছিলেন ঋত্বিক। সেজন্যই মৃণালের বাসায় গিয়ে সেদিন বলেছিলেন, তিনি আর বেশিদিন বাঁচবেন না।
মৃণালের গৃহে মৃত্যুর কথা উচ্চারণের দেড় মাস পর, ১৯৭৬ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি মারা যান ঋত্বিক। অন্তিমশয়নে পাশেই ছিলেন মৃণাল। ঋত্বিক তাঁকে দেখতে পাননি। রাত এগারোটা পাঁচে সমাপ্তি ঘটে ঋত্বিক অধ্যায়ের। মৃণাল বলছেন, ‘বোধহয় মরে গিয়ে ঋত্বিক বেঁচে গেল। মৃত্যুর কয়েকবছর আগের সময়গুলো ছিল ভয়ংকর। অবাধ্য ঋত্বিক, হৃদয়হীন ঋত্বিক, শৃঙ্খলাহীন ঋত্বিক আবার সবার ওপরে সম্মাননীয় ঋত্বিক! এখনও সেভাবেই বেঁচে আছে।’
এভাবেই বেঁচে আছেন ঋত্বিক। ‘দামাল ঋত্বিক, বেপরোয়া ঋত্বিক, অসহিষ্ণু ঋত্বিক, বিশৃঙ্খল ঋত্বিক’।
একই ভাবে ঋত্বিক ঘটক সম্পর্কে সত্যজিৎ বলেছিলেন, “ঋত্বিক মনে-প্রাণে বাঙালি পরিচালক ছিল, বাঙালি শিল্পী ছিল– আমার থেকেও অনেক বেশি বাঙালি। আমার কাছে সেইটেই তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় এবং সেইটেই তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান এবং লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য।”
৯ই আগস্ট ২০১৫ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় ঋত্বিক ঘটকের স্মরণে কবি, লেখক, পরিচালক ও সংগীতকার গুলজার লিখেছিলেন,
“দে খলেই মনে হবে এক জন গ্রিক মাস্টার সামনে দাঁড়িয়ে। খুব লম্বা, উসকোখুসকো চুল, পাঞ্জাবির ওপর বোতাম-খোলা খাদির জ্যাকেট, কাঁধে একটা ঝোলা, আর জ্বলজ্বলে দুটো চোখ— যেন এই বার অলৌকিক কোনও আখ্যান শুরু হবে।ঋত্বিকদার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা বিমলদা মারফত। ঋত্বিকদার বড়দাদা আবার ছিলেন বিমলদার প্রোডাকশন হেড। এক দিন আমায় ডেকে বললেন, ‘শোনো, তুমি ওঁর কাছ থেকে গল্পটা শুনে লিখে নাও আর নোট্স নিয়ে নাও। পরে এটার ওপর একটা স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে হবে।’ আমি আর ঋত্বিকদা বসে গেলাম। এর পর এই রকম বসা বহু বার হয়েছে, কিন্তু তা থেকে কোনও দিন কোনও সিনেমা তৈরি হয়নি। পরে জেনেছিলাম, কোনও বাঙালির প্রয়োজনে বিমলদা তাঁকে খালি হাতে ফেরান না। কিন্তু ঋত্বিকদাকে কোনও কাজ ছাড়া সাহায্য করাটা যে ঋত্বিকদার সম্মানে এবং মনে বড় লাগবে, সে কথা বিমলদার মাথায় থাকত। তাই দু’পক্ষের মন ও সম্মানের আশ্চর্য দেওয়া-নেওয়ার সাক্ষী হয়েছিলাম আমি।এর পর অবশ্য মাইডিয়ার হিসেবে ঋত্বিকদাকে চিনতে আরম্ভ করি অভীদা, মানে অভিনেতা অভী ভট্টাচার্যের বাড়িতে। সেখানে রোজ সন্ধেবেলায় একটা জমাটি আড্ডা বসত। তখনকার বম্বে-বাঙালিদের দু’জায়গায় একদম নিশ্চিত করে পাওয়া যেত। এক, কাজের জায়গা— বিমল রায় প্রোডাকশন্স। কারণ, বিমলদা বড়লোক প্রোডিউসার ছিলেন। সবাইকে নাইয়ে-খাইয়ে রাখতেন। আমাকেও। আমি তো কনভার্টেড বাঙালি। আর দুই, অভীদার বাড়িতে, সেখানে সবাই আড্ডা দিতে যেত। অভীদার বাড়িতেই আমি প্রথম ‘জতুগৃহ’ পড়েছিলাম, বাংলায়।সেই আড্ডায় রোজ আমরা একটা করে নতুন সিনেমা বানাতাম, কাস্ট ঠিক হত, বাজেট হত, স্ক্রিপ্ট কে করবে— সব ঠিক হত। পরের দিন যথারীতি ভেস্তে যেত। আবার একটা নতুন সিনেমা তৈরি হত। অন্য রকমের নতুন সিনেমা। যখনই মিউজিক ডিরেকশনের কথা উঠত, আমরা বলে উঠতাম, ‘ওই তো, সলিলদাই তো করবে, আবার কে?’ ঋত্বিকদা তাঁর প্রাণের বন্ধু সম্পর্কে বলে উঠতেন, ‘কী! সলিল মিউজিক দেবে? কোথায় মাল খেয়ে উলটে পড়ে থাকবে!’ আমরা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতাম, মনে মনে বলতাম, ‘ঋত্বিকদা এই কমেন্ট করছে!’ আর তার পর একটা বিরাট হাসির রোল উঠত। আর সবাই মিলে তখন ঋত্বিকদার পেছনে লাগা হত।
ঋত্বিকদার ছবির সঙ্গে আমার আগেই পরিচয় হয়েছিল। আমি এখনও ‘মেঘে ঢাকা তারা’য় সুপ্রিয়ার চটি ছিঁড়ে যাওয়ার সিনটা ভুলতে পারি না, কিংবা যে বিশাল গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে অনিলদা বন্দিশ গাইছিলেন, সেই দৃশ্যটা। ওই গাছটা চুজ করাই একটা মাস্টারের কাজ। ওই বিশালত্ব, ওই রাজকীয় ব্যাপারটা ওই সিনটাকে একেবারে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। ঋত্বিকদাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম, ওই গাছটার মতো মনে হয়েছিল আমার। খুব আলুথালু রাজকীয়।
কিন্তু আমার মোহ ভাঙল ‘সুবর্ণরেখা’ দেখে। একটা-দুটো দৃশ্য এত মেলোড্রামাটিক যে আমার পছন্দ হয়নি। হয়তো ঋত্বিকদার অনেক কিছুই আমার পছন্দ ছিল না। পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ডিন থাকাকালীন উনি যে ভাবে নিজেকে কনডাক্ট করেছিলেন, তা-ও আমার পছন্দ ছিল না। সেখানে ছাত্রদের সঙ্গে একটা ফারাক রাখার দরকার ছিল বলে আমার মনে হয়। এতটা বোহেমিয়ানিজ্ম ধারণ করার ক্ষমতা সবার থাকে না। শিষ্যরা যদি অন্ধের মতো ফলো করে, সেটা শিষ্যদের পক্ষে সব সময় শুভ হয় না, সেখানে একটা দায়িত্ব থাকা দরকার ছিল। কোথাও যেন ডিসিপ্লিনের ভারী অভাব ছিল। আর ওঁর যা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল, নিজেকে একটু ঠিক ভাবে চালনা করলে শিল্প হয়তো আরও সমৃদ্ধ হতে পারত।
আবার ভেবেছি, ঋত্বিকদা যদি ডিসিপ্লিন্ড আর প্রথাগত ‘প্রপার’ হতেন, তা হলে ঋত্বিকদা হতেন না। অন্য মানুষ হতেন। তিনি ওই একটা রকম ভাবেই বাঁচতে পারতেন, শিল্প করতে পারতেন। ওটা তাঁর ঘরানা, তার যাপন। সেটা তাঁর সিনেমায় প্রতিফলিত। ঋত্বিকদার নিয়মছাড়া ভাব হয়তো কিছুটা জেনেটিকও। ওঁর আরও দুই ভাইকেও আমি খুব ভাল ভাবেই চিনতাম। তাঁদের মধ্যেও এই খামখেয়ালিপনা বা একসেনট্রিক ব্যাপারস্যাপার লক্ষ করেছি।
কিন্তু শিল্পের মানচিত্র তো হরেক রকম প্রতিভা দিয়ে তৈরি। কিছু মানুষ থাকবেনই, যাঁরা ছন্নছাড়া, উদ্দাম প্রতিভাধর, উল্কার মতো— স্বল্পকালীন। সেই সব মানুষকে তাঁদের মতো করেই গ্রহণ করতে শিখতে হবে।
অনেক বছর পর মুম্বইয়ের খার স্টেশনের কাছে ঋত্বিকদার সঙ্গে দেখা। সব সময়ই ওই স্টেশনের কাছে একটা লজে উঠতেন। সেই না-আঁচড়ানো উসকোখুসকো চুল, না-কামানো দাড়ি, খাদির জ্যাকেট, একই রকম রাজকীয়, কেবল চেহারা একটু ভেঙেছে, জৌলুস একটু কমেছে, এই যা। দেখা হতেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। গালে আলতো একটা থাপ্পড় মেরে বললেন, ‘তুই কী এমন করেছিস রে, যে এত নাম হয়েছে তোর!’ এ কথা বলাটা ওঁরই সাজে। সেই কবে থেকে আর কত কাছ থেকে দেখেছেন তো এই ছোকরাকে! কিন্তু অত বড় হাতের চেটো, তার থাপ্পড় যত আলতোই হোক, তা হজম করার কলজে থাকতে হবে। আমার তো মনে হয়, আমার সেই কলজে ছিল বইকী! আ স্মল টোকেন অব লাভ ফ্রম আ গ্রিক মাস্টার!”
আত্মধ্বংসী কিছু প্রবণতা ছিল ঋত্বিক ঘটকের মধ্যে। এই সব নিয়ে গালগল্পও কম হয়নি! একান্ত নিজস্ব এক সিনেমা ভাষা ছিল ঋত্বিকের। ঋত্বিকের ছবি দেখলে মনে হয়, হলিউড বলে যেন কখনও কিছু ছিল না! নাটকীয় সংলাপ, চরিত্রদের মঞ্চ-নাটকীয় শরীরী ভাষা, উচ্চকিত অভিনয়, আপতিক ঘটনার অতিব্যবহার, এসব বৈশিষ্ট্য ওঁর ওপর গণনাট্যের দিনগুলির প্রভাব ছাড়াও যা তুলে ধরে, তা হচ্ছে, পশ্চিমী সিনেমার প্রভাব বলয় থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রেখেছিলেন ঋত্বিক। আবার একই সঙ্গে ইউরো-মার্কিন সিনেমার সর্বশেষ চালচলন সম্পর্কে ঋত্বিকের মতো ওয়াকিবহাল পরিচালকই বা ভারতে ক’জন ছিলেন! ঋত্বিক ঘটক যখন পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের শিক্ষক তখন এ ব্যাপারে কুমার সাহনি, মণি কল বা আদুর গোপালকৃষ্ণনের কাছ থেকে শোনা নানা কথা সেই সাক্ষ্য দেয়। পশ্চিমী চলচ্চিত্রভাষাকে পরিহার করা তাই অজ্ঞতাপ্রসূত কিছু ছিল না। ঋত্বিকের দিক থেকে তা ছিল এক সচেতন প্রয়াসই। যাঁরা শিল্প-সংস্কৃতিতে উত্তর-উপনিবেশ বিষয়টি নিয়ে চর্চা করেন, ঋত্বিকের সিনেমা-শৈলীতে চিন্তার অনেক খোরাকই তাঁরা পাবেন। একটা প্রতিতুলনা টানা যায়। কুরোসাওয়া জাপানি, আবার আন্তর্জাতিকও। কিন্তু ওজু একান্তই জাপানি। ওজুকে সঠিক ভাবে বুঝতে জাপানি শিল্প-সংস্কৃতির ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা থাকতে হয়। ঋত্বিক ঘটকও যেন তেমনই আমাদের একান্তই বাঙালি এক শিল্পী যাঁর বিষয়বস্তু, গল্প বলার ধরন, বাংলা ভাষার নাটকীয় প্রকাশভঙ্গি অনুযায়ী নাটকীয় সংলাপ, বাংলা মঞ্চ-নাটকের ধারায় উচ্চকিত অভিনয়রীতি, এমন কী ওজুর লো ক্যামেরা অ্যাঙ্গেলের মতো নিজের আলাদা ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল— ঋত্বিকের ছবির ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্সের শটগুলো স্মরণ করুন, এ সবই এক বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালকের একান্ত নিজস্ব চলচ্চিত্রভাষার প্রকাশ। তাই ঋত্বিকের শিল্পউৎসকে খুঁজতে হবে পশ্চিমী চলচ্চিত্রভাষায় নয়, সেটা খুঁজতে হবে বাংলার লোকজ ঐতিহ্য ও শিল্পমাধ্যমগুলির মাঝে।
খণ্ডিত বাংলার প্রতীক এক বাংলা মাকে কল্পনা করে নিয়েছিলেন ঋত্বিক, যে মাতৃরূপটি ওঁর ছবিতে আদিমাতার এক রূপকল্প হয়ে ফিরে আসে বার বার। মার্কসবাদের পাশাপাশি ইয়ুং-এর যৌথ নিশ্চেতনার ধারণাও ততদিনে ঋত্বিকের বিশ্ববীক্ষায় গভীর ভাবে প্রোথিত হয়ে গিয়েছে। সেই আদিমাতার আবার দুই রূপ। কখনও দেখি তার কল্যাণী জগদ্ধাত্রী রূপ— ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, কখনও বা ধ্বংসের কালী— ‘সুবর্ণরেখা’।
নারীকে রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে না দেখে পুরাণের চরিত্রের প্রতীক হিসেবে দেখবার যে প্রবণতা, যা অনেকটাই পুরুষ-কল্পনা, তাতে পুরুষের ইচ্ছাপূরণ ও পিতৃতন্ত্রের আয়ু বাড়ে বটে, কিন্তু নারীর দৈনন্দিন বেদনার বারমাস্যা তাতে কিছু কমে না। ঋত্বিক আদিমাতার রূপকে নারীর পৌরাণিকীকরণ ঘটিয়েছেন বটে, তবে ঋত্বিকই আবার সেই শিল্পী যিনি সবচেয়ে সার্থক ভাবে দেশভাগ পরবর্তী নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাঙালি নারীর তীব্র ও কঠোর জীবনসংগ্রামটাকে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। একজন ঋত্বিক ঘটকের পক্ষেই সম্ভব ছিল ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র নীতা চরিত্রটিকে পর্দায় ওই রকম জীবন্ত ভাবে তুলে আনা। সেই সংবেদ ও প্রখর বাস্তববোধ ওঁর ছিল। পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলোর বিরুদ্ধে ঘরে ঘরে বাঙালি নারীর যে প্রতি দিনের সংগ্রাম, ঋত্বিকের ছবিগুলি থেকে তা পাওয়া যায়।
দেশভাগের বেদনার ভাষা কি আজও তৈরি হয়েছে? তবে ঋত্বিকের ছবি নিঃসন্দেহে বিষাদের সেই অতলান্ত গভীরতাকে ছুঁতে পেরেছে অনেক বারই। নিজে যন্ত্রণায় আকীর্ণ নীলকণ্ঠ এক একক শিল্পী হয়েও সমষ্টির প্রতিবাদী চেতনার প্রতি আস্থাটা ঋত্বিক অবিচল রেখেছিলেন আজীবন। ‘সুবর্ণরেখা’-তে জন্মভূমি থেকে উৎপাটিত হয়ে উদ্বাস্তু শিবিরে গড়ে তোলা হয়েছিল ‘নবজীবন কলোনী’। সে যৌথতার আদর্শ থেকে নিজের একক সুখের অন্বেষায় চলে যাওয়া ঈশ্বর চরিত্রটার করুণ পরিণতি এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে তার নতুন বাড়ির সন্ধান, মানব জীবনের গোটা চক্রটাকেই যেন ধারণ করলেন ঋত্বিক। পালানোর পথ নেই। লড়াই করেই বাঁচতে হবে। অভিজ্ঞতার উপলব্ধি অপাপবিদ্ধ মননের কাছে কখনওই ধরা দেয় না। দেশভাগের আদিপাপের উপলব্ধি যখন সকল বাঙালির চেতনাকে স্পর্শ করবে, ঋত্বিক ঘটক নামের এই অসামান্য সিনেমা-শিল্পীর আজন্ম এষণা সেদিন সার্থক হবে।
ঋত্বিকের সিনেমা, গল্প, ইন্টারভিউ, চিঠিগুলি না-জানা থাকলে রস পাওয়া দুষ্কর। ইন্টারভিউতে ঋত্বিক বলেছিলেন, ‘সিনেমার প্রেমে আমি পড়ে নেই, মশাই। আমি গল্প লিখতাম। দেখলাম, গল্পের থেকে নাটকে আরও বেশি লোককে অ্যারাউজ করা যায়। তার পর দেখলাম, নাটকের থেকে সিনেমা আরও শক্তিশালী। যে দিন আরও শক্তিশালী মাধ্যম বেরোবে, সিনেমাকে লাথি মেরে চলে যাব।’ ১৯৭১ সালে স্ত্রীকে লেখা চিঠিতে এসেছিল কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সাধারণ সম্পাদক পি সি জোশীর কথা, “আমাকে বলেছে, ঋত্বিক, ইউ আর দ্য ওনলি পিপল্স আর্টিস্ট।” ছবিতে সযত্নে বুনে দেওয়া হয়েছে এই সব উক্তি। যাঁরা ঋত্বিক দেখেননি, কী ভাবে বুঝবেন এই অনুষঙ্গ? উত্তর একটাই। বুঝলে বুঝবেন, না বুঝলে বুঝবেন না। বোর্হেসের গল্প বা উমবের্তো একোর উপন্যাসেও অনেক ক্রস-রেফারেন্স থাকে, ধৈর্য নিয়ে পড়তে হয়।
রাতের ট্রেন।
গন্তব্য বহরমপুর।
সংবর্ধনা নিতে চললেন ঋত্বিককুমার ঘটক। সঙ্গে তাঁর সহকারী সুনীল দত্ত, গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কবি পূর্ণেন্দু পত্রী। শিয়ালদহ থেকে ট্রেন ধরার আগে, মিনার্ভা হোটেলে সন্ধ্যা-আহ্নিকে বসেছেন ঋত্বিক। বজ্রের মতো গর্জমান।
‘‘দাঁড়াও হে, দাঁড়াও! সবটা শুনে যাও। দু’পেগ একসঙ্গে নিয়ে আসবে। দু’ পেগ!’’
‘‘সোডা?’’
‘‘না হে না, আমার নাম ঋত্বিককুমার ঘটক! সোডা দিয়ে কখনও মদ খাই না। যাও, যাও জলদি নিয়ে এসো! জলদি!’’
দু’পাত্তর চড়তেই চোখ লাল। গাড়ি ছুটল শিয়ালদার দিকে। যাত্রাসঙ্গী পূর্ণেন্দু জানাচ্ছেন, ট্রেনে উঠেই ঋত্বিক তাঁর ময়লা পাঞ্জাবিটা খুলে মেঝেতেই দু’পা ছড়িয়ে বসলেন। ঢোলা পায়জামা হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে শুরু হল ফের মদ্যপান। সহকারী কিছু একটা বলতেই গলা চড়ল তাঁর! দাউ দাউ জ্বলে উঠলেন!
‘‘কেন রে শুয়োর! আমার কী দোষ?’’
‘‘হাতে টাকা পেলেই তো আপনার অন্য চেহারা। মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা… জীবনে কিছু তো কম পাননি। কত লোক আপনার পিছনে টাকা ঢালতে রাজি, যদি সুস্থ থাকেন। সে তো থাকবেন না।’’
‘‘কে আমাকে টাকা দেবে শুনি? তোদের ওই বেঙ্গলি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি? মরে গেছে!’’
‘‘মাধবী মুখার্জি ডিস্ট্রিবিউটরদের দোরে দোরে ঘুরে বেড়ায়নি আপনার জন্য? বিশ্বজিৎ প্রোডিউসার, সকলে রাজি ছিল। সেই আপনি বিশ্বজিৎবাবুকে স্ক্রিপ্টটা পর্যন্ত শোনালেন না। বম্বেতে শক্তিদার অনুরোধ ফেরালেন। কেন? না, শ্যুটিং-এ মদ খাওয়া যাবে না।…হিন্দিতে ‘মেঘে ঢাকা তারা’ হল না! রাজেশ খন্নার অফারও ফিরিয়ে দিলেন! ছিঁড়ে উড়িয়ে দিলেন স্ক্রিপ্ট।… বলুন, মিথ্যে কথা বলছি? জবাব দিন! বলুন?’’
সুনীলের কথা শুনে শিশুর মতো হাসছেন ঋত্বিক! আর হাসতে হাসতেই রেলগাড়ির কামরায় অন্যদের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলছেন, ‘‘হারামজাদা সব জেনে ফেলেছে!’’
তাঁর উচ্ছ্বল হাসি একটু একটু করে ভেঙে ভেঙে মিশে যাচ্ছে রাতের রেলগাড়ির ঝমঝম শব্দে। কামরার পেট এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছে পথের হাওয়া। ‘লাথি ছোড়াছুড়ি, খিস্তি, ঠাট্টা’— সবই ঠিক ছিল, গোল বাধল টিটাগড়ে। দু’জন রেলপুলিশ উঠতেই যেন আগুনে ঘি পড়ল! চিৎকার করে উঠলেন ঋত্বিক, ‘‘এখানে কী? ফার্স্ট ক্লাস কামরায় উঠেছ কেন? শালারা জানে না, চোর-ডাকাত কোথায় থাকে? জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা হচ্ছে? নামো। নামো এখুনি! নইলে লাথি মেরে নামাব। আবার বন্দুক!… ঋত্বিক ঘটকের নাম শুনেছ? শোনোনি। তোদের বাবা কে আছে, তাকে গিয়ে বল যে আমি আছি এই গাড়িতে। বুঝলি…!’’
পূর্ণেন্দু লিখছেন, ‘‘হ্যাঁচকা টানে বন্দুক দুটো ছিনিয়ে নিলেন তাদের কাছ থেকে। …ঠিক কোন মুহূর্তে যে রক্তপাতের ঘটনা ঘটবে, আমরা শুধু তারই অপেক্ষায়। আমরা অনুনয় করি। চুপ করুন। নেমে যাবে পরের স্টেশনে। আমাদের কথায় তাঁর কান নেই। …আমাদের দিকে তাকান চোখে-ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি মাখিয়ে।… হাতে গেলাস। টলমলে লাল জল। টলমল ঋত্বিক ঘটকও। হাসিটাও টলমলে জলের ঢেউ। বিজয়ীর হাসি!’’
না, সেদিন কোনও রক্তপাত হয়নি!
খাকি দুটো ‘নুন-গেলা জোঁকে’র মতো চুপটি করে নেমে গিয়েছিল পরের এক স্টেশনে!
আর তাদের নামবার সময় ঋত্বিক খেলনা লাঠির মতো বন্দুক দুটো ছুড়ে দিয়ে হাসতে হাসতে ফের ডুবলেন লালজলে। তাঁর চাহনি বাইরের নিকষ কালো অন্ধকারের দিকে। হাওয়ায় হাওয়ায় এলোমেলো তাঁর চুল। কত কথা মনে পড়ছে আজ। পদ্মা, হাওড়বিল, কাশবনের কথা, রাজশাহী-পাবনার গল্প। বিএ পরীক্ষা দিতে এসে বহরমপুরের দেশভাগের দীর্ণ দিনকাল!
‘‘ভবা? এই ভবা… বড় গাঙে চলল মাল্লারা, ঘাটে যাবি?’’
‘‘কে! কে ডাকে!’’
চমকে ওঠেন ভবা। রেলগাড়ির জানলায় মাথা রেখে কোথায় যেন ভেসে যান! ছলাৎ ছল ঘাটের সামনে এসে দাঁড়ান। স্মৃতির ভিটে ভারেঙ্গা।
দেখেন, কবেকার যমুনা নদী দিয়ে পাবনার গ্রামে পালতোলা নৌকো ভিড়ছে। আশ্বিনের উদাস দুপুর। এক নদী নৌকো। তাঁর মনে পড়ছে, একবার কোজাগরীর আগের রাতে আবছা বিলে সারারাত লগি ঠেলেছিলেন। সারারাত! ‘শেষ রাতে দাঁতে দাঁত লাগা হিমে সে এক অদ্ভুত হতাশার অনুভূতি।’
ঢাকা শহরে শিশিরভেজা হেমন্তে তাঁর জন্ম। বাবা সুরেশচন্দ্র ছিলেন সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মী। মা ইন্দুবালা। ঋত্বিক নয় ভাইবোনের মধ্যে ছিলেন অষ্টম। তিনি এবং তাঁর পরের বোন সাত মিনিটের ছোট, প্রতীতি দেবী। ছোটটির সঙ্গে কত খেলনাবাটি! স্ম়ৃতি যেন আত্ম-হারা পাখি।
‘‘যাস না ভবা, ভবা শোন… ভবা!’’
ছেলেবেলায় ঠিক যেন ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’-র কাঞ্চন ছিল সে। বাঁধন-ছেঁড়া একরোখামি।
প্রথমে ময়মনসিংহের মিশন স্কুলে। তারপরে কলকাতার বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে ক্লাস থ্রিতে। কিন্তু স্কুল পালানো ছেলে, তার কি ক্লাসঘরে মন টেকে! সই জাল করে স্কুল থেকেও উধাও সে! মন যে তার নাটকে। ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকে সে-ই সাজত চাণক্য। বয়স গড়াতে গড়াতেই ডায়েরির পাতা ভরল গোপন প্রেমের কবিতা। সেই দেখে ম্যাডক্স স্কোয়ারের ছেলের দল খুব খ্যাপাত তাকে।
একদিন যুদ্ধ শুরু হল!
কলকাতা ছেড়ে চলল ভবা। ঠিকানা রাজশাহীতে, ডাকঘর ঘোড়ামারা। একবার পাবলিক লাইব্ররির মাঠে ‘ডাকঘর’ হল। নির্দেশক সে-ই।
কিন্তু ক্রমেই বাতাসে বারুদের গন্ধটা বাড়ছে। ক্রমে অস্থির সে চারপাশের ঘটনায়। তাঁর নিজের কথায়, সে ‘এক বিড়ম্বিত কাল।’
দেশ স্বাধীন হল। ঠিক পরের বছর, ভবা ইংরেজি অনার্সের ছাত্র। তার তখন নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই, বের করল কাগজ, ‘অভিধারা’। তাঁর মনে পড়ে, বহরমপুরে কৃষ্ণনাথ কলেজে গিয়ে পরীক্ষা দিয়েছিল।
তখন থেকেই কাঁটাতারে রক্তাক্ত তাঁর বুক। হাঁটতে হাঁটতে লালবাগ, খোশবাগ ছাড়িয়ে দূরে দূরে কোথায় যে চলে যেতেন। মর্মদাহে কেবলই বলে, ‘বাংলারে কাটিবারে পারিছ, কিন্তু দিলটারে কাটিবারে পার নাই!’
‘‘ঋত্বিকদা, দুই বাংলার ভাগ নিয়ে আপনার সব ছবিতেই বড্ড মাতামাতি!’’
‘‘মাতামাতি! বাংলাকে ভেঙে চুরমার করে দিল, আর মাতামাতি! বিক্ষুব্ধ সময়ে মুজরো করব? এটা বদমাইসি! আমি ওই শুয়োরের বাচ্চা…! চাই, খুব বেশি করে চাই দু’ বাংলার সংস্কৃতিকে এক ফ্রেমে আঁটতে। তাতে তোমরা মাকর্সবাদীই বলো আর যাই বলো। প্রতিবাদ করাটা দরকার। কিন্তু শালা বুঝল না কেউ।’’
নেশায় চুরমার ঋত্বিক! একে একে নিঃশেষ অমৃতের বোতল!
জায়গাটা খালাসিটোলা নয়, অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশন ক্লাব। ‘যুক্তি-তক্কো-গপ্পো’র পরে নতুন ছবি নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলছিলেন ঘনিষ্ঠ এক সাংবাদিক। ঋত্বিক বলছিলেন ‘সে বিষ্ণুপ্রিয়া’ নামে একটি ছবি করতে চান। তার মাঝে দেশভাগ প্রসঙ্গ এসে পড়ায় বাধল তুলকালাম!
‘‘এ দেশের কমিউনিস্টরা…!’’
‘‘শুয়োরের বাচ্চা! সব শালা অশিক্ষিতের দল। কেউ কিছু বোঝে না। ও সব ছাড়ো। ছবির গল্পটা শোনো।’’
বিপদ তখনও ঢের বাকি। ঋত্বিকের উত্তেজিত হয়ে স্টোরি লাইন বলার ফাঁকে হল্লা করতে করতে মঞ্চে প্রবেশ করলেন ত্রয়ী। শক্তি-সুনীল-সন্দীপন!
অদূরে বসে প্রমাদ গুনলেন পূর্ণেন্দু পত্রী। ছিলেন তুষারবাবুও। তাঁর স্মৃতি বলছে, মদ্যপান করতে করতে হঠাৎ উঠে পড়লেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সকলের পিঠ চাপড়ে ঋত্বিকের ছবির প্রশংসা আদায় করতে শুরু করলেন। একসময় ঋত্বিকের কাছে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে ঝাঁকাতে শুরু করলেন। রেগে গিয়ে উঠে পড়লেন ঋত্বিক!
মুহূর্তে থমথমে পানশালা!
ঋত্বিক বললেন, ‘‘মদ খেয়ে হুল্লোড় করা ব্যাপারটা আমার একদম বরদাস্ত হয় না। এতে নেশাটা চটে যায়!’’
টালমাটাল পায়ে বাইরে গাড়িতে বসতেই গাড়ি ছুটল ময়দানের দিকে। নেশার ঝোঁকে এলোমেলো বকছেন। ময়দানি হাওয়ায় মুঠো ছুড়ে বলছেন, ‘‘প্রতিবাদ করাটা দরকার। কিন্তু শালা বুঝলো না কেউ। সব ভেঙে গেল। দেশ। দল… সব!’’
ভিক্টোরিয়ার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে ভবা। একপায়ে চটি। একটু পরেই বেন্টিক স্ট্রিটে তুষারবাবু চটি কিনতে নিয়ে যাবেন। এসপ্ল্যানেডের মো়ড়ে বসে পড়ে ফের মদ খেতে চাইবেন ভবা। … জ্যোৎস্নায় চারপাশ ধবধবে। একটা নিভন্ত বিড়িকে ধরিয়ে চাইলেন পরীর দিকে।
তাঁর মনে পড়ছে কলকাতার বিক্ষুব্ধ সময়! একদিকে এমএ ক্লাস চলছে, অন্য দিকে গণনাট্য। কখনও বসন্ত কেবিন। সেখানে বসেই সে গল্প-নাটক শোনাচ্ছেন সুহৃদ বিজন ভট্টাচার্য, কুমার রায়দের। একসময় মনে হল, ‘‘গল্পটা inadequate।’’ নিজেই লিখছেন, ‘‘আমার তখন টগবগে রক্ত, immediate reaction চাই। সেই-সময়ে হল ‘নবান্ন’। ‘নবান্ন’ আমার সমস্ত জীবন-ধারা পাল্টে দিল।… আমি নাটকের দিকে ঝুঁকে পড়লাম!’’
বসন্ত কেবিন থেকে বেরিয়ে হাঁটছেন ওয়েলিংটন স্কোয়ারের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে হাজরা।
ছোট্ট চায়ের দোকানটায়। সেখানেই যে রোজ আড্ডা জমছে। ওরা বলে, ‘প্যারাডাইস কাফে।’ কয়েকটা ভাঙা চেয়ার-টেবিল, কাপ-প্লেট। ঘন ঘন চা খেতে খেতে কথা বলছেন একবগ্গা ঋত্বিক। শুনছেন সলিল চৌধুরী, ঋষীকেশ মুখোপাধ্যায়, তাপস সেন, মৃণাল সেন। সিগারেট নয়, ঋত্বিকের ব্র্যান্ড লাল সুতোর বিড়ি। বলতেন, ‘আমরা আগুনখেকো আঁতেল।’
‘নবান্ন’ দেখার পরেই তাঁর সঙ্গে যোগ বাড়ল প্রগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের। কিন্তু কোথাও যেন স্বস্তি মিলছে না। মনে হচ্ছে, লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে যেতে হবে! ছবি করতে হবে!
‘‘কিন্তু গল্প কার? তোমার গল্প মানেই তো সেই দেশভাগ, কলোনি আর দাঙ্গা।’’
সহযোদ্ধাদের কথায় খেপে যান ভবা, ‘‘অশিক্ষিতের মতো কথা বোলো না। ছবিতে গল্পের যুগ শেষ হয়ে গেছে, এখন এসেছে বক্তব্যের যুগ।’’
‘‘সেই তো ওপার বাংলা থেকে ছিন্নমূল মানুষের…!
রুক্ষ রাগি মুখে হঠাৎ উঠে পড়েন ঋত্বিক। আড্ডা ছেড়ে যেতে যেতে বলেন, ‘‘শুয়োরের দল। বাংলার আবার এপার-ওপার কি রে!’’
লেকের ধার। দুপুর। নিভৃত পূর্ণদাস রোডে পাশাপাশি হাঁটছে দু’জন।
জলের কাছে পা ছড়িয়ে বসে ঋত্বিক। হাঁটু পর্যন্ত তোলা পাজামা। জলে দুলছে তাঁর ছায়া। বাংলা খাচ্ছেন। পাশে আরেকটা বোতল গড়াগড়ি। তাঁকে ঘিরে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়রা। কেউ একজন বসে থাকতে থাকতে একসময় বলেন, ‘‘ঋত্বিকদা আমরা তাহলে একটু…’’
‘‘খাও।’’
দু’ঢোঁক খেতেই ঋত্বিক বললেন, ‘‘আমার কিন্তু টিবি!’’
বেশিক্ষণ কথা বললে কাশি হয়। কাশলে মুখ দিয়ে রক্ত পড়ে। রুমালে মুখ মুছে নেন। তবু জনতার কী অপূর্ব মুগ্ধতা! সঞ্জয় লিখছেন, ‘‘ওটাই খাওয়ার জন্য কাড়াকাড়ি। ওটা তখন ঋত্বিক ঘটকের মদ এবং সেটা হচ্ছে প্রসাদ।’’
‘‘ইউনিভার্সিটিতে বার্গম্যানের একটা রেট্রোস্পেকটিভ হচ্ছে ঋত্বিকদা। যাবেন?’’
‘‘বার্গম্যানের পুরোটাই চালিয়াতি, একশোভাগ জোচ্চুরি। আন্তোনিওনির স্টাইলটা ধ্রুপদী। যাকগে, যা বোঝো না তা নিয়ে তোমরা ফ্যাচফ্যাচ কোরো না। শোনো, আরও আট-দশ বছর বাদে লোকে আমার ছবি নেবে। আমার ছবি পাগলের মতো খুঁজবে। তোমরা দেখে নিও!’’
এমন শিবতুল্য ভবাকে তাঁর শিষ্যরা চেনে। তারা শ্রদ্ধা করে। ভবা লেকের গহনে তাকিয়ে নিজের লেখা কবেকার লাইনগুলো ভাবেন। ‘‘মানুষ, তোমাকে ভালবাসি।/ এইভাবে,/ পৃথিবীর ইতিহাস বারবার/ বদলে গেছে,/ তবুও মানুষ, সবসময় বেঁচেছে। মানুষ, তোমাকে ভালবাসি।’’
লেকের জলে ছায়াময় দুপুর দেখতে দেখতে তাঁর মনে পড়ে লেকভিউ রোডে ‘জ্বালা’-র অভিনয়।
সে সময় শহরে পর পর ৩১টা আত্মহত্যার খবর!
‘পিপলস এজ’ কাগজে রিপোর্ট করতে গিয়ে তাঁর সে কি ছটফটানি। ‘সুইসাইড ওয়েভ ইন ক্যালকাটা’ রিপোর্টাজ লিখেও শান্তি নেই। মনে হল, এভাবে নয়। লিখলেন, বিষাদময় ‘জ্বালা।’ তবু জ্বালা জুড়োল কই! আজীবন নীলকণ্ঠ হয়েই রইলেন!
লেকের জলে ছায়ারা দীর্ঘ হচ্ছে।
ছেঁড়া কাঁথা পরে পাগলের ভূমিকায় অভিনয়-স্মৃতির সংলাপ ভেসে এল হাওয়ার চিৎকারে, ‘‘জ্বালা আমারও কম নয়। ব্যথা আমারও আছে। ধোঁয়াচ্ছে! জানলে ধোঁয়াচ্ছে…!’’ অস্থির হয়ে, একটা লাল সুতোর বিড়ি ধরান ঋত্বিক।
দমকা কাশির সঙ্গে সঙ্গে রক্ত ওঠে কেবল। সুখটান দিয়ে প্রথম ছবি ‘ছিন্নমূল’-এর কথা ভাবেন। মনে পড়ে শোভার মুখটা।
শিলং পাহাড়ের এক মেয়ের প্রেমে পড়ছেন ভবা!
ও দিকে ভিতরে ভিতরে ছটফটানি বেড়েই চলেছে। উদ্বাস্তু জীবন নিয়ে লিখলেন ‘দলিল।’ সেন্ট্রাল স্কোয়াডের প্রযোজনায় মঞ্চস্থ করলেন। গণনাট্যের কনফারেন্স যোগ দিতে ‘দলিল’ নিয়ে পাড়ি দিলেন বোম্বে। সেখানেই দেখা!
একুশ বছরের দাম্পত্যের স্মৃতিসুধায় সুরমা লিখছেন, ‘‘একটা ভিড়ের দৃশ্যে সমীরণ দত্তের অনুরোধে একটুখানি অভিনয় করে দিয়ে আসি। রোগা, লম্বা চেহারার মানুষটি আমাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে আসেন।’’ ঘনিষ্ঠতা বাড়ল শহরে ফিরে।
ঋত্বিক তখন মা, দিদিদের সঙ্গে বালিগঞ্জ প্লেসের বাড়িতে। আর সুরমা শিলং থেকে কলকাতায়, এমএ পড়তে মামার বাড়িতে।
ভবা রোজ সুরমাকে পড়ায়। বই কিনে দেয়। লেনিন, মার্ক্স, প্লেখানভ! ভবার কথায় যুক্তি, প্রত্যয়, ‘বিসর্জন’-এর রিহার্সালে অপর্ণার চরিত্রটি দেখিয়ে দিতে দিতে গহন চোখে চোখ রেখে বলা, ‘যবে বসে আছি ভরা মনে—/ দিতে চাই, নিতে কেহ নাই!’
সব যেন ওলোটপালোট করে দিল সুরমার। প্রেমে পড়ল সেও!
একদিন তাঁর খুব মনখারাপ। পড়তে পড়তে বলছিলেন দু’বছর জেলের কথা, ছেলেবেলায় মাকে হারানোর কথা। ভবার হাতে মায়ের লেখা ডায়েরি তুলে দিলেন। পাতা উল্টে চোখে জল ভবার!
সেই প্রথম নিবেদন! ‘‘লক্ষ্মী! আমি তোমার জন্য সব করব।’’
মুগ্ধতায় অপলক দু’জন! দেরি হয় রিহার্সালে। দু’জনের ঘনিষ্ঠতার নানা কথা ওড়ে হাওয়ায়। বাড়ির নিষেধ, গণনাট্যের গুঞ্জনের তোয়াক্কা না করে স্কোয়াড বদলে নেন সুরমা। রোজ ঋত্বিকের বাড়িতে যান পড়তে। ফিরতি পথে ভবা বলেন হাওড়বিলের গল্প, ময়মনসিংহ আর রাজশাহীর কথা। ‘বেদেনী’র কথা।
সন্ধেরাতের গলিপথে হাঁটতে হাঁটতে একদিন বাঁশির শোক আর তানপুরার জলধ্বনি।
‘‘বেকার যুবকের ঘর বাঁধার স্বপ্নের ছবি ছিল ‘নাগরিক।’ গাঁটের কড়ি খরচ করে আমরা তুললাম জানো। ভূপতি নন্দী বাড়িটা মর্টগেজ দিল। কে যেন প্রভিডেন্ট ফান্ড ভাঙল। শেষ রক্ষা হল না! ছবির গল্পে ছিল রামু নামে এক যুবক। সে রোজ ঘরের একটি ক্যালেন্ডারের ছবির দিকে তাকিয়ে দেখে, আর রাতে দূরে এক বেহালাবাদকের ছড় টানার শব্দ শুনে ঘুমিয়ে পড়ে।’’
‘‘কাগজে খুব বিজ্ঞাপন দেখেছি। মুক্তি পেল না কেন?’’
‘‘হা হা হা! হয়তো পাবে কখনও! শুনেছ পার্টি আমার বিরুদ্ধে ওয়ান ম্যান কমিশন বসিয়েছে। কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত তার মেম্বর!’’
‘‘জানি। সে দিন ‘নীচের মহল’ নাটকের রিহার্সাল থেকে ফিরছি, মামি বলল। পার্টি তোমাকে এক্সপেলড করবে! উমানাথদা, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, মমতাজ আহমেদ খান সকলে নাকি তোমার বিরুদ্ধে চার্জের সমর্থন জানিয়েছে!’’
‘‘তারপরও তুমি…!’’
‘‘দেরি হয়ে যাচ্ছে চলো।’’
‘‘লক্ষ্মী!’’
‘‘কমরেড জ্যোতি বসু তোমার পক্ষে। কিন্তু এই পার্টি, আইপিটিএ, তেইশটা চার্জ কোনও কাজ করতে দেবে না! নতুন দল করো। গ্রুপ থিয়েটার!’’
‘‘লক্ষ্মী! তুমি কি আসবে? তোমাকে পেলে জীবনটা গুছিয়ে আরম্ভ করব!’’
‘‘আসব!’’
গলির বাঁকে অন্ধকারে ওরা হারিয়ে যায়। হাওয়ার হল্লায় ওদের দু’জনের কথা আর উপকথন আর শোনা যায় না! শূন্যে পাক খেয়ে ওড়ে ভবার বিড়ির ধোঁওয়া! ভবা কিছুতেই যেন স্বস্তি পান না। শান্তি নেই কোথাও! উৎপলের পরিচালনাতে ‘বিসর্জন’ করেছিলেন। রঘুপতি।
লক্ষ্মীকে এগিয়ে দিয়ে ফিরতি পথে গলির অন্ধকারই যেন হয়ে ওঠে রস্ট্রাম।
ভবা বলেন, বলে চলেন, ‘‘পাষাণ ভাঙিয়া গেল জননী/ আমায় এ বার দিয়েছ দেখা প্রত্যক্ষ/ প্রতিমা। জননী অমৃতময়ী!’’
‘সংঘাত অনিবার্য।’ এ পক্ষ, ও পক্ষ ভাগ হয়ে গিয়েছে। জর্জ ওদের কথা শোনে।
এক শনিবার, সন্ধেয় গোপন মিটিং, ঋত্বিক হাজির দুপুর তিনটেতেই। অস্থির ভাবে পায়চারি করছেন। মাথার চুল মুঠো করে ধরা। একবার এই মোড়া, একবার ওই মোড়া। জর্জ আর থাকতে না পেরে বললেন, ‘‘আঃ! স্থির হইয়া বোসো না।’’
‘‘সবাই আসবে তো!’’
‘‘খবর পাইছে হক্কলে, আইবে কিনা কইতে পারি না।’’
‘‘সেইটাই প্রধান সমস্যা। বুঝলা, কেউ কারও মনের ভিতরটা জানে না।’’ একই কথা বার বার বলতে বলতে মাথা ঝাঁকাচ্ছেন ঋত্বিক। মোড়ায় বসে, পা-টা তুলে দিয়েছে খাটের ওপর। শীর্ণ, শিরা-ওঠা পায়ে কাদার ছোপ। অস্থিরভাবে পায়ে আঙুল নাড়তে নাড়তে সে বলেই চলেছেন, ‘‘ভাঙনের জয়গান, বুঝলে… ভাঙনের জয়গান! আমি একটু পার্কে ঘুরে আসি। মুক্ত বাতাস দরকার। অন্ন চাই, প্রাণ চাই, চাই মুক্ত বায়ু!’’ ঝোলা কাঁধে উঠে দাঁড়ান ঋত্বিক। জর্জ জানেন ওই ঝোলায় কী আছে!
বললেন, ‘‘মুক্ত বায়ু, না বোতল-বদ্ধ তরল! আমি সব জানি। আমার ঘরে হেই সব চলবো না। তুমি যাও, পার্কে বইস্যা যা খুশি করো।’’
মিটিং ভন্ডুল! সাড়ে সাতটার সময় ঋত্বিক ফিরলেন। টালমাটাল। কোনওমতে টাল সামলে জর্জকে জিজ্ঞেস করেন, ‘‘মিটিং হইল না? ডিসিশান দাও, দুই বছর এপাশ-ওপাশ ভালো লাগে না। ডিসিশান চাই… কোন পক্ষে যাব, কোন দলে? বলো, বলো?’’
জর্জ চলে যেতে বলেন ঋত্বিককে। তাঁর গলা কেঁপে ওঠে। ঋত্বিক চলে যান।
গলির আলো-অন্ধকারে দীর্ঘ চেহারাটা হারিয়ে যায়। ঘাড় কাত করে তার চলে যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে থাকেন জর্জ। পিছনে পড়ে থাকে ১৭৪-ই রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের জর্জের একলা ঘর। একটু পরে হারমোনিয়ামের সামনে বসেন জর্জ। গেয়ে ওঠেন শ্রাবণের গান, ‘‘আমার যে দিন, ভেসে গেছে। চোখের জলে, আমার যে দিন…!’’
কোথায় যাবেন ভবা এখন?
তৃপ্তি থেকে আকণ্ঠ পান করে পথের রোদ-ছায়ায় হাঁটছেন। ভবানীপুরের জগুবাজারের সামনে হাঁটতে হাঁটতে পা টলছে তাঁর। হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে কিনলেন দুটি পদ্মফুল। ‘‘কী করবি ভবা?’’
হাসেন ভবা। কাঁধের ঝোলায় ফুলগুলি যত্নে ভরে রাখতে রাখতে বলেন, ‘‘লক্ষ্মীকে দিতে হবে, পদ্মের মতো যার মন তাকেই ত দেব!’’
প্রথম প্রেমের চিঠিতে লক্ষ্মীকে লিখছেন, ‘‘মাসিক একটা আয়ের সংস্থান করা প্রথম কর্তব্য। নইলে জীবনে স্নিগ্ধতা আসবে না।’’ কখনও লিখছেন, ‘‘…আমাকে অ্যাট অল কোন মেয়ের ভাল লাগে কি করে- আমার নোংরা পা, বিড়ি ও হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তুলে বসাসমেত। … আমি তোমার মোটেই উপযুক্ত নই, মিছিমিছি তোমাকে ডোবাচ্ছি। ‘লক্ষ্মী’ মহিলাটি জলে পড়লেন।’’
দু’জন ঠিক করলেন বিয়ে করবেন! পরস্পরকে জানার সেই চিঠিতেই জানাচ্ছেন পার্টির খবর, উৎপলের খবর, গীতা ঘটকের ‘সাঁকো’-র রিহার্সালে আসার খবর। বোম্বে থেকে চাকরির সুখবর এল তখনই। সলিল চৌধুরী তার করলেন ঋত্বিককে। ফিল্মিস্তানের চাকরি হল ভবার। ১৯৫৫-র বৈশাখে হল বিয়েও!
বোম্বেতেই ‘মধুমতী’র শুটিং-এ আলাপ দিলীপকুমারের সঙ্গে।
জমিয়ে আড্ডা জুহু বিচে বলরাজ সাহনির বাড়িতে। কিন্তু স্বস্তির জীবন যে ভবার নয়!
বিমল রায়ের ‘মধুমতী’ ও ঋষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘মুসাফির’-এর চিত্রনাট্য লিখতে লিখতেই সুরমাকে লিখছেন, ‘‘দশটা-পাঁচটা গিয়ে বসে থাকতে হবে। … দাঁতে দাঁত চেপে শুধু পয়সার জন্য এখন চেষ্টা করা।… দেখো লক্ষ্মী এ জীবন আমাদের নয়। … এসব ছেড়ে দেব। এ হবে না!’’
ছেড়ে দিলেন চাকরি!
ফের বেকার! কলকাতায় ফিরে আবার হাত দিলেন ছবিতে। সুবোধ ঘোষের কাহিনি অবলম্বনে ‘অযান্ত্রিক’। চরিত্র বলতে জগদ্দল আর বিমল। ঝরঝরে একটি শেভ্রোলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন নেতারহাট, রাঁচি, ঝরিয়ার রুখা-শুখা প্রকৃতির মাঝে। ছবির সঙ্গীত করলেন আলি আকবর খান। স্মৃতি থেকে সুরমা লিখছেন মিউজিকের রেকর্ডিং-এর কথা। ‘‘বিরাট অর্কেষ্ট্রা, অনেক লোকজন। আছেন আলি আকবর খান, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় ও শিশিরকণা ধরচৌধুরী।… পরিচালক ও আলি আকবর খান মাঝে মাঝে একটু একটু মদ্যপান করছেন। শেষ রাতে নেশা কমলেও কাজের বিরতি নেই। ভোর হয়ে আসে!’’
ছবি মুক্তি পেল, উচ্ছ্বসিত দর্শক!
জীবনে সেই প্রথম সংবর্ধনা পেলেন ঋত্বিক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
জনপ্রিয় হল পরের বছর শিবরাম চক্রবর্তীর ছোটগল্প অবলম্বনে তাঁর ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ ছবিও। খালেদ চৌধুরীর আঁকা পোস্টার-হোর্ডিং এখনও কলকাতার স্মৃতির আকাশে।
আর পাঁচজন বাঙালির মতো প্রেমের কবিতা দিয়েই ঋত্বিকের লেখালিখির হাতেখড়ি। প্রথম গল্প বের হয় ‘গল্পভারতী’তে। সেটা ১৯৪৭ সাল। আর সে বছরই ‘অভিধারা’ নামে একটি কাগজ বের করলেন তিনি। পর পর গল্প লেখেন সেই নিজের কাগজেই। নাটক-উপন্যাস লিখলেন আরও পরে। সে সময় তাঁর গল্প প্রকাশ হয় ‘দেশ’, ‘অগ্রণী’, ‘শনিবারের চিঠি’-তে। তাঁর নিজের দাবি, ৫০টি গল্প লিখেছিলেন। তারমধ্যে উল্লেখ্য ‘চোখ’, ‘কমরেড’, ‘গাছ’, ‘অয়নান্ত’, ‘আকাশগঙ্গা’ প্রভৃতি। বেশিরভাগ গল্পেই এসেছে দেশভাগ, কাঁটাতার, দুই বাংলার বিক্ষুব্ধ সময়ের কথা। আছে প্রেমও। কোনও কোনও গল্প নিছক কবিতাও। তাঁর নিজের কথায়, ‘‘চারপাশে যে সমস্ত খারাপ বদমাইশি অত্যাচার ইত্যাদি দেখেছি তার রাজনৈতিক জীব হিসাবে সোচ্চার প্রতিবাদ করার ইচ্ছে থেকেই গল্প লেখায় আরজ্ এসেছিল সেই ছোট বয়সেই।’’ আর কাঁচা বয়সের গল্প পড়েই নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় ঋত্বিককে ‘শক্তিমান নবীন লেখক’ বলেন।
রোজ শিলং পাহাড়ের উপর ঝগড়া চলছে ছবির প্রযোজক মহেন্দ্রজি আর পরিচালক ঋত্বিকের। ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’-এর পরে ফের ক্ষয়িষ্ণু জীবনের কাছে ফিরে এলেন ঋত্বিক। ছিন্নমূল মানুষের কলোনিতে ফের তাঁর ক্যামেরা আঁতিপাঁতি ধরল ক্ষয়-জীবন।
শক্তিপদ রাজগুরুর কাহিনি নিয়ে ‘চিত্রকল্প’-এর প্রযোজনায় শুটিং শুরু করলেন ‘মেঘে ঢাকা তারা’র।
একদিন শুটিং-এ বেশ রাত। চারদিক শুনশান। ক্যামেরা রোল করছে। নীতার কাশি হচ্ছে। কাশির গমকে গমকে রক্ত বের হচ্ছে। ঋত্বিক নির্দেশ দিচ্ছেন সুপ্রিয়াকে, ‘দু’ তিন স্টেপ এগিয়ে আয়। আকাশের দিকে তাকা। বাঁদিকে মুখটা ফেরা। চোখ ডান দিকে।’ হঠাৎ একটা প্যাঁচা ডেকে উঠল। ঋত্বিক চিৎকার করে উঠলেন কাট! তারপর, সুপ্রিয়াকে বললেন, ‘‘ছেমরি আজ প্যাক-আপ। বাড়ি যা।’’
শেষ হল ‘মেঘে ঢাকা তারা’র কাজ। ছবি সেন্সর হচ্ছে। বোর্ডের সদস্য তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
ছবি দেখে বেরিয়ে ঋত্বিককে বললেন, ‘‘মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা ছাড়া কী আর ছবি হয় না?’’
একবগ্গা ঋত্বিক। তাঁর উত্তর, ‘‘আপনার কাছে যা বাস্তব, তা হয়তো আমার কাছে নয়।’’ এর পরেই নিজের গল্প নিয়ে করলেন ‘কোমল গান্ধার।’ সেখানে ঘুরে ফিরে ভৃগু আর অনসূয়ার গল্পে বললেন নিজের দীর্ণ জীবনের কথাই। ছবি মুক্তি পেলে, চূড়ান্ত সমালোচিত হল ঋত্বিকের বামপন্থী বন্ধুদের কাছে! পার্টি সমালোচনা করল ‘সুবর্ণরেখা’-ও! বলা হল, ঋত্বিক ঘটকের ছবিতে ‘বুর্জোয়া নৈরাশ্যবাদ প্রচার করা হয়েছে।’ হতাশায় ভেঙে পড়লেন ভবা, শুরু হল দিনভর নেশা।
সুরমা লিখছেন, ‘‘সুবর্ণরেখা মুক্তি লাভ করল না। তখন থেকে শুনতাম আমি মারা যাব। মাইকেল মধুসূদন, প্রমথেশ বড়ুয়া, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতোই মারা যাব। কেন এই মৃত্যু? আমি তা জানি না।’’ কখনও সুরমাকে বলছেন, ‘‘লক্ষ্মী, আমি মরে যাব। আর দু’বছর!’’
কখনও বলছেন, ‘‘এক বছর!’’
পঁয়ষট্টি থেকেই সারা দিনমান ডুবে থাকেন চোলাই মদে। তার আগে যখন ‘বগলার বঙ্গদর্শন’ করছেন, সকলেই ভবাকে নিয়ে খুব চিন্তিত। তিনি যাতে কালীঘাটের পোটোপাড়ায় চোলাইয়ের ঠেকে যেতে না পারেন কিংবা ভবানীপুরের গাঁজা পার্কে, সকলেরই খেয়াল সেদিকে। পুণায় ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে যখন পড়াবার ডাক এল, ভেবেছিলেন নতুন করে শুরু করবেন। সেও আর হল না!
সুরমা ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাবার কাছে শিলং-এ গেলেন।
বম্বে থেকে তাঁকে লিখছেন, ‘‘এখানে সম্মান, বাঁধা মাইনে এবং মনের মতো কাজ। … ইন্দিরা গান্ধীও অনেক কিছু করেছে আমার জন্যে, গিয়ে বলব।’’ ভাইস প্রিন্সিপ্যালও হলেন। নেশার খপ্পরে সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল!
চূড়ান্ত অস্বাভাবিকতা নিয়েই চাকরি ছেড়ে একদিন শিলং-এ হাজির। শ্বশুরমশাইকে বললেন, সুরমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। হাজারটা টাকা দিতে! নাগাড়ে ১৭ ঘণ্টা ধরে ‘পণ্ডিতমশাই’-এর গল্প লিখে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। হ্যালিউসিনেশন! ভবাকে ভর্তি করা হল হাসপাতালে। সেই চরম সময়ে পাশে ছিলেন উত্তমকুমার, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। উত্তম ‘বনপলাশীর পদাবলী’ করবার জন্য টাকা দিলেন।
কিন্তু ভবার যে আর কোনও কাজে মন নেই। এখন তাঁর বিটোফেনের সিম্ফনি শোনার দিন। একের পর এক রেকর্ড বেজে চলেছে। কখন আব্বাসউদ্দিন শুনছেন, কখনও শচীনকর্তা। আর প্রায়ই রবিঠাকুর।
‘‘রাস্তায় ঋত্বিকবাবু অজ্ঞান হয়ে গেছেন! মুখের ভিতরে একটা টাকার নোট!’’
সুরমার সেদিন কলেজের শেষ ক্লাস। ছুটতে ছুটতে খবর দিল দুটি ছেলে। চারদিক অন্ধকার দেখলেন সুরমা! পাগলের মতো ছুটছেন তিনি। ভবাকে ভর্তি করা হল হাসপাতালে। ভবা তখন দাড়ি রাখছেন। অসংলগ্ন কথা বলছেন,
‘‘দশটা টাকা হবে ডাক্তার? না খেলে সুস্থ হব কী করে! একটু তো খেতেই হবে, নাকি। পারছি না বিশ্বাস করুন। কাজ করতে পারছি না। মাথা কাজ করছে না তো! একটু বাইরে যেতে দিন!’’ নেশা থেমে রইল না !
তুষারবাবুকে বলেছিলেন হাসপাতালে বাংলা মদ জোগাড়ের গোপন কাহিনি।
‘‘কেমনভাবে জোগাড় করতেন?’’
‘‘খুব সোজা। পায়খানার দেওয়ালের দুটো ইট সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। সেখানে হেড সুইপার এক বোতল মদ রেখে যেত। আর খাওয়ার পর আবার ইট লাগিয়ে দিতাম।’’
‘‘টাকা কে জোটাত!’’
‘‘কিছু ভিজিটর তো আসত নাকি! তারা ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করত। কিছু টাকাও রেখে যেত। সে সময় উত্তম আর রমাও এসেছে।’’
‘‘রমা মানে সুচিত্রা সেন?
‘‘ইয়েস স্যার। সুচিত্রা সেন। এর আগে তাঁর বালিগঞ্জ সাকুর্লার রোডের বাড়িতে ছবির বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আর উত্তমের ইচ্ছে ছিল টলস্টয়ের রেজারেকশন অবলম্বনে একটি ছবি করা। তাই তারা চাইছিল আমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হই আর ছবি করি। কাজ করি।’’
কাজ করেছিলেন। একটু সুস্থ হয়েই গোবরার হাসপাতালে বসেই ঋত্বিক ‘কুমারসম্ভব’-এর অষ্টম সর্গ নিয়ে পড়লেন। আবার লিখলেন ‘সেই মেয়ে!’ হাসপাতালে নাটকটি অভিনয়ও করালেন অন্য রোগীদের দিয়ে, নিজেও অভিনয় করলেন!
কিন্তু ছাড়া পেয়েই, ‘লক্ষ্মী, টাকা দাও। দশটা টাকা। এই শেষ!’
শেষ পর্যন্ত আর পেরে উঠলেন না সুরমা!
’৬৯-এ কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মান দিল। এর পরে তাঁর মদ্যপানের মাত্রা যেন বেড়ে গেল। খালাসিটোলায় নিত্যসঙ্গী সন্তোষকুমার ঘোষ, সমরেশ বসু।
আমরা শুনি ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’-র অবিকল সেই বিচ্ছেদ সংলাপের প্রতিধ্বনি।
‘‘কোনও জিনিসের দরকার আছে নাকি?’’
‘‘শুধু বই ও রেকর্ডগুলো থাক!’’
‘‘বই ও রেকর্ডগুলো রেখে গেলেই বিক্রি করে মদ খাওয়া হবে। তাই ওগুলো দেব না। ছেলের জন্য যত্ন করে রাখব। বড় হয়ে পড়বে ও শুনবে।’’
‘‘তা হলে শুধু পাখাগুলো থাক।’’
সুরমা লিখছেন, ‘‘আমি রাজি হই। যদিও জানতাম, চলে গেলেই বিক্রি করে মদের বোতল আসবে।… চলে আসার সময় কী আকুল দৃষ্টি! তবু, এসে ট্যাক্সিতে উঠি। কী করব, আমি মা! তিনটি ছেলেমেয়েকে তো আমাকে রক্ষা করতেই হবে।’’
৭১-এর ১ জানুয়ারি সংসার দু’ভাগ হয়ে গেল। স্কুলে চাকরি নিয়ে সাঁইথিয়া চলে গেলেন সুরমা!
একা হয়ে গেলেন ভবা!
একা!
মাস পাঁচেক পরে বোম্বে থেকে সাঁইথিয়ায় চিঠি এল পঁচিশে বৈশাখ। ‘‘আসছি। চার পাঁচদিন জ্বালাব। না, শান্তিনিকেতনে থাকব। একবার করে দেখে যাব। তারপর রামপালান পালাব। চিরকালের মতো। দেখি, পারি কিনা।’’ চিঠির শেষে লিখলেন, ‘‘ঘৃণা-ঋত্বিক!’’
সেই পালালেন!
গোছানোই ছিল সুটকেস।
নতুন জামাকাপড়, নতুন সাবান, তোয়ালে। শেভিং সেট। সবার উপর কালো জহরকোট। সেটা পরেই যুক্তি তক্কোতে শুটিং করেছিলেন। সুরমা বার বার নিষেধ করতেন, ওই কোট আর না পরতে। শুনে সে কি প্রচণ্ড অট্টহাসি!
এখনও যেন হাসছেন।
জহরকোটের উপর হাত রেখে হেসে ওঠেন। বলেন, ‘‘লক্ষ্মী তো আমার মারা যাওয়া সহ্য করতে পারে না, তাই জহরকোটটি দেখতে পারে না।’’
‘‘প্লিজ আর খাবেন না!’’ নিষেধ করেন ডাক্তার। বেপরোয়া ঋত্বিক!
‘‘হয়নি, কিছু হয়নি। আরও একটু চাই।’’
হাসপাতালের বেডে শুয়ে সারাক্ষণ স্মৃতির পথে হাঁটেন ভবা। সতত পোড়েন স্মৃতির ধূপে! ‘‘যখন ‘জ্বালা’ লিখেছিলাম, তখন জানতাম না কাশির সঙ্গে রক্ত কেমন করে ওঠে… আর আজ! আর বাঁচতে চাই না। এই শুয়োরের বাচ্চার দেশে বেঁচে লাভ কি?’’
নাগাড়ে কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে ওঠেন! কখনও রক্তবমি।
এমন অসুস্থতা সঙ্গে নিয়েই করলেন শেষ দুটো ছবি। জলে ভিজে, রোদে পুড়ে ওপারে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, আর এপারে ‘যুক্তি-তক্কো-গপ্পো।’ কিন্তু ধকল নিতে পারলেন না আর!
ঢাকা থেকে দুঃসংবাদ এল ঋত্বিক অসুস্থ। চিন্তিত কলকাতা। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন সত্যজিৎ রায়। মৃণাল সেন নিজে গিয়ে তাঁকে নিয়ে আসার দায়িত্ব নিলেন। ফিরলেন। তার পর একদিন বাংলাদেশে মুক্তি পেল ‘তিতাস একটি নদীর নাম।’ ভবা তখন হাসপাতালে।
জানলার বাইরে হাতছানি দিয়ে কে যেন তাকে বার বার ডাকে। হাত ধরে নিয়ে যায় আদিগন্ত পদ্মার চরে। জল ঠেলে ঠেলে নৌকো টেনে চলেছে পটনা-বাঁকীপুর-মুঙ্গেরের মাল্লারা। উদাস, রোগজর্জর ভবা দেখছে, ইলশাগুঁড়ি প্রথম বর্ষায় কেমন খুশিতে মাতোয়ারা মাঝি-মাল্লারা। জলমাখানো হাওয়ায় ভেসে তারা সুর ছাড়ে। ভবা পাগল সুরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে স্টিমারের ছাদে। দোল খায় মাতাল নদীর দাপটে। কান পেতে সে শোনে ‘এঞ্জিনের ধস-ধস, সারেঙ্গের ঘণ্টি, খালাসির বাঁও না মেলা আর্তনাদ!’
একটু সুস্থ হলেই বেরিয়ে পড়ছেন হাসপাতাল থেকে।
তখন রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে এক দোকানির বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। খুবই অসুস্থ। তবু ছুটলেন তথ্যচিত্র তুলতে শান্তিনিকেতনে। রামকিঙ্কর।
গোটা গোটা দিন যায়। কিঙ্করের সঙ্গে বাংলা মদে ডুবে দু’জনে শিল্পের গভীর তত্ত্ব আলোচনা করেন।
ছবি এগোয় রয়ে সয়ে! ফের হাসপাতাল। সুরমার সঙ্গে সাঁইথিয়ায় গিয়ে দেখা করে এলেন। সেই শেষ দেখা!
গলির মুখে মিলিয়ে যাচ্ছে কালো জহরকোট, ল্যাকপেকে–লম্বা শরীরটা। যেতে যেতে নিজের মনেই বলছেন, ‘‘লক্ষ্মী! টাকা থাকবে না। কাজটাই থেকে যাবে। তুমি দেখে নিয়ো, আমি মারা যাওয়ার পর, সবাই আমাকে বুঝবে!’’
উনিশ দিনেই সব শেষ!
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ভবা। চোখের জলে ঝাপসা হয়ে আসছে চরাচর।
ঝাপসা পদ্মার বাঁধ, মেঘনার চর, ভৈরব বাজার। কবে যেন লিখেছিলেন, ‘‘বুড়িগঙ্গা, বহুদিন তোর কোলে মাথা রাখিনিকো!’’
মৃণাল সেন খবর পাঠালেন সুরমাকে। কলকাতার হাওয়ায় ছড়াল শোকসংবাদ। পিজির সামনে অগণিত মানুষের ঢল। কেউ রবিঠাকুর ধরল, ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি, ভাঙল ঝড়ে।’ ভবার প্রিয় গান!
স্টুডিয়োপাড়া হয়ে শবযাত্রা এগিয়ে চলল ঘাটের দিকে।
(তথ্যসূত্র:
১- মৃণাল সেন, তৃতীয় ভুবন, আনন্দ পাবলিশার্স (২০১১), কলকাতা।
২- মৃণাল সেন, আমি ও আমার সিনেমা, বাণীশিল্প (২০১৫), কলকাতা।
৩- মৃণাল সেন, অনেক মুখ অনেক মুহূর্ত, পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ ও থীমা (২০১৫), কলকাতা।
৪- মৃণাল সেন, মানিকবাবুর সঙ্গে তর্ক এখনও আমার শেষ হয়নি, ঋতুপর্ণ ঘোষ সম্পাদিত ‘আনন্দলোক’, ২ মে ১৯৯৮, কলকাতা।
৫- ‘সত্যজিৎ রায় ভিন্ন চোখে’ – শীতলচন্দ্র ঘোষ ও অরুণকুমার রায় সম্পাদিত।
৬- অনন্য সত্যজিৎ — প্রবোধকুমার মৈত্র সম্পাদিত।
৭- দৈনিক স্টেটসম্যান, ২রা মে ২০১৯ সাল।
৮- ঋত্বিক ঘটক, রজত রায়, প্রতিভাস।
৯- সাক্ষাৎ ঋত্বিক (ঋত্বিক ঘটকের ১৮ টি সাক্ষাৎকার ওঋত্বিক সম্পর্কে ২১ জনের লেখা /কথা), শিবাদিত্য দাশগুপ্ত, দীপায়ন।
১০- শিলং জেলের ডায়েরি, সুরমা ঘটক, অনুষ্টুপ।
১১- ঋত্বিক, পদ্মা থেকে তিতাস, সুরমা ঘটক, অনুষ্টুপ।
১২- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৭শে ডিসেম্বর ২০১৬ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত