এককালে শহরে গ্রামে বাঙালি মায়েরা বলতেন, বাছা শুয়ে পড়, নইলে কে সি নাগের অঙ্ক কষতে দেব। তার জন্য ছাত্রছাত্রীদের ইস্কুল যেতে পেটব্যথা হত। পরীক্ষার হলে ঘাম দিতে থাকত। তেল মাখা বাঁশে উল্লাসে উঠেছে বাঁদর! প্রোপোজ-টোপোজ ঘুচিয়ে ম্যাথস-এর কোচিং-এ প্রেস্টিজ ফুটো হবে। কেননা চৌবাচ্চার ফুটো দিয়ে তত ক্ষণে সব জল বেরিয়ে যাচ্ছে, আর উপরের কোন ব্যাটাচ্ছেলে খুলে দিয়েছে কল! এমতাবস্থায় কোনটে চাই, ত্রৈরাশিক না ভগ্নাংশ, সেটুকু ধরতেই মাথা ঘেঁটে ‘ঘ’। এই কিংকতর্ব্যবিমূঢ়তারই আদি পিতা কে সি নাগ।
আবার, কে সি নাগ একটা চ্যালেঞ্জের নাম। তেমন জুতসই একটা অঙ্কের সমাধান কারও কনফিডেন্সের ফুসফুসটা আরও ফুলিয়ে দেয়। এক-একটা অনুশীলনী যত গড়িয়ে আসতে থাকে, খেলা তত জমে। উনতিরিশ, তিরিশ, একত্রিশের দাগের অঙ্কগুলো যেন এক একটা হার্ডল, টপকে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে সাঁইসাঁই রেস জেতার উল্লাস।
এটা বাংলা ১৪২৬ সাল। আর উনি জন্মেছিলেন বাংলা ১৩০০ সালে, ঠিক ১২৬ বছর আগে। ‘রাউন্ড ফিগার’ হলে কত সহজ হয়ে যায় যোগ-বিয়োগগুলো! অথচ তাঁর অঙ্কগুলো দেখো, দাঁত ফোটানো যায় না এমন সংখ্যা, বিটকেল ভগ্নাংশের হিসেবপত্তর। চৌবাচ্চায় দুটো নল, একটা দিয়ে অমুক সময়ে তমুক বেগে জল ঢুকছে, তমুক বেগে অমুক সময়ে বেরোচ্ছে। তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উঠতে-নামতে বাঁদরটা কাহিল। মুদির চালে কাঁকর, গোয়ালার দুধে জল মেশানোর নিদারুণ অনুপাত। সমান্তরাল রেললাইনে কত ট্রেন আসছে-যাচ্ছে, কত স্টেশনে দেখা কতশত রেলগাড়ির। ওদের নিয়ে আঁক কষার কী আছে! ‘সরল’ যদি এতই জটিল, তা হলে তাকে আর সরল বলা কেন? প্রশ্নগুলো রামকঠিন, উত্তর অজানা।
বাঙালি অঙ্ক শুনলেই যাঁকে গড় করে, সেই কে সি নাগকে নিয়ে একটা প্রশ্ন সকলের মনেই জাগে, এত কঠিন কঠিন অঙ্ক উনি কী করে বানাতেন? যাঁরা গল্প-উপন্যাস লেখেন, তাঁদের নাহয় মাথায় একটা প্লট, চরিত্র থাকে। ছবি আঁকতে গেলে তুলির আঁচড়েরও আগে কল্পনা লাগে। কিন্তু এমন কঠিন সব অঙ্ক ‘লিখতে’ পারার পিছনে কোন কল্পনা, কোন বাস্তব কাজ করেছিল কে সি নাগ, কেশবচন্দ্র নাগ নামের মানুষটির?
ত্রিদিবেশ নাগ – কেশবচন্দ্র নাগের নাতি তাঁর দাদুর স্মৃতিচারণে সাম্প্রতিক অতীতে জানিয়েছিলেন যে, এই প্রশ্ন তাঁকেও বিদ্ধ করেছে স্কুলবেলায়। তাঁর বক্তব্য অনুসারে – ‘‘বন্ধুরা বলত, তোর দাদু এত কঠিন অঙ্ক কী করে বানালেন! অঙ্ক ক্লাসে সবার আলাদা নজর, আমি কে সি নাগের নাতি বলে কথা! তবে দাদু খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতেন অঙ্ক। মনে আছে, ভলিউম আর পেরিমিটারের অঙ্ক শিখিয়েছিলেন। একটা কাগজের বৃত্ত থেকে একটা স্কোয়্যার কেটে নিতে বললেন কাঁচি দিয়ে। তার পর বললেন, এ বার তুমিই ভেবে বলো, ভলিউম আর পেরিমিটার কোনটার কী হল। কোনটাই বা বাড়ল, কোনটা কমল। আজ যখন টিভি আর সোশ্যাল মিডিয়ায় অঙ্ক শেখার বিকল্প ও রোমাঞ্চকর পদ্ধতির টিউটোরিয়াল-অ্যাপের বিজ্ঞাপন দেখি, আমার তখন দাদুর কথা মনে পড়ে। সেই কবে আমাকে ‘অন্য রকম’ ভাবে অঙ্ক শিখিয়ে গেছেন!’’
হোয়াটসঅ্যাপে, ফেসবুকে একটা ছবিওয়ালা জোক খুব হিট হয়েছিল দিন কয়েক আগে। তাতে উপরে কে সি দাসের ছবি, তিনি বলছেন: আমি রসগোল্লা বানানোর জন্য বিখ্যাত। তলায় কে সি নাগের ছবি, তিনি বলছেন: আমি রসগোল্লা পাওয়ানোর জন্য বিখ্যাত! বঙ্গভূমি গণিতক্ষেত্রে বহু প্রতিভার জন্ম দিয়েছে, এই নিয্যস সত্যটাকে কী ভাবে যেন চাপা দিয়েছে বাঙালির অঙ্কভীতি, ভয়ঙ্কর হিন্দি বলা আর পেটের অসুখের পরম্পরা। শেষের দুটো নিয়ে যদি বা তাও ঘর করা যায়, অঙ্কে গোল্লার ভয় যে কত বাঙালি সন্তানকে আন-কেরিয়ারমুখো করেছে, গুনে থই পাওয়া যাবে না। আর সেই সাংঘাতিক ভয়েরই প্রতিশব্দ— কেশবচন্দ্র নাগ!
১২৬ বছর আগে এক রথযাত্রা পড়েছিল ১০ই জুলাই। সালটা ছিল ১৮৯৩। ১০ই জুলাই, রথযাত্রার দিন হুগলির গুড়াপের নাগপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন কেশবচন্দ্র নাগ। বাবা রঘুনাথ, মা ক্ষীরোদাসুন্দরী। শৈশবেই পিতৃহারা হন কেশব। সন্তানদের মানুষ করতে শুরু হল ক্ষীরোদাসুন্দরীর লড়াই। কেশবচন্দ্রের পড়াশোনার শুরু স্থানীয় বাংলা স্কুলে। গুড়াপে তখন ওই একটিই স্কুল। তার পর ক্লাস সেভেন থেকে ভাস্তাড়া যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়। রাত থাকতে থাকতে বেরিয়ে পড়া, তিন মাইল পথ পায়ে হেঁটে প্রতি দিন স্কুল যাওয়া। হেঁটেই ফেরা। ক্লাস নাইনে ভরতি হলেন কিষেণগঞ্জ হাইস্কুলে। ১৯১২ সালে সেখান থেকেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হওয়া। এ বার রিপন কলেজ। বিষয় বিজ্ঞান। এই সময় থেকেই প্রাইভেট টিউশনি শুরু করে দেন কেশবচন্দ্র। ১৯১৪ সালে প্রথম বিভাগেই পাশ করলেন আইএসসি।
যে ভাস্তাড়া যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ে এক দিন ছাত্র ছিলেন, সেখানেই শুরু করলেন শিক্ষকতা। যোগ দিলেন থার্ড মাস্টার হিসেবে। সংসারের ভার তখন কাঁধে, চাকরি ছেড়ে উচ্চ শিক্ষার চেষ্টা চলল। বিজ্ঞান নয়, যদি কলা বিভাগেও স্নাতক হওয়া যায়! অঙ্ক ও সংস্কৃত নিয়ে বিএ পাশ করলেন কেশবচন্দ্র। এ বার ডাক এল অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার, সেই ছাত্রবেলার কিষেণগঞ্জ হাইস্কুল থেকে। সেখানেও কিছু দিন শিক্ষকতা করলেন তিনি। তার পর বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুল। এ সময়ই অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে কেশবচন্দ্রের সুখ্যাতির কথা স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কানে পৌঁছয়। মানুষ চিনতে তিনি ভুল করেননি। মিত্র ইনস্টিটিউশন ভবানীপুরে অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে নিয়ে আসা হয় কেশবচন্দ্রকে। রসা রোডে মেসবাড়িতে থাকতে শুরু করেন তিনি। তত দিনে তাঁর জীবনের কেন্দ্রে কেবল একটিই শব্দ গণিত। এই মিত্র ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক হয়ে অবসর নেন কেশবচন্দ্র। মেসবাড়ি ছেড়ে ১৯৬৪ সাল থেকে থাকতে শুরু করেন দক্ষিণ কলকাতার গোবিন্দ ঘোষাল লেনের নতুন বাড়িতে। আজও যে বাড়িতে ‘কেশবচন্দ্র নাগ’ লেখা নেমপ্লেটটি উজ্জ্বল! তাঁর শিক্ষকজীবনের শেষার্ধ কেটেছে কলকাতায়। তিনি পাকাপাকি ভাবে কলকাতার বাসিন্দা হয়েছেন। কিন্তু, অন্তরের টানে বারে বারে ফিরে গিয়েছেন হুগলির গুড়াপে, তাঁর মাটির কাছে।
ভবানীপুরের মিত্র ইন্সটিটিউশন, যে স্কুলে অঙ্কের মাস্টারমশাই ও পরে হেডমাস্টারও ছিলেন কে সি নাগ, সেখানকার চল্লিশ-পঞ্চাশের দশক কি তার পরের দিকের ছাত্ররা কিন্তু জোর প্রতিবাদ করবেন। খোদ কে সি নাগের অঙ্ক ক্লাস করেছেন তাঁরা, জানেন, অঙ্ককে কেমন সহজ করে বুঝিয়ে দিতেন মাস্টারমশাই। কেমন ছিল সে পদ্ধতি? ক্লাসে এসে গম্ভীর গলায় বলতেন ‘সিমপ্লিফাই’, আর মুখে বলতে বলতে বোর্ডে লিখে দিতেন অঙ্কটা। তার পর কোনও ছাত্রকে ডেকে বোর্ডে কষতে বলতেন। পুরোটা করতে দিতেন, ভুল করতে দিতেন। তার পর ভুল-হওয়া অংশটুকু চিহ্নিত করে, মুছে দিয়ে, ঠিক পথে নিয়ে যেতেন অঙ্কটাকে। একটা অঙ্ক ঠিক হলেই হল না। একই রকম, বা একই গোছের আরও অঙ্ক তক্ষুনি করতে দিতেন। এতে ছাত্রদের মনে অঙ্কগুলো করার তরিকা, বা এ ধরনের অঙ্কে যে যে জায়গায় ভুল হতে পারে সেগুলো গেঁথে থাকত, তারা আর ভুল করত না। বীজগণিত নয়, পাটিগণিতের পদ্ধতিতে সমাধান করতে বলতেন— তাতে যুক্তির বোধ বাড়ে। সোজা থেকে ক্রমশ কঠিন, এই ভাবে অঙ্ক করাতেন। কে সি নাগের বই থেকে অঙ্ক করা ছাত্রমাত্রেই জানে, অনুশীলনীর গোড়ার অঙ্কগুলো সোজা, পঁচিশ-তিরিশ দাগের পর থেকে জব্বর কঠিন। কিন্তু ওঁর ক্লাসে অঙ্ক শিখেছে যারা, তাদের কাছে জলভাত। অঙ্ক তো অঙ্ক নয়, ভালবাসা। দৈনিক বসুমতীর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, অঙ্ক কি জুজু না কি? ভালবাসলেই অঙ্ক সহজ হয়ে যায়।
এত ভাল অঙ্ক কষা নিজে শিখলেন কী করে? কী ভাবে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর নাম, যা শুনে স্বয়ং স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুল থেকে নিয়ে এলেন সে কালের কলকাতার গর্ব মিত্র ইন্সটিটিউশনে? আবারও ফিরে যাই হোয়াটসঅ্যাপে ভাইরাল হওয়া কে সি নাগ-কথায়। ছোট্ট ছেলে কেশবকে কাকা মুখে মুখে ধরছেন পৌনে তেরোর নামতা। ছেলেও বলছে ঠিক, নির্ভুল। বা, ছোটবেলার কেশব দেখছে এক ফড়ে আর আড়তদারের ইলিশের দরদস্তুর। গুঁফো আড়তদারবাবুটি ফড়েকে জিজ্ঞেস করছেন, ইলিশের মণ দেড়শো টাকা হলে একটা আড়াইসেরি ইলিশের দাম কত পড়বে? ঠোঁটের গোড়ায় নিশপিশ করতে থাকা উত্তর ফস করে দিয়ে বসছে গঙ্গার পাড়ে বসে থাকা বালক কেশবচন্দ্র— ন’টাকা ছ’আনা! গোঁফবাবু ছেলের নামধামইস্কুল জেনে নিয়ে বলছেন, স্কুলের হেডস্যরকে আমার নাম বোলো, ‘আশুতোষ মুখোপাধ্যায়’, পড়াশোনার খরচা মায় বইখাতাটাও ফ্রি হয়ে যাবে!
রটে যা তা সব সত্য নয়। এই সবই কে সি নাগকে ঘিরে কিংবদন্তি। আসল মানুষটা কলকাতা এসেছিলেন বড় হয়ে কলেজে ভর্তির সময়। উঠেছিলেন মির্জাপুর স্ট্রিটে বড়দা সত্যচরণ নাগের মেসে, ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন রিপন কলেজে (এখন সুরেন্দ্রনাথ কলেজ)। তাঁর স্কুলবেলাও গোলাপগন্ধী নয়। বর্ধমানের গুড়াপের ছেলে সিক্স অবধি পড়েছেন গ্রামেরই ইস্কুলে, পরের দু’বছর তিন মাইল দূরের ভাস্তাড়া যজ্ঞেশ্বর স্কুলে। রোজ তিন-তিন ছ’মাইল পথ হেঁটে যাওয়া-আসা। রাস্তাও বলিহারি, গ্রীষ্মে এক পা ধুলো, বর্ষায় হাঁটু-ডোবা কাদা। শীতের বেলা বাড়ি ফিরতে গড়িয়ে যেত সন্ধেয়। এক দিন সন্ধেয় নির্জন পথে হেঁটে ফিরছেন, হঠাৎ খটাস খটাস শব্দ। যত এগোনো, শব্দও বাড়ে। নির্ঘাত ভূত! ছেলে তো পায়ের চটিজোড়া খুলে দে দৌড়! তার পরেই বোঝা গেল শব্দরহস্য। চলতি পথে চটির মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল ছোট ছোট নুড়ি, পা ফেলতে তারাই এক-একটা বেরিয়ে আসছিল ছিটকে, আর শব্দ হচ্ছিল ও রকম। ইস্কুলবেলার সেই ঘটনাই নাকি পরে তাঁর বইয়ের বিখ্যাত ‘টাইম অ্যান্ড ডিসট্যান্স’-এর অঙ্কগুলোর শেকড়!
জীবন তাঁকে নিয়ে গিয়েছে বিচিত্র পথে। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছেন কিষেনগঞ্জের স্কুল থেকে। তাঁর মেজদা তখন কাজের সূত্রে সেখানে। এই মেজদা, পরে কলকাতায় থাকা বড়দা একে একে মারা গেলে কেশবচন্দ্রের উপরেই এসে পড়ে সংসারের ভার। ভবিষ্যতের প্রবাদপ্রতিম অঙ্কশিক্ষক খুব কম বয়সে স্কুলশিক্ষকতার চাকরি নেন। গোড়ায় নিজের পড়া দুই স্কুলে, পরে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুলে। সেখানে চাকরি পাওয়াও এক গল্প। সে আমলে বহরমপুরের বিখ্যাত স্কুলটির হর্তাকর্তা ছিলেন সাহেবরা। কেশবচন্দ্রের ইন্টারভিউ হয়েছিল কলকাতায় গ্র্যান্ড হোটেলে। সাহেবরা চমৎকৃত হয়েছিলেন ছিপছিপে তরুণের আচরণের ঋজুতায়। ভাল মাটি, জল-হাওয়া পেলে প্রতিভাও বাড়ে তরতরিয়ে, বহরমপুর কৃষ্ণনাথ স্কুল থেকেই নাম ছড়িয়েছিল তরুণ শিক্ষক কেশবচন্দ্রের। মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী ঘরের ছেলেদের টিউটর নিযুক্ত করেছিলেন তাঁকে। তাঁর জন্য খুলে দিয়েছিলেন রাজবাড়ির বিশাল লাইব্রেরি। তাতে কতশত বিজ্ঞানের বই, দেশবিদেশের পত্রপত্রিকা! কেশবচন্দ্র পরে বলেছিলেন, পরে অঙ্কের বই লেখার সময় কাজে দিয়েছিল সেই বই-ভরা লাইব্রেরিতে তন্নিষ্ঠ পাঠস্মৃতি।
১৯২৪ থেকে ১৯৬০, ‘মিত্র স্কুল’ দেখেছিল এক জীবন্ত কিংবদন্তিকে। শুধু কে সি নাগ কেন, বিখ্যাত সব মাস্টারমশাইরা তখন পড়ান মিত্র ইনস্টিটিউশনে। ম্যাট্রিকে প্রথম দিকের র্যাঙ্কগুলো বাঁধা থাকত স্কুলের ছেলেদের, পূর্ণ সিনেমাহলের কাছে মিষ্টির দোকানের বিখ্যাত ‘মাতৃভোগ’ রেজ়াল্টের দিন নাম পাল্টে হয়ে যেত ‘মিত্রভোগ’। কোন মাস্টারমশাইদের শ্রমের ফসল ঘরে তুলত ইস্কুল? বাংলায় কবিশেখর কালিদাস রায়, সংস্কৃতে পণ্ডিত জানকীনাথ শাস্ত্রী, ভূগোলে যতীন্দ্রকৃষ্ণ মিত্র, আর্টে দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী! বই লেখার কথা দূর কল্পনাতেও ছিল না। তখন তিনি মিত্র ইনস্টিটিউশনে। সেখানে তাঁর অগ্রজ সহকর্মী কবিশেখর কালিদাস রায়। তাঁর বাড়িতে বসত সাহিত্যিকদের আড্ডা ‘রসচক্র সাহিত্য সংসদ’। আসতেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, জলধর সেনের মতো সাহিত্যিকরা। কেশবচন্দ্রও হয়ে ওঠেন সেই আড্ডার অন্যতম। শরৎচন্দ্রই নাকি তাঁকে প্রথম বলেন গণিতের বই লেখার কথা। তখন কেশবচন্দ্র বিষয়টাকে বড় একটা পাত্তা দেননি। তার পর এক দিন তাঁকে প্রায় চেপেই ধরেন কবিশেখর। ক্লাস ফাইভ-সিক্সের জন্য বই লেখার কথা বলেন। ‘অনন্য কেশবচন্দ্র’ প্রবন্ধে সে কথোপকথনের একটা ইঙ্গিত রেখেছেন লেখক চিত্তরঞ্জন ঘোষাল। কালিদাসবাবু কেশবচন্দ্রকে বলেছিলেন, ‘ক্লাসে যেভাবে অঙ্ক শেখাও, আর ছেলেরা যেভাবে চুপ করে ওই শুকনো খড়কুটো গোগ্রাসে গেলে, দেখে তো মনে হয় ভাই যে তুমি গল্প লেখা শেখাচ্ছো। তাহলে নিজে লিখতে পারবে না কেন?’ শুরু হল পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজ। তখন তিরিশের দশকের মাঝামাঝি। প্রকাশিত হল ‘নব পাটীগণিত’। প্রকাশক ইউ এন ধর অ্যান্ড সন্স। কেশবচন্দ্র নাগের সেই ‘কে সি নাগ’ হয়ে ওঠার শুরু। বছর কয়েকের মধ্যেই তামাম বাংলায় ছড়িয়ে পড়ল বইটি। পাঠ্যপুস্তক হিসেবেও অনুমোদিত হল।
কেশবচন্দ্র কলকাতায় থাকতেন ভবানীপুরের ১২ নম্বর রসা রোডের মেসে, সেখানে বসেই লিখে ফেললেন পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণির পড়ুয়াদের জন্য ‘নব পাটীগণিত’। পরে পরিচয় ক্যালকাটা বুক হাউস-এর কর্ণধার পরেশচন্দ্র ভাওয়ালের সঙ্গে। এক দিন তিনি কেশবচন্দ্রের ঘরে এসে দেখেন, টেবিলের উপরে মোটা একটা খাতায় পাতার পর পাতা জুড়ে অঙ্ক। শুধু অঙ্কই নয়, কোন অঙ্ক কী ভাবে, কত রকম ভাবে করা যাবে, গুছিয়ে লেখা। পরেশবাবু চাইলেন সেই খাতা, বই আকারে ছাপবেন। কেশবচন্দ্র কিছুতেই দিতে রাজি নন, ছেলেমেয়েরা অঙ্ক শেখার আগে অঙ্কের ‘মানে বই’ হাতে পেলে বিপদ। পরেশবাবু বোঝালেন, অঙ্কের শিক্ষকদের জন্য এ খুবই দরকারি বই হবে, তাঁদের জন্য অন্তত প্রকাশ করা দরকার। রাজি হলেন কেশবচন্দ্র। ১৯৪২-এ বেরোল ‘ম্যাট্রিক ম্যাথমেটিক্স’। ‘নব পাটীগণিত’-এর মতোই, মার্কেট ও মন, দুই-ই জয় করল তা। আর ফিরে তাকাতে হয়নি। মোট ৪২টা বই লিখেছেন, ‘অঙ্কের বই মানেই কে সি নাগ’ লব্জ হয়ে গিয়েছে তত দিনে। এবং এখনও। ‘‘দাদুর বই বিদেশে পাঠাতে হয় আমাকে ক্যুরিয়ার করে,’’ হাসছেন ত্রিদিবেশ। তাঁর উপরেই এখন ‘নাগ বুক হাউস’ তথা কে সি নাগের যাবতীয় বই এই সময়ের উপযোগী করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার গুরুভার। কাদের পাঠান বই? ‘‘ইউরোপ-আমেরিকার বাঙালিরা যোগাযোগ করেন। তাঁরা নিজেরা কে সি নাগ পড়েছেন, পরবর্তী প্রজন্মকে অঙ্ক শেখাতে যে এই বইয়ের বিকল্প নেই, জানেন।’’ বড় জেঠু, কেশবচন্দ্রের বড় ছেলে দেবীপ্রসাদ নাগ ত্রিদিবেশকে বলেছিলেন এই দায়িত্ব নেওয়ার কথা। উপযুক্ত পরিমার্জন, পরিবর্ধন, নতুন সংস্করণ, কাজ অনেক। তাঁর বক্তব্যে, ‘‘আমি ছোটবেলায় দাদুকে দেখেছি নিজের বইয়ের প্রুফ দেখছেন অখণ্ড মনোযোগে। বয়স নব্বই পেরিয়েছে, তখনও!’’
আক্ষরিকই, অপাঠ্য বই লিখেও অনেকের কপালে সাহিত্যিক-সুলেখকের তকমা জোটে। কিন্তু, পাঠ্যবইয়ের রচয়িতাকে ‘লেখক’ বলে স্বীকৃতি দেওয়া আমাদের প্র্যাকটিসে নেই। ল্যাডলিমোহনের কেমিস্ট্রি বা সিআরডিজি-র ফিজিক্স অনেক বাজারি গপ্পো-কবিতার চেয়ে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছেছে, বেশি মানুষের ‘কাজে’ লেগেছে। তবু তাঁদের আমরা লেখক বলি না। কে সি নাগের ক্ষেত্রেও ‘পাঠক’-এর অবস্থানটা সেরকমই। ভুললে চলবে না, কে সি নাগকে অঙ্কের বই লিখতে বলছেন কবি আর কথাশিল্পী। শরৎচন্দ্র মজা করেই তাঁকে ডাকছেন ‘গণিত-শিল্পী’ বলে! কে সি নাগের সেই সব অঙ্কবইয়ে কি তবে কোনও মৌলিকত্ব নেই? তাঁকে পুরোদস্তুর ‘লেখক’-এর তকমা দেওয়া কি উচিত নয়?
ঘটনাচক্রে কেশবচন্দ্রের মেসে এক দিন এসে পড়েন ক্যালকাটা বুক হাউসের পরেশচন্দ্র ভাওয়াল। টেবিলের উপরেই ছিল কেশবচন্দ্রের বাঁধানো অঙ্কের খাতা। দেখামাত্রই চমকে ওঠেন পরেশবাবু। কোন অঙ্ক কোন উপায়ে করলে সহজেই বোধগম্য হবে ছাত্রদের, তার হরেক রকম টেকনিক লিখে রাখা পাতার পর পাতায়। সেই খাতাটি বইয়ের আকারে ছাপার প্রস্তাব দেন তিনি। প্রথমে একেবারেই রাজি হননি কেশবচন্দ্র। তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল, অঙ্কের কি হেল্প-বুক হয়, না শিক্ষকদের জন্য গাইডবুক হবে এটি? শেষমেশ কেশবচন্দ্রকে রাজি করাতে সফল হন প্রকাশক। ১৯৪২। প্রকাশিত হল অঙ্কের সহায়িকা ‘ম্যাট্রিক ম্যাথমেটিক্স’। বেরনো মাত্রই বইটির চাহিদা হয়েছিল আকাশছোঁয়া। একে একে তাঁর আরও বই প্রকাশিত হতে থাকে। ইংরেজি, হিন্দি, নেপালি, উর্দু ভাষায় অনূদিত হয়। পাকিস্তান বোর্ডের সিলেবাস অনুযায়ী লিখেছিলেন ‘পাক ম্যাথমেটিক্স’। দৃষ্টিহীনদের জন্য প্রকাশিত হয়েছে ব্রেল সংস্করণও। ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক মার্টিন বার্ড স্নাইডার কে সি নাগের বইগুলির বিষয়ে বলেছিলেন, ‘দ্য থিয়োরিটিকাল ট্রিটমেন্ট অব দ্য সাবজেক্ট ইন দিজ বুকস ওয়্যার সুপিরিয়র টু দ্যাট ফাউন্ড ইন সিমিলার বুকস ইন দ্য ইউএসএ’।
গণিতের বাইরেও অগণিত ক্ষেত্রে অবিচল যাতায়াত ছিল কেশবচন্দ্রের। ছেলেবেলাতেই তাঁর ভেতর জনসেবার বীজ রোপণ করেছিলেন প্রতিবেশী জিতুদা জিতেন্দ্রনাথ রায়। পরে যিনি হয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী বিশুদ্ধানন্দ মহারাজ। এক কথায় তিনি ছিলেন কেশবচন্দ্রের মেন্টর। তাঁর প্রতিটি কথা জীবনভর মন্ত্রের মতো পালন করতেন কেশবচন্দ্র। তাঁর আয়োজনেই উপনিষদ, বেদ-বেদান্তের চর্চা। শ্রীশ্রীসারদামায়ের প্রত্যক্ষ শিষ্যত্বও নিয়েছিলেন কেশবচন্দ্র। সমাজসেবা আর অধ্যাত্মচিন্তা একযোগে চলেছে, শিক্ষকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরি ‘রত্ন-বেদী’-তে তিনি লিখে গিয়েছেন বহু কবিতা, ভক্তিমূলক গান। আবার একই সঙ্গে রয়েছে নানা ধরনের রসিকতার কথাও। ধর্ম, ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য যেখানে যে মন্তব্যটি মনে ধরেছে, টুকে রেখেছেন এই খাতায়। আর খাতার উপরে লিখে রেখেছেন ‘বিনা অনুমতিতে পাঠ নিষেধ’! ১৯২৫ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত টানা এই অভ্যাস চালিয়েছেন। এ ছাড়াও কেশবচন্দ্র বাংলায় অনুবাদ করেছেন স্বামী অভেদানন্দের বহু ইংরেজি বক্তৃতা। অনুবাদ করেছেন ভগিনী নিবেদিতার লেখাও।
গান্ধীজির ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনেও শামিল হয়েছিলেন কেশবচন্দ্র। তখন তিনি মিত্র ইনস্টিটিউশনে। তাঁর বই তত দিনে বাজারে ঝড় তুলে দিয়েছে। কিন্তু তিনি ফিরে এলেন গ্রামে। ধনেখালি থানা কংগ্রেসের তখন তিনি সভাপতি। চলল মিছিল, আন্দোলন। পুলিশ গ্রেপ্তার করল কেশবচন্দ্রকে। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দিন কাটতে লাগল জেলখানায়। গুজব রটল ইংরেজরা চাইছে কেশবচন্দ্রকে গুম করে দিতে! অবশেষে তিনি ছাড়া পেলেন বেশ কয়েক মাস পর। ফিরে এসে ফের যোগ দিলেন গান্ধীজির অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ আন্দোলনে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁকে সক্রিয় রাজনীতিতে আসার আহ্বান জানান। ভোটে দাঁড়াতে বলেন। সবিনয়ে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন কেশবচন্দ্র।
অঙ্কের মাস্টারমশাই মানেই রাগী, গম্ভীর, নীরস একটা অবয়ব মনে পড়ে সবার। কে সি নাগও কি তেমনই ছিলেন? বকুনি দিতেন? মারতেন? মিত্র ইন্সটিটিউশনের প্রাক্তনীদের স্মৃতিচারণে তাঁদের ‘স্যর’-এর বর্ণনা আছে। মোটা কালো ফ্রেমের চশমা চোখে, গায়ে আলোয়ান, খদ্দরের পাঞ্জাবি-ধুতিতে গটগট হাঁটতেন। ক্লাসে অঙ্ক না পারলে ‘গাধা’ সম্বোধন বিরল ছিল না, তা বলে পিঠে ধাঁইধপাধপ নয়। কারণ অঙ্ক কী কায়দায় শেখানো হচ্ছে তা তো বলাই হল! হেডমাস্টারের ঘর থেকে খেয়াল রাখতেন, পাশের মাঠে ফুটবল খেলতে গিয়ে কোন ছেলে কত কড়া ট্যাকল করছে। পরে ডেকে পাঠিয়ে অভিনব শাস্তি: স্কুলের পিছল উঠোন পরিষ্কার, দু’দিন প্যারালাল বার প্র্যাকটিস, বা জ্যামিতির রাইডার সল্ভ করতে হবে! ক্লাসে মাঝে মাঝে পাওয়া যেত তাঁর রসবোধের ঝলক। একটি বৃত্তের কেন্দ্র O থেকে বৃত্তের পরিধির উপরে একটি বিন্দু X পর্যন্ত রেখা টেনে জিজ্ঞেস করছেন, তা হলে এটা কী হল? ‘একটি ব্যাসার্ধ’, ‘OX ব্যাসার্ধ’, ‘কেন্দ্র O থেকে X বিন্দু পর্যন্ত OX ব্যাসার্ধ’, নানান উত্তর এল। কিছুতেই খুশি নন। বললেন, ‘‘O X যোগ করে হল অক্স, মানে ষাঁড়!’’ এক দিন ক্লাসে নিজের বইখানা ছাত্রদের দেখিয়ে বললেন, এই বইটা পাঁচ টাকায় বিক্রি করলে আমার কত লাভ থাকবে, বল। ছাত্ররা সবাই বইয়ের দাম জানে, তিন টাকা। সমস্বরে উত্তর, দু’টাকা লাভ! মাস্টারমশাই বললেন, হল না। পাঁচ টাকা। সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে, সে কী! ‘‘আমাকে তো আর বইটা কিনতে হয়নি, তাই পাঁচ টাকাই লাভ!’’ বলেই মুচকি হাসি। এক বাড়িতে ছাত্র পড়াচ্ছেন, ছেলেটির মাথায় কিছুতেই অঙ্ক ঢোকে না। পাশ দিয়ে ছাত্রের বাবা যাচ্ছিলেন, মাস্টারমশাইকে সৌজন্য-প্রশ্ন করলেন, ছাত্রের পড়াশোনা কেমন বুঝছেন? কেশবচন্দ্রের উত্তর, কালীপুজো আসছে, দেখবেন যেন এ বাইরে বেরিয়ে না যায়, মায়ের সামনে বলি দিয়ে দেবে! সহাস্য অভিভাবক মাস্টারমশাইকে ‘লাঠ্যৌষধি’র প্রয়োগ করতে বলে পা বাড়ালেন।
তাঁর ছাত্রদের তালিকাটা স্বভাবতই বেশ লম্বা। তারকাখচিতও বটে। চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। সুভাষ মুখোপাধ্যায়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বিকাশ রায়। রঞ্জিত মল্লিক। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘অনন্য কেশবচন্দ্র’ গ্রন্থে (চিত্তরঞ্জন ঘোষাল সম্পাদিত ও ‘গ্রন্থ সম্পুট’ প্রকাশিত) কলম ধরেছিলেন তাঁর এই সব কৃতী ছাত্ররা। নিজেদের মাঠে যাঁরা সব হিসেব এক্কেবারে মিলিয়ে দিয়েছেন। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘গণিতবিদ হয়েও বেদ-উপনিষদে কেশববাবুর যে টান, তাতেও এ দুইয়ের নিকটাত্মীয়তা স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে।’ সরোদিয়া বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বলছেন, ‘ছাত্রদের সাহায্য করতে (শুধু অঙ্কে নয়, যে কোনও ব্যাপারে) তাঁর দিনে রাত্রে কোনো সময়েই কিছুমাত্র অনাগ্রহ বা উদ্যমের অভাব ছিল না। এবং সে সাহায্যের মধ্যে কোনো দেনাপাওনার সম্পর্কের লেশমাত্র ছিল না।’ সংগীতশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘অবাক হয়েছিলাম, যাঁকে দেখে ভয় হোত, কড়া ধাতের মানুষ বলে মনে হোত সেই কেশববাবু স্যারই যখন গান করার উৎসাহ দিতেন আমাকে।’ তাঁকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর নিতে দেখেছেন অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিক। তিনি লিখছেন, ‘তাঁরই প্রেরণায় উপলব্ধি করলাম অঙ্ক কত সহজ অঙ্ক একটা ম্যাজিক অঙ্কের মধ্যেও সাহিত্য-শিল্প আছে।’ আবার গুড়াপ সুরেন্দ্র স্মৃতি পাঠাগারের স্মারকগ্রন্থে লিখছেন অভিনেতা বিকাশ রায় ‘মোটা চশমার আড়ালে গম্ভীর মুখের ছায়ায় একজোড়া সহানুভূতি-ভরা চোখ আমরা দেখেছিলাম, আমরা ভাল কিছু করতে পারলে সেই চোখে উৎসাহ জ্বলে উঠতো, আমাদের দুষ্টুমি দেখে সেই চোখে মৃদু ভর্ৎসনার সঙ্গে সামান্য indulgence ফুটে উঠতো।’
ঘরে ছেলে-বৌমা, নাতিনাতনিদের কাছের মানুষ। নাতনি রত্না বন্দ্যোপাধ্যায়ের কত যে সুখস্মৃতি দাদুকে ঘিরে! আদিগঙ্গার কাছে গোবিন্দ ঘোষাল লেনের বাড়িতে তখন ডিসি কারেন্ট। লোডশেডিং হত নিয়ম করে। কারেন্ট যাওয়া মানেই দাদুর কাছটি ঘেঁষে শুয়ে পড়া, ওঁর হাতপাখার বাতাস খাওয়া যাবে! মজার মজার গল্পও বলতেন। একটা হাতি কিছুতেই ঘুমোচ্ছে না, কে ঘুম পাড়াতে পারবে? একটা লোক এসে বলল, আমি পারব। ছ’টা টুল, ছ’টা লোক, ছ’টা বই চাই। গোল করে ছ’টা টুল পেতে, একটা করে লোক বসিয়ে দিল সে, তাদের হাতে ধরিয়ে দিল বই, বইয়ের পাতা বাইরের দিক করে খোলা। হাতি এল, ঘুরে ঘুরে সবার হাতে খোলা বইয়ের পাতা দেখল, তার পরেই ধপাস শুয়ে পড়ে ঘুম! খোলা বই দেখলেই সব্বার ঘুম আসে, এ তো জানা। হাতি কোন ছার!
এ এক অন্য কে সি নাগ। ইনি উত্তম-সুচিত্রার ছবির ভক্ত, নাতনিকে নিয়ে হল-এ গিয়ে ছবি দেখে আসেন। কেশবচন্দ্রের আরও এক আগ্রহের জায়গা ছিল খেলার মাঠ। ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস সবেতেই সমান আগ্রহ। মোহনবাগান ক্লাবের কট্টর সমর্থক। ওঁর আর এক নাতি সংবাদমাধ্যমে স্মৃতিচারণে জানিয়েছিলেন, মোহনবাগান ক্লাবের আজীবন সদস্যতালিকায় এক নম্বরে গোষ্ঠ পাল, আর দ্বিতীয় নামটা জানেন? কেশবচন্দ্র নাগ! মারাদোনাকে নিয়ে যে বার বিশ্বকাপে হইহই, নাতির হাতে চেক লিখে দিলেন, দোকান থেকে নতুন টিভি কিনে আনার জন্য। এক পুত্রবধূ সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, এমনও হয়েছে, মোহনবাগান ম্যাচ হারলে সে রাতে না খেয়েই শুয়ে পড়েছেন। বয়সকালে মাঠে যেতে পারতেন না, রেডিয়োয় সম্প্রচার শুনতেন। আর পাটিগণিত থেকে শিফ্ট করে যেতেন জ্যামিতিতে! রিলে শুনতে শুনতেই কাগজে আঁক কেটে বুঝতেন ও বুঝিয়ে দিতেন মাঠের এক একটা মুভমেন্ট।
তিনি মিষ্টি খেতে ভালবাসতেন, গজা খুব প্রিয় ছিল। রথের দিন জন্মেছিলেন, প্রতি বছর রথে সন্ধেয় নাগবাড়ির ঘরোয়া স্মরণসভা শেষে আজও সবার জন্য একটা করে গজা বাঁধা। জন্মদিনে ওঁর ছাত্রেরা আসতেন বাড়িতে। অভিনেতা বিকাশ রায় আসতেন গোলাপের তোড়া নিয়ে। যত বছরের জন্মদিন, ততগুলো গোলাপ। তাঁর ছাত্রতালিকায় আছেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সকলের স্মৃতিময় লেখাপত্তরে ভরে আছে মাস্টারমশাইয়ের কথা।
যশোবৃত্তের বাইরে, অন্তরঙ্গ পারিবারিকতা পেরিয়েও তো আর একটা মানুষ থাকে। ভিতরের মানুষ। সেই কে সি নাগকে জানলে বিস্ময়ের সীমা থাকে না। মা সারদার কাছে মন্ত্রদীক্ষা পেয়েছিলেন তিনি। মায়ের জপ করে দেওয়া মালা, কাপড়ের উপরে আলতা বুলিয়ে নেওয়া পদচিহ্ন ছিল তাঁর সারা জীবনের সম্পদ। জপ করতেন রোজ। গুড়াপের প্রতিবেশী জিতেন্দ্রনাথ রায়— পরবর্তী কালে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অষ্টম অধ্যক্ষ স্বামী বিশুদ্ধানন্দ— ছিলেন তাঁর ফ্রেন্ড ফিলসফার অ্যান্ড গাইড। তরুণ কেশবকে তিনিই দেখিয়েছিলেন কর্মযোগের দিশা। স্কুল, লাইব্রেরি, রাস্তা, সেবা সংস্থা তৈরি করে কেশবচন্দ্র পাল্টে দিয়েছেন গুড়াপকে। দুজনের মধ্যে অসংখ্য পত্রবিনিময় কেশবের অধ্যাত্মজীবনের সাক্ষী। বিবেকানন্দের আর এক গুরুভাই, স্বামী অভেদানন্দের স্নেহভাজন ছিলেন কেশবচন্দ্র। ওঁর বক্তৃতার নোট নেওয়া, বঙ্গানুবাদের কাজও করেছেন। অনুবাদ করেছেন ভগিনী নিবেদিতার ‘শিব ও বুদ্ধ’! আর ছিল নিজের এক খাতা। নাম ‘রত্নবেদী’। খুলতেই প্রথম পাতায় কয়েক লাইনের স্বরচিত কবিতা, নীচে লেখা ‘বিনা অনুমতিতে প্রাইভেট পাঠ নিষিদ্ধ’। ওঁর পরিবারের অনুমতিক্রমে হাতে নিয়ে দেখেছি সেই খাতা। পাতায় পাতায় গীতা, চণ্ডী, শিবস্তোত্র, রামনাম, খণ্ডনভববন্ধন, শ্রীমাকে নিয়ে লেখা কবিতা ‘টু মাদার্স ফিট’, ‘নৈবেদ্য ও কালীপূজার দ্রব্যাদি’, বেদান্তদর্শন। তারই পাশে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের বক্তৃতা, ‘দার্শনিক বঙ্কিমচন্দ্র’, ‘ফিলসফি অব রবীন্দ্রনাথ’, বিপিনচন্দ্র পালের ‘দ্য সোল অব ইন্ডিয়া’, ‘লেকচার নোটস’। বুঝ মন যে জান সন্ধান!
আর কষ্ট, যন্ত্রণা? ত্রিদিবেশের জন্মের আগেই মারা যান তারাপ্রসাদ নাগ, কেশবচন্দ্রের ছোট ছেলে। যশস্বী মানুষটিকে ছেড়ে কথা বলেনি পুত্রশোক। তার বছরখানেকের মধ্যেই মারা যান স্ত্রী লক্ষ্মীমণি, যিনি সংসার সামলাতেন বলে স্কুল, বই লেখা আর হাজারটা কাজ করতে পেরেছেন কাজপাগল শিক্ষক। স্ত্রীর মৃত্যুর পর বলেছিলেন, আই লস্ট মাই ফ্রেন্ড। ব্যক্তিগত বেদনাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন বলেই এক-এক জন মানুষ বুঝি সমষ্টির হয়ে যান। কে সি নাগ যেমন হয়ে উঠেছেন গোটা বাঙালি জাতির অঙ্কের মাস্টারমশাই। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ছাত্রদের, অন্য মানুষেরও। রসা রোডের মেসে থাকার সময় খেতেন জগদ্বন্ধু ভোজনালয়ে, তার মালিক আঁক কষায় দড় নয় বলে পাইকাররা টাকায় জল মেশাত। তাকেও হিসেব করা শিখিয়ে দিয়েছিলেন। আর কেউ ঠকাতে পারেনি। সেই মালিকের ছেলে, হোটেলের বর্তমান মালিকও মাথায় হাত ঠেকান ‘মাস্টারবাবু’র নামে। তাঁর জীবনের অঙ্কও যে মিলিয়ে দিয়েছেন কে সি নাগ। রাত পোহালে কাল মাধ্যমিকের অঙ্ক পরীক্ষা, ও সব প্রশ্ন তো জলভাত!
১লা ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫ সাল। রেডিয়োয় চলছে ক্রিকেটের ধারাবিবরণী। কানপুরে সেদিন ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট চলছিল। কেরিয়ারের শুরুতেই তিন নম্বর সেঞ্চুরিটি হাঁকাচ্ছিলেন মহম্মদ আজহারউদ্দিন। টানটান রোমাঞ্চ। উত্তেজনায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কেশবচন্দ্র। সেরিব্রাল। আরও দু’বছর পর থেমে গেল সব অঙ্ক। দিনটা ছিল ৬ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭ সাল।
আমি-আপনিও কি কে সি নাগের ছাত্র নই? কে সি নাগ বহু মানুষের কৈশোরের এক অনিবার্য স্মৃতি। এক আইকন। তিনিই আমাদের পাঠ্যক্রমের একমাত্র অরণ্যদেব। অথচ বইয়ের টাইটেল পেজে নামের পাশে ডিগ্রি লিখতেন না তিনি। আজও তাঁর বই বিক্রি থেকে প্রাপ্ত রয়্যালটির টাকার একটা বড় অংশ চলে যায় দুটি চ্যারিটি ফান্ডে। একটি তাঁর নিজের নামে, অন্যটি তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মীমণির নামে। এখনও প্রতি বছর তাঁর জন্মদিন পালন করা হয় গুড়াপে। তাঁরই প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের উদ্যোগে। আয়োজিত হয় কেশবচন্দ্র নাগ স্মারক বক্তৃতা। কিন্তু সে খবর আমরা ক’জন রাখি? ক’টা টিভি ক্যামেরা যায় সেখানে? হরিশ চ্যাটাজির্ স্ট্রিট থেকে জাস্ট দু’পা হাঁটলেই কে সি নাগের কলকাতার বাড়ি। এই পাড়ার এককালের অখ্যাত, আজ বিখ্যাত আর বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ নামে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মেয়েটিও আগে জন্মদিনে প্রণাম করে যেতেন বৃদ্ধ কে সি নাগ’কে, আজও তিনি প্রণাম জানিয়ে যান সকলের অজান্তে – সংবাদমাধ্যমে বলছিলেন তাঁর বড় ছেলে দেবীপ্রসাদ নাগ। এখন মেয়েটি ইচ্ছে করলেই হয়তো মানুষটির স্মৃতি উদযাপনে অনেক কিছু করতে পারেন।
আমাদের অবশ্য প্রণাম-ট্রনাম খুব ভাল আসে না। পাটিগণিতের মতোই, বেশ গুলিয়ে গেছে। এই নল দিয়ে ঢুকছিল শ্রদ্ধা ও মূল্যবোধ আর ওই নল দিয়ে খরচ করে ফেলছিলাম ফুর্তিময় বিন্দাস মুহূর্ত, হাতে রইল যেন কী?
(তথ্যসূত্র:
১- অনন্য কেশবচন্দ্র, চিত্তরঞ্জন ঘোষাল সম্পাদিত, গ্রন্থ সম্পুট (১৯৮৫)।
২- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৪ই জুলাই ২০১৩ সাল।
৩- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ই ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত