আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ভারতের অর্থনীতিকে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার বুলি আউড়িয়ে দেশবাসীকে যে স্বপ্নের ফানুসে চড়িয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, এক বছর পেরনোর আগেই যে তা ফুটো হয়ে গিয়েছে, সে কথা স্পষ্ট। কারণ প্রায় রোজদিনই তলানিতে নামার নতুন নতুন রেকর্ড করে চলেছে দেশের অর্থনীতি। এই আবহেই শনিবার সংসদে বাজেট পেশ করেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ। যেখানে ব্যাঙ্ক আমানতে বিমার পরিমাণ ১ লক্ষ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ লক্ষ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি।
তবে সেটা হলে, গত বছর মহারাষ্ট্রের পিএমসি সমবায় ব্যাঙ্ক অথবা ২০১৩ সালে গ্লোবাল ট্রাস্ট ব্যাঙ্কের গণেশ ওল্টানোর মতো ঘটনায় আমানতকারীদের আমানত সর্বাধিক ৫ লক্ষ টাকা অবধি সুরক্ষিত হবে ঠিকই কিন্তু ওই বিমার জন্য খরচ বইতে হতে পারে আমানতকারীদেরই। আর ব্যাঙ্ক আমানতে বিমার পরিমাণ বাড়ানোর ফলে ব্যাঙ্কগুলিকে যে বর্ধিত প্রিমিয়াম দিতে হবে সেটা তারা গ্রাহকদের উপরেই চাপাবে সন্দেহ নেই।
প্রসঙ্গত, ২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রতি ১০০ টাকা আমানতের বিমার জন্য ব্যাঙ্কগুলিকে ৮ পয়সা হিসাবে প্রিমিয়াম দিতে হত। তারপর তা বাড়িয়ে বর্তমানে ১০০ টাকায় ১০ পয়সা করা হয়েছে। সেই হিসাবে প্রতি ১ লক্ষ টাকা বিমার উপর ১০০ টাকা প্রিমিয়াম দিতে হয় ব্যাঙ্কগুলিকে। বিমার পরিমাণ ১ লক্ষ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ লক্ষ টাকা করা হলে ওই প্রিমিয়াম খাতে ব্যাঙ্কগুলির খরচ পাঁচগুণ বাড়বে।
কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতেই বর্তমানে মোট ৮০ কোটি ২৫ লক্ষ গ্রাহক রয়েছেন। এই হিসাবে ব্যাঙ্কগুলিকে প্রতি বছর প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা থেকে ৮ হাজার কোটি টাকার প্রিমিয়াম দিতে হয়। বিমার পরিমাণ ৫ লক্ষ টাকা হলে এই প্রিমিয়ামও বেড়ে প্রায় ৩৫,০০০ কোটি টাকা হবে বলে ব্যাঙ্কগুলির ধারণা। উপদেষ্টা সংস্থা ক্রেডিট স্যুইসের অনুমান, এর ফলে ব্যাঙ্কগুলিকে অতিরিক্ত ২৮,৪০০ কোটি টাকা প্রিমিয়ামের বোঝা বইতে হবে। কেবল ডিপোজিট ইনসিওরেন্স অ্যান্ড ক্রেডিট গ্যারান্টি কর্পোরেশনই (ডিআইসিজিসি) এই বিমা করে।
২০১৮-১৯ অর্থবর্ষে ব্যাঙ্কগুলি আমানতের বিমার প্রিমিয়াম বাবদ ডিআইসিজিসিকে ১২,০৪৩ কোটি টাকা দিয়েছিল। ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে ওই পরিমাণ ছিল ১১,১২৮ কোটি টাকা। কলকাতায় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এক আধিকারিকের কথায়, ‘কেন্দ্র বিমার পরিমাণ বাড়ালেও তা অন্য দেশের তুলনায় অনেকটাই কম। কাজেই এতে গ্রাহকদের আদৌ কতটা ভালো হল সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে, দীর্ঘ ২৭ বছর পর এই বৃদ্ধি তাৎপর্যপূর্ণ।’ রাষ্ট্রায়ত্ত এবং বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলি বিভিন্ন চার্জ বাড়িয়ে এই টাকা তোলার চেষ্টা করলেও সুদের হার কমানোর পথে আর হাঁটবে না বলেই তাঁর মত।
ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার (ইউবিআই) এক আধিকারিক নাম উল্লেখ না করার শর্তে বলেন, ‘বাজেটে কেন্দ্র অতিরিক্ত ঋণ নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। তা হলে বাজারে টাকা কমবে। তার জোগান দিতে ব্যাঙ্কগুলিকে হয়তো আমানতে সুদ বাড়াতে হতে পারে। এখনও এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া না হলেও সে রকমই ইঙ্গিত মিলছে। আমানতে সুদ বাড়ানো হলে, ব্যাঙ্কগুলির খরচ বাড়বে। তার উপর বর্ধিত প্রিমিয়ামের বোঝা চাপলে স্বাভাবিক ভাবেই তা গ্রাহকদের কাছ থেকেই ঘুরপথে তোলার ভাবনা করবে ব্যাঙ্কগুলি। সে ক্ষেত্রে আরবিআই-এর নির্দেশিকা মেনে যে ক্ষেত্রগুলিতে চার্জ বাড়ানো সম্ভব, তা বাড়ানো হতে পারে।’
বিষয়টি সম্পর্কে সহমত এলাহাবাদ ব্যাঙ্ক এবং সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার দুই আধিকারিকও। যদিও এ বিষয়ে কিছুটা রক্ষণাত্মক ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্ক। কলকাতায় ব্যাঙ্কটির এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘আমানতে বিমার পরিমাণ বাড়ানোর ফলে আরও বেশি সংখ্যক মানুষ ব্যাঙ্কে টাকা রাখায় নিশ্চিন্ত বোধ করবেন। এর ফলে ব্যাঙ্ক আমানত বাড়বে।’ তবে তিনি মনে করেন, ন্যূনতম ব্যালান্স বাড়ানোর পথে হাঁটবে না ব্যাঙ্কগুলি। কেননা, ন্যূনতম ব্যালান্সের পরিমাণ বাড়ালে ব্যাঙ্কগুলিকে গ্রাহকদের অসন্তোষের মুখে পড়তে হবে।