সরস্বতী হলেন জ্ঞান, সংগীত, শিল্পকলা, বুদ্ধি ও বিদ্যার হিন্দু দেবী। তিনি সরস্বতী-লক্ষ্মী-পার্বতী এই ত্রিদেবীর অন্যতম। এই ত্রিদেবীর কাজ হল ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবকে যথাক্রমে জগৎ সৃষ্টি পালন করতে সাহায্য করা। সরস্বতীর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদে। বৈদিক যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত তিনি হিন্দুধর্মের একজন গুরুত্বপূর্ণ দেবী। হিন্দুরা বসন্তপঞ্চমী (মাঘ মাসের শুক্লাপঞ্চমী তিথি) তিথিতে সরস্বতী পূজা করে। এই দিন ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের হাতেখড়ি হয়। বৌদ্ধ ও পশ্চিম ও মধ্য ভারতে জৈনরাও সরস্বতীর পূজা করেন। জ্ঞান, সংগীত ও শিল্পকলার দেবী হিসেবে ভারতের বাইরে জাপান, ভিয়েতনাম, বালি (ইন্দোনেশিয়া) ও মায়ানমারেও সরস্বতী পূজার চল আছে।
কলার দেবী তাই প্রায় সব বিদ্যায়তনেই সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে তবে সাধারণত সব বাড়িতেই সরস্বতী পূজার প্রচলন আছে। কেউ সরস্বতীর মূর্তি পূজা করেন, কেউ ছবিতে। দেবী সরস্বতীর মূর্তি আমরা যা দেখি, তা হল দেবী শ্বেতবসনা,এক হাতে বীণা, অন্য হাতে বরাভয় মুদ্রা, দেবীর বাহন রাজহাঁস। ভারতীয় পুরাণ-সংস্কৃতিতে সরস্বতী বহুমাত্রিক দেবী হিসাবে পরিচিত। আদিতে সরস্বতীর পরিচয় ছিল উত্তর ভারতের সপ্তনদীর (গঙ্গা, যমুনা, শতদ্রু, বিপাশা, ইরাবতী, চন্দ্রভাগা ও সরস্বতী) অন্যতমা সরস্বতী নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসাবে। পরবর্তীকালে সেই নদীর দেবতা কী ভাবে শিক্ষা ও সংস্কৃতির অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসাবে পরিচিতি লাভ করল, তা খুবই বিস্ময়ের!
প্রথমে দেখা যাক বিভিন্ন পুরাণগ্রন্থ সরস্বতীর উৎস সম্পর্কে কী বলছে। পদ্মপুরাণে সরস্বতী দক্ষকন্যা এবং কশ্যপ-পত্নী হিসাবে স্বীকৃত। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুসারে সরস্বতী বিষ্ণু বা নারায়ণের পত্নী। কিন্তু পদ্মপুরাণে তিনি কশ্যপ মুণির পত্নী। শিবপুরাণ আর স্কন্ধপুরাণ মতে সরস্বতী আবার শিবেরও পত্নী । ঋগ্বেদ-পরবর্তী হিন্দু শাস্ত্র আলোচনায় সরস্বতী ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর এই ত্রিদেব-এর পত্নী রূপে বর্ণিত হলেও, অধিক প্রচলিত মতে তিনি নারায়ণ-পত্নী।
কোনও কোনও আলোচনায় দেখা যায়, বিষ্ণু বা নারায়ণের তিন স্ত্রী হলেন গঙ্গা, লক্ষ্মী ও সরস্বতী। বিহারীলাল চক্রবর্তী ‘সারদামঙ্গল’ কাব্যে লিখেছেন, ‘‘তুমি লক্ষ্মী-সরস্বতী আমি ব্রহ্মাণ্ডের পতি। হোক গে বসুমতী, যার খুশি তার’’। কিন্তু ‘অতি পবিত্রতার’ কারণে গঙ্গা এবং বিদ্যাবত্তার কারণে সরস্বতী নারায়ণের হৃদয় জয় করতে অসমর্থ হলে বিষ্ণু তাঁদের দু’জনকে যথাক্রমে মহাদেব ও ব্রহ্মাকে দান করে দেন।
স্কন্দপুরাণ অনুসারে, ব্রহ্মা তার কন্যা সরস্বতীর প্রতি দুর্ব্যবহার করলে শিব তাকে শরবিদ্ধ করে হত্যা করেন। তখন ব্রহ্মার পত্নী গায়ত্রী কন্যা সরস্বতীকে নিয়ে স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে আনার জন্য গন্ধমাদন পর্বতে তপস্যা শুরু করেন। তাদের দীর্ঘ তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে শিব ব্রহ্মার প্রাণ ফিরিয়ে দেন। সেই থেকে শিবের নির্দেশে গায়ত্রী ও সরস্বতীর তপস্যাস্থলে দুটি প্রসিদ্ধ তীর্থ সৃষ্টি হয়।
জগতে সকল দেবতা তীর্থ আছে, শুধু ব্রহ্মার তীর্থ নেই – একথা ভেবে ব্রহ্মা পৃথিবীতে নিজের তীর্থ স্থাপনে উদ্যোগী হলেন। তিনি একটি সর্বরত্নময়ী শিলা পৃথিবীতে নিক্ষেপ করলেন। সেটি চমৎকারপুরে এসে পড়ল। ব্রহ্মা সেখানেই নিজের তীর্থ স্থাপন করবেন বলে ভাবলেন। ব্রহ্মার নির্দেশে সরস্বতী পাতাল থেকে উঠে এলেন। ব্রহ্মা তাকে বললেন, “তুমি এখানে আমার কাছে সব সময় থাকো। আমি তোমার জলে ত্রিসন্ধ্যা তর্পণ করব।” সরস্বতী ভয় পেয়ে বললেন, “আমি লোকের স্পর্শ ভয় পাই বলে সব সময় পাতালে থাকি। কিন্তু আপনার আদেশ আমি অমান্যও করতে পারি না। আপনি সব দিক বিচার করে একটি ব্যবস্থা করুন।” তখন ব্রহ্মা সরস্বতীর অবস্থানের জন্য একটি হ্রদ খনন করলেন। সরস্বতী সেই হ্রদে অবস্থান করতে লাগলেন। ব্রহ্মা ভয়ংকর সাপেদের সেই হ্রদ ও সরস্বতীর রক্ষক নিযুক্ত করলেন।
অনেক পরবর্তীকালে রচিত ‘মৎস্যপুরাণ’ অনুসারে, পরমাত্মার মুখনিঃসৃত শক্তিগুলির মধ্যে সরস্বতী সর্বশ্রেষ্ঠা । তিনি রূপে দেবীর ন্যায় পরমা সুন্দরী । মহাশ্বেতা (সর্বশুক্ল বা যার সর্বাঙ্গ শ্বেত বর্ণের) ও বীণাবাদিনী । সরস্বতী সম্পর্কে যত পুরাণ-কাহিনি পাওয়া যায়, সেগুলি থেকে, আর যাই হোক, বিদ্যার দেবীকে চরিত্রগত ভাবে শুদ্ধ বলা যায় না ! তাঁর জন্ম, প্রণয়, বিবাহ, যৌনজীবন সব কিছুই খুব জটিল সম্পর্কের আবর্তে ঘূর্ণায়মান। সরস্বতী বিদ্যা ও সংস্কৃতির দেবী হলেও প্রণয়ের ব্যাপারে তিনি খুব একটা সুনামের অধিকারিণী নন।
আবার বিভিন্ন উপপুরাণে দেবী সরস্বতীকে নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন কাহনী বর্ণিত হয়েছে।
দেবীভাগবত পুরাণ অনুসারে, দেবী আদ্যাপ্রকৃতির তৃতীয় অংশে দেবী সরস্বতীর জন্ম। তিনি কৃষ্ণের জিহ্বাগ্র থেকে উৎপন্ন হয়েছেন। সরস্বতী বাক্য, বুদ্ধি, বিদ্যা ও জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী; সকল সংশয় ছেদকারিণী ও সর্বসিদ্ধিপ্রদায়িনী এবং বিশ্বের উপজীবিকা স্বরূপিনী। ব্রহ্মা প্রথম তাকে পূজা করেন। পরে জগতে তার পূজা প্রতিষ্ঠিত হয়। সরস্বতী শুক্লবর্ণা, পীতবস্ত্রধারিণী এবং বীণা ও পুস্তকহস্তা। তিনি নারায়ণের অন্যতম পত্নী হয়েছিলেন। তারপর কৃষ্ণ জগতে তার পূজা প্রবর্তন করেন মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে তার পূজা হয়।
গঙ্গা, লক্ষ্মী ও সরস্বতী ছিলেন নারায়ণের তিন পত্নী। একবার গঙ্গা ও নারায়ণ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসলে, তিন দেবীর মধ্যে তুমুল বিবাদ উপস্থিত হয়। এই বিবাদের পরিণামে একে অপরকে অভিশাপ দেন। গঙ্গার অভিশাপে সরস্বতী নদীতে পরিণত হন। পরে নারায়ণ বিধান দেন যে, সরস্বতী এক অংশে নদী, এক অংশে ব্রহ্মার পত্নী ও এক অংশে তার সঙ্গিনী হবেন এবং কলিযুগের পাঁচ হাজার বছর অতিক্রান্ত হলে সরস্বতী সহ তিন দেবীরই শাপমোচন হবে।
গঙ্গার অভিশাপে সরস্বতী মর্ত্যে নদী হলেনে এবং ব্রহ্মার প্রিয়তমা পত্নী ব্রাহ্মী হলেন।
শুম্ভ ও নিশুম্ভ অসুরদ্বয়কে বধ করার সময় দেবী দুর্গার শরীর থেকে যে কৌশিকী দেবীর উৎপত্তি হয়েছিল, তার অপর নাম সরস্বতী।
ওদিকে “শুক্ল যজুর্বেদ” অনুসারে, একসময় ইন্দ্রের শরীরের শক্তি চলে যাওয়ার ফলে তিনি মেষ আকৃতি গ্রহণ করেন। সেসময় ইন্দ্রের চিকিৎসার দায়িত্ব ছিল স্বর্গের অশ্বিনীদ্বয়ের উপর এবং সেবা-শুশ্রুষার ভার ছিল সরস্বতীর হাতে। সংগীত ও নৃত্যপ্রেমী ইন্দ্র সরস্বতীর গানবাজনা ও সেবায় সুস্থ হওয়ার পর তাকে মেষটি দান করেন।
রামায়ণ রচয়িতা বাল্মীকি যখন ক্রৌঞ্চ হননের শোকে বিহবল হয়ে পড়েছিলেন, সে সময় জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী তার ললাটে বিদ্যুৎ রেখার মত প্রকাশিত হয়েছিলেন।
‘সরস + বতী’ = ‘সরস্বতী’ অর্থ জ্যোতিময়ী। ঋগ্বেদে এবং যর্জুবেদে অনেকবার ইড়া, ভারতী, সরস্বতীকে একসঙ্গে দেখা যায়। বেদের মন্ত্রগুলো পর্যালোচনায় প্রতীতী জন্মে যে, সরস্বতী মূলত সূর্যাগ্নি।
শুধু হিন্দু ধর্মেই নয়, তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মেও দেবী সরস্বতীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এখানে সরস্বতীর রূপ ও আয়ুধের কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। বৌদ্ধ সাধনমালায় দ্বিভুজা সরস্বতীর চার প্রকার ধ্যান আছে, ‘মহাসরস্বতী’, ‘বজ্রবীণা সরস্বতী’, ‘বজ্রসারদা‘ ও ‘আর্যা সরস্বতী’। মহাসরস্বতী শুভ্র বসনা, শ্বেত পদ্মের উপর দেবী আসীন, দেবীর ডান হাতে বরদমুদ্রা, বাম হাতে সনাল শ্বেত পদ্ম। বজ্রবীণা সরস্বতীও দ্বিভুজা, শ্বেতবর্ণা আর দুই হাতে বীণা ধরে আছেন। মহাসরস্বতীর সঙ্গে বজ্রবীণা সরস্বতীর অনেকটাই মিল দেখা যায়। বৌদ্ধ সাধনমালা অনুযায়ী বজ্রসারদা দ্বিভুজা, পদ্মাসীনা এবং ত্রিনেত্রা; এক হাতে পদ্ম অন্য হাতে পুস্তক। আর্যা সরস্বতী ষোড়শী বালিকার মত উদ্ভিন্নযৌবনা, শ্বেতবর্ণা। ডানহাতে রক্ত পদ্ম ও বাম হাতে সনাল পদ্ম এবং প্রজ্ঞাপারমিতা পুস্তক।
বজ্র সরস্বতী, সরস্বতীর আরেকটি রূপ। বজ্রসরস্বতী রক্তবর্ণা,ত্রিমস্তকযুক্ত, ষড়ভুজা- নীল ও সাদা রঙের তিনটি মুখ। পালযুগের একটি বীণাবাদিনী সরস্বতীর মূর্তি পাওয়া গেছে যেটি বৌদ্ধ সরস্বতীর একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন। এছাড়া পাত্র ও পদ্ম হাতে নালন্দার ব্রোঞ্জের মুর্তি টিও খুবই উল্লেখযোগ্য, এটি নবম শতাব্দীর তৈরি। বিদ্যার দেবী সরস্বতী জৈনদেরও একজন প্রধান দেবী। জৈনরা সরস্বতী কে শ্রুতদেবী নামে অভিহিত করেছেন। মথুরার কঙ্কালটিলায় একটি মস্তকবিহীন (ভাঙ্গা) জৈন দেবী সরস্বতীর একটি মূর্তি পাওয়া গেছে। হিন্দু ধর্মের গণ্ডি অতিক্রম করে দেবী সরস্বতী বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মেও প্রবেশ করেছেন, কিন্তু সব ধর্মেই সরস্বতীকে বিদ্যার দেবী রূপেই দেখা যায়।
শুধুমাত্র ভারতবর্ষেই নয়, দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতেও ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতি বিশেষ ভাবে বিস্তার লাভ করেছিল। সরস্বতী আরাধনার নিদর্শন হিসেবে এখান থেকে দুটি সরস্বতী মূর্তি উদ্ধার হয়েছে। চিনে সরস্বতী ‘তিয়েন-মু‘ (Tien-mu) নামে ও জাপানে সরস্বতী ‘বেনতেন‘ নামে পরিচিত। তিব্বতে যেসব সরস্বতীর নিদর্শন পাওয়া গেছে তার অধিকাংশ দেখা গেছে দেবী ময়ূরবাহনা। রাশিয়ার লেনিনগ্রাদ মিউজিয়ামেও একটি সরস্বতী মূর্তি পাওয়া গেছে, মায়ানমারে ত্রিপিটক রক্ষার দেবী হলেন সরস্বতী।
এদিকে তিনি যেমন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দেবী, তেমনই তিনি আমাদের অন্তঃস্থ শক্তির প্রতীক৷ আবার তিনিই হারিয়ে যাওয়া নদী৷ ভারতীয় পুরাণ ও ইতিহাসে এভাবেই মিলেমিশে আছেন সরস্বতী৷
সরস্বতী শব্দের মধ্যেই এই দু’ধরনের অর্থের দেখা মেলে৷ প্রথমত, ‘স্ব’ অর্থাৎ আমাদের অন্তঃস্থ শক্তির ‘সার’৷ তা থেকেই সরস্বতী৷ আবার ‘সরস বতী’ রূপেও সরস্বতী শব্দের ব্যাখ্যা করেন অনেকে৷ সরস্বতী তাই একাধারে নদী ও দেবী দুইই৷
ঋকবেদেই প্রথম সরস্বতী শব্দের উল্লেখ মেলে৷ গায়ত্রী ছন্দে বাঁধা সে সূক্তটি এরকম-
“পাবকা নঃ সরস্বতী বাজেভির্বাজিনীবতী।
যজ্ঞং বষ্টু-ধিয়াবসুঃ।।
চোদয়িত্রী সূনৃতানাম্ চেতন্তী সুমতীনাম্।
যজ্ঞং দধে সরস্বতী।।
মহো অর্ণঃ সরস্বতী প্রচেতয়তি কেতুনা ধিয়ো বিশ্বা বিরাজতি।।”
এখানে সরস্বতীকে অন্নদাত্রী, শিক্ষয়িত্রী, জ্ঞানদাত্রী ও জলদাত্রী হিসেবেই বর্ণনা করা হয়েছে৷ অধুনা অবলুপ্ত বৈদিক নদী সরস্বতীর ধারণা আমরা এখান থেকেই পেয়ে যাই৷ বৈদিক সভ্যতার ভিত্তি ছিল এই নদীর জলরাশিই৷ কিন্তু কালক্রমে তা হারিয়ে যায়৷ বস্তুত সিন্ধু সভ্যতাও সরস্বতীর জলেই পুষ্ট হয়েছিল৷ আজ যে যমুনাকে আমরা দেখি, তা এককালে সরস্বতীরই উপনদী ছিল৷ আমরা স্মরণ করতে পারি, কৃষ্ণের দাদা বলরাম একবার যমুনাকে আকর্ষণ করেছিলেন৷ পৌরাণিক এ কাহিনীর ভিতর থেকে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট৷ বড়সড় কোনও পরিবর্তনের জেরেই রাজস্থানের কোনও গ্রামের কাছে হারিয়ে যায় সরস্বতীর পথ৷ তবে অন্তঃসলিলা হয়ে সরস্বতী আজও বয়ে চলে বলে অনেকের ধারণা৷ সরস্বতী নদী যে ছিল এ নিয়ে আজ আর কোনও সংশয় নেই৷ দীর্ঘ গবেষণায় তা প্রমাণিত হয়েছে৷
বৈদিক সভ্যতা যত সরস্বতীর জলরাশির আশীর্বাদ পেয়েছে, ততই দেবীর মাহাত্ম্য পেয়েছেন সরস্বতী৷ তাঁকে সভ্যতার ধাত্রী, জ্ঞানদায়িনী হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে৷ কখনও বলা হয়েছে তিনি ব্রহ্মার মানসপুত্র৷ ব্রহ্মা স্বয়ং এই জগৎ সৃষ্টি করেছে সরস্বতীকে সঙ্গে নিয়ে৷ বিপুলা জলরাশির নদী ছাড়া যে সভ্যতা গড়ে উঠতে পারে না তা সহজেই অনুমেয়৷ আবার কখনও সরস্বতীকে ব্রহ্মার স্ত্রী হিসেবেও কল্পনা করা হয়েছে৷ জানা যায়, সরস্বতী বিষ্ণুরই স্ত্রী ছিলেন৷ কিন্তু লক্ষ্মী-সরস্বতী ও বিষ্ণুর অন্য স্ত্রীর মধ্যে কলহ লেগে থাকত৷ আর তাই বিষ্ণু সরস্বতীকে ব্রহ্মার হাতে তুলে দেন৷ কলহ তো নেহাতই ছুতো৷ আসলে লক্ষ্মী ও সরস্বতী- অর্থ ও প্রজ্ঞা- দুয়ে মিলেই যে সভ্যতার উণ্মেষ, এ কাহিনী যেন তারই ইঙ্গিত দেয়৷
দেবীমাহাত্ম্য থেকে হারানো নদীর রহস্য- সব মিলিয়ে সরস্বতী আজও রহস্যাবৃতাই৷ একই সঙ্গে গবেষকদের কাছে কৌতূহলেরও৷ বৈদিক সরস্বতী নদী ছাড়া এক সরস্বতী নদী আছে এ বাংলাতেও৷
এবারে দেবী সরস্বতীর রূপটি (মূর্তিকল্প) ঠিক কেমন সেদিকে নজর দেওয়া যাক। এক্ষেত্রেও বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থ, শাস্ত্র, পুরান ও উপপুরানে বিভিন্ন রকমের বর্ণনা রয়েছে।
দেবীর ধ্যানমন্ত্রে বর্ণিত প্রতিমাকল্পটিতে দেবী সরস্বতীকে শ্বেতবর্ণা, শ্বেত পদ্মে আসীনা, মুক্তার হারে ভুষিতা, পদ্মলোচনা ও বীণাপুস্তকধারিণী এক দিব্য নারীমূর্তিরূপে কল্পনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে,
‘ওঁ তরুণশকলমিন্দোর্বিভ্রতী শুভ্রকান্তিঃ কুচভরনমিতাঙ্গী সন্নিষণ্ণা সিতাব্জে।
নিজকরকমলোদ্যল্লেখনীপুস্তকশ্রীঃ সকলবিভবসিদ্ধৈ পাতু বাগ্দেবতা নঃ।।’
অর্থাৎ, “চন্দ্রের নূতন কলাধারিণী, শুভ্রকান্তি, কুচভরনমিতাঙ্গী, শ্বেত পদ্মাসনে (উত্তমরূপে) আসীনা, হস্তে ধৃত লেখনী ও পুস্তকের দ্বারা শোভমানা বাগ্দেবী সকল বিভবপ্রাপ্তির জন্য আমাদিগকে রক্ষা করুন।”
আবার পদ্মপুরাণ-এ উল্লিখিত সরস্বতীস্তোত্রম্-এ বর্ণিত হয়েছে,
‘শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেতপুষ্পোপশোভিতা।
শ্বেতাম্বরধরা নিত্যা শ্বেতগন্ধানুলেপনা।।১
শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চিতা।
শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারভূষিতা।।২’ … ইত্যাদি
অর্থাৎ, “দেবী সরস্বতী আদ্যন্তবিহীনা, শ্বেতপদ্মে আসীনা, শ্বেতপুষ্পে শোভিতা, শ্বেতবস্ত্র-পরিহিতা এবং শ্বেতগন্ধে অনুলিপ্তা।১ অধিকন্তু তাঁহার হস্তে শ্বেত রুদ্রাক্ষের মালা; তিনি শ্বেতচন্দনে চর্চিতা, শ্বেতবীণাধারিণী, শুভ্রবর্ণা এবং শ্বেত অলঙ্কারে ভূষিতা।২”
ধ্যান বা স্তোত্রবন্দনায় উল্লেখ না থাকলেও সরস্বতী ক্ষেত্রভেদে দ্বিভূজা অথবা চতুর্ভূজা এবং মরালবাহনা অথবা ময়ূরবাহনা। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে সাধারণত ময়ূরবাহনা চতুর্ভূজা সরস্বতী পূজিত হন। ইনি অক্ষমালা, কমণ্ডলু, বীণা ও বেদপুস্তকধারিণী। বাংলা তথা পূর্বভারতে সরস্বতী দ্বিভূজা ও রাজহংসের পৃষ্ঠে আসীনা।
‘‘সরস্বতীর হাঁস, সেও কি এমএ পাশ? কোন বিষয়ে গবেষণা, প্রাচীন ইতিহাস!’’ – নিজের ছড়ায় এমনই প্রশ্ন করেছেন কবি মৃদুল দাশগুপ্ত। কিন্তু সত্যিই তো রাজহাঁস কেন সরস্বতীর বাহন? একটা যুক্তিতে বলা হয়, হাঁস জলমেশানো দুধ থেকে দুধটা আলাদা করে পান করতে পারে। এটাকে তুলনা করা হয় অবিদ্যা থেকে বিদ্যাকে ছেঁকে নেওয়ার সঙ্গে। এটাই তো আসল শিক্ষা। তাই সরস্বতী হংসবাহিনী।
বলা হয়, জ্ঞান সাধনার ক্ষেত্রেও হংসের এই স্বভাব তাৎপর্যপূর্ণ। সংসারে নিত্য ও অনিত্য দুই-ই রয়েছে। বিবেক বিচার দিয়ে নিত্য বস্তুর বিদ্যমানতা স্বীকার করে তা গ্রহণ শ্রেয়, অসার বা অনিত্য বস্তু পরিত্যাজ্য। হাঁস জলে বিচরণ করে কিন্তু তার দেহে জল লাগে না। আবার মহাবিদ্যাও প্রতিটি জীবের মধ্যে থেকেও জীবদেহের কোন কিছুতে তাঁর আসক্তি নেই, তিনি নির্লিপ্তা।
কিন্তু কখনও কখনও তিনি ময়ূরাসীনাও। এরও একটা অর্থ আছে। বলা হয়, ময়ূর অহঙ্কারী, নিজের রূপের মোহে নিজেই আবিষ্ট। তাকে বাহন করে সরস্বতী শিক্ষা দেন, ‘বিদ্যা দদাতি বিনয়ম্’।
একটা সময় পর্যন্ত সরস্বতী শুধু বিদ্যার দেবী রূপেই পূজিতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন জীবনদায়িনী নদীরূপে পরিচিত। সেই সঙ্গে তাঁকে অন্নদায়িনী, শত্রুবিনাশিনী রূপেও কল্পনা করা হত। তবে দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে সরস্বতী হয়ে উঠেছেন হিন্দু ধর্মের জ্ঞানদাত্রী দেবী।
মানুষের তৈরি ধর্মে মানুষই কখনও শ্রদ্ধায়, কখনও বা ভয়ে নানা প্রাকৃতিক শক্তিকে মর্যাদা দিতে শুরু করে। জল, বায়ু, মাটি থেকে শুরু করে গাছ, ফুল, পশু, পাখিদের বিভিন্ন শক্তির প্রতীক রূপে আরাধনা শুরু হয়। ভক্তের কল্পনায় তাঁরা হয়ে ওঠেন দেবদেবীর অঙ্গ। কখনও বাহন রূপে, কখনও অস্ত্র রূপে।
দেবী সরস্বতী বৈদিক যুগে আরও অনেক গুণের প্রতীক ছিলেন। নদী রূপে পূজিতা হতেন সরস্বতী। তাই কৃষিভিত্তিক সভ্যতা তার দেবীর সঙ্গে সমান ভক্তিতে বাহন করে নিয়েছে জলচর রাজহাঁসকে।
তবে হাঁস তো শুধু জলচর নয়। সে মাটিতেও থাকে। আবার আকাশেও উড়তে পারে। সর্বত্র তার অনায়াস চলন। জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে সর্বত্রই হাঁসের সমান গতি, যেমন জ্ঞানময় পরমাত্মা সর্বব্যাপী— স্থলে, অনলে, অনিলে সর্বত্র তাঁর সমান প্রকাশ। জ্ঞানের দেবীর বাহন তবে আর কে হবে!
তবে সরস্বতী বৈদিক দেবী হলেও সরস্বতী পূজা বর্তমান রূপটি আধুনিক কালে প্রচলিত হয়েছে। তবে প্রাচীন কালে তান্ত্রিক সাধকেরা সরস্বতী-সদৃশ দেবী বাগেশ্বরীর পূজা করতেন বলে জানা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাঠশালায় প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে ধোয়া চৌকির উপর তালপাতার তাড়ি ও দোয়াতকলম রেখে পূজা করার প্রথা ছিল। শ্রীপঞ্চমী তিথিতে ছাত্রেরা বাড়িতে বাংলা বা সংস্কৃত গ্রন্থ, শ্লেট, দোয়াত ও কলমে সরস্বতী পূজা করত। গ্রামাঞ্চলে এই প্রথা বিংশ শতাব্দীতেও প্রচলিত ছিল। শহরে ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই সরস্বতীর প্রতিমা নির্মাণ করে পূজা করতেন। বর্ধমান মহারাজার পূজায় বিশেষ সমারোহের আয়োজন করা হয়। দূর দুরান্ত থেকে মানুষ এই পূজার বিসর্জন দেখতে আসত। পূজা উপলক্ষে দুই ঘণ্টা আতসবাজিও পোড়ানো হত। আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজার প্রচলন হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে।
(তথ্যসূত্র:
১- সরস্বতী সারদার অনুধ্যানে, অরুণ কুমার বিশ্বাস, আনন্দ পাবলিশার্স।
২- বিলুপ্ত সরস্বতী ও আর্য-হরপ্পা প্রসঙ্গ, কৃষ্ণেন্দু দাস, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স (২০১১)।
৩- Devi: The Goddesses of India, John Stratton Hawley & Donna Marie Wulff, Aleph Book Company (২০১৭)।
৪- এইবেলা পত্রিকা, ১৩ই ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সাল।
৫- সংবাদ প্রতিদিন, ২৫শে জানুয়ারি ২০১৯ সাল।
৬- উইকিপিডিয়া।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত