১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ৯ই জুলাই শ্রীমতী তোশিকোর সঙ্গে রাসবিহারী বসুর বিবাহ সম্পন্ন হয়। ১৯২০-র ১৩ই অগস্ট জন্ম নেয় পুত্র মাশাহিদে, যাঁর ভারতীয় নাম ভারতচন্দ্র। ১৯২২-এর ১৪ই ডিসেম্বর জন্ম হয় মেয়ে তেৎসুকো-র। ১৯২৩ সালের ২রা জুলাই জাপানের নাগরিকত্ব পান রাসবিহারী। এই নাগরিকত্ব প্রাপ্তির আগে মার্চ মাসে এবং ঠিক তার পরেই ১৯২৩-এর সেপ্টেম্বর মাসে, জাপানে প্রবল ভূমিকম্প হয়। সমুদ্রের ঢেউ ৪০ ফুট উঁচু সুনামি হয়ে দেখা দিয়েছিল। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১ লক্ষ ৪০ হাজার মানুষ মারা যান। ৪০ হাজার মানুষ নিখোঁজ হন, ধরে নেওয়া হয় তাঁরা মারা গিয়েছেন। এ ছাড়াও ৪৪ হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছিলেন। রাসবিহারীর আশ্রয়স্থলটি ধ্বংস হয়ে যায়। এই বিপর্যয়ে রাসবিহারী বসু স্ত্রী, আড়াই বছরের পুত্র এবং আট মাসের কন্যাকে নিয়ে ভীষণ বিপদে পড়েন। এ ছাড়া ওই সময়ও তাঁকে অজ্ঞাতবাসে থাকতে হচ্ছিল। এই দুর্দিনে তিনি বাংলার বিপ্লবী চন্দননগরের শ্রীশচন্দ্র ঘোষকে ১,০০০ টাকা পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন। অগ্নিযুগের শীর্ষস্থানীয় বিপ্লবী শ্রীশচন্দ্র রাসবিহারীর মতো চন্দননগরের ডুপ্লে স্কুলে পড়েছেন। তাঁর সঙ্গে রাসবিহারীর আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। রাসবিহারীর পিতা বিনোদবিহারী এবং শ্রীশচন্দ্রের কাকা বামাচরণ শৈশবে খেলার সঙ্গী ছিলেন এবং যৌবনে উভয়ে একসঙ্গে সরকারি ছাপাখানায় চাকরি করেছেন। পারালিবিঘাটি গ্রামের নবীনচন্দ্র সিংহের দুই কন্যাকে দু’জনে বিবাহ করেছেন এবং চন্দননগরে বাড়ি করে পাশাপাশি বসবাস করছিলেন। অর্থাৎ রাসবিহারীর মা ভুবনেশ্বরী দেবী ও শ্রীশচন্দ্রের কাকিমা ব্রজেশ্বরী দেবী ছিলেন আপন সহোদরা বোন। শ্রীশচন্দ্র শৈশবে পিতৃহীন হওয়ায় পিতৃব্য বামাচরণ ঘোষের কাছে চন্দননগরের ফটকগোড়া অঞ্চলে রাসবিহারীদের পাশের বাড়িতে প্রতিপালিত হয়েছিলেন।
শ্রীশচন্দ্র ভেবেছিলেন, দিল্লি-লাহৌর-বারাণসী ষড়যন্ত্রের নায়ক রাসবিহারীর বিপদের কথা শুনলে ভারতীয়রা নিশ্চয় অর্থসাহায্য করবেন। রাসবিহারীর নামডাক আছে, সুতরাং তাঁর নাম মন্ত্রশক্তির মতো কাজ করবে। তাই ব্যক্তির পিছনে না ছুটে, তিনি রাসবিহারীর পত্রটি সংবাদপত্রে ছাপিয়ে প্রকাশ করে দেন। কিন্তু দেখা গেল, কাগজে রাসবিহারীর চিঠি বা ওই সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশের পর মনিঅর্ডারে তাঁর অর্থসাহায্য জুটল সর্বমোট ১৬ টাকা। শ্রীশচন্দ্র তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না। তখন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পণ্ডিত মদনমোহন মালবীয় এবং বাংলার প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। ও দিকে শ্রীশচন্দ্র তাঁর ব্যক্তিগত ভাবে টাকা চাওয়ার বিষয়টি সংবাদপত্রে প্রকাশ করায় রাসবিহারী বিরক্ত হয়েছিলেন। শ্রীশকে তিনি পত্রে লেখেন, ‘‘আমার ভিতরটা কি কেউ দেখছ, দেশের জন্য যে সবটা পেতে দিয়ে বসে আছি সেটা কি কেউ দেখছ, তারা বোধ হয় দেখে, আমি বোমা আর রিভলবার, আমি ষড়যন্ত্রের একটা মস্ত খেলোয়াড়। তারা আমায় জানবে কেন? ঘুম না ভাঙলে তারা আমায় জানবে কেন? তাদের কাছে টাকা চাওয়া কেন?’’ তার পর অবশ্য শ্রীশকে সান্ত্বনা দিয়ে লিখেন, ‘‘আচ্ছা লড়ে যাব, তোমরা অত ভয় খেয়ো না।’’
শ্রীশচন্দ্র সংবাদ পেলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনের জাপান সাহায্য তহবিলের সংগৃহীত অর্থ মোট ৬২১ টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন। তখনও শ্রীশচন্দ্রের মনে হল, এক হাজার তো হল না। তাই আবার তিনি মদনমোহন মালবীয় এবং লালা লাজপত রাইকে চিঠি লিখলেন। কিন্তু সে চিঠিতেও কোনও কাজ হল না। শেষে শ্রীশ রাসবিহারীর চিঠি পেয়ে তাঁর জন্য অর্থসংগ্রহের কাজ ত্যাগ করলেন।
ব্রিটিশের শত্রু রাসবিহারীকে ভারতীয়রা কেন সাহায্য করেনি? জাপানে রাসবিহারীর বিরুদ্ধে ব্রিটিশ প্রশাসন আইনত কোনও ব্যবস্থা করতে পারেনি। কিন্তু বেআইনি ভাবে সেই চেষ্টায় তারা সফল হয়েছিল ভারতের অভ্যন্তরে। তাই রাসবিহারীকে অর্থসাহায্য করার সাহস ও সামর্থ্য থাকলেও ভারতে প্রায় কেউই তা করে দেখাতে পারেননি। ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকা রাসবিহারী সম্পর্কে ধারাবাহিক ভাবে লিখছিল, তিনি বলশেভিক-আফগান কত কী ষড়যন্ত্রই না করে চলেছেন।
ব্রিটিশের শত্রু রাসবিহারী নিশ্চয়। কিন্তু কী কারণে? ভারতবর্ষের স্বাধীনতার কারণে। আজ স্বাধীনতার এত দিন পরেও দেখি স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবীদের মূল্যায়ন হয় না।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, রাসবিহারী বসুর সঙ্গে শ্রীশচন্দ্র ঘোষের (১৮৮৭-১৯৪১) নিয়মিত যোগাযোগ ছিল, রাসবিহারী তাঁকে চিঠিপত্র ও বই পাঠাতেন। নানা আশাভঙ্গের কারণে, দারিদ্র ও মানসিক পীড়নে শ্রীশচন্দ্র পরবর্তী কালে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। রাসবিহারীর পাঠানো বই বুকে চেপে ধরে তাঁকে প্রকাশ্যে খেপার মতো ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন চন্দননগরের বহু মানুষ। শেষে ১৯৪১ সালের ২রা মে অগ্নিযুগের এই অমূল্যনিধি আফিম খেয়ে আত্মহনন করেন। আমরা তাঁকে এই পথেই ঠেলে দিয়েছিলাম।
এবারে চলে যাই আরও অতীতে।
১০০ বছর আগের কথা। টোকিওর রেইনানসাকা থেকে অন্ধকারে ছদ্মবেশী কয়েক জন যুবা এল শিনজুকু শহরে। দোকান-বাড়ি ‘নাকামুরায়া’-র পিছনে ছিল নির্জন একটা ভুতুড়ে ভবন। সেটির দোতলায় এক গোপন আস্তানায় আশ্রয় নিল দুই বাঙালি। ওঁদের একজন রাসবিহারী বসু। লর্ড হার্ডিঞ্জকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ছিল ওঁর বিরুদ্ধে। বেশ কিছু দিন ভারতের নানা জায়গায় গা ঢাকা দিয়ে থাকার পর গোপনে তিনি পাড়ি দেন জাপানে।
কোন পরিস্থিতিতে লর্ড হার্ডিঞ্জকে হত্যার ষড়যন্ত্র আঁটছিলেন রাসবিহারী বসু? আলিপুরের বোমা মামলায় গ্রেফতার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ১৯০৮ সালেই কলকাতা ছাড়েন তিনি। দেহরাদূনে গিয়ে ফরেস্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের হেড ক্লার্কের একটি কাজ যোগাড় করেন। সেখানে গিয়ে যতীন মুখোপাধ্যায় (বাঘা যতীন) আর ‘যুগান্তর’ গোষ্ঠীর অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ষড়যন্ত্র আঁটকে থাকেন। ঠিক হয়, ব্রিটিশরাজকে কড়া বার্তা দিতে সরিয়ে দেওয়া হবে লর্ড হার্ডিঞ্জকে। এ বিষয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয় বসন্ত বিশ্বাসকে। অবশেষে, আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। দিল্লিতে রাজা পঞ্চম জর্জের সঙ্গে সঙ্গে দেখা করে ফিরছিলেন হার্ডিঞ্জ। সেই সময়ে ভাইসরয়কে লক্ষ্য করে বোমা ছোড়েন বসন্ত। বোমা অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। সন্দেহভাজনদের তল্লাশিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্রিটিশ পুলিশ।
লাহৌরে গার্ডস সাহেবকে বোমা মেরে হত্যার চেষ্টা ছাড়াও ‘সন্ত্রাসবাদী’ কাজের আরও অভিযোগ ছিল বসন্তর বিরুদ্ধে। ধরা পড়েন তিনি। ১৯১৫-র ১১মে পঞ্জাব জেলে তাঁর ফাঁসি হল। এ বার ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের পাখির চোখ বসন্তর গুরু রাসবিহারী বসু। হন্যে হয়ে পুলিশ তাঁর খোঁজে নামে। মোটা অর্থের পুরস্কার ঘোষণা হল।
প্রাণে বাঁচতে দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন রাসবিহারী। বসন্তর ফাঁসির ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভারত ছাড়লেন। জাহাজে করে পৌঁছলেন জাপানের কোবে শহরে, পি এন টেগোর ছদ্মনামে। ৮ জুন ট্রেনে কিয়াতো হয়ে টোকিও। ইংরেজি জানা এক পুলিশ নাকি তাঁকে ওখানে থাকা, বাড়ি খুঁজে দেওয়ার কাজে সাহায্য করেন। টোকিওতে তখন বেশ কিছু ভারতীয় গদর পার্টির সদস্য। ওঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে রাসবিহারী বিপ্লবী কাজে নেমে পড়লেন। কয়েক মাস বাদে সাংহাই থেকে জাহাজে জাপানে এলেন বাঙলার আর এক বিপ্লবী হেরম্বলাল গুপ্ত। তিনিও জাহাজে এলেন কোবে বন্দরে। এর পরের ইতিহাসটা রীতিমত গল্পের মত।
শিনজুকুর ওই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আইজো সোমা ও তাঁর স্ত্রী কোক্কো দু’জনেই ছিলেন সংস্কৃতিমনস্ক। এক সময়ে এই দ্বিতল ভবনটি ব্যবহৃত হত শিল্পঘর হিসাবে। দুই বিদেশির আশ্রয়ে তাই কারও সন্দেহ হওয়ার কথা নয়। তা সত্ত্বেও সোমা-দম্পতি ওই দু’জনের ব্যাপারে গোপনীয়তা বজায় রাখতে সতর্ক করে দিলেন তাঁদের কর্মীদের। চলতে লাগল দুই বঙ্গতনয়ের গোপন কর্মকাণ্ড।
কোক্কো ইংরেজি বুঝতে ও বলতে পারতেন। অচিরেই তিনি দুই বঙ্গতনয়ের অভিভাবিকা হয়ে উঠলেন। তথ্য আদানপ্রদানের দূত আর অনুবাদক হিসাবে অগ্রণী ভূমিকা নিলেন পরিবারের জ্যেষ্ঠ কন্যা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী তোশিকো।
কোন পরিস্থিতিতে, কী ভাবে জাপানে এসেছিলেন রাসবিহারী? জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে আরও কয়েক মাস। শেষ রাত।
২০১৬-র ৭ নভেম্বর টোকিওতে জাপান-ভারত একটি চুক্তি হয়। রাসবিহারী-হেরম্বকে জাপান থেকে বার করে দেওয়ার অনুরোধ করে ব্রিটিশ প্রশাসন। ১২ ডিসেম্বর জাপান সরকার ওঁদের জাপান ছাড়ার নির্দেশ দেয়। সোন বুন নামে এক প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছে সাহায্য চাইলেন রাসবিহারী বসু। ‘ইন্দো দোকুরিৎসু হিৎসুওয়া’ (ভারতের স্বাধীনতার গোপন কথা) বইয়ে সানজো কুসাবিরাকি লিখেছেন, হেরম্বলালের মাধ্যমে এই যোগাযোগ। মতান্তরে, এই পরিচয় হয়েছিল জাপান প্রবাসী গদর পার্টির কর্তা ভগবান সিংয়ের মাধ্যমে।
মাস তিনেক বাদে মতানৈক্যের জেরে হেরম্বলাল জাপান ছেড়ে আমেরিকায় চলে যান। ব্রিটিশরা রাসবিহারীর খোঁজে তন্নতন্ন অভিযান শুরু করল। তাঁর আত্মগোপন হল আরও কঠোর। কোক্কো পরিবারের আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলেন বছর ত্রিশের রাসবিহারী। তা সত্ত্বেও ডেরা ছাড়তে হল তাঁকে। কিন্তু কোথায় যাবেন?
এই বিপ্লবী-পুলিশ খেলার মধ্যে দিয়ে রাসবিহারী এসে পৌঁছেছিলেন সোমা পরিবারে। আকাশছোঁয়া অনিশ্চয়তা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। যুবাটিকে সস্নেহ আশ্রয় না দেওয়ার অর্থ তাঁকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে তুলে দেওয়া। তাকেশি নাকাজিমা ‘নাকানুরায়া নো বোউসু’ বইতে লিখেছেন এ সব কথা। এই অবস্থায় সোমা দম্পতি ঠিক করলেন সদ্য স্কুল ডিঙোনো তোসিকোর সঙ্গে রাসবিহারীর বিয়ে দেবেন।
নাকামুরা ত্সুনে নামে এক শিল্পীর সঙ্গে তোসিকোর বিশেষ সম্পর্ক ছিল। ত্সুনে যক্ষায় আক্রান্ত হওয়ায় সেই সম্পর্কে আপত্তি জানান সোমা-দম্পতি। সম্পর্কের ইতি পড়ে। ঠিক হল ১৯১৮-র মে মাসের মাঝামাঝি মিৎসুরু তোয়ামার বাড়িতে রাসবিহারী-তোসিকোর বিয়ে হবে। তারিখ পিছিয়ে হল ৯ জুলাই।
প্রথম মহাযুদ্ধের দামামা বাজছে। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে জার্মানির গুপ্তচর হিসাবে চিহ্ণিত করেছিল। মিত্রশক্তি তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ তৈরি করল জাপানের উপর। রাসবিহারীর সংগ্রাম তাই আরও বাড়ল। কোক্কো সোমা আত্মজীবনীতে লিখেছেন, অন্তত ১৭ বার বাসাবদল করতে হয়েছে নবদম্পতিকে। বহু বার ওঁদের নিতে হয়েছে ছদ্মনাম।
বিয়ের মাস চারেক বাদে সম্পাদিত হল ভার্সাই চুক্তি। প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ। এক দিন কোক্কো মেয়ে-জামাইকে দেখতে গেলেন। এত অন্ধকার ঘর! আলো-হাওয়া ঢোকে না! এ ভাবে, এ রকম অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় মানুষ থাকতে পারে? কেঁদে ফেললেন কোক্কো। একরাশ অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতা, দুশ্চিন্তার মধ্যে এক ছেলে, এক মেয়েকে নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে তোসিকো। আর তাঁর স্বামী ডুবে গিয়েছেন ভারতকে স্বাধীন করার দুরূহ কর্মযজ্ঞে। আইএনএ তৈরি, নেতাজিকে জাপানে আহ্বাণ— তালিকা অতি দীর্ঘ। দু’বার জাপানে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেন। শান্তিনিকেতনের জন্য চাঁদা তুলে দেন কবিগুরুকে।
ঠাণ্ডা-জ্বরে ক্রমাগত ভুগছিলেন তোশিকো। সঙ্কটের ভ্রূণ অঙ্কুর মেলেছে ওঁর বুকে। সে সময় যক্ষার আধুনিক চিকিৎসা ছিল না। ১৯২৪-এ রোগে ভুগে মারা গিয়েছেন তোশিকোর প্রাক্তন প্রেমিক ত্সুনে। ১৯২৫-এর মার্চ মাসে সব শেষ। চিরতরে চলে গেলেন তোশিকো নিজে।
কোক্কোর মনে হল যেন স্বেচ্ছায় মেয়েকে জলে ভাসিয়ে দিলেন। কিন্তু সেই সঙ্গে মনের জোর পেলেন রাসবিহারী কতটা ভেঙে পড়েছেন তা জেনে। প্রচণ্ড মানসিক আঘাত আর নিঃসঙ্গতা ভাঙতে আরও বেশি করে রাসবিহারী জড়িয়ে পড়লেন বিপ্লবী কর্মকান্ডের সঙ্গে। মাতৃহারা ছেলে মাসাহিদে আর মেয়ে তেৎসুকো বড় হতে লাগল দিদা কোক্কোর কাছে।
এই অবস্থায় রাসবিহারীকে কিছু যুবতী বিয়ে করার আগ্রহ দেখান। কোক্কো নাকি জামাইকে ফের বিয়ে করার প্রস্তাবও দেন। কিন্তু স্বপ্নের ভাগীদার, একান্ত সচিব হিসাবে আর কাউকে ভাবতে পারেননি ওই দামাল বিপ্লবী। পরের বছর তিনি নাকামুরায় খোলেন ‘ইন্ডিয়ান কারি’ নামে এক রেস্তোরাঁ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান যখন হেরে যায়, রাসবিহারী প্রায় শয্যাশায়ী। দীর্ঘ দিন অসুখে ভুগে মারা যান ১৯৪৫-এর ২০ জানুয়ারি। বয়স হয়েছিল ৫৮। ছেলে মাসাহিদে যোগ দিয়েছিলেন জাপানি বাহিনীতে। ৫ মাস বাদে মার্কিন সেনাদের হাতে মারা যান ওকিনাওয়া যুদ্ধক্ষেত্রে।
১৯৫৭ সালে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু মেয়ে ইন্দিরা, বোন বিজয়লক্ষ্মী আর কিছু পারিষদকে নিয়ে জাপানে যান। রেনকোজি বুদ্ধ মন্দিরে গেলেও ওঁরা নাকামুরায় যাননি। প্রবীর বিকাশ সরকার তাঁর ‘জানা অজানা জাপান’-এ কথা জানিয়ে লিখেছেন, কোক্কো সোমা নাতনি তেৎসুকো হিগুচিকে নিয়ে নেহরুর কাছে যান। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রায় অকথিত একটা অধ্যায় অশীতিপর কোক্কো প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে শোনান নেহরুকে। রাসবিহারীর কিছু স্মারক তুলে দেন। এর বছরখানেক বাদে মারা যান মহীয়সী কোক্কো। সম্রাট হিরোহিতো জাপানের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক দিয়ে স্বীকৃতি জানান রাসবিহারী বসুকে।
একজন অবস্থাপন্ন ঘরের জাপানি যুবতী। আর একজন বাঙালি বিপ্লবী। সংগ্রামের পথ যেন সত্যি বেঁধে দিয়েছিল দু’জনের বন্ধনহীন গ্রন্থি। সেই চলায় স্নেহের ডালি উজাড় করে দিয়েছিলেন আর এক জাপানি মহিলা।
শতবর্ষের ইতিহাসে যেন চাপা পড়ে গিয়েছে সেই অমর প্রেমকথা!
ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই মানুষটি আজ ভারত এবং জাপানে এক কিংবদন্তী পুরুষ। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায় ১৮৮৬ সালে তাঁর জন্ম। মাত্র ১৫ বছর বয়স থেকেই স্বাধীনতামন্ত্রে উদীপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। ১৯০৮ সালে তিনি ’আলীপুর বোমা বিস্ফোরণ’ মামলায় অভিযুক্ত হয়ে জেলে ছিলেন। কারাগার থেকে বের হয়ে দেরাদুনে যান। সেখানে বন গবেষণা ইনস্টিটিউটে হেডক্লার্ক হিসাবে কাজ করেন। দেরাদুনে থাকার সময়ে তাঁর সঙ্গে বাংলা, উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাবের বিপ্লবীদের দেখাসাক্ষাৎ ঘটে। তরুণ বয়সে এই বাঙালি বীর ভারতে বৃটিশ ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জকে (Lord Hardinge, Viceroy of India, ১৯১০-১৯১৬) হত্যা এবং আর একটি সিপাহী বিপ্লব ঘটানোর লক্ষ্যে মহাষড়যন্ত্র করেছিলেন, যা ইতিহাসে দিল্লী-লাহোর ষড়যন্ত্র (Delhi-Lahore Conspiracy, ১৯১২) নামে খ্যাত। দুর্ভাগ্যক্রমে দুটো পরিকল্পনাই বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়। রাসবিহারী বসু জাপানে পালিয়ে আসেন ১৯১৫ সালের ৫ই জুন। তখন তাঁকে ধরিয়ে দেবার জন্য তাঁর মাথার উপর তৎকালীন বৃটিশ সরকারের ১২,০০০ রুপী তথা ৫ হাজার বৃটিশ পাউন্ডের মহাপুরস্কার ঝুলছিল।
জাপানে এসে তিনি প্রথমে পাঞ্জাবের দুর্দান্ত বিপ্লবী ভগবান সিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারপর জাপানে পলাতক চীনের জাতীয়তাবাদী নেতা ড. সান-ইয়াৎ সেনের (১৮৬৬-১৯২৫) কথা জানতে পেরে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান সহযোগিতা পাবার আশায়। সান-ইয়াৎ তাঁকে গুরু তোয়ামা মিৎসুরুর সঙ্গে দেখা করার পরামর্শ দেন। এর কয়েক মাস পরেই জাপানে আসেন আর এক দুর্দান্ত বিপ্লবী হেরাম্বলাল গুপ্ত (১৮৮৯-১৯৬৫) একই পুরস্কারের অঙ্ক মাথায় নিয়ে। তাঁদের দুজনকে জাপানি পুলিশের হাত থেকে রক্ষার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তৎকালীন প্রভাবশালী গণমুক্তি আন্দোলনের পুরোধা রাজনীতিক এবং ‘গেনয়োশা’ নামক গুপ্ত সমিতির পরিচালক গুরু তোয়ামা মিৎসুরু (১৮৫৫-১৯৪৪)। তাঁকে আরও যাঁরা সহযোগিতা করেন এবং পরবর্তীকালে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন তাঁরা হলেন: কুজো ইয়োশিহিসা, উচিদা রিয়োহেই, ওওকাওয়া শুমেই, সুগিয়ামা শিগেমারু, ইয়াসুওকা মাসাহিরো, শিমোনাকা ইয়াসাবুরো, ওজাকি য়ুউকিও, গোতো শিনপেই, মিৎসুকাওয়া কামেতারো, নাকানো সেইগো, সাসাকি ইয়াসুগোরো, কিমুরা নিক্কি, ড.ওওকুরা কুনিহিকো, ফুজিওয়ারা ইওয়াইচি, য়োশিদা শিগেরু প্রমুখ প্রভাবশালী আদর্শবান এশিয়াবাদী (প্যান-এশিয়ানিস্ট) রাজনীতিক, সামরিক কর্মকর্তা ও বুদ্ধিজীবীবৃন্দ। তাঁদের আগমনের কয়েক মাস পর নভেম্বর মাসে জাপান সফরে আসেন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের চরমপন্থী নেতা, ভয়ঙ্কর বিপ্লবী বলে পরিচিত লালা লাজপৎ রায় (১৮৬৫-১৯২৮)। রাসবিহারী বসু তাঁর আগমনকে উপলক্ষ করে একটি সংবর্ধনা সভার আয়োজন করতে মনস্থির করেন। কিন্তু উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অর্থাৎ তিনি চাচ্ছিলেন জাপানি সমাজে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রচার করতে যাতে করে জাপানি নাগরিকরা প্রবাসী বিপ্লবীদেরকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসে, পাশাপাশি ভারতে বৃটিশের অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। যদিও জাপান তখন সাম্রাজ্যবাদী বৃটেনের সঙ্গে মৈত্রীচুক্তিতে আবদ্ধ।
ইতিমধ্যে হেরাম্বলাল গুপ্তের সঙ্গে তখনকার প্রখ্যাত প্যান-এশিয়ানিস্ট এবং ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রের গবেষক তুখোড় তরুণ বুদ্ধিজীবী ওওকাওয়া শুমেই (১৮৮৬-১৯৫৭)-এর ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছে। তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি গভীরভাবে সহানুভূতিশীল ছিলেন। সম্ভবত তাঁরই পরামর্শে টোকিওর উয়েনো শহরের বিখ্যাত সেইয়োকেন্ মিলনায়তনে তাইশো সম্রাট ইয়োশিহিতো’র (১৯১২-২৬) সিংহাসন আরোহণকে কেন্দ্র করে একটি অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তাতে মূল লক্ষ্য অনুসারে ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন লালা লাজপৎ রায়, রাসবিহারী বসু, হেরাম্বলাল গুপ্ত। তোয়ামা মিৎসুরুসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও বক্তব্য রাখেন।
ওই সভায় কতিপয় গুপ্তচর উপস্থিত ছিলেন তাঁরা যথা সময়ে বিবরণ উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রদূতের কাছে। পরের দিন বৃটিশ দূতাবাস জাপান সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে বিপ্লবীদেরকে ধরিয়ে দেবার জন্য। সরকার বাধ্য হয়ে তাঁদেরকে জাপান ত্যাগের নির্দেশ জারি করেন। লালা রাজপৎ রায় আমেরিকা চলে যান। রাসবিহারী এবং হেরাম্বলালকে গুরু তোয়ামা আশ্রয় প্রদান করেন। তাঁদেরকে তাঁর বাড়ির কাছেই শিনজুকু শহরে অবস্থিত সুবিখ্যাত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ‘নাকামুরায়া’র কর্ণধার সোমা আইজোর সঙ্গে আলাপ করে প্রতিষ্ঠানের ভিতরে একটি পরিত্যক্ত ছবি আঁকার স্টুডিও ভবনে লুকিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু কিছুদিন পর পুলিশ ঠিকই তাঁদের গুপ্ত অবস্থান জানতে পারে। এর মধ্যে হেরাম্বলাল গৃহবন্দী অবস্থায় অস্থির হয়ে বেরিয়ে পড়েন এবং ওওকাওয়ার বাড়িতে আশ্রয় নেন। মাস চারেক সেখানে থাকার পর আমেরিকায় চলে যান।
এদিকে যখন রাসবিহারী বসুকে আর কিছুতেই পুলিশের নজর থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না তখন তোয়ামা মিৎসুরু সোমা আইজোকে তাঁর জ্যেষ্ঠকন্যা তখন কলেজ ছাত্রী তোশিকো সোমার সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দেন। অপ্রত্যাশিত এই প্রস্তাবে সোমা দম্পতি মহাবিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যান। কিন্তু তাঁদেরকে রক্ষা করেন তোশিকো নিজেই এগিয়ে এসে। প্রস্তাবিত বিয়েতে তিনি রাজি হন। বলেন, ‘মিঃ বোস স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য জাপানে থেকে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁকে সহযোগিতা করতে চাই, আমাকে তাঁর কাছেই যেতে দাও।’ তাঁদের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ১৯১৮ সালের ৯ই জুলাই তোয়ামা মিৎসুরুর বাড়িতে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে।
কিন্তু বিয়ের পরও কয়েক মাস বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে জীবন যাপন করতে হয় তাঁদেরকে। শাশুড়ি সোমা কোক্কো’র ডায়েরি থেকে ১৭ বার বাসা বদলের তথ্য পাওয়া যায়। এই সময় বিহারী বসু তাঁদের বিয়ে নিয়েও মানসিক অশান্তিতে ভোগেন কিছুদিন। নববিবাহিতা স্ত্রী তোশিকো আসলেই তাঁকে ভালোবাসে কিনা এই সন্দেহে দগ্ধ হচ্ছিলেন। তোশিকো কি পারিবারিক শুভাকাঙ্খী গুরুস্থানীয় তোয়ামা মিৎসুরুর প্রস্তাব উপেক্ষা করতে না পেরে অনিচ্ছাসত্ত্বে তাঁকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে? এই প্রশ্নটি তাঁকে সর্বক্ষণ তাড়া করছিল। একদিন দুজনে বেড়াতে গিয়ে নিভৃতে বিহারী বসু তোশিকোকে সরাসরি জিজ্ঞেস করেন, তোশিকো যদি সত্যিই তাঁকে ভালোবাসে তাঁর সামনে প্রমাণ করতে পারবে কিনা? তোশিকো এই কথা শুনে অশ্রুসিক্ত হন। বিহারী বসু বলেন, যদি ভালোবাসো তাহলে এই বারান্দা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মরে প্রমাণ করতে পারবে? সঙ্গে সঙ্গে তোশিকো দৌড়ে ঝাঁপ দিতে গেলে বিহারী বসু তাঁকে নিরস্ত করেন। এরপর আর কোনোদিন তাঁদের মধ্যে এ প্রসঙ্গ ওঠেনি। এই ঘটনার পেছনে মূল কারণ ছিল তোশিকোর সঙ্গে নাকামুরায়ার অভ্যন্তরে আশ্রিত নাকামুরা ৎসুনে নাম্নী জনৈক তরুণ চিত্রশিল্পীর সঙ্গে তোশিকোর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল যা বিহারী বসু জানতেন। ৎসুনে কর্তৃক গোপনে তোশিকোর কয়েকটি ছবি আঁকার ফলে সম্পর্কের কথা ফাঁস হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ঐ চিত্রশিল্পীকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। বিহারী বসু বিয়ের পরও সেই প্রেম তোশিকো ভুলতে পারেনি বলে মনে মনে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তা যে নয় তোশিকো তা প্রমাণ করে দেয়ার পরে বিহারী বসু আশ্বস্ত হয়েছিলেন। বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে পালিয়ে থাকলেও দুজনে খুব সুখী ছিলেন। তোশিকো ছিলেন মেধাবী ছাত্রী এবং ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী। তিনি বিহারী বসুর একান্ত সচিবের মতো সকল দাপ্তরিক কাজকর্ম করতেন।
১৯১৮ সালের নভেম্বর মাসে ইউরোপে যুদ্ধবিরতি এবং পরের বছর প্যারিস শান্তিচুক্তির মাধ্যমে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ গঠিত হয়। ফলে বিহারী বসুর উপর থেকে জাপান সরকার সকল বাধানিষেধ প্রত্যাহার করে নেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বন্ধের সূত্র ধরে ভারতে বৃটিশ প্রশাসন ১৯২১ সালে ‘রয়্যাল ক্লেমেন্সি’ বা ‘রাজকীয় ক্ষমা’ ঘোষণা করে বৃটিশবিরোধী বিদ্রোহী, বিপ্লবী-সন্ত্রাসীদের জন্য একটি শর্তে যে, ক্ষমা চেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে হবে। এই সুযোগ গ্রহণ করেন অনেক জেলবন্দী বিপ্লবী; এমনকি যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরিত আসামিরা পর্যন্ত ছাড়া পান কিন্তু তাঁরা মুক্ত হয়েই গা ঢাকা দেন। এই সুযোগ গ্রহণ করার জন্য রাসবিহারী বসুও চন্দননগরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মতিলাল রায়ের মাধ্যমে বাংলার ইংরেজ গভর্নমেন্টের কাছে লিখিত পত্রে আবেদন জানান ১৮ এপ্রিল ১৯২১ তারিখে। কিন্তু বৃটিশ সরকারের বিবেচনায় বিহারী বসু তখনও এক নম্বর শত্রু বলে তাঁর আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়। এরপর কী হয়েছিল জানা যায় না, তবে তাঁর এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রকৃত কারণ আজও রহস্যজনক। যাই হোক, পলাতক জীবনের ইতি ঘটিয়ে এবার মুক্ত আলোয় স্বাধীনভাবে বসবাস শুরু করেন নবদম্পতি। দুবছর পর ১৯২০ সালে পুত্র মাসাহিদে ১৯২২ সালে এবং কন্যা তেৎসুকো জন্মগ্রহণ করে। নিজের বংশ পরিচয়ে পরিচিত করার জন্য তিনি জাপানি নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন ১৯২৩ সালে। কিন্তু দাম্পত্য-সুখ বেশি দিন তাঁর ভাগ্যে সয় না। পলাতক জীবনে স্ত্রী তোশিকোকে অমানবিক কষ্ট সহ্য করতে হয় লুকিয়ে লুকিয়ে বিভিন্ন জায়গায়, সেখানে না ছিল পর্যাপ্ত আলো-বায়ু, না ছিল সুস্থ পরিবেশ। ফলে লাগাতার জ্বরজারি থেকে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ভুগে ১৯২৫ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সে পরলোকে যাত্রা করেন। ধরায় রেখে যান প্রাণপ্রিয় স্বামী ও দুটি শিশুসন্তানকে। পরলোকগত স্ত্রীর ভালোবাসার সম্মানার্থে রাসবিহারী বসু আর বিয়ে করেননি বাকি জীবনে শাশুড়ির আবেদন-বিবেদন সত্ত্বেও। পত্নীবিয়োগের এক বছর পর ১৯২৭ সালে নাকামুরায়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দ্বিতলে ভারতীয় কারি রেস্টুরেন্ট ‘ইন্দো নো মোন’ তথা ‘ভারতীয় তোরণ’ প্রতিষ্ঠা করেন। ৮০ বছর পেরিয়ে এই কারি রেস্টুরেন্ট এখনও ‘নাকামুরায়া নো কারেএ’ নামে জাপানে কিংবদন্তীসম জনপ্রিয়। রাসবিহারী বসুই প্রথম জাপানে ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় মশলায় রাঁধা মুরগি-মাংসের কারি প্রচলন করেন। একই ধরনের সুস্বাদু কারি আজও জাপানি পাচক উপহার দিচ্ছেন প্রতিদিন। ভারত বাংলাদেশের মানুষ যাঁরা তাঁর সম্পর্কে জানেন এই রেস্টুরেন্টে এসে এই কারির স্বাদ গ্রহণ এবং রাসবিহারী বসুকে স্মরণ করেন তবে তাঁদের সংখ্যা নিতান্তই আঙুলে গোনার মতো।
এই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠেছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পর্যন্ত ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। এখানে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থনকারী জাপানি রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ আলাপ-আলোচনায় বসতেন। অবশ্য অন্যান্য প্রবাসী ভারতীয়রাও আসতেন নিয়মিত। রাসবিহারী বসু ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের (IIL: Indian Independence League) প্রেসিডেন্ট। অসাধারণ কূটনৈতিক মেধাশক্তি ও বিচক্ষণতা দিয়ে প্রভাবশালী জাপানি নেতৃবৃন্দের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার যেমন করতে পেরেছিলেন তেমনি জাপানি ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশ্বাস ও রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এটা ছিল ভিন্ন দুটি জাতি ও সংস্কৃতির সমন্বয় রক্ষার্থে অত্যন্ত দুরূহ একটি কাজ। কিন্তু এই কাজে তিনি সফল হয়েছিলেন বলা যায়।
ভারতীয় স্বাধীনতা অর্জনে জাপান-প্রবাসী রাসবিহারী বসুর অবদানের কথা বলতে গেলে এটাই শুধু বলতে হয় যে, তিনি জাপানে না এলে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন কোন পথে যেত এবং কবে স্বাধীনতা আসত বলা মুশকিল। মূলত তাঁর প্রচেষ্টার জোরেই জার্মানি প্রবাসী সুভাষচন্দ্র বসু জাপানে আহুত হয়েছিলেন। আজাদ হিন্দ ফৌজ (INA: Indian National Army) মূলত বিহারী বসুর পরিকল্পনা ও উদ্যোগে গঠিত হয়েছিল ১৯৪২ সালেই এবং পরে সুভাষচন্দ্র বসু যার অধিনায়ক হন। এবং এই উপলক্ষে সিঙ্গাপুরে আয়োজিত এক মহাসভায় রাসবিহারী বসুই সুভাষ বসুকে ‘নেতাজি’ অভিধা প্রদান করেন বলে কথিত আছে। তিনি গোঁড়া থেকেই গান্ধীকে ভক্তি করলেও তাঁর অহিংস নীতির উপর আস্থা রাখতে পারেননি। তিনি গান্ধীর বিকল্প একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধিনায়কের প্রত্যাশায় ছিলেন। সেই অধিনায়কই হচ্ছেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাঁকে ‘দেশনায়ক’ স্বীকৃতি দিয়েছিলেন মৃত্যুর আগে। তাঁর সঙ্গে ১৯৩৮ সাল থেকেই রাসবিহারী চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করে আসছিলেন। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিস্থিতি বুঝে ১৯৪০ সালে গান্ধীকে ‘গতকালের লোক’ বলে অভিহিত করে ‘আজকের অবিসংবাদিত নেতা’ হিসেবে সুভাষচন্দ্র বসুর নাম ঘোষণা করেন। বিভিন্ন জাপানি পত্রিকা ও সাময়িকীতে সুভাষ বসুর নেতৃত্ব প্রসঙ্গে তাঁর চৌকস তারুণ্য, যোগ্যতা, অনস্বীকার্যতা এবং বুদ্ধিমত্তার গুরুত্ব তুলে ধরে একাধিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন মূলত এশিয়াবাদী ভারতদরদী জাপানি রাজনীতিক, প্রভাবশালী সরকারি কর্তাব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ ও সহানুভূতি লাভের জন্য। যাতে করে জাপানিদের সামনে বর্তমান ও আগামী ভারতবর্ষের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে সুভাষচন্দ্র বসুর একটি সর্বজনগ্রাহ্য ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে—যেহেতু জাপান ছাড়া আর কোনো দেশ ছিল না তখন যে দেশটি ভারতের স্বাধীনতা এনে দিতে পারে। শেষ পর্যন্ত জাপানের সশস্ত্র ভূমিকাই ভারতবাসীর আরাধ্য স্বাধীনতা দ্রুত অর্জনে সহায়ক হয়েছিল। কিন্তু এর জন্য রাসবিহারী বসুসহ অসংখ্য প্রবাসী বিপ্লবী ও নেতাজির বহু বছরের সাধনা, ত্যাগ, তিতিক্ষাকে স্বীকার না করলে নয়। কিন্তু তাঁদের সঠিক মূল্যায়ন আজও হয়েছে বলে মনে হয় না।
চরমপন্থী রাজনীতিক সুভাষচন্দ্র বসু ভারত ত্যাগ করে রাশিয়া হয়ে ১৯৪১ সালের ২৮ মার্চ জার্মানির বার্লিন শহরে পৌঁছেছিলেন। সেখানে থেকেই তিনি স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করতে থাকেন। একমাত্র বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলেই ১৯৪৩ সালের ১৬ মে জাপানে আগমন করেন। এই সালেই নেতাজি গঠিত স্বাধীন ভারত সরকারের (Free India Government/Provisional Government) প্রধান উপদেষ্টা হয়েছিলেন রাসবিহারী বসু। তখন তিনি মরণব্যাধি যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত, অসুস্থ। তাঁর ঘটনাবহুল জীবনের অবসান ঘটে ১৯৪৫ সালের ২১ জানুয়ারি টোকিওর নিজগৃহে। তাঁর মৃত্যুর পর ছেলে মাসাহিদে বোস জাপানি সৈন্য হিসেবে ওকিনাওয়া যুদ্ধে মিত্রশক্তি মার্কিনী সেনাদের হাতে প্রাণ হারান। মেয়ে তেৎসুকো বোস হিগুচি পদবিধারী জনৈক জাপানি প্রকৌশলীকে বিয়ে করে বর্তমানে বার্ধক্য জীবন অতিবাহিত করছেন। একবারও যেতে পারেননি স্বাধীন পিতৃভূমিতে। কেন যেতে পারেননি সেও এক রহস্য। স্বাধীন ভারতের কোনো রাজনীতিক তাঁকে তাঁর পিতৃভূমিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন কিনা জানি না, জানালে নিশ্চয়ই তিনি যেতেন। তবে মেয়ে তথা রাসবিহারীর পৌত্রী মাতামহের জন্মস্থান একবার ঘুরে এসেছেন ব্যক্তিগতভাবে। সম্প্রতি বিশিষ্ট ভারত-বিষয়ক গবেষক এবং হোক্কাইদো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাকাজিমা তাকেশি তেৎসুকো হিগুচির মুখে শোনা তাঁর পিতার কাহিনী একটি চমৎকার গ্রন্থ চিচি বোওসু বা পিতা বোস-এ লিপিবদ্ধ করেছেন। বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর জীবন যেমন শিক্ষামূলক তেমনি বৈচিত্র্যময় একটি উপন্যাস বললে অত্যুক্তি হয় না, যা চলচ্চিত্রে চিত্রায়িত হলে পরে তরুণ প্রজন্মকেই শুধু স্বাদেশিকতায় উদ্বুদ্ধ করবে না, বাংলাদেশের তথাকথিত ‘জাতীয়তাবাদী’দের জন্যও শিক্ষণীয় হবে নিঃসন্দেহে। ন্যাশনালিস্টরা যে চোর হয় না, জনগণের সম্পদ লুন্ঠনকারী নয়, একমাত্র নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক হয়ে ওঠেন কৈশোর থেকেই তার আদর্শ উদাহরণ হচ্ছে মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসুর জীবন। তাঁর নীতিজ্ঞান ছিল অত্যন্ত খাঁটি। তিনি যেমন ছিলেন একনিষ্ঠ হিন্দুধর্মাবলম্বী তেমনি নিঃস্বার্থ স্বদেশপ্রেমে তেজস্বী। নিয়ম ও সময়জ্ঞান ছিল তাঁর অত্যন্ত প্রখর। তাঁর প্রবল আধ্যাত্মিক চেতনাবোধ তাঁকে আজীবন সশস্ত্রবিপ্লবের প্রতি অবিচল থাকতে সাহস জুগিয়েছিল। ১৯৩৫ সালে তিনি টোকিওতে বিশ্ব আধ্যাত্মিক সংস্কৃতি মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ছাত্র, শিক্ষক, গবেষককে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, নিজেও গবেষণা করেছিলেন মূলত বিশ্বসংস্কৃতিকে আরও অনুধাবন করার জন্য। শুধু এশিয়ার পরাধীন মানুষের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির কল্যাণার্থে তাঁর উদ্যোগের ইতিহাস অপ্রচারিতই থেকে গেছে।
রাসবিহারী বসুর মৃত্যুর পর এত বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু আজও তিনি প্রবীণ জাপানিদের মনে বিখ্যাত ‘ইনদো শিশি’ বা ‘ভারতীয় বীরপুরুষ’ ভাবমূর্তিতে অধিষ্ঠিত। টোকিওর প্রাণকেন্দ্র শিনজুকু শহরস্থ ‘নাকামুরায়া’ মানেই রাসবিহারী বসু। প্রতিষ্ঠানের দোতলায় রেস্টুরেন্টের প্রবেশপথেই স্থাপিত শোকেসে তাঁর ও পরিবারের আলোকচিত্র রক্ষিত আছে। কিন্তু বাঙালি জানে না তাঁর ইতিহাস একেবারেই। আজকে এই যে দুই বাংলা থেকে হাজার হাজার বাঙালি জাপানে এসে কাজ করছে, ব্যবসা করছে এবং স্বদেশী সংস্কৃতির সংগঠন-সমিতি প্রতিষ্ঠা করছে এই ধারার সূচনাই করেছিলেন তিনি। ১৯৩৩ সালে শিনজুকু শহরে ‘এশিয়া হাউস’ নামে একটি ৮ কক্ষবিশিষ্ট দ্বিতল রেস্টহাউস স্থাপন করেছিলেন সেখানে ৫৮ জন এশিয়ান অভিবাসী বসবাস করতেন। এখানে এশিয়ার মুক্তি, জাপানের সঙ্গে এশিয়ার ভাতৃবন্ধন, সাংস্কৃতিক বিনিময় ইত্যাদি বিষয়ক সভা, আলোচনা অনুষ্ঠানের পাশাপাশি পান-ভোজনাদি অনুষ্ঠিত হত। তখনকার খ্যাত-অখ্যাত একাধিক জাতীয় পত্রিকা, সাময়িকীর সম্পাদক, সাংবাদিক পর্যন্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে আসতেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। রাসবিহারী বসু জাপানস্থ ভারতীয়সহ এশিয়ানদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য ‘কারিভোজ’ দিয়ে আমন্ত্রণ জানাতেন। অবশ্য জাপানি খাবার-দাবার যে ছিল না তা নয়। তবে ‘নাকামুরায়া’ প্রতিষ্ঠানের দোতলায় নিজস্ব ভারতীয় রেস্টুরেন্টে তাঁর নিজের হাতে তৈরি ‘ইন্ডিয়ান কারি-রাইস’ খাবারের সুনাম ইতিমধ্যে টোকিওসহ বড় বড় শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল। ফলে ‘এশিয়া হাউসে’ সভা-সমাবেশ মানেই ভারতীয় কারি আর সেটা তৈরি করবেন ভারতীয় বিপ্লবী রাসবিহারী বসু—এই ঘটনা শহরব্যাপী মুখরোচক সংবাদে পরিণত হয়েছিল। ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানটি কার্যকর ছিল।
শুধু তাই নয়, ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রবাসী ভারতীয়দেরকে একত্রিত করার জন্য তিনি ‘ভারত মৈত্রী সমিতি’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখানে শুধু যে ভারতীয়রা আসতেন তা নয়, ভারত, এশিয়ার অন্যান্য দেশের প্রতি আগ্রহী জাপানিরাও আসতেন। আলাপ-আলোচনা এবং পান-ভোজনাদি হত বেশ ঘটা করে। প্রথম সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৩৬ সালের ৩০ শে জুন তারিখে তাঁর রেস্টুরেন্টের ভিতরেই। তাতে ৩১ জন উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে তৎকালীন জাপানের স্বনামখ্যাত আন্তর্জাতিক কবি রবীন্দ্রনাথের বন্ধু নোগুচি ইয়োনেজিরো (১৮৭৫-১৯৪৭) বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত সমিতির সর্বমোট ১০টি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সমিতি থেকে ১৯৩৭ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনের সম্মেলনে জাপান থেকে একজন প্রতিনিধি প্রেরণের সিদ্ধান্তের কথা জানা যায়। আবার ভারত থেকে বিশেষ অতিথি কেউ এলে তাঁর স্মরণে বিশেষ সভা-সম্মিলনেরও আয়োজন করেছেন তিনি। যেমন জাপানস্থ প্রাচ্য গবেষণা সংস্থায় অতিথি হয়ে এসেছিলেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ বিনয়কুমার সরকার; জাপান সফরে এসেছিলেন স্বনামখ্যাত বৌদ্ধভিক্ষু রাষ্ট্রপাল সান্ধিরিয়া; বিশ্বভারতীর জনৈক শিল্পী-অধ্যাপকও এসেছিলেন বলে জানা যায়, তাঁরা বিশেষ সভায় আলোচনা ও বক্তৃতা করেছিলেন।
নানাবিধ কাজের পাশাপাশি রাসবিহারী বসু নিয়মিত লেখালেখিও করতেন। ভারতের সাহিত্য-সংস্কৃতি, ধর্ম, লোকসাহিত্য এবং ভারতে বৃটিশের শাসন-শোষণ নিয়ে অনেক লেখা জাপানি জাতীয় দৈনিক, সাময়িকী ও সংকলনে প্রকাশ করেছেন। তবে অধিকাংশই জাপানি ভাষায়। সারা জাপান ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন সভা-সমিতিতে অবরুদ্ধ, শোষিত মাতৃভূমির রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক দুরবস্থার ইতিহাস তুলে ধরেছেন জাপানিদের সামনে। জাপানে এশিয়ানদের বিরুদ্ধে জাতিগত বৈষম্য দূরীকরণেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। এশিয়ানদের মুখপত্র হিসেবে নিজব্যয়ে মাসিক নিউ এশিয়া নামে একটি তথ্যভিত্তিক কাগজ প্রকাশ করেছিলেন কিছুদিন। স্বনামে ও যৌথভাবে প্রায় ১৫/১৬টি গ্রন্থ লিখে রেখে গেছেন। যার মধ্যে গ্রন্থিত আছে মূল্যবান বিস্তর তথ্য ও ঘটনা। গ্রন্থগুলোর মধ্যে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতা তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে যৌথভাবে অনুবাদ করেছেন। চরমপন্থী বিপ্লবী হলেও তিনি যে রোমান্টিক ছিলেন তাতেই প্রমাণিত হয়। যুদ্ধপূর্ব টোকিওর সবচেয়ে ব্যয়বহুল কেতাদুরস্ত আধুনিক শহর ‘গিনজা’তে প্রায়শ সন্ধ্যেবেলা ‘সুশি বার’ পানশালায় বন্ধুদের সঙ্গে দিলখোলা আড্ডা দিতে পছন্দ করতেন। কবিগুরুর সঙ্গে তাঁর জাপানে একাধিকবার সাক্ষাৎ ঘটেছিল। তাঁকে ঘটা করে সংবর্ধনা প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। কবিগুরু ১৯২৪ সালের জুন মাসের একদিন তাঁর বাড়িতে এসে পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। রাসবিহারী বিশ্বভারতীর জন্য চাঁদা তুলে কবির হাতে তুলে দেন। স্ত্রীর মাসতুতো বোন মাকি হোশিকে শান্তিনিকেতনে পাঠান ফুলসজ্জাবিদ্যা ‘ইকেবানা’ ও ঐত্যিবাহী চা-অনুষ্ঠান ‘চাদোও’র প্রশিক্ষক হিসেবে। ১৯২৯ সালে কবিগুরু কানাডা থেকে ফেরার পথে জাপানে কিছুদিন বিশ্রাম নেয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলে টোকিওতে তাঁর তিন সপ্তাহকাল বসবাসের ব্যবস্থা করেন তাঁর ধনাঢ্য ব্যবসায়ী বন্ধু ড. ওওকুরা কুনিহিকোর প্রাসাদোপম বাড়িতে। এটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের শেষ জাপান সফর। উল্লেখ্য যে, রবীন্দ্রনাথ পাঁচবার জাপান ভ্রমণ করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের অশেষ আশীর্বাদ পেলেও একটি বিষয়ে তাঁর সহানুভূতিলাভে ব্যর্থ হন রাসবিহারী বসু। ১৯৩১ সালে চীনের মাঞ্চুরিয়া রাজ্য জাপান আক্রমণ করলে রবীন্দ্রনাথ মনঃক্ষুণ্ন হন; অপ্রত্যাশিত হিসেবে এই সামরিক অভিযানের কঠোর সমালোচনা করেন। ১৯৩৭ সালে যখন চীন-জাপান দ্বিতীয় যুদ্ধ বাঁধে তাতে রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীসহ ভারতের অনেক রাজনীতিবিদ প্রতিবাদ ও সমালোচনার ঝড় তোলেন জাপানের বিরুদ্ধে। প্রকৃতপক্ষে, মাঞ্চুরিয়ার আসল ইতিহাস ও ঘটনা এবং দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধের পটভূমি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ অনেক কিছুই জানতেন না বলে অনেক গবেষকই মনে করেন। তাঁর কানে ভুল তথ্য দিয়ে থাকবেন তখন শান্তিনিকেতনে অবস্থানরত চীনা ভবনের শিক্ষক-ছাত্র-ছাত্রীরা বলে কোনো কোনো গবেষকের ধারণা। যাহোক, চীন আক্রমণ নিয়ে ভারতে যখন জাপান-বিরোধী প্রতিবাদ তুঙ্গে তখন জাপানিরাও মনঃক্ষুণ্ন হন। বিশ বছরের পুরনো বন্ধু কবি নোগুচি ইয়োনেজিরো এই সময় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এক ঐতিহাসিক পত্রযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। সবচেয়ে বেশি নিরাশ হন রাসবিহারীকে সুদীর্ঘ ২১ বছর ধরে যে সকল প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে আসছিলেন ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইয়ে তাঁরা। রাসবিহারী বসু এই মহাসংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে এবং রবীন্দ্রনাথকে প্রকৃত ঘটনা বুঝিয়ে বলার জন্য তাঁকে ১৯৩৮ সালের ১১ অক্টোবর তারিখে জাপানে আসার আমন্ত্রণপত্র পাঠান জাহাজ ভাড়া ৫০,০০০ ইয়েন বাজেটের কথা উল্লেখ করে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই প্রস্তাবে রাজি হননি, উত্তরে তিনি লিখেন, ‘দীর্ঘ ভ্রমণের ফলে আমার শরীর উত্তম পর্যায়ে নেই। কিন্তু জাপানের প্রতি আমার যে মিশন তা বাস্তবায়নের জন্য উপযুক্ত আয়োজন করে থাকলে তোমার প্রস্তাব বিবেচনা না করলে নয়। আমার মিশন হচ্ছে, এখন এশিয়ার যে মহা দুটি জাতি পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, তাদের মধ্যে সংস্কৃতি ও মৈত্রী সম্পর্ক বিদ্যমান। কিন্তু জাপানি কর্তৃপক্ষ আমাকে মুক্তচিত্তে চলার ও বলার সুযোগ দেবে কিনা এই সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। কাজেই জাপান ভ্রমণ করে ছলচাতুরির মাধ্যমে ভুল বোঝাবুঝির কারণ হতে চাই না। তথাপি জাপানের প্রতি আমার সত্যিকার ভালোবাসা বহন করছি।’ এই কারণে অনেক ভারতীয় ও বাংলাদেশী রাসবিহারী বসুকে জাপানের দালাল বলে কটাক্ষ করেন যা কিনা অজ্ঞতার পরিচায়ক ছাড়া আর কিছু নয়। যাঁরা ইতিহাস সচেতন তাঁরাই তাঁকে বীর দেশপ্রেমিক হিসেবে সম্মান করেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন। রাসবিহারী বসুর জাপানে জীবিতকালের সুদীর্ঘ ৩০ বছরের ঘটনাবহুল ইতিহাস সত্যিই আকর্ষণীয়। তিনি যেমন বিদেশী হিসেবে তৎকালীন রক্ষণশীল জাপানি সমাজের কঠোর সমালোচনা করেছেন তেমনি উদারপন্থী প্রভাবশালী জাপানিদের প্রিয়ভাজনও হয়ে উঠেছিলেন, জাপানের সামরিক শক্তির সাহায্যে মাতৃভূমি ভারতের মুক্তির স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে সফল হয়েছিলেন। আধুনিক যুগে জাপান ও ভারতবর্ষের রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক সম্প্রীতি-বন্ধনের প্রথম সেতুই হচ্ছেন রাসবিহারী বসু।
মৃত্যুর পূর্বে মহাপূর্ব-এশিয়া যুদ্ধ তথা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার মূল্যায়নস্বরূপ শোওয়া সম্রাট হিরোহিতো (১৯০১-৮৯) সর্বোচ্চ রাজকীয় সম্মাননা-পদক প্রদান করেন রাসবিহারী বসুকে। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করতে আগ্রহী হননি বলে কন্যা তেৎসুকোর ভাষ্য থেকে জানা যায়। মৃত্যুর পর সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে সেটা পাঠানো হয় রাসবিহারীর বাড়ির ঠিকানায়। এই রকম রাজকীয় সম্মান পেয়েছেন আর একজন বাঙালি দূরপ্রাচ্য টোকিও আন্তর্জাতিক সামরিক বিচার তথা টোকিও ট্রাইব্যুনালের (১৯৪৬-১৯৪৮) অন্যতম বিচারপতি বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় জন্ম ড.রাধাবিনোদ পাল ১৯৬৬ সালে। ১৯৪৫ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকেও জাপান সরকার অনুরূপ পদক প্রদানের পরিকল্পনা করেছিলেন নেতাজি বিনীতভাবে তা প্রত্যাখান করেন।
১৯৫৭ সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু তাঁর বোন বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতসহ জাপান সফরে আসেন। কথিত আছে, তিনি রাসবিহারী বসু সম্পর্কে কোনো খোঁজ-খবর নেননি। ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসুর অপরিসীম অবদানকে স্মরণ করে নেহেরু ইচ্ছে করলে শিনজুকু শহরে অবস্থিত নাকামুরায়া তথা একদা বসুর শ্বশুরালয়ে পদধুলি রাখতেই পারতেন। কিংবা টোকিওর অদূরে অকুতামা শহরে অবস্থিত তাঁর সমাধিতে অর্পণ করতেই পারতেন সামান্য কিছু ফুল। তিনি কিছুই করেননি। ঐ সময়ে নেহেরু টোকিওর রেনকোজি বৌদ্ধমন্দিরে (এখানে নেতাজির তথাকথিত চিতাভস্ম (!) সংরক্ষিত আছে) যে বাণী লিখেছেন সেখানে নেতাজির কোনো প্রসঙ্গই নেই, আছে গৌতম বুদ্ধ ও বৌদ্ধধর্ম প্রসঙ্গে ইংরেজিতে লিখিত দুছত্র মন্তব্য। নেতাজিকে রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘ভারতরত্ন’ প্রদান করা হয়েছে এই সেদিন ১৯৯২ সালে। নেতাজি তবুও সম্মানিত হয়েছেন; কিন্তু রাসবিহারী বসুর ভাগ্যে কোনো পুরস্কারই জোটেনি—এক কলকাতার এক রাস্তার পাশে নির্মিত একটি বিসদৃশ প্রস্তরমূর্তি ছাড়া।
(তথ্যসূত্র:
১- Rash Behari Bose: The Father of the Indian National Army by Elizabeth Eston.
২- বিপ্লবী রাসবিহারী বসু, মণি বাগচী, শিক্ষা-ভারতী।
৩- Bose of Nakamuraya: An Indian Revolutionary in Japan by Takeshi Nakajima.
৪- রাসবিহারী বসু, জলধর মল্লিক, গ্রন্থতীর্থ (২০০৯)।
৫- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১২ই ডিসেম্বর ২০১৫।
৬- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩রা মার্চ ২০১৯ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত