‘কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানার’ ঢঙে কখনও তিনি বিনা নিমন্ত্রণেই চলে যাচ্ছেন কোন অনুষ্ঠানে। কখনও ছুটির দিনে চলে যাচ্ছেন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার কখনও বা রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ বিল আটকে বিধানসভা মুলতবি করে দিচ্ছেন। কখনও বা বলছেন অর্জুনের তীরের ফলাতেই ছিল পারমাণবিক শক্তি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা তাকে দেখলাম কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর উদ্ধারকারীর ভূমিকায়। তার কার্যকলাপ দেখে মনে হচ্ছে গম্ভীর রাজভবন যেন বিজেপির দলীয় অফিস। জাতীয় পতাকা নয়, সেখানে যেন উড়ছে গেরুয়া পতাকা। রাজভবনের মর্যাদা ও গুরুত্ব দুটোই খর্ব করছেন রাজ্যপাল। রাজ্যপাল হয়ে বাংলায় আসার পর থেকেই ধনখড়ের একের পর এক প্রচারসর্বস্ব ও ক্যাডারসুলভ আচরণে রাজ্যের মানুষ বিরক্ত। আমি আমার দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে এমন রাজ্যপাল আর দেখিনি।
মাননীয় রাজ্যপাল রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান। এই পদটার একটা আলাদা মর্যাদা আছে। বাংলায় এর আগে ধর্মবীর থেকে শুরু করে ডায়াস সহ বহু রাজ্যপালের সঙ্গে শাসক ও বিরোধী দলের সংঘাত হয়েছে। কিন্তু সে সংঘাতে একটা রাজনৈতিক দিক ছিল, আদর্শের লড়াইও ছিল। ছিল ভুল বোঝাবুঝি এবং রাজনৈতিক অপরিণামদর্শীতা। কিন্তু তা কখনই এমন হাস্যকর মেগালোম্যানিয়ায় পর্যবসিত হয়নি। জনসমক্ষে রাজ্যের শাসকদল ও শিক্ষা-সংস্কৃতি জগতের বিশিষ্ট ব্যাক্তিত্ব এবং রাজ্যের ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কে মাননীয় রাজ্যপাল যে ধরণের দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করছেন তার ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া কঠিন। তিনি নিজেই নিজের সন্মান নষ্ট করছেন। সব ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া আছে, সেই ঘটনাটাই এখন ঘটতে শুরু করেছে।
রাজভবনে মহামান্য রাজ্যপালের ডাকা বাংলার সব উপাচার্যদের বৈঠকে একজন উপাচার্যও আসেননি। রাজভবনের ডাক উপেক্ষা করেছেন তারা। এই ঘটনাকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য তথা রাজ্যপালের প্রতি উপাচার্যদের মত শিক্ষা ব্যাক্তিত্বদের অনাস্থা ছাড়া আর কিই বা বলা যেতে পারে! এই অবস্থার জন্য তিনি নিজেই দায়ী। বাংলায় আসার পর প্রথম থেকেই নিজেকে রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে তুলে ধরার বদলে তিনি একজন সক্রিয় দলীয় কর্মীর মত আচরণ করেছেন। তার পদের ওজনের সঙ্গে এটা মোটেই যায় না। যার পরিণতিতে রাজভবনে রাজ্যপালের বৈঠকে হাজির হওয়ার বদলে উপাচার্যরা নিজেরাই একটা কমিটি গঠন করেছেন, যেখানে আচার্য মানে রাজ্যপাল সংক্রান্ত যে কোন বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন তারা। রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধানকে এভাবে খোলাখুলি অগ্রাহ্য করার এমন ঘটনা রাজ্যে এর আগে আর ঘটেনি।
একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে এমনটা ঘটাই ছিল স্বাভাবিক। নিজের পদের মর্যাদার তোয়াক্কা না করে প্রায়শই তিনি এমন সব কাজ করে চলেছেন যা নিয়ে প্রতিদিনই শুরু হচ্ছে নতুন নতুন বিতর্ক। ছাত্র, শিক্ষক, উপাচার্য, শিক্ষাকর্মী থেকে শুরু করে রাজ্যের সাধারণ মানুষ কেউই এতে খুশি নন। আমার অবাক লাগে আগ বাড়িয়ে সব কিছুতেই নিজের মত জাহির করা; নেতা ও মন্ত্রীদের সঙ্গে দুদিন পরপরই নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে তার কী লাভ হচ্ছে! রাজ্যপাল পদটির সন্মান যে এতে ধুলোয় লুটোচ্ছে সেটা বোঝার হুঁশ কী তার নেই?
এর আগের রাজ্যপালেরা সরকারের ভাল কাজের প্রশংসা করেছেন, সমালোচনা করেছেন খারাপ কাজেরও। এটাই তো স্বাভাবিক, এটাই তো অভিভাবকত্ব। রাজ্যকে সঠিক দিশায় চালিত করাটাই তো তার কাজ। কথায় কথায় যিনি নিজেকে সংবিধান বিশেষজ্ঞ বলে ঘোষণা করেন তিনি এমন কাজ কী করে করেন তা ভাবতে খুব অবাক লাগে! নিজেকে হাসির খোরাক করে তুলেছেন তিনি!
রাজভবন, রাজ্যপাল এসব নিয়ে লোকের যে একটা সম্ভ্রম ছিল এই রাজ্যপালের আমলে তার আর কিছু রইলো না। বাংলার রাজ্যপাল মানেই এখন যেন একের পর এক ঘটনার ঘনঘটা, বিতর্কের পর বিতর্ক। ছোটবেলায় কঙ্কালের টঙ্কার নামে একটা ভূতের গল্প পড়েছিলাম। একেকটা কাণ্ডকারখানায় মানুষকে হতচকিত করে দিত সেই ভূত। আর বাংলা এখন দেখছে ধনখড়ের টঙ্কার!
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত