আগামী ৫ বছরের মধ্যে ভারতের অর্থনীতিকে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার বুলি আউড়িয়ে দেশবাসীকে যে স্বপ্নের ফানুসে চড়িয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, এক বছর পেরনোর আগেই যে তা ফুটো হয়ে গিয়েছে, সে কথা স্পষ্ট। কারণ প্রায় রোজদিনই তলানিতে নামার নতুন নতুন রেকর্ড করতে চলেছে দেশের অর্থনীতি। এবার যেমন মোদী সরকারের পরিসংখ্যান মন্ত্রক স্পষ্ট জানিয়ে দিল, চলতি বছরে আর্থিক বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশে আটকে থাকতে চলেছে। গত বছর অর্থনীতির হার খারাপ হলেও বৃদ্ধির হার ৬.৮ শতাংশ ছুঁয়েছিল। বিশ্ব জুড়ে আর্থিক মন্দার পরে গত ১১ বছরে দেশের বৃদ্ধির হার এত তলানিতে নামেনি।
প্রসঙ্গত, মোদী জমানায় জিডিপি মাপার পদ্ধতি বদলে দেওয়ার পরে বৃদ্ধির হার এত খারাপ হয়নি। কারখানার উৎপাদন, লগ্নীর ক্ষেত্রেও ছবিটা এত খারাপ হতে চলেছে যে, সেখানেও অনেক রেকর্ড ভেঙে যাবে। অর্থনীতির এই করুণ ছবি ১ ফেব্রুয়ারির বাজেটের আগে আরও কঠিন পরীক্ষার মুখে ফেলতে চলেছে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনকে। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পড়াশোনা, গোটা দেশের নজর এখন সেই জেএনইউ-এর দিকে। কিন্তু জেএনইউ-এর প্রাক্তনী অর্থনীতিকে কীভাবে চাঙ্গা করবেন, সেটা অনেক দূরের কথা। গত জুলাইয়ে পেশ করা তাঁর প্রথম বাজেটের অঙ্ক মেলাবেন কী করে, সেটাই প্রশ্ন।
গতকাল পরিসংখ্যান মন্ত্রক প্রথম আগাম অনুমানে জানিয়েছে, চলতি বছরে মূল্যবৃদ্ধি-সহ জিডিপি বৃদ্ধির হার হবে মাত্র ৭.৫ শতাংশ। অথচ গত জুলাইয়ের বাজেটে নির্মলা অনুমান করেছিলেন, মূল্যবৃদ্ধি-সহ জিডিপি ১২ শতাংশ হারে বাড়বে এবং এ বছর জিডিপি প্রায় ২১১ লক্ষ কোটি টাকায় গিয়ে পৌঁছবে। রাজকোষ ঘাটতিকে সেই জিডিপি-র ৩.৩ শতাংশে রাখার লক্ষ্য নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পরিসংখ্যান মন্ত্রক জানিয়েছে, এ বছর জিডিপি ২০৪ লক্ষ কোটি টাকাতেই আটকে থাকবে।
তাদের অনুমান, চলতি বছরে কারখানার উৎপাদন বাড়বে মাত্র ২ শতাংশ হারে। গত বছর যা ছিল ৬.২ শতাংশ। বিনিয়োগ বাড়বে মাত্র ০.৯৭ শতাংশ হারে। গত ১৫ বছরে এত খারাপ পরিস্থিতি হয়নি। অর্থ বছরের দ্বিতীয়ার্ধে নতুন যন্ত্রাংশে লগ্নী ০.৫ শতাংশ কমবে। গোটা বছরে বাড়বে ১ শতাংশ হারে। যা গত বছর ১০ শতাংশ ছিল। গত দু’দশকে নতুন যন্ত্রাংশে পুঁজি এই হারে কমেনি। মোট লগ্নীর পরিমাণ জিডিপির এক তৃতীয়াংশ থেকে চার ভাগের এক ভাগে নেমে আসতে চলেছে। জিডিপি থেকে করের পরিমাণ বাদ দিলে যা পড়ে থাকে, সেই জিভিএ-র ক্ষেত্রেও বৃদ্ধি ৪.৯ শতাংশে আটকে থাকছে বলে অনুমান।
উল্লেখ্য, চলতি অর্থ বছরের গোড়া থেকেই মূল্যবৃদ্ধির হার তলানিতে। এপ্রিল থেকে নভেম্বরে পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ১.৪ শতাংশ। গোটা বছরে মূল্যবৃদ্ধির হার ২.৫ শতাংশের মতো থাকবে বলে আজ পরিসংখ্যান মন্ত্রক আঁচ করছে। মূল্যবৃদ্ধির হার এত কমের অর্থ, বাজারে চাহিদা নেই। সরকারি অনুমান বলছে, এ বছরে ব্যক্তিগত কেনাকাটার খরচে বৃদ্ধির হার ৫.৮ শতাংশে আটকে থাকছে। যা গত বছরের ৮.১ শতাংশের তুলনায় বেশ কম। ফলে বাজারে চাহিদা না থাকলে নতুন লগ্নী আসবে কীভাবে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। যদিও লগ্নীর হাত ধরেও অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত মিলছে না বলেই মত অর্থনীতিবিদের।
অবস্থা এত দ্রুত খারাপ হয়ে চলেছে যে, অদূর ভবিষ্যতেও কোনও আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। চলতি অর্থ বছরের প্রথম তিন মাসে বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশে নেমেছিল। পরের তিন মাসে তা ৪.৫ শতাংশে নেমে যায়। তখনই আশঙ্কা হয়েছিল, গোটা বছরের বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশে আটকে থাকবে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক প্রথমে ৬ শতাংশের বেশি বৃদ্ধির পূর্বাভাস করলেও তা কমিয়ে ৫ শতাংশে নিয়ে আসে। মূল্যায়নকারী সংস্থা কেয়ার রেটিংস-এর মতে, সব কিছু এমনই চলতে থাকলে সোজা হিসেবে রাজকোষ ঘাটতি বেড়ে ৩.৪৪ শতাংশে পৌঁছবে। আর অর্থনীতিবিদদের মতে, রাজকোষ ঘাটতি ৩.৫ শতাংশে পৌঁছলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।