আপনাদের সবাইকে ইংরেজি নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানাই। নতুন বছরে খারাপ, গোলমেলে লোকজনদের সম্পর্কে কিছু লিখতে ইচ্ছে করেনা, কিন্তু তাদের আদত না বদলালে প্রতিবাদ ছাড়া আর কোন উপায়ও নেই। নতুন বছরে একচুলও বদলাননি মোদি-অমিতরা। নতুন উদ্যমে, নতুন কৌশলে আরও ভয়ঙ্করভাবে অসংখ্য মানুষকে দেশছাড়া করার খেলায় নেমেছেন তারা। একটা জিনিস লক্ষ্য করেছেন, ইদানিং বিজেপির জয় শ্রীরাম ধ্বনি কমে এসেছে। তার জায়গায় জোরদার হয়েছে পাকিস্তান বিরোধী আওয়াজ। আমার মনে হয় পরিকল্পিতভাবেই এটা করা হচ্ছে। পাকিস্তান-মুসলমান-দাঙ্গা-যুদ্ধ এই লাইনে এগোচ্ছে বিজেপি। ভূতের মুখে রামনাম মানুষ আর বিশ্বাস করছেন না বলেই তারা এই শঠতার আশ্রয় নিচ্ছে। উদ্দেশ্য যুদ্ধ ও সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতির এক বিপজ্জনক ককটেলের নেশায় দেশের মানুষকে বুঁদ করে তাদের মনে দাঙ্গা ও ধর্মীয় বিভাজনের বীজ বুনে দেওয়া।
আমার প্রশ্ন হল, তারা তো তাদের কাজ করছে কিন্তু আমরা যারা সচেতন মানুষ তারা কী করছি? এদের ঠেকাতে আমরা নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারছি না কেন? দেশের স্বার্থ যদি আমাদের স্বার্থ হয় তাহলে দেশ বাঁচাতে আমাদের এক হতে আটকাচ্ছে কোথায়? আমি অবাক হয়ে দেখছি মোটামুটিভাবে বিজেপি ও নিতান্ত দায় পড়ে তাদের সঙ্গে যারা আছেন তাদের মধ্যেও সামান্য কয়েকটি দল ছাড়া সবাই এনআরসি এবং ক্যা বিরোধী। তাহলে এক হয়ে লড়াই করতে আমরা পারছি না কেন? যখন গোটা দেশের মানবতা ধর্মীয় রাজনীতির স্বার্থে একটি দল বিপন্ন করে তুলেছে, স্থায়ী বাসিন্দাদের রাজনৈতিক স্বার্থে দেশ থেকে বার করে দিতে চাইছে তখনও বিরোধী দলগুলি একযোগে সরব হচ্ছে না কেন?
এর একটা সোজা উত্তর আছে, তা হল যৌথ লড়াই হলে অনেক তথাকথিত সুবিধাবাদী বিরোধী দলের রাজনীতির স্বরূপ উন্মোচিত হবে। ধরা পড়বে তাদের মেকি আদর্শবাদ। আন্দোলনের নামে চাপ সৃষ্টি করে কামিয়ে নেওয়ার রাজনীতিও ধাক্কা খাবে। আমার মনে হয়, এই মুহূর্তে সব দল এক মঞ্চে এসে একযোগে এনআরসি, ক্যা’র বিরোধিতা না করলে দেশে বিরোধী রাজনীতি করার আর জায়গাই থাকবে না। কায়েম হবে ধর্মান্ধদের একদলীয় শাসন। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে আর কিছু থাকবে না।
আমার মনখারাপ হয়ে যায়, মনে পড়ে স্যামুয়েল বেকেটের ওয়েটিং ফর গোডো নাটকের সেই বিখ্যাত সংলাপ – কিস্যু করার নেই। অন্যদের কথা বাদ দিলাম, সাংবাদিক বন্ধুদের কাছেও আমার একটা প্রশ্ন আছে, সত্যিই কি আমাদের কিছু করার নেই? কোটি কোটি মানুষকে যারা দেশ থেকে তাড়াতে চাইছে, পাঠাতে চাইছে ডিটেনশন ক্যাম্পে, একবার দাঙ্গার শিকার হয়ে এদেশে আসা মানুষগুলিকে আবার যারা গৃহহীন করতে চাইছে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ করার সাহস এখনও যদি না আসে তাহলে আর কবে আসবে? কবে আমরা বলতে পারবো এই বর্বরতার রাজনীতি আমাদের মৃতদেহের ওপর দিয়ে করতে হবে! কবে আমরা এনআরসি, ক্যা’র সাঁড়াশি আক্রমণে বিধ্বস্ত মানুষকে দল বেঁধে বুকে আগলে রাখার সাহস দেখাবো? কবে আমরা বলবো, পেশাদার দায়িত্ব পালন করা ছাড়াও সাংবাদিকদের একটা সামাজিক দায়িত্বও আছে। সেই দায়িত্ব পালন করার জন্যই আমাদের পথে নামতে হবে। গোটা দেশে এনআরসি-ক্যা বিরোধী লড়াইয়ের প্রধান মুখ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এর প্রতিবাদে সাংবাদিকদের পথে নামার কথা বলেছেন।
লেখায়, রেখায়, ক্যামেরায়, কলমে বিশ্লেষণে, বিতর্কে আমরা সাংবাদিকরাই কিন্তু মানুষকে বিজেপির এই দানবীয় রাজনীতির মোকাবিলায় উদ্বুদ্ধ করতে পারি। সে কাজ যে যেভাবে পারি সীমিত সাধ্য নিয়ে এখনই শুরু করা উচিৎ। আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ, নানা প্রশ্নে মতভেদ থাকতেই পারে কিন্তু এই মুহূর্তে এনআরসি, ক্যা ঠেকানোর জন্য পথে নামাটাই আমাদের মূল কাজ। তা যদি না করতে পারি তাহলে আমরা নিজেরাই নিজেদের ক্ষমা করতে পারবো না।
অনেকে বলবেন, সাংবাদিকদের নিরপেক্ষ হতে হবে। কিন্তু নিরপেক্ষতা মানে ক্লীবতা নয়। এটাই দর্শকের আসন থেকে আমাদের রাস্তায় নেমে আসার সময়। নতুন বছরে ভালো থাকতে হলে এই কাজটুকু আমাদের করতেই হবে।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত