মোদী জমানায় দেশের অর্থনীতির বেহাল দশা নিয়ে দফায় দফায় উদ্বেগপ্রকাশ করেছেন তিনি। নোবেল জয়ের পরেও আন্তর্জাতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা টালমাটাল বলে মন্তব্য করে মোদী সরকারের অস্বস্তি বাড়িয়েছেন। এবার সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন এবং নাগরিকপঞ্জী ও এনআরসি নিয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্যকে সমর্থন করলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ-দম্পতি অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার ডুফলো। একটি ইংরেজি সর্বভারতীয় দৈনিকে প্রকাশিত উত্তর-সম্পাদকীয় লিখে বিতর্কিত সিএএ এবং এনআরসি নিয়ে মত প্রকাশ করেছেন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির এই দুই অধ্যাপক। সেখানেই মোদী সরকারের এনআরসি এবং সিএএ-কে ‘ঝুঁকিপূর্ণ জুয়া’র মতো মারাত্মক বলে মন্তব্য করেছেন তাঁরা।
নাগরিকত্ব প্রমাণে সঠিক তথ্য এবং নথি জোগানের প্রশ্নে আলোকপাত করে নিজেদের লেখায় অভিজিৎ ও এস্থার একটি উদাহরণ টেনে এনেছেন। লিখেছেন, কোনও এক সমীক্ষায় দক্ষিণ ২৪ পরগনায় এক কুড়ি বছর বয়সি মেয়েকে তাঁর জন্মস্থান জিজ্ঞেস করায় মেয়েটি দীর্ঘ উত্তর দিয়েছিল। কোন গ্রামে তাঁর জন্ম বোঝাতে বহু বিবরণের পর মেয়েটি বলেছিল, ‘আমার মা জানতেন। কিন্তু, তিনি মারা গেছেন।’ অবশেষে সমীক্ষার ফর্মে ‘তথ্য জানা যায়নি’ লিখতে হয়েছিল তাঁকে। অভিজিতের মতে, এনআরসি এই মেয়েটির কাছে তাঁর নাগরিকত্বের প্রকৃত প্রমাণ আশা করছে। তিনি তা দিতে না পারলে অনুপ্রবেশকারী। অন্য সব ধর্মের মানুষের জন্য সিএএ এনেছে সরকার। কিন্তু, এই মেয়েটি মুসলিম হলে তিনি বাদ! এই ধরনের উদ্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ জুয়া খেলার মতোই মারাত্মক বলে মনে করছেন তাঁরা।
এই দুই ইস্যুতে মোদী সরকারের ‘ন্যূনতম শাসন ও অধিকতর প্রশাসন’ স্লোগানের বাস্তবায়ন নিয়েও খোঁচা দিয়েছেন অভিজিৎ ও এস্থার। তাঁদের মতে, এনআরসির নথির জন্য সাধারণ মানুষ নাজেহাল হলে তা আর ন্যূনতম নয়, অধিকতর শাসনে পরিণত হয়। মনে রাখতে হবে, ২০১৪ সালে এই স্লোগানকে সামনে রেখেই ক্ষমতায় এসেছিল মোদী সরকার। তাঁরা মনে করছেন, সরকার চাইলেই এ নিয়ে বিতর্ক বন্ধ করতে পারে। কিন্তু, তা করা হচ্ছে না। তাঁরা ব্যাখ্যা দিয়েছেন, আসাম এবং ভারতের অন্যত্র সিএএ এবং এনআরসির তফাত। বলেছেন, আসামে সমস্যা ভিন্ন। যুক্তিগত সিদ্ধান্ত হিসেবে সেখানে জাত, ধর্ম নির্বিশেষে শরণার্থীদের সমস্যা বলে ধরা হয়। তাই সেখানে সিএএ অভিশাপ। এবং আশা অনুযায়ী যথার্থ সংখ্যক বিদেশি খুঁজে বের করতে না পারায় এনআরসি নিন্দনীয়।
তাঁদের সাম্প্রতিক লেখা বই ‘গুড ইকনমিক্স ফর হার্ড টাইমস’–এর উল্লেখ করে তাঁরা লিখেছেন, ‘যথেস্ট প্রমাণ মিলেছে যে, নিম্ন আয়ের অদক্ষ শরণার্থীরা নিম্ন আয়ের অদক্ষ ভারতীয়দের জন্য কখনওই ক্ষতিকারক নয়। বরং তারা কাজের সন্ধানে থাকবে। যা আয় করবে, তা ব্যয় করবে। প্রকৃত আর্থিক চ্যালেঞ্জ হতে পারে মধ্যবিত্তরা। তারা চাকরির সন্ধান করবে। কিন্তু, ভারতে চাকরি কোথায়? ভারতীয় রেলে ৬৩ হাজার সাধারণ পদে চাকরির জন্য প্রায় দু’কোটি চাকরিপ্রার্থী আবেদন করেছেন। এ থেকেই প্রমাণ হয় আমরা ভুল পথে চলেছি। এটাই খারাপ শাসনের উদাহরণ।’ নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনে হিন্দু-সহ ছ’টি দেশের শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হলে শ্রীলঙ্কার হিন্দু তামিল এবং পাকিস্তানের আহমেদিয়া মুসলিমরা বাদ গেলেন কেন, সেই প্রশ্ন উসকে দিয়েছেন দুই নোবেলজয়ী।
তাঁদের প্রশ্ন, ‘যাঁরা আমাদের গণতান্ত্রিক, উদার, সহনশীল মতবাদকে পাথেয় করে জাতীয় লক্ষ্যের শরিক হতে রাজি, তাঁদের জন্য কেন দরজা খোলা হবে না? কেন পাকিস্তানে অত্যাচারিত আহমদিয়া, শ্রীলঙ্কার তামিলদের বুকে টেনে নেব না?’ অভিজিৎ-এস্থারের মতে, ভারতে ১৩০ কোটি মানুষ আছেন। আরও কয়েক লক্ষ মানুষ না হয় এই মহামানব-সমুদ্রের স্রোতে মিলেমিশে যাবেন। তা হলেই ভারত গোটা বিশ্বের ‘ভার বহনে সমর্থ’ হয়ে উঠবে। অন্যদিকে, প্রকাশিত নিবন্ধ সম্পর্কে তৃণমূলের বর্ষীয়ান সাংসদ সৌগত রায় বলেছেন, ‘বিশ্ব সমাদৃত অর্থনীতিবিদরা কার্যত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের মতকে সমর্থন করেছেন। এটা আনন্দের। গর্বের। ওঁদের ধন্যবাদ। আমরা মনে করছি, স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে আমরা ঠিক পথেই চলছি।’