ঝাড়খণ্ডে বিজেপি শাসনের অবসান। কংগ্রেস-জেএমএম-আরজেডি জোট ক্ষমতায়। সেই বিরোধী ঐক্যে মমতা নেই। বরং, তিনি আলাদাভাবে ঝাড়খণ্ডে তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে প্রার্থী দিয়েছিলেন। সবকটি আসনেই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। ভোট জুটেছে মোটে ০.২৯ শতাংশ। অথচ রাজনৈতিক মহল বলছে পড়শি রাজ্যের এই ফলাফলে সবচেয়ে লাভবান তৃণমূল। স্বভাবতই খুশি তৃণমূল নেত্রী। টুইট করে হেমন্ত সোরেনদের শুভেচ্ছাও জানিয়েছেন তিনি। মমতা লিখেছেন, ‘নাগরিকদের পক্ষেই রায় দিয়েছে ঝাড়খণ্ড!’
কিন্তু তৃণমূলের খুশি হওয়ার কারণটা কী? অঙ্কটা খুব সহজ। প্রথমত, ঝাড়খণ্ড বাংলার প্রতিবেশী রাজ্য হওয়ায়, সেরাজ্যের নির্বাচনের পুরোদস্তুর প্রভাব এরাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিতে পড়ে। গত লোকসভা নির্বাচনেও দেখা গিয়েছে ঝাড়খণ্ড সীমান্তবর্তী অধিকাংশ এলাকায় দুর্দান্ত ফলাফল করেছে বিজেপি। এবার, সেরাজ্যে গেরুয়া সরকারের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে, এরাজ্যের ঝাড়খণ্ড লাগোয়া জেলাগুলিতে বিজেপির প্রভাব যে কমবে তা বলাই বাহুল্য। তাছাড়া, ঝাড়খণ্ডে তৃণমূলের ‘বন্ধু’ দল ক্ষমতায় থাকলে, একুশের নির্বাচনে তাঁরা মমতার হয়ে প্রচারও করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার অভিযোগ করেন, এরাজ্যের সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে হোক বা রাজ্যের অন্যপ্রান্তের যে কোনও জনসভা। সব জায়গাতেই ঝাড়খণ্ড থেকে লোক ঢোকায় বিজেপি। এমনকী, বসিরহাটে সাম্প্রদায়িক অশান্তির জন্যও ‘বহিরাগত’দেরই দায়ী করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। ঝাড়খণ্ডে বিজেপি শাসনের অবসান হওয়ায় সেই ‘বহিরাগত’দের উৎপাত বন্ধ হবে।
তবে তৃতীয় কারণটাই বৃহত্তর। সেটা হল, লোকসভা ভোটে এই ঝাড়খণ্ডেই ১৪ টি আসনের মধ্যে একা ১১ টি আসনে জিতেছিল বিজেপি। তাদের শরিক আজসু জিতেছিল একটি আসনে। মাত্র ৬ মাসের মধ্যে কেন এমন কাঙাল অবস্থা হল গেরুয়া দলের? এবং তা পর্যালোচনা করতে গিয়ে তাঁরা এও দেখছেন, ঠিক একইরকম কাণ্ডই তো ঘটেছিল হরিয়ানা ভোটেও। মহারাষ্ট্রেও সরকার গড়তে পারেনি বিজেপি। তা হলে কি নরেন্দ্র মোদীর মুখ দিয়ে আর রাজ্যের ভোটে জেতা যাচ্ছে না? হ্যাঁ, সেটাই। চোদ্দ সালে লোকসভা ভোটের পর কিন্তু এমন ছিল না। নরেন্দ্র মোদী তখন সবে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ‘আচ্ছে দিন’-এর স্বপ্নে বুঁদ হয়ে আছে গোটা দেশ। দেখা গিয়েছিল, তাঁর মুখ সামনে রেখেই একের পর এক রাজ্য জিতে নিচ্ছে বিজেপি। উত্তরপ্রদেশের মতো বড় রাজ্যেও সেই এক রসায়নই সামনে রেখেছিল গেরুয়া শিবির। কিন্তু উনিশের ভোটের পর আর তা আর হচ্ছে না। একের পর এক রাজ্যে আঞ্চলিক আবেগ, চাহিদা ও রাজনীতি চাইছে স্থানীয় মজবুত নেতা। তা না থাকাতেই বিপর্যয় হয়েছে, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খণ্ডে। হরিয়ানায় মনোহর লাল খট্টর, মহারাষ্ট্রে দেবেন্দ্র ফড়নবীশ বা ঝাড়খণ্ডে রঘুবর দাসকে কোনওভাবেই মজবুত নেতা বলা যায় না। নিজের রাজ্যেই তাঁদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব মজবুত নয়। বরং সাধারণ ধারনা হল, তাঁরা দিল্লির অঙ্গুলিহেলনে চলেন। নিজেদের কোনও বক্তব্য নেই। ফলে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে তাঁরা বেসামাল হয়ে পড়ছেন। তৃণমূলের বড় স্বস্তির কারণ সম্ভবত এটাই।
চতুর্থত, লোকসভা ভোটে মোদীর সামনে কোনও গ্রহণযোগ্য মুখ চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে না পারায় তিনি একাই তিনশ পার করেছেন ঠিকই। কিন্তু রাজ্যের ভোটে বিজেপির মুখ নেই। বাংলাতেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারার মতো কোনও মুখই নেই এখনও পর্যন্ত। ফলে এই এক অ্যাডভান্টেজই উতরে দিতে পারে একুশের ভোট। ফের ক্ষমতায় আসতে পারে তৃণমূল। বস্তুত প্রশান্ত কিশোরও সেই দিদির ব্র্যান্ড মজবুত করার কাজটাই করছেন।
তাই সার্বিকভাবে দেখতে গেলে ঝাড়খণ্ডে বিজেপির পতন সোনায়-সোহাগা তৃণমূলের জন্য। তাছাড়া, সার্বিকভাবে বিজেপি যত দুর্বল হবে তৃণমূলের তো ততটাই ফায়দা। গেরুয়া শিবির যে একের পর এক রাজ্যে ক্ষমতা হারাচ্ছে, তাতে সার্বিকভাবেও এরাজ্যের উপর প্রভাব পড়বে বলে মত রাজনৈতিক মহলের।