মোদী-শাহের আপন দেশে, আইন-কানুন সর্বনেশে- এ এখন চালু কথা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সাজার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও বন্দী হয়েই থাকতে হবে! মগের মুলুক নাকি! ক্ষোভে ফু্ঁসছেন আসামের সকল বাঙালি। যেমন আসামের হাইলাকান্দির কাবেরী দত্ত। তাঁর বাবা কাঞ্চন দত্ত (৫২) এখনও বাড়ি ফেরেননি। সাড়ে তিন বছরেরও বেশি হয়ে গিয়েছে। কবে বাড়ি ফিরবেন, জানেন না কাবেরী (২২)। কাঞ্চনবাবু রয়েছেন শিলচর জেলে। তাঁর ‘অপরাধ’ তিনি ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে নাগরিকত্ব প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে সাজার মেয়াদ শেষ হলেও জেলেই বন্দী থাকতে হচ্ছে তাঁকে।
জেলে মানে যদিও জেল নয়। জেলখানার ভিতর বিদেশি বন্দীশালায়। অর্থাৎ ডিটেনশন সেন্টারে। সাজার মেয়াদ শেষ হতেই জামিনের ২ লাখ টাকা ও ২ জন জামিনদার জোগাড় হলেও নানা জটিলতায় ছাড়া পাননি কাঞ্চনবাবু। মেয়ে তাই উদ্বিগ্ন। সেই উদ্বেগ এখন ক্ষোভ। তাঁর বাবা বা বাবার মতো আরও অনেক মানুষ রয়েছেন বিদেশি বন্দীশালায়। অথচ প্রধানমন্ত্রী বলছেন, কোনও ডিটেনশন ক্যাম্প নেই! তাই তাঁর রাগ।
ক্ষুব্ধ বৃদ্ধা কাজলবালাও। গত সপ্তাহেই ছাড়া পেয়েছেন তিনি। বিদেশি বলে তাঁকে জেলের ভিতর ক্যাম্পে রাখা হয় প্রায় আড়াই বছর। এখন অবশ্য ট্রাইব্যুনাল তাঁকে স্বদেশি বলে ছাড়িয়ে এনেছে। লামডিঙের ছন্দা পাল (৩৭) বা বদরপুরের মায়ারানি সিং (৫৭)-এর মতো অনেকেই রয়েছেন বন্দীশালায়। কবে মুক্তি পাবেন তাঁরা জানেন না। অনেকের মস্তিষ্কেও বিকৃতি এসেছে। বহু মানুষ ডিটেনশন ক্যাম্পে যাওয়ার ভয়ে আত্মহত্যাও করেছেন। এটা বাস্তব। তবু নাকি আসামে ডিটেনশন ক্যাম্পই নেই!
আসামের বাঙালিরা বলছেন, মিথ্যারও একটা সীমা থাকে। মোদী-শাহরা সেই সীমাও ছাড়াচ্ছেন। তাঁরা খুব ভাল করেই জানেন রাজ্যে ৬টি বিদেশি বন্দীশালা বা ডিটেনশন ক্যাম্প রয়েছে। বিধানসভার সরকারি তথ্য বলছে, প্রায় ১ হাজার বন্দী রয়েছেন এই ৬টি ক্যাম্পে। কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক সহায়তায় শুধুমাত্র ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের বিচারে বিদেশি সাব্যস্তদের জন্য গোয়ালপাড়ায় হচ্ছে ৩ হাজার শয্যার বিশেষ বন্দীশালা।
আসামের শিলচর, ডিব্রুগড়, তেজপুর, জোরহাট, গোয়ালপাড়া ও কোকরাঝাড়ে রয়েছে ৬টি ডিটেনশন ক্যাম্প। ৬টিই জেলখানার ভিতর অবস্থিত। মোট আবাসিক সংখ্যা প্রায় ১ হাজার। বন্দীরা বেশিরভাগই বাঙালি। নামে ডিটেনশন ক্যাম্প বা সেন্টার হলেও সবই জেলখানার ভিতরে। সবকিছুই চলে জেলের নিয়মেই। অনেক সময়ে দেখা গিয়েছে, দাগি আসামিদের সঙ্গে থাকতে দেওয়া হয় ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে নাগরিকত্ব প্রমাণে ব্যর্থদেরও।
মোদী বলছেন, একটিও ডিটেনশন ক্যাম্প নেই। কিন্তু আসাম সরকারের পরিসংখ্যান বলছে ডিটেনশন ক্যাম্পেই মারা গিয়েছেন ২৮ জন। এরমধ্যে গত নভেম্বর মাসেই মৃতের সংখ্যা ৩। সবাই বাঙালি। নভেম্বরের মৃতেরা হিন্দু বাঙালি। আর ২৮ জনের মধ্যেও প্রায় সত্তর শতাংশই হিন্দু। শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্পের আবাসিকদের মধ্যেও বেশিরভাগই হিন্দু বাঙালি। ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের বিচারে নাগরিকত্ব প্রমাণে ব্যর্থ হয়ে তাঁরা জেল খাটছেন।
বন্দিশালা নিয়ে মোদির ‘অসত্য’ ভাষণ অবশ্য আসামের বাঙালিদের কাছে নতুন কিছু নয়। ২০১৪ সালে শিলচরে ভোটপ্রচারে এসে বলেছিলেন, বিজেপি ক্ষমতায় এলে সমস্ত বিদেশি বন্দীশালা গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী হয়ে শিলচরে পরবর্তীতে এলেও সে বিষয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করেননি তিনি। বরং প্রধানমন্ত্রী হয়ে আসামে নতুন ডিটেনশন ক্যাম্প বানাতে অর্থ বরাদ্দ করেছে তাঁর সরকার।
সেই অর্থেই গোয়ালপাড়ায় গড়ে উঠছে বিশাল বন্দীশালা। যেখানে এক সঙ্গে ৩ হাজার ‘বিদেশি’ থাকতে পারবেন। এছাড়াও আরও বন্দীশালা বানানোর প্রক্রিয়া চলছে আসামে। আসাম রাজ্য নাগরিক অধিকার সুরক্ষা সমন্বয় সমিতির চেয়ারম্যান তপোধীর ভট্টাচার্যের অভিযোগ, বর্তমান শাসকশ্রেণি মিথ্যার চরম সীমাও লঙ্ঘন করেছে। আসামের মানুষ দানবীয় ব্যবস্থার শিকার। গোটা দুনিয়া জানে, আসামে ডিটেনশন ক্যাম্প রয়েছে। আর সেখানে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।