বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডে একটা হনুমান মন্দির ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। তার পাশ দিয়ে হেঁটে আসার সময় দেখি টহলরত কিছু সিআরপি জওয়ান সেই ভাঙা মন্দিরের চাতালে নিজেদের আগ্নেয়াস্ত্রগুলি নামিয়ে রেখে হনুমানজিকে প্রণাম করছেন। ছবিটা তুলে আমি অফিসে তৎকালীন সহযোগী সম্পাদক গৌরী চ্যাটার্জিকে দেখাই। গৌরীদি বললেন, ছবিটা খুব ভাল কিন্তু আমরা এই ছবিটা ছাপবো না। কারণ, একটা ভুল বার্তা যাবে। এই হল দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা, সাংবাদিকদের ভাল-মন্দ বোধের পরিচয়। এই ব্যাপারটা আজকের সাংবাদিকতা থেকে প্রায় হারিয়ে গেছে। কোন ঘটনা ঘটলে আমরা নিজেদের অবস্থান নিতে ভয় পাই, দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করি। ঠিক এই ঘটনাটাই এখন ঘটছে।
নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নামে গত কয়েকদিন ধরে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় এক শ্রেনির দুর্বৃত্ত যেভাবে লুঠতরাজ ও সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর করছে তার প্রতিবাদে সমাজের অন্যান্য অংশের মানুষদের সঙ্গে সাংবাদিকদেরও প্রতিবাদ করা দরকার। কারণ, তারাও সমাজে বাস করেন এ ক্ষতি তাদেরও ক্ষতি। দিনের শেষে আমরাও কিন্তু বাড়ি ফিরি, যে কোন সামাজিক ঘটনা আমাদের স্পর্শ করে। কাজ করতে গিয়ে পুলিশ আমাদের মারলে কিংবা দুর্বৃত্তরা আমাদের আক্রমণ করলে আমরা প্রতিবাদ করি। কারণ, আঘাতটা সরাসরি আমার ওপর এসেছে। তাহলে যে কোন সামাজিক ঘটনায় আমাদের প্রতিক্রিয়া থাকবে না কেন? এখনও অবধি আমি গত কয়েকদিন ব্যাপী লাগাতার উশৃঙ্খলতার বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের কোন প্রতিবাদ দেখিনি। সাংবাদিকদের কোন সংগঠন বা প্রেস ক্লাব এখনও অবধি এ ঘটনার নিন্দা করেছেন বলে আমার জানা নেই। অর্থাৎ সমাজে বাস করেও আমরা সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে পারলাম না। ভাল-মন্দ বিচার করার বোধটুকুও যেন আমাদের লুপ্ত হয়েছে। চলে গেছে প্রতিবাদের সাহস।
অথচ কলকাতার সাংবাদিকদের অবস্থাটা এরকম ছিল না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে জরুরি অবস্থা, আরও পরবর্তী পর্বে বিহার প্রেস বিল ইত্যাদি নানা ইস্যুতে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন শহরের সাংবাদিকরা। এখন চারপাশের ঘটনা সম্পর্কে তাদের কোন অবস্থান নিতে দেখা যায় না। এবারও তার পুনরাবৃত্তি হল। উশৃঙ্খলতার বিরুদ্ধে সাংবাদিকরা কোন প্রতিবাদ জানালেন না। প্রেস ক্লাব কিংবা সাংবাদিক সংগঠনগুলি মিছিল, নিদেনপক্ষে কোন বিবৃতি বা নিন্দা প্রস্তাব নিয়েও এই ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে পারতেন। নতুন নাগরিকত্ব আইন নিয়ে মতপার্থক্য থাকতেই পারে কিন্তু আন্দোলনের নামে পরিকল্পিত উশৃঙ্খলতার বিরুদ্ধে লড়াই নিয়ে তো কোন মতভেদ নেই! তাহলে আমরা প্রতিবাদ করছি না কেন? কেনই বা শহর, গ্রাম, মফঃস্বলের সাংবাদিকরা হোক কলরবের ধাঁচে কোন প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ নিচ্ছেন না?
সমস্যাটা আসলে অন্য জায়গায়, প্রতিটি সামাজিক প্রশ্নে গৌরীদির মতই একটা ব্যাক্তিগত অবস্থান থাকা দরকার। কিন্তু নিরপেক্ষতার নামে অধিকাংশ সাংবাদিক এবং সাংবাদিক সংগঠনগুলি এতটাই গা বাঁচিয়ে চলতে অভ্যস্ত যে কোন কিছুতেই তারা প্রতিক্রিয়া দেন না, এবারও সেই ঘটনা ঘটছে। এ তো হল সংগঠনের কথা কিন্তু আমরা যারা এই উশৃঙ্খলতার বিরুদ্ধে তারা নিজেরাও তো এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে পথে নামতে পারি। তাহলে অন্তত নিরপেক্ষতার নামে গা বাঁচানোর সুবিধাবাদের পাপ আমাদের স্পর্শ করবে না। আমরা তো সবাই জানি কোন মানুষই প্রকৃত অর্থে নিরপেক্ষ নন, নিরপেক্ষতা আসলে একটা রাজনীতি। এটা অন্যায়কেই শক্ত করে।
কয়েকজন মিলে প্রতিবাদ শুরু করলেই দেখবেন অনেকেই পায়ে পা মিলিয়েছেন, এগিয়ে এসেছেন সমর্থনে। মানুষ দেখবে আমরা শুধু প্রতিক্রিয়ার খবর লিখি না, দেখাই না, ছবি তুলি না, তা আমাদেরও স্পর্শ করে। কপিতে কিংবা বুম ধরে বারবার প্রতিবাদ কথাটা বলবো অথচ নিজেদের জীবনে তার কোন চিহ্ন থাকবে না এটা কী খুব ভালো দেখায়! সাংবাদিকরাও সামাজিক জীব, এই সরল সত্যটা বুঝলেই আমরা প্রতিবাদের শক্তি অর্জন করতে পারবো।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত