সোমবার লোকসভায় প্রায় ৭ ঘণ্টার হই-হট্টগোলের পর মধ্যরাতে পাশ হয়েছিল বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল(ক্যাব)। আর তারপর দীর্ঘ বিতর্ক-আলোচনা চলার পর বুধবার রাতে রাজ্যসভাতেও পাশ হয়ে যায় তা। আর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর নাগরিকত্ব সংশোধনী এখন আইন। তবে নিজেদের লক্ষ্য পূরণের পরও নাগরিকত্ব সংশোধনীর প্রতিবাদ ঘিরে ঘরে-বাইরে চাপের মুখে মোদী সরকার।
বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিদেশমন্ত্রী ভারত সফর বাতিলের পর জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের আগামী সপ্তাহের গুয়াহাটি সফরও বাতিল করা হয়েছে। শুধু বিদেশি অভ্যাগতদের নয়, বাতিল হল খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মেঘালয় এবং অরুণাচল প্রদেশের সফরও। কোনও ক্ষেত্রেই সফর বাতিলের কারণ দর্শানো হয়নি।
যদিও রাজনীতিক মহলে গুঞ্জন, ক্যাব-প্রতিবাদে উত্তপ্ত উত্তর-পূর্বের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখেই আর কোনও ঝুঁকি নিতে চাইছে না মোদী সরকার। ধাক্কাটা এসেছে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার সংগঠনের থেকেও। তাদের স্পষ্ট বক্তব্য, ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইন মূলগতভাবে বৈষম্যমূলক। এই আইনের রূপায়ণ নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা। ঘুরিয়ে সেই বার্তা দিয়েই সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে সচেষ্টা হতে নয়াদিল্লিকে বার্তা দিয়েছে ওয়াশিংটনও।
রবিবার শিলংয়ের ‘নর্থ-ইস্ট পুলিশ অ্যাকাডেমি’তে পাসিং আউট প্যারেডে যাওয়ার কথা ছিল শাহের। পর দিন অরুণাচল প্রদেশের তাওয়াংয়ে একটি উৎসবে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শুক্রবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে ওই সফর বাতিলের কথা জানানো হয়। সফর বাতিলের ক্ষেত্রে সরকারিভাবে কোনও কারণ দর্শানো না হলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক আধিকারিকের দাবি, উত্তর-পূর্বের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখেই শাহের সফর বাতিল করা হয়েছে।
একই ঘটনা জাপানের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রেও। ১৫-১৭ ডিসেম্বর অসমের গুয়াহাটিতে আবে-মোদী বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। গত দু’দিনের বিক্ষোভে বৈঠকের মঞ্চ, হোর্ডিং ভেঙে দেওয়া হয়। তখনই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল আবের সফর নিয়ে। শুক্রবার দুপুরের দিকে ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রবীশ কুমার জানান, দু’পক্ষের সহমতের ভিত্তিতে শীঘ্রই মোদী-আবে বৈঠকের নতুন দিন ঠিক করা হবে। কিন্তু নির্ধারিত বৈঠক বাতিলের কারণ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখে কুলুপ।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার রাতেই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে স্বাক্ষর করেছেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। বিলের আইনে পরিণত হওয়ার খবর বিক্ষোভে নতুন ইন্ধন জুগিয়েছে। শুক্রবার বড়সড় বিক্ষোভের সাক্ষী থেকেছে মেঘালয়ের শিলং। সেখানে রাজভবনের সামনে পুলিশকে লক্ষ্য করে প্রতিবাদকারীরা পাথর ছোঁড়েন বলে অভিযোগ। তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস ও লাঠি চালায় পুলিশ। তাতে আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন।
বিক্ষোভের আঁচ পেয়েই বৃহস্পতিবার রাতে কার্ফু জারি হয়েছিল শিলংয়ের বেশ কিছু এলাকায়। ৪৮ ঘণ্টার জন্য বন্ধ করা হয়েছিল ইন্টারনেট ও মেসেজিং পরিষেবা। শুক্রবার সকালে ১২ ঘণ্টার জন্য কার্ফু শিথিল করতেই হাজার হাজার মানুষ নেমে পড়েন রাস্তায়। শিলংয়ের দোকানপাট ছিল বন্ধ, রাস্তায় যানবাহনও তেমন চোখে পড়েনি। তার মধ্যেও চলে তাণ্ডব। পুলিশ বাজারে দু’টি গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেন বিক্ষোভকারীরা।
শিলং থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে উইলিয়ম নগরে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা। কিন্তু তিনি চপার থেকে নামতেই প্রতিবাদকারীদের প্রতিবাদ ও ধাক্কাধাক্কির মুখে পড়েন। ‘কনরাড গো ব্যাক’ স্লোগান দিতে থাকেন শয়ে শয়ে মানুষ।
এছাড়া আসামে আর বড়সড় বিক্ষোভের খবর না মিললেও নাগরিকত্ব বিলের প্রতিবাদে ‘অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়নে’র (আসু) ডাকে চাঁদমারিতে গণ অনশনে বসেছেন হাজার হাজার মানুষ। নাগরিকত্ব আইনকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে মামলাও করেছে আসু। আর আসামের এই অবস্থাকে জরুরি অবস্থার থেকেও খারাপ বলছেন অসমের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ।
অন্যদিকে, ত্রিপুরায় নতুন করে কোনও অশান্তির খবর না মিললেও বন্ধ ছিল সব অফিস-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আগরতলা কার্যত বনধের চেহারা নিয়েছিল। আবার নাগরিকত্ব বিলের প্রতিবাদে মিছিল করতে গিয়ে গতকাল পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন দিল্লির জামিয়া-মিলিয়া ইসলামিয়ার কয়েকশো পড়ুয়া। কাঁদানে গ্যাস ও লাঠি চালায় পুলিশ। ৫০ জন প্রতিবাদকারীকে আটক করা হয়েছে।