পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডি হোক বা কোচবিহার বারেবারে সামনে চলে আসা গেরুয়ার গোষ্ঠী কোন্দল প্রমাণ করছে এই মুহূর্তে গেরুয়া শিবিরের অন্দরমহল ঠিক কতটা টলমল। কোথাও ‘এই সভাপতিকে মানব না’ বলে প্রকাশ্যেই স্লোগান উঠছে, তো কোথাও রীতিমতো হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ছে দলের দুই গোষ্ঠী।
তবে শুধু পুরুলিয়া বা কোচবিহারই নয়। সামনে এসেছে রাজ্যের আরও কয়েকটি প্রান্তের ঘটনা। যেমন গভীর রাতে বারাকপুরের বিজেপি সভাপতি ফাল্গুনি পাত্রর বাড়িতে চড়াও হন দলেরই শ’দুয়েক কর্মী। কারও হাতে লাঠি, কারও পকেট-ভর্তি ইট। শুরুতে গালিগালাজ। তার পরই শুরু ইট-বৃষ্টি। ভেঙে দেওয়া হয় ফাল্গুনির বাড়ির জানালা ও গাড়ির কাচ।
অন্যদিকে, বহরমপুরে যখন বিজেপির সাংগঠনিক নির্বাচন চলছে। কারচুপির অভিযোগে সদলবলে সেখানে হাজির মহিলা মোর্চার রাজ্য কমিটির সদস্য অনামিকা ঘোষ। শুরু হয়ে যায় ধুন্ধুমার। ঘটনাস্থল থেকে ফেসবুক লাইভ করেন ওই নেত্রী। তার পর জেলা পার্টি অফিসেই বসে যান অনশনে।
আবার সকালে ঘুম থেকে উঠে বারাসতের বিজেপি জেলা সভাপতি শঙ্কর চট্টোপাধ্যায় দেখলেন, বাড়ির বাইরে বিজেপির ছেলেরাই তাঁর বিরুদ্ধে পোস্টার সেঁটে গিয়েছে। রাতে জেলার নবনির্বাচিত মণ্ডল সভাপতিদের বৈঠকে ডাকেন শঙ্কর। আচমকা সেখানেও দলবল নিয়ে হাজির হন কয়েক জন প্রাক্তন মণ্ডল সভাপতি। তর্কাতর্কি থেকে অচিরেই বেধে যায় হাতাহাতি। জল গড়ায় থানা-পুলিশ পর্যন্ত।
এই তিন ঘটনা ঘটেছে বিজেপির সাংগঠনিক নির্বাচন ঘিরেই। তবে এ সবই সিন্ধুতে বিন্দুমাত্র। সাংগঠনিক নির্বাচন ঘিরে গত এক মাসে অবিরাম অভিযোগ জমা পড়েছে রাজ্য বিজেপি দফতরে। মণ্ডল সভাপতির চেয়ারে কে বসবেন আর কে বাদ পড়বেন, তা নিয়েই কখনও জেলা পার্টি অফিসের বাইরে বোমা পড়েছে, কখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিজেপি কর্মীরাই ঘেরাও করে রেখেছেন জেলা সভাপতিকে।
মণ্ডল সভাপতি হওয়ার জন্য এই মরিয়া লড়াই কেন? বিভিন্ন সূত্রে রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব জানতে পেরেছেন, নেপথ্যের কারণটি আসলে আর্থিক। ‘পার্টি ফান্ডে’র নিয়ন্ত্রণ হাতে রাখার জন্যই মণ্ডল সভাপতি হওয়ার এত তাগিদ নেতাদের। আগামী বিধানসভা ভোটকে বাংলায় পাখির চোখ করেছেন অমিত শাহরা। ফলে আগামী দেড় বছর রাজ্য জুড়ে গুচ্ছ রাজনৈতিক কর্মসূচী থাকবে। সে জন্য দিল্লী থেকে বরাদ্দ টাকা রাজ্য, জেলা হয়ে পৌঁছবে মণ্ডল সভাপতিদের হাতেও।
বিজেপির মণ্ডল-স্তরের নেতা-কর্মীরা বিলক্ষণ জানেন, টাকার অঙ্কটা মন্দ নয়। অভিযোগ, পার্টির কর্মসূচীতে খরচের জন্য বরাদ্দ টাকায় ভাগ বসাতেই প্রাণপাত করছেন রাজ্যে বিজেপির ১২৪৪টি মণ্ডলের তাবড় নেতারা। সামনে রাজ্যে শতাধিক পুরসভায় ভোট।
বিজেপির সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী, পুরভোটে টিকিট কারা পাবেন, তাও অনেকাংশে নির্ভর করে মণ্ডল সভাপতিদের ওপর। দলের একাংশের মত, পুরভোটে টিকিট ‘বিক্রি’ করে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার জন্যও অনেকে মরিয়া। সে কারণেই সাংগঠনিক নির্বাচন ঘিরে এত লড়াই।
রাজ্য বিজেপির এক শীর্ষ নেতার কথায়, ‘মণ্ডল সভাপতি হয়ে ‘টু-পাইস’ কামিয়ে নেওয়ার আরও উপায় আছে। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, মণ্ডলস্তর পর্যন্ত দেশের সর্বত্র নতুন পার্টি অফিস হবে। এ রাজ্যেও বিভিন্ন জেলায় পার্টি অফিস তৈরির জন্য জমি কেনা হয়েছে। পার্টি অফিস তৈরির জন্য ইমারতি দ্রব্য কারা সাপ্লাই করবে, সেটাও মণ্ডল সভাপতিদের হাতেই থাকবে। ফলে সেখানেও রয়েছে কাটমানি খাওয়ার সুযোগ!’
পুরভোট আসন্ন কলকাতাতেও। তার আগে শহরে মণ্ডল সভাপতি নির্বাচনেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব তীব্র হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে আশঙ্কায় কলকাতার চারটি সাংগঠনিক জেলাতেই নির্বাচন স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছেন বিজেপি রাজ্য নেতৃত্ব। তবে মণ্ডল সভাপতি নির্বাচনের সঙ্গে অর্থিক যোগ প্রকাশ্যে স্বীকারে নারাজ নেতারা।
দলের সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসুর কথায়, ‘টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে তৃণমূলে গন্ডগোল হয়। আমাদের দলে ভাগও নেই, বাঁটোয়ারাও নেই। সাংগঠনিক নির্বাচন নিয়ে যেটুকু ঝামেলা, সেটা কিছু কর্মীর অতি উৎসাহে।’ যা শুনে তৃণমূলের এক নেতার কটাক্ষ, ‘বিজেপিতে ভাগ-বাঁটোয়ারাই যে সব, সেটা বুঝতে কারও বাকি আছে নাকি!’