বেশি নয়, মাত্র তিন আসনের উপনির্বাচনের ফল। কিন্তু সেই ফলের দিকেই তাকিয়ে ছিল রাজনৈতিক মহল৷ কারণ এই উপনির্বাচন তো শুধুমাত্র উপনির্বাচনই ছিল না। এ ছিল আদতে ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের কোয়ার্টার ফাইনাল। তাই বেশিরভাগ সময়ই উপনির্বাচন নিস্তরঙ্গ ভাবে কেটে গেলেও, এবার রাজ্য রাজনীতি রীতিমতো আলোড়িত। ৩ কেন্দ্রের উপনির্বাচনেই বিজেপির বিরুদ্ধে রায়ে স্পষ্ট বাংলার রাজনীতির হাওয়ামোরগ এখনও মমতার দিকেই মুখ করে আছে।
প্রসঙ্গত, গত লোকসভা নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে এই লড়াই আসলে ছিল আগের তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে পড়া তৃণমূলের সঙ্গে আচমকাই রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল হয়ে ওঠা বিজেপির। ফল দু’দলের কাছেই অপ্রত্যাশিত। কারণ বিজেপিকে ‘হোয়াইট ওয়াশ’ করে দেওয়ার ‘আশাবাদী’ হিসেব তৃণমূলের উপরতলাও কষেনি। অপর দিকে বিজেপিও ভাবতে পারেনি, করিমপুর ছাড়া খড়গপুর এবং বিশেষ করে কালিয়াগঞ্জ থেকেও তাদের হেরে ফিরতে হবে। ঠিক যেমন লোকসভায় ১৮টি আসন হারাতে হবে, ভাবতে পারেনি তৃণমূল।
যে তিনটি আসনে উপনির্বাচন হল, তার মধ্যে একমাত্র করিমপুরই ছিল তৃণমূলের হাতে। তবে এ বার সেখানে জয়ের ব্যবধান ২০১৬-র বিধানসভা এবং ২০১৯-এর লোকসভা ভোটকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। কালিয়াগঞ্জে ব্যবধান খুব বেশি না হলেও এই প্রথম সেখানে জিতল তৃণমূল। তা-ও বিজেপিকে হারিয়ে। আর খড়গপুরে তৃণমূলের এই প্রথম জয় যাঁকে সবচেয়ে বড় ধাক্কা দিল, তিনি এই কেন্দ্রের প্রাক্তন বিধায়ক, বর্তমান সাংসদ ও বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ।
উল্লেখ্য, মানুষ যখন ভোট দেন, তখন তাঁর বিবেচনায় প্রধানত একটি-দু’টি বিষয় বড় হয়ে ওঠে। এই ভোটে যেমন ছিল জাতীয় নাগরিক পঞ্জী বা এনআরসি। সেই সঙ্গে গত ছ’মাসে দলকে ‘বদলে’ দেওয়ার জন্য মমতার চেষ্টাও ভোটদাতাদের নজরে এসেছে। গোটা দেশে এনআরসি চালু এবং দেশবাসীর ঘাড়ে নিজের ‘ভারতীয়ত্ব’ প্রমাণের দায় চাপানোর যে প্রচেষ্টা বিজেপি চালাচ্ছে, তাতে সকলেই আতঙ্কিত। উল্টো দিকে মমতা যেভাবে এই রাজ্যে ‘যে কোনও মূল্যে’ এনআরসি রুখবেন বলে দাবি করেছেন, তাতেই রাজ্যবাসীর কাছে এক বড় ‘ভরসা’ হয়ে উঠেছেন তিনি।
যে তিন কেন্দ্রে এই উপনির্বাচন হল, তার মধ্যে নদিয়ার করিমপুরে মুসলিম এবং উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জে রাজবংশী ভোট ফলাফল নির্ধারণে বড় ভূমিকা নিয়েছে। খড়গপুরের ফলে ছাপ ফেলেছে রেল কলোনির অবাঙালি ভোট। এবং এই ৩ কেন্দ্রের বিজেপি নেতারাও এখন খোলাখুলি মেনে নিচ্ছেন যে, এনআরসিই ব্যুমেরাং হয়েছে। কারণ এটা পরিষ্কার, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দের বাংলায় ভেদাভেদের সঙ্কীর্ণতা শেষ কথা বলে না। জনগণও তা বরদাস্ত করে না। কারণ বাংলা আশ্রয় দিতে জানে, তাড়াতে নয়।
এ তো গেল ফলাফলের একটি দিক, যা সবচেয়ে বেশি নজরে পড়ার। তৃণমূলের ‘ঘুরে’ দাঁড়ানোর পিছনে আরও যা কাজ করেছে, তার অন্যতম হল ‘সংশোধিত’ তৃণমূলকে তুলে ধরার চেষ্টা। পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গ্রামে মানুষের কাছে যাওয়া, মানুষের দৈনন্দিন চাওয়া-পাওয়া, ক্ষোভ, অভিযোগ শোনা এবং তার প্রতিকারে জোর দেওয়ার মতো নিবিড় জনসংযোগ তিন উপনির্বাচনে তৃণমূলের সাফল্যের একটি বড় কারণ বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। সঙ্গে দলের পুরনোদের সঙ্গে ‘নব্য’ এবং ‘যুব’দের দূরত্ব ঘোচানোর উপরেও যথেষ্ট নজর ছিল মমতার।
এই ‘সংশোধিত’ পথ ধরেই দলকে এগিয়ে দিয়ে মমতা তিনে তিন জিতেছেন বলে দল নিঃসংশয়। তাই এই জয়কে শুধু ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোরের ‘কেরামতি’ বলে জাহির করার বদলে কৃতিত্ব তৃণমূল নেত্রীকে দেওয়ার পক্ষপাতী তৃণমূলের একটি বড় অংশ। তাদের মতে, সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মমতা। তা কার্যকর করেছেন পিকে। তাই আগামীতেও এই পথই ধরে রাখতে চায় তৃণমূল।