১৯৩৯। জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। প্রগতি সাহিত্য সম্মিলনে তরুণ কবি বুদ্ধদেব বসু ঘোষণা করলেন, যে সময় রবীন্দ্রনাথকে গড়ে তুলেছিল, সেই সময় অনেক দিন হল অতীত। সোজা কথা, রবীন্দ্রনাথের দিন ফুরিয়েছে, তরুণ কবির মতে, তিনি এ কালের আর কেউ নন। এই অস্বীকৃতি রবীন্দ্রনাথের বুকে গভীর ভাবে বেজেছিল, দুঃখ পেয়েছিলেন, অভিমান হয়েছিল তাঁর। সেই অভিমান প্রকাশ করতে দ্বিধাও করেননি। ‘আকাশপ্রদীপ’ বইয়ের ‘সময়হারা’ কবিতায় তাঁর বেদনা ধরা পড়েছিল। এই কবিতার বইটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন বুদ্ধদেবেরই সমকালীন আর এক জন কবিকে— সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে উৎসর্গ করার কারণ, সুধীন্দ্র অস্বীকৃতির আঘাত দেননি রবীন্দ্রনাথকে।
তিনি গদ্যে অর্জুন, কবিতায় যুধিষ্ঠির, কাব্যনাটকে কৃষ্ণ। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি নিজেই ছিলেন মহাভারত। একটা আকর গ্রন্থ। তবু তাঁকে কর্ণ মনে হয়। তাঁর রথের চাকা বসেনি, কিন্তু নজরুল, জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, সুভাষ-সুকান্ত সবার চাকা তুলে এনে, তাঁর নিজের চাকা যেন থমকে গিয়েছিল! লিজেন্ড হয়েও তাঁর চোখে জল আরও ভাল কবিতা যে তিনি লিখতেই পারতেন!
ষাটের দশকে, সত্তরের দশকে, আশির দশকে যে দু’জন বাঙালি কবি কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন কলেজ স্ট্রিট, তাঁদের একজনের নাম শার্ল ব্যোদলেয়র। আর একজন রাইনের মারিয়া রিলকে। ফ্রান্স এবং জার্মানি থেকে দু’জনকে যে ভাবে সশরীরে ধরে এনে অনুবাদ করেছিলেন, বাঙালি করেছিলেন, তা অভূতপূর্ব। রবীন্দ্রনাথ অজস্র বিদেশি কবিতা অনুবাদ করেছেন। কিন্তু তিনি কাউকে নিজের জায়গা ছেড়ে দেননি। বুদ্ধদেব নিজের ঘর ছেড়ে দিয়েছিলেন, গর্ভগৃহ ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেটা কখনও কখনও মনে হয়েছে আত্মহত্যা। নিজের কবিতা বিসর্জন দিয়ে অন্যের কবিতা নিয়ে মাতামাতি করা কি অন্যায়! আসলে আত্মহত্যাও এর থেকে সুন্দর হয় না।রবীন্দ্রনাথের পর বুদ্ধদেব বসুই হলেন সব চেয়ে বড় আইকন। প্রথমে ছিলেন রবীন্দ্রবিরোধী। ওই বিরোধিতা না থাকলে নিজের লেখা লিখতে পারতেন না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবন নিয়ে যে লেখা লিখেছিলেন, তা পড়ে চোখে জল আসবে না, এ রকম কোনও বাঙালি নেই। এত বিরোধী ছিলেন যিনি, তিনি এ ভাবে কাঁদিয়ে দিতে পারেন? এর থেকে সুন্দর বিরোধিতাও আর হয় না। ডাঁটাচচ্চড়ি খেয়ে যাঁরা ইংরেজিতে লেখালিখি করেন, তাঁদের সম্পর্কে একটা মারাত্মক কথা বলেছিলেন বুদ্ধদেব। ওঁদের রাস্তাটা ব্লাইন্ড অ্যালি। ওঁদের লেখালিখি হল কিউরিও শপ। মাতৃভাষায় না লিখলে লেখা কখনও সাহিত্য হয়ে ওঠে না। লেখা লেখাই থেকে যায়। কিন্তু গত পঁচিশ বছরে ওঁর কথাটা ক্রমশই মিথ্যে হয়ে, আরও দীর্ঘতর হয়ে সামনে এগিয়ে এল।
সলমন রুশদি, অরুন্ধতী রায়, অমিতাভ ঘোষ, বিক্রম শেঠ এই চার জন প্রমাণ করে দিয়েছেন ইংরেজদের থেকে ওঁরা অনেক ভাল লেখেন এবং নিউ ইয়র্ক টাইমসে ওঁরাই বেস্ট সেলার্স লিস্টে থাকেন। ব্রিটিশ লেখক উইলিয়াম ডারলিম্পল, যিনি জয়পুর ফেস্টিভ্যালে ‘নেটিভ’ কবি-লেখক বাদ দিয়ে থাকেন, খোঁচা দিয়েছেন অমিতাভদের, ‘দুন স্কুল ডায়াস্পোরা’ দিয়ে সাহিত্য হবে না। ওঁরা ভারত চেনেন না। হরি হরি, ভূতের মুখে রামনাম। এ আবার হয় নাকি? তাহলে অরওয়েল যে ‘ইটন’ থেকে বেরনো প্রোডাক্ট, তিনি কেন ব্রিটিশ ওয়ার্কিং ক্লাস নিয়ে লিখতে গেলেন?
বুদ্ধদেব বসু যে তর্কটা ৫০ বছর আগে তুলে দিয়েছিলেন, সেটা এখনও তাহলে জীবিত? সাহিত্যে ‘নেটিভ বনাম নেটিভ’ (ভারতে যাঁরা ইংরেজিতে লেখেন তারা সুপিরিয়র নেটিভ, যাঁরা বাংলা বা তামিলে লেখেন তাঁরা ইনফেরিয়র নেটিভ) এখনও একটা গরম আলু যা হাতে ধরে থাকা যায় না।
জীবনানন্দকে কেউ কবি বলতেই চাইত না, বুদ্ধদেব বসু যদি ওই লেখা না লিখতেন, জীবনানন্দকে আমরা আবিষ্কার করতে পারতাম কি না সন্দেহ। ঠিক টি এস এলিয়টের মতো। জন ডান চারশ বছর ধুলোর নীচে শুয়েছিলেন। তুলে আনলেন এলিয়ট, এখন জন ডান সারা পৃথিবীতে পাঠ্য। জীবনানন্দের ‘হায় চিল’ কবিতাটিকে তিনি ইয়েটসের ‘ও কারলিউ’ কবিতাটির থেকে অনেক ‘তৃপ্তিকর’ বলেছিলেন। গভীর ভাবে শ্রদ্ধা করেও বিষ্ণু দে-কে এক হাত নিয়েছিলেন, ‘ক্রতুকৃতম, অপাপবিদ্ধমস্নাবির, সোৎপ্রাসপাশ, এই সব শব্দ ব্যবহার করে সত্যি লাভটা কোথায়?’ সেই লেখাতেই লিখলেন, ‘সুধীন্দ্রনাথের মারফৎ জানলুম যে আপনার মতো এলিয়ট-ভক্ত কখনও নিছক অন্তঃপ্রেরণার তাড়নে কবিতা লেখেন না। তবে কিসের তাড়নায় লেখেন?’যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে জাতে তুলে দিয়ে গেছেন। এখনও ভারতের বহু শহরে তাঁর নামেই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে চেনে। ওঁর মতো উঁচু মানের শিক্ষক আর হবে না। তাঁর গদ্য পড়ে আজও শিহরন হয়, গর্ব হয় বাংলা ভাষাটা এত ভাল, একটু নমুনা দিই, ‘বহুমুখী গ্যেটে ও রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে আছেন একান্ত হ্যেল্ডারালিন ও জীবনানন্দ, মনীষী শেলি ও কোলরিজের পাশে উন্মাদ ব্লেক ও অশিক্ষিত কীটস, উৎসাহী বোদলেয়ারের পরে শীতল ও নিরন্জন মালার্মে।’
এ রকম একটা ইতিহাসে হস্তক্ষেপ করা লাইনে আধুনিক কবিতার দুশো বছর বলে ফেলা যায়, বাংলায় দ্বিতীয় বার লেখা হয়নি এ রকম মৌলিক পাণ্ডিত্য। এখন যা সব লেখা হয়, সব এখান ওখান থেকে ঝেপে লেখা, বড্ড বেশি ‘বরোড’। বাঙালি এখন বিদ্যাচর্চায় ক্রীতদাস, হাভার্ডে কলম্বিয়ায় মেঘ করলে কলকাতায় বৃষ্টি হয়।শেষ জীবনের রবীন্দ্রনাথকে যে ভাবে দেখেছিলেন, তাতে ছিল মহাকাব্যের উপাদান। ‘মনে করা যাক দিগ্বিজয়ী একজন রাজা, রাজত্ব রইল, রইল অন্তরের রাজকীয়তা। কিন্তু যে পথ দিয়ে রাজার সঙ্গে রাজত্বের যোগাযোগ, সেগুলো বন্ধ হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি প্রেরণা অক্ষুণ্ণ। কিন্তু দেহের যে সামান্য কয়েকটা যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া শিল্প প্রকাশিত হতে পারে না, তারা ঘোষণা করেছে অসহযোগ। শ্রবণশক্তি নিস্তেজ, আঙুল দুর্বল, তুলি ধরার মতো জোর নেই, কলমও কেঁপে যায়। তিনি নাকি বলেন ‘বিধাতা মুক্তহস্তেই দিয়েছিলেন, এবার একে একে ফিরিয়ে নিচ্ছেন।’ এই লেখাতেই লিখেছিলেন, ‘এত সুন্দর বুঝি তিনিও ছিলেন না, এর জন্য এই বয়সের ভার আর রোগ-দুর্ভোগের প্রয়োজন ছিল।’ এই লেখা এখনও চোখ প্লাবিত করে দেয় জলে, কিন্তু জল পড়তে দেয় না। এক জন মাস্টারমশাই, একজন ঔপন্যাসিক, একজন অনুবাদক, ইউরোপ আমেরিকা চষে বেড়ানো প্রাবন্ধিক, এবং সবার উপরে একজন কবি, খণ্ড খণ্ড সত্তা নিয়ে যে অখণ্ড বুদ্ধদেব বসু তিনিই পারতেন এমন করে লিখতে।পাস্তেরনাককে নিয়ে অমিয় চক্রবর্তীকে তিনি যে খোলা চিঠি লিখেছিলেন সেটি বাংলা ভাষায় লেখা একটি শ্রেষ্ঠতম খোলা চিঠি। কেননা গোপন চিঠিতে রাণুকে লেখা ভানুর চিঠিগুলোই এখনও পর্যন্ত হিরের নাকছাবি। পাস্তেরনাকের ‘ডক্টর জিভাগো’ নিয়ে তখন পৃথিবী তোলপাড়, ইউরোপ জুড়ে ‘আমরা ওরা’। বন্ধু অমিয় চক্রবর্তী লিখলেন পাস্তেরনাকের বিরুদ্ধে, ‘রাত্রে ঘরে বসে ভদকা খেলে কী হবে, ওই মানবত্বহীন অবস্থায় লেখা কবিতার দৌড়ও তথৈবচ।’ বুদ্ধদেব শাণিত অক্ষরে উত্তর দিলেন এই বলে যে, যাঁরা জল ও বিশুদ্ধ গোদুগ্ধ ছাড়া আর কিছুই পান করেন না এবং যাঁরা সুরাসক্ত, উভয় শ্রেণীর মানুষই ভাল এবং খারাপ কবিতা লিখেছেন ও লিখে থাকেন।’
অমিয় বলেছিলেন, ‘জিভাগো লোক ভাল নয়।’ বুদ্ধদেব লিখলেন, শেলির অবিবেচনায় তাঁর প্রথম স্ত্রীকে জলে ডুবে মরতে হয়েছিল, গ্যেটে সজ্ঞানে দদ্ধ করেছিলেন বহু নারীর জীবন, বহুকাল পর্যন্ত রক্ষিতাকে পত্নীর মর্যাদা দেননি। ভাল লোক না হলে ভাল কবিতা লেখা যাবে না কে বলেছে? আপনি যদি জিভাগোর কবিতা ‘স্ববিলাসী’ বলেন আমি চুপ করে থাকব যে রকম চুপ করে থাকি টলস্টয়ের সামনে যখন তিনি বলেন ‘কিং লিয়র’ হাস্যকর এবং অপাঠ্য। দশ পাতার এই চিঠিটি প্রত্যেক লেখকের রোজ এক বার করে পড়া উচিত।মস্কো থেকে চল্লিশ মিনিট দূরে পাস্তেরনাকের বাড়ি, আরও দূরে একটি কবরখানায় গিয়েছিলাম তাঁর সমাধি দেখতে। সেখানে দাঁড়িয়েও আমি একটা বিকেল জুড়ে পড়ছিলাম বুদ্ধদেব বসুর এই যুগান্তকারী চিঠি।পাস্তেরনাক জানতে পারলেন না তাঁর হয়ে পৃথিবীতে সব চেয়ে দামি চিঠিটি লিখে রেখে গেলেন একজন বাঙালি কবি।
রবীন্দ্রোত্তর বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বিচিত্রমুখী স্রষ্টার নাম করতে গেলে প্রথমেই মনে পড়বে বুদ্ধদেব বসুর কথা। তাঁর মূল পরিচিতি কবি হিসেবেই। কিন্তু কবিতার পাশাপাশি ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, ভ্রমণকাহিনি, শিশুসাহিত্য, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা— সাহিত্যের এই বিভিন্ন ধারায় সর্বতোমুখী অভিযানে বুদ্ধদেব অবশ্যই অনন্য। এর প্রত্যেকটি ধারায় তাঁর চেয়ে কৃতী স্রষ্টা নিশ্চয়ই আছেন, কিন্তু এতগুলি শাখায় প্রায় সমান দক্ষতা নিয়ে বিচরণ করার মতো ক্ষমতা রবীন্দ্র-পরবর্তী খুব কম লেখকের মধ্যেই লক্ষ করা গেছে। উপরন্তু, শুধু স্রষ্টারূপে নয়, পত্রিকা-সম্পাদক হিসেবে বুদ্ধদেব দীর্ঘদিন যে দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে গেছেন, তারও নজির বেশি নেই। প্রথম ‘প্রগতি’ এবং তার পরে ‘কবিতা’, এই দু’টি পত্রিকা নিয়মিত বের করেছেন তিনি। ‘পরিচয়’, ‘নিরুক্ত’, ‘পূর্বাশা’র পাশাপাশি ‘কবিতা’র মতো অবাণিজ্যিক পত্রিকা চালিয়ে যাওয়া রীতিমতো দুঃসাধ্য ছিল চল্লিশ-পঞ্চাশের প্রতিকূল অর্থনৈতিক পরিবেশে। কিন্তু বুদ্ধদেব তাঁর অদম্য উৎসাহে এবং ভালোবাসায় সে কাজটি সম্পন্ন করে গেছেন। বস্তুত তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টাতেই সেদিন নতুন করে আবিষ্কৃত হয়েছেন ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন জীবনানন্দ দাশ-এর মতো কবি। কোনও বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের দ্বারা চালিত না হয়ে শিল্পগুণকেই লেখার প্রকাশযোগ্যতার একমাত্র শর্ত বলে গণ্য করতেন তিনি। ফলে ‘কবিতা’ পত্রিকায় নরেশ গুহ, অরুণকুমার সরকার, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, কামাক্ষীপ্রসাদ, বিশ্ব বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশাপাশি বিষ্ণু দে সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায় বা সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো বিভিন্ন মানসিকতার কবিদের কবিতা বা তাঁদের কবিতা বিষয়ে আলোচনা ছাপা হতে পেরেছিল।
সেই ‘কবিতা’ পত্রিকা আজ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অসামান্য ঐতিহ্যের ধারক। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, প্রায় পঁচিশ বছর একটানা প্রকাশের পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। হয়তো অর্থনৈতিক কারণে, কিংবা এমনও হতে পারে, সম্পাদক স্বয়ং মনে করেছিলেন— কবিতায় নতুন যুগ এসে গিয়েছে, পুরনো পত্রিকা চালানোর আর প্রয়োজন নেই। কারণ, পাঁচের দশকে ‘উত্তরসূরী’, ‘শতভিষা’ বা ‘কৃত্তিবাস’-এর মতো অনেকগুলি নতুন কবিতাপত্রের আবির্ভাব ঘটেছিল। ‘কবিতা’ বন্ধ হয়ে যায় ১৯৬১ সালে, তারপর অর্ধশতকের বেশি সময় অতিবাহিত। ফলে আজকের প্রজন্ম ‘কবিতা’ সম্পর্কে যেটুকু জানে, তা শুধু অন্যের স্মৃতিচারণের মাধ্যমেই। পত্রিকাটির চেহারা-চরিত্র বিষয়ে প্রত্যক্ষ কোনও ধারণা তৈরি হওয়ার উপায় নেই। কবির জ্যেষ্ঠা কন্যা মীনাক্ষী দত্ত তিন খণ্ডে ‘কবিতা’র নির্বাচিত সংকলন প্রকাশ করেছিলেন প্যাপিরাস থেকে— ডিসেম্বর ১৯৮৭ থেকে জানুয়ারি ১৯৮৯-র মধ্যে। ওই ১৯৮৯-তেই প্রভাতকুমার দাস ‘কবিতা’ পত্রিকা: সূচিগত ইতিহাস প্রকাশ করেন প্যাপিরাস থেকে। কিন্তু তারপর আরও সিকি-শতাব্দী পার হয়ে গেছে। বুদ্ধদেব বসুর রচনাসংগ্রহ খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত হচ্ছিল যে প্রতিষ্ঠান থেকে, সেটিও অধুনালুপ্ত। ফলে আজকের উত্সাহী পাঠকের পক্ষেও জাতীয় গ্রন্থাগার বা ওই ধরনের প্রতিষ্ঠান ছাড়া বুদ্ধদেব বসুর প্রতিটি বইয়ের হদিশ পাওয়া দুঃসাধ্য। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে তিন খণ্ডে বুদ্ধদেব বসুর অগ্রন্থিত গদ্য: ‘কবিতা’ থেকে বইগুলির প্রকাশ গভীর তাৎপর্যবহ। বইগুলি সম্পাদনা করেছেন কবির কনিষ্ঠা কন্যা দময়ন্তী বসু সিংহ।
প্রথম খণ্ডে স্থান পেয়েছে ‘কবিতা’ পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় প্রকাশিত ‘সম্পাদকীয়’ ও নানা গ্রন্থের সমালোচনা। বুদ্ধদেব প্রথম দিকে ‘সম্পাদকীয়’ শব্দটি ব্যবহার করতেন না। শব্দটির প্রথম ব্যবহার লক্ষ করা যায় ‘কবিতা’র বিশেষ ‘রবীন্দ্র সংখ্যা’ (১৯৪১) থেকে। আর শেষ পাঁচ বছর তিনি ‘সম্পাদকীয়’ প্রায় লেখেনইনি। এই সম্পাদকীয়ের অন্তর্গত শোকবার্তা-ও অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধের চেহারা নিয়েছে। যেমন ‘সুকান্ত’। গ্রন্থ-সমালোচনা ‘কবিতা’র আর এক বিশেষ সম্পদ। বুদ্ধদেব নিজেই এ কাজটি করতেন। সমকালীন কবিদের প্রায় প্রত্যেকের কোনও-না-কোনও কাব্যগ্রন্থের (ক্ষেত্র বিশেষে একাধিক) যে সমালোচনা তিনি করে গিয়েছেন, তাতে বোঝা যায়, সমালোচনার কোনও উঁচু মানদণ্ডকে তিনি সচেতন ভাবে প্রয়োগ করতে অভ্যস্ত ছিলেন। শুধুমাত্র স্তবকীর্তন বা ছিদ্রান্বেষণ-এর কোনওটাই তাঁর সমালোচনায় দেখতে পাওয়া যায় না। কাউকে বড় করতে গিয়ে অন্যকে ছোট করা— এ স্বভাব ছিল না তাঁর। যাঁর যেটুকু সম্মান প্রাপ্য, অকৃপণ ভাবে তিনি বিলিয়েছেন। কিন্তু তাঁর নিজস্ব যুক্তিক্রম বা বিশ্বাসের শক্ত ভিত থেকে সরে আসেননি কখনও। প্রয়োজনবোধে অনেক অপ্রিয় সত্যও উচ্চারণ করেছেন নির্দ্বিধায়। যেমন, উত্তরকালীন জীবনানন্দ প্রসঙ্গে তাঁর মূল্যায়ন, যা অনেকেরই অপছন্দের কারণ বলে গণ্য হবে: “মনে-মনে এখনও তিনি নির্জনের নির্ঝর, তাঁর চিত্ততন্ত্রী এখনো স্বপ্নের অনুকম্পায়ী। কিন্তু পাছে কেউ বলে তিনি এস্কেপিস্ট, কুখ্যাত আইভরি টাওয়ারের নির্লজ্জ অধিবাসী, সেই জন্য ইতিহাসের চেতনাকে তাঁর সাম্প্রতিক রচনার বিষয়ীভূত করে তিনি এইটেই প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন যে তিনি ‘পিছিয়ে’ পড়েননি। করুণ দৃশ্য, এবং শোচনীয়।” আবার মনের মতো বই হলে, বুদ্ধদেব তার লিখনভঙ্গির প্রশংসায় উদার, অকৃপণ। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জোড়াসাঁকোর ধারে প্রসঙ্গে তাই তাঁর এমন উচ্ছ্বাসমুগ্ধতা: “জীবনস্মৃতি যে আমরা বারবার পড়ি তা তো খবর জানবার লোভে নয়, শুধু ভালো লাগে বলেই। তেমনি এ-বইও বারবার পড়বো আমরা— পড়বো ছুটির দিনে, দুঃখের দিনে, কাজের ফাঁকে ফাঁকে। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর রঙের পাত্র, রসের পাত্র, এতে একেবারে ঢেলে দিয়েছেন, অথচ দিতে-দিতেও নিজেকে সামলে নিয়েছেন, আবেগের রাশ টেনে ধরেছেন এমন করে যে তাঁর হৃদয়ের ভাবপুঞ্জ সমস্ত বইটিতে অলৌকিক আভার মতো ছড়িয়ে আছে— কোনোখানেই হাত দিয়ে তাকে ধরা যায় না, অথচ সবখানেই সে আছে।”
শঙ্খ ঘোষের ভূমিকা-সংবলিত আলোচ্য বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডের উপজীব্য— রবীন্দ্রনাথ।
আমরা সকলেই জানি, বুদ্ধদেব বরাবরই রবীন্দ্রনাথের এক গুণমুগ্ধ পাঠক। ঠিক ভক্তিতদ্গত চিত্তে তিনি কখনওই রবীন্দ্র-ভজনা করেননি, রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে বরং অনেক ব্যাপারেই তাঁর কুণ্ঠা আছে। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে রবীন্দ্রনাথই তাঁর বিচারে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিল্পী। শতবার্ষিকীর পরে লেখা একটি প্রবন্ধের শুরুই করেছেন তিনি এই ভাবে: “যেন এক দৈব আবির্ভাব— অপর্যাপ্ত, চেষ্টাহীন, ভাস্বর, পৃথিবীর মহত্তম কবিদের অন্যতম: আমার কাছে এবং আমার মতো আরো অনেকের কাছে, এ-ই হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।” যদিও একই অনুচ্ছেদ শেষ করেছেন তিনি এই বাক্যে: “চিন্তাহীন মাল্যচন্দনে আজ আবৃত তিনি, এক বিগ্রহ, তাঁর মাতৃভূমির নব্যতম ‘অবতার’।’’ রবীন্দ্রনাথ তাঁর দৃষ্টিতে এক ক্রমজায়মান শিল্পী— ধীর সানুপুঙ্খ যাঁর বিবর্তন। উত্তরজীবনে বুদ্ধদেবের কয়েকটি সেরা বই রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করেই রচিত। তাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ: কথাসাহিত্য, সঙ্গ: নিঃসঙ্গতা: রবীন্দ্রনাথ কিংবা কবি রবীন্দ্রনাথ-এর কথা স্বতঃই মনে পড়বে। পাশাপাশি ইংরেজিতে লেখা টেগোর: পোর্ট্রেট অব আ পোয়েট (১৯৬২) বইটিও স্মরণীয়। কিন্তু এই বইগুলি প্রকাশের বেশ কিছু আগে থেকেই ‘কবিতা’র পৃষ্ঠায় তিনি রবীন্দ্রনাথের অজস্র গ্রন্থের সমালোচনা করেছিলেন, লিখেছিলেন রবীন্দ্র-রচনাবলী-র (বিশ্বভারতী) বিভিন্ন খণ্ডের পর্যালোচনা কিংবা নীহাররঞ্জন রায় প্রণীত রবীন্দ্র বিষয়ক গ্রন্থের সমালোচনা। সেগুলির কোনও কোনওটিতে হয়তো পরবর্তী-সময়ে-করা বিশদ আলোচনার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল। রবীন্দ্র রচনাবলী প্রথম খণ্ডের আলোচনা করতে গিয়ে তিনি জানিয়েছিলেন— “আঙ্গিকের দিক থেকে এবং ভাবের দিক থেকেও বটে, ‘মানসী’কে রবীন্দ্রকাব্যের মাইক্রোকজম্ বলা যায়।”— ১৯৩৯-এর এই পর্যবেক্ষণই বিস্তৃততর বিশ্লেষণে ফিরে এসেছে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষের সময়ে রচিত ‘বাংলা কাব্যের স্বপ্নভঙ্গ: মানসী’ প্রবন্ধে, যেখানে ‘মানসী’কে তিনি রবীন্দ্রকাব্যের ‘অণুবিশ্ব’ বলেছেন। কবিতার ছন্দ মিল স্তবকবিন্যাস সম্পর্কে তাঁর অনেক তীক্ষ্ন সমীক্ষণ ধরা আছে রবীন্দ্রনাথের ছন্দ বইয়ের আলোচনায়।
তৃতীয় খণ্ডে আমরা পাচ্ছি কবিতার দুর্বোধ্যতা, আধুনিকতা, গদ্যছন্দ কিংবা সমালোচনার পরিভাষা-সংক্রান্ত তত্ত্বভিত্তিক প্রবন্ধের পাশাপাশি ইয়েটস, পল ভালেরি, গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল, এজরা পাউন্ড বা পাস্টেরনাক প্রসঙ্গে বুদ্ধদেবের বক্তব্য। হয়তো সেগুলি পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ নয়, ক্ষেত্র বিশেষে কিছু বিচ্ছিন্ন মন্তব্যের সমষ্টি— কিন্তু তবু তাদের এক জায়গায় যে পাওয়া গেল, সেটাও কম কথা নয়। ‘সমালোচনার পরিভাষা’ রচনাটি আজকের সমালোচককেও সহায়তা করবে। ‘গদ্য ও পদ্য’ কিংবা ‘বাংলা ছন্দ ও মিল’-এর মতো প্রবন্ধ আজকের কবিযশঃপ্রার্থীদেরও ভাবনার খোরাক জোগাবে। সব মিলিয়ে বলতে পারি এই বই তিনটি বুদ্ধদেব-চর্চার ক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য সহায়ক হিসেবে বিবেচিত হবে।
বুদ্ধদেব বসুর হঠাৎ চলে যাওয়াতে দুটো আক্ষেপ তৈরি হয়েছিল ওঁর ভক্তদের মধ্যে। এক, ‘আমাদের কবিতা ভবন’-এর পর তাঁর আত্মস্মৃতিতে যে অংশ আসার কথা ছিল, তা আর এল না। আর দুই, তাঁর ‘মহাভারতের কথা’র দ্বিতীয় খণ্ডে আর হাত দেওয়া হল না।
‘মহাভারতের কথা’য় মহাপ্রস্থানিক পর্বে এসেছিলেন বুদ্ধদেব, সে-পর্বের সঙ্গে টলস্টয়ের ‘ওয়র অ্যান্ড পিস’ উপন্যাসের বিস্তৃত উপসংহার বৃত্তান্তের তুলনা করেছিলেন। এর পর দ্বিতীয় খণ্ডে কী প্রসঙ্গ আনতেন ভক্তদের ধারণা নেই।
কিন্তু আত্মস্মৃতির পরের অংশ এলে?
ভোজ, ভূরিভোজ, ব্যাঙ্কোয়েট! তিনি লিখবেন নিজেকে নিয়ে, আর তারই মধ্যে পাঠক প়ড়ে নেবে কিছুটা কিছুটা বাঙালির ইতিহাস। তাঁর অতীব স্বাদু ও সূক্ষ্ম গদ্যে বর্ণিত দৃশ্যগুলো হবে ক্যামেরাবন্দি মুহূর্তের মতো। স্ন্যাপশটস্!
যেমন, শান্তিনিকেতনে শেষ বয়েসের রবীন্দ্রনাথকে দেখে বুদ্ধদেবের মনে এসেছিল শেষ বয়েসের টলস্টয়কে।যেমন, নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্রেনে উঠেছেন ঢাকার পথে। সঙ্গে স্ত্রী রাণু, মানে প্রতিভা এবং কন্যা মিমি, মানে মীনাক্ষী। কামরায় উঠে বসবার পরেই চোখে পড়ল উল্টো দিকের আসনে বসে নজরুল ইসলাম। কবি জানলা দিয়ে গম্ভীর মুখে বাইরে তাকিয়ে আছেন।বুদ্ধদেব স্ত্রীকে বললেন, ‘‘রাণু, ওই যে তোমার কাজিদা।’’ প্রতিভা দ্রুত তাঁর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘‘আপনি!’’ কবি মুখ ফেরালেন, অনেকক্ষণ প্রতিভাকে দেখে বললেন, ‘‘রাণু?’’ বুদ্ধদেবের শঙ্কা হয়েছিল কবি ঠিক প্রকৃতিস্থ নেই। যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে দেখা যাচ্ছে ফিনফিনে ধুতি-পাঞ্জাবিতে হাতে গোল্ড ফ্লেক সিগারেটের টিন নিয়ে উদাস চোখে হেঁটে যাচ্ছেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু।
‘মহাভারতের কথা’ প্রকাশকালে একটা ধারণা চারিয়েছিল বুদ্ধদেব বসুর ভক্তসমাজে। তা হল, তাঁর বইয়ের নায়ক যুধিষ্ঠিরের মধ্যে নিজের সারস্বত জীবনের ছবি দেখছেন বুদ্ধদেব। বনবাসকালে কী করছেন যুধিষ্ঠির? না, ক্রমান্বয়ে মুনিঋষিদের সঙ্গে আলাপে, আলোচনয় মগ্ন। তাঁর চরিত্রের ব্যাখ্যায় (পড়ুন সমর্থনে) বুদ্ধদেব লিখছেন —
‘‘যুধিষ্ঠির কোনো মহাপুরুষ নন, আমাদের অনেক ভাগ্য তিনি মানুষ, শুধুমাত্র মানুষ— ইতিপূর্বে এরকম একটি কথা আমি বলেছিলাম। সেই সঙ্গে এ কথাটিও এখন যোগ করা দরকার যে তিনি কোনো দেবতার দ্বারা বিশ্রুতভাবে বরপ্রাপ্ত বা অভিশপ্ত হননি (যেমন হয়েছিলেন অর্জুন ও কর্ণ); তাঁর সব বর এবং অভিশাপ তাঁর নিজের মধ্যে প্রচ্ছন্ন ছিলো— সেগুলিকে তিনি কেমন করে স্বীয় চেষ্টায় সমন্বিত ও বিকশিত ক’রে তুলেছিলেন, হ’য়ে উঠেছিলেন সর্বক্ষণসম্পন্ন এক মর্ত্য মানুষ, তারই ইতিহাসের নাম মহাভারত।’’
বুদ্ধদেবের জীবনে যুক্তি-তক্কো-গপ্পের ভূমিকা প্রসঙ্গে খুব সুন্দর মন্তব্য আছে কন্যা মীনাক্ষীর। ‘স্মৃতিতে চিঠিতে বুদ্ধদেব বসু’ বইয়ে লিখছেন—‘‘‘কবিতা ভবন’ ছিল বারোমাসের ‘ওপেন হাউস’। বহু রাত অবধি চলত হাসি-গল্প-তর্ক। মতানৈক্য বাবা শুধু সহ্যই করতেন না, স্বাগত জানাতেন। সেটা ছিল তাঁর কাছে উত্তেজক টনিক ও মননের প্রয়োজনীয় ব্যায়াম।’’
তর্কে জমে যাওয়াটা কদ্দুর পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেত বুদ্ধদেবকে তারও একটা সুন্দর গল্প শুনিয়েছেন মীনাক্ষী: ‘‘আমার মেয়ে তিতির (কঙ্কাবতী) বাড়ির প্রথম নাতনি। মার কাছেই সে বেশি সময় কাটাত। একদিন তিতিরের জ্বরজ্বর হওয়াতে ও বাড়ি যায়নি। মা বাবাকে পাঠালেন নাতনির খোঁজ করতে, আমাদের কর্নফিল্ড রোডের ফ্ল্যাটে। বাবা ঢুকেই জ্যোতির (জ্যোতির্ময় দত্ত) সঙ্গে তর্কে জমে গিয়ে ঘণ্টা দুয়েক কাটিয়ে বাড়ি চলে গেলেন। নীচে নেমেও দু’জনের কথা শেষ হয় না, আমি পাঁচ তলার ওপর থেকে দেখছি, জল পাঠিয়ে দিলাম, বাবা বার বার জল খান বলে। জলের গ্লাস হাতে নিয়ে খেয়াল হল, চোখ তুলে বললেন, ‘তিতির কেমন আছে রে? তোর মাকে গিয়ে বলতে হবে।’ সে দিন সন্ধ্যায় মা আর আমি মিলে বাবাকে যা বকুনি!’’
আমাদের সৌভাগ্য বুদ্ধদেব বসুর জীবনের অনেক মূল্যবান ছবি আমরা পেলাম ওঁর স্ত্রী, কন্যার রচনায়। বিশেষ করে প্রতিভা বসুর স্মৃতিচারণা ‘জীবনের জলছবি’-তে এমন সব টুকরো টুকরো ঘটনা যা স্বভাবসংবৃত বুদ্ধদেবকে বেশ কাছের, জীবন্ত মানুষ করে তোলে। এমন একটা টুকরো কথা হল বুদ্ধদেবের সঙ্গে প্রতিভার রবীন্দ্রনাথকে দেখতে যাওয়া। বিবরণটা প্রতিভার চিত্তাকর্ষক উপন্যাসিক ভাষাতেই শোনা উচিত—
‘‘আমার বিবাহের কিছুকালের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোতে এসেছেন শুনে বুদ্ধদেব আমাকে নিয়ে প্রণাম করতে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ খুশি হলেন বুদ্ধদেব নববধূ নিয়ে তাঁর কাছে যাওয়াতে। আমি প্রণাম করে মুখ তুলতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। পা নড়ে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে, দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ‘মেয়েটিকে তো আমি চিনি গো। তা হলে এই গাইয়ে কন্যাটিকেই তুমি বিবাহ করেছো?’ সামান্য একটু উত্তেজিত হলেই রবীন্দ্রনাথ হাঁটু নাড়াতেন, দাড়িতে হাত বুলোতেন। বুদ্ধদেব বাড়ি ফিরে বললেন, ‘তোমার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আগেও দেখা হয়েছে?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’ ‘আমাকে বলোনি তো!’ ‘কী প্রসঙ্গে বলবো। তুমি তো জিজ্ঞাসা করোনি।’ ‘এর জন্য প্রসঙ্গ দরকার হয়? জিজ্ঞাসা করার প্রশ্ন ওঠে? রবীন্দ্রনাথকে দেখা শোনা পরিচয় থাকা সবই তো একটা ঘটনা। একটা বলবার বিষয়।’ ‘সে তো নিশ্চয়ই।’ ‘তবে?’ …’’
স্ত্রী প্রতিভার যেমন স্মৃতি আছে স্বামীর সঙ্গে রবীন্দ্রদর্শনে যাবার, কন্য মীনাক্ষীর মনে পড়ে বাবার সঙ্গে পথ চলতে মাঝেমধ্যে অল্প সময়ের জন্য জীবনানন্দের সঙ্গে দেখা হওয়ার। বুদ্ধদেব তাঁর প্রিয় জীবনানন্দকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘নির্জনতম কবি’ এবং ঘোষণা করেছিলেন ‘জীবনানন্দর দৃশ্যগন্ধময় নির্জন কান্তারে’ তিনি আনন্দে বিচরণ করেন। মীনাক্ষী লিখেছেন তাঁর বাবা প্রায় জীবনানন্দের ফেরিওয়ালার কাজ করেছেন।
তো এই নির্জন কবির সঙ্গে পথের সাক্ষাৎগুলো কেমন হত? কন্যা লিখছেন, জীবনানন্দ মানুষ এড়িয়ে চলতেন, ‘‘পথে বাবার সঙ্গে দেখা হলে আমরা থাকলে কথা বলতেন না। চট করে রাস্তা পার হয়ে চলে যেতেন, যদি দেখা যেত রাস্তার ওপারে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তা হলে বাবা রাস্তা পার হয়ে গিয়ে কথা বলে আসতেন।
‘‘আমাদের বাড়ি অবশ্য প্রায়ই আসতেন জীবনানন্দ, সকাল অথবা দুপুরের দিকে, যখন ধরে নেওয়া যায় বাইরের কেউ থাকবেন না। কখনো রিল্যাক্স করে আড্ডা দিতে দেখিনি তাঁকে, দেখিনি বাড়ির কোনো উৎসবে কি নিমন্ত্রণে। কাজের কথা বলেই চলে যেতেন।’’
বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত পত্রিকার (‘প্রগতি’, ‘কবিতা’ ও ‘বৈশাখী’) ওপর জীবনানন্দের নির্ভরতা এবং বুদ্ধদেবের জীবনানন্দ মুগ্ধতার এক চমৎকার তথ্য দিয়েছেন সমীর সেনগুপ্ত তাঁর ‘বুদ্ধদেব বসুর জীবন’ বইয়ে। লিখছেন— তাঁর কবিতার সংখ্যা ১৬২ (জীবিত অবস্থায়)। ‘প্রগতি’, ‘কবিতা’ ও বৈশাখী’ মিলিয়ে বুদ্ধদেব বসু প্রকাশ করেছেন তাঁর ১১৪টি। ‘কবিতা’ পত্রিকার সঙ্কলন করার সময় পুরোনো সংখ্যাগুলো পড়তে গিয়ে মীনাক্ষী দেখেছেন এক-এক সংখ্যায় আটটি-দশটি করে জীবনানন্দের কবিতা।
বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’-য় জীবনানন্দের উনিশটি কবিতা, যেখানে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের ষোলোটা এবং পঞ্চ কবির কারওরই ষোলোটার বেশি নয়। ‘‘আজীবন বাবা ছিলেন,’’ মীনাক্ষীর কথায়, ‘‘জীবনানন্দের পরম সুহৃদ ও উগ্র প্রচারক।’’
প্রতিভা বসু তাঁর স্মৃতিচারণায় শ্লাঘার সঙ্গে জানিয়েছেন যে, পরবর্তী সময়ে সেরা কবির দলে আসা প্রায় সকলের লেখাই ‘কবিতা’ পত্রিকা বা কবিতা ভবন থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। তার মধ্যে জীবনানন্দের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘পদাতিক’ ও সমর সেনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কবিতা। প্রতিভা লিখছেন, কবিতা ভবনের প্রথম প্রকাশিত বই জীবনানন্দের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’; দ্বিতীয়টি প্রতিভার গল্পের বই ‘মাধবীর জন্য’।
কবিতা ভবন থেকে যখন ‘এক পয়সায় একটি’ সিরিজ বেরোলো তার কবিতা সম্পাদক হলেন বুদ্ধদেব, গল্পের সম্পাদক প্রতিভা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তা জেনে প্রতিভাকে বললেন, ‘তবে তো আপনার সম্পাদনায় আমার গল্পই প্রথমে যাওয়া উচিত।’ তাই গেল, কিন্তু মানিকবাবুকে সম্মান দক্ষিণা দেওয়া গেল না। প্রতিভা লিখছেন, ‘‘মোটা কাচের চশমার ফাঁকে তাঁর সেই দুই উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি প্রজ্বলিত করে আমাকে ভস্ম করে দিয়ে বললেন, ‘লেখা আমি স্বেচ্ছায় দিয়েছি, টাকার জন্য দিইনি।’
বুদ্ধদেব ও তাঁর বন্ধুবর্গ প্রসঙ্গে সুধীন্দ্রনাথ দত্তর কথা এসে পড়বেই। মীনাক্ষীর মতে, পঞ্চাশের দশকে ওঁর বাবার প্রিয়তম বন্ধু ছিলেন সুধীন্দ্র। সুধীন্দ্র বিএ পাশ করেছিলেন। সমস্ত রকম অ্যাকাডেমিক ও সরকারি বাধা অতিক্রম করে বুদ্ধদেব তাঁকে যাদবপুরে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে পড়াবার জন্য নিয়ে আসেন। বিভাগের প্রথম কয়েক বছরের ছাত্রছাত্রীরা বুদ্ধদেব ও সুধীন্দ্রনাথকে একই সঙ্গে শিক্ষকরূপে পেয়েছিল। এ বার মীনাক্ষীর বয়ানে শুনুন সেই সময়কার একটা ঘটনা—
‘‘ওই সময় সুধীন্দ্র ও রাজেশ্বরী দত্ত প্রায়ই বিকেলে কবিতা ভবনে আসতেন। কিন্তু রাত হওয়ার আগেই তাঁরা চলে যেতেন। জ্যোতি বাবাকে বলল, ওঁরা রাত হবার আগে কেন চলে যান বুঝতে পারেন না? আমাদের একটু এলকোহল রাখতে হবে। জ্যোতি খলনায়কের মতো, অতি সুচতুরভাবে সুধীন্দ্রের নাম করে বাড়িতে প্রথম এক বোতল জিন নিয়ে এল। জ্যোতি রন্ধন ও ককটেল শিল্পে নিপুণ। বাতাবি লেবুর রস দিয়ে সে এক উত্তম পানীয় বানাল। বরফের বালতি, বিটার্স ইত্যাদি অনুষ্ঠানের ত্রুটি নেই, সে এক উৎসব শুরু করে দিল। সুধীন্দ্র সেই সন্ধ্যায় উসখুস করার সঙ্গে সঙ্গেই পানীয় উপস্থিত। অনেকেই কী খাচ্ছেন বুঝতে না পেরে তুলে নিয়েছিলেন।’’
এখানে আমার দুটো বুদ্ধদেব–স্মৃতি উল্লেখ করলে কাজে দেবে। যার একটিতে লেখকের তর্কপ্রিয়তা এবং অন্যটিতে নিজেকে নিয়ে বেশি কিছু বলার অনীহা প্রকট হয়।
গত শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষ পাদে কলেজ স্ট্রিট পাড়ার বড় বাটার দোকানের পাঁচ তলায় আমেরিকান ইউনিভার্সিটি সেন্টারে বিতর্ক, বক্তৃতা, কাব্যপাঠ, ক্যুই়জ ইত্যাদির জমাটি আসর বসত মাসে অন্তত চার-ছ’দিন। এমএ ক্লাসের পড়ুয়ারা কোনওটাই মিস করতেন না।
এরকম এক আলোচনা চক্রে মধ্যমণি হয়ে এলেন বুদ্ধদেব। অন্য আলোচকদের মধ্যে তখনকার ডাকসাইটে লেখক-সাংবাদিক, ঠোঁটে পাইপ-ধরা সন্তোষকুমার ঘোষ, জ্যোতির্ময় দত্ত, কবি নরেশ গুহ ছিলেন। আলোচনা অচিরে তর্কে দাঁড়িয়ে গেল এবং সমস্ত তর্ক উছলে উঠছিল বুদ্ধদেবের হঠাৎ হঠাৎ করা সাহিত্যিক মন্তব্য থেকে। সন্তোষবাবু কিছুক্ষণ তর্কে থেকে তার পর পাইপ ধরিয়ে এক মনে বুদ্ধদেবের মন্তব্য উপভোগ করতে লাগলেন।
নরেশ গুহ মাঝে মাঝে কিছু বলছিলেন ঠিকই, কিন্তু তর্ক যা চালিয়ে যাচ্ছিলেন জ্যোতির্ময়। শেষে তিনিও হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘এ বার অডিয়েন্সও যোগ দিন, আমি আর কত ঝগড়া করব?’ এটা বলার কারণ তার একটু আগে জ্যোতির্ময় বুদ্ধদেবকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনার কি মনে হয়, এখানকার সাহিত্যে ইংরেজ কবি জন ডান-এর মতো কাউকে কখনও পাওয়া গেছে?’ ওঁর প্রশ্ন শেষ হতে না-হতে বুদ্ধদেব বলে বসলেন, ‘কেন, বিদ্যাপতি!’ অমনি কী তুমুল হাসি হল জুড়ে। বিদ্যাপতি সত্যিই জন ডান-এর মতো কিনা এবং হলে কেন, সে-সব চিন্তা সকলের কাছেই তখন অমূলক। সবাই তখন উপভোগ করছে বুদ্ধদেবের ধাঁধিয়ে দেবার মতো ঝাঁ চকচকে রেপার্টি। সন্তোষকুমারকেও দেখা গেল ঠোঁট থেকে পাইপ সরিয়ে ভাল করে হেসে নিচ্ছেন।
দ্বিতীয় স্মৃতিটা এক সাংবাদিক ও লেখকের, কবির নাকতলার বাড়িতে। তিনি অধুনালুপ্ত হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার পূজা অ্যানুয়ালের জন্য এক সন্ধ্যায় বুদ্ধদেবের ইন্টারভিউ নিতে গিয়েছিলেন। তাঁর ভাষায় –
“বেজায় দুর্যোগের সন্ধে। তার ওপর এলাকা জুড়ে লোডশেডিং। ফাঁকে ফাঁকে চা আসছিল। একটা হাল্কা গাউন জড়িয়ে লম্বা সোফায় বসেছিলেন বুদ্ধদেব। দেখলাম খুব রোগা হয়ে গিয়েছেন ‘তপস্বী ও তরঙ্গিনী’-র নাট্যকার, ‘মহাভারতের কথা’-র লেখক, ‘আমাদের কবিতা ভবন’-এর স্মৃতি রোমন্থক। কিন্তু মাথার এক ঝাঁক চুল, ঘাড়-কান বেয়ে নেমে আসছে। আমার ইংরেজিতে করা প্রশ্নের উত্তরে ধীরেসুস্থে ইংরেজিতে উত্তর জুগিয়ে যাচ্ছেন। আমি মোমবাতির আলোতে লংহ্যান্ডে কমা, ফুলস্টপ সমেত ওঁর প্রতিটি শব্দ লিখে নিচ্ছি। বুদ্ধদেব উত্তর দিতে দিতে একের পর এক ‘ব্লু অ্যান্ড হোয়াইট’ সিগারেট টেনে যাচ্ছেন (পরে শুনেছিলাম ওঁর দেখাদেখি কিছু কবি, বুদ্ধিজীবী ‘ব্লু অ্যান্ড হোয়াইট’ ধরেছিলেন)। সেই সাক্ষাৎকার ছিল ষোলো আনা বুদ্ধদেবের কাজ নিয়ে। ওঁর উত্তরগুলো টাইপ করে ওঁর কাছে পাঠালাম দু’দিন পরে। তার পরের দিনই অপিসে ফোন এল কবির। ‘শোনো, ইন্টারভিউ ছেপো না।’ … ‘কেন স্যার?’ … ‘আমি নিজেকে নিয়ে এত সব বলেছি ভাবতেই পারছি না। মনেই হচ্ছে না এসব আমার কথা।’ … ‘লেখায় কিছু ভুল দেখলেন?’ … ‘না, ভুলের কথা তো বলিনি। তবে যা বলেছি, তা আমার নিজের কথা বলে ভাবতে পারছি না।’ … ‘তা হলে?’ … ‘এবারটা ছেড়ে দাও। পুজোর লেখালেখি যাক। নতুন করে একটা সংলাপে বসব। নিজেকে নিয়ে নয়, সাহিত্য নিয়ে।’ …”
সেই দ্বিতীয় সুযোগটা আর আসেনি, কোনও কিছুর জানান না দিয়েই ‘বন্দীর বন্দনা’-র কবি এই জীবন থেকে মুক্তি নিয়ে নিলেন। স্ত্রী প্রতিভা সেই সঙ্কটকালের এক অপরূপ ছবি রেখেছেন ‘জীবনের জলছবি’-তে—
‘‘ডাক্তার ওঁকে বলেছিলেন লেখা নিয়ে সমস্তক্ষণ বসে থাকেন, একটু হাঁটা ভালো। সেই থেকে বাড়ির ছাদে গিয়ে নিয়মিত দু’চার পাক হাঁটতেন। চিরকাল বিদ্যাসাগরীয় চটি পরতেন। ছাদে ঐ চটির শব্দ ছাদের তলাকার মানুষদের কানেও বেশ ভালোভাবে পৌঁছতো। এক দিন হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চটির শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। আমি রুদ্ধশ্বাসে সেই শব্দ শোনার জন্য উৎকর্ণ হয়ে রইলাম। এ পাশ ও পাশ তাকিয়ে আয়াকে দেখতে না পেয়ে ‘গঙ্গামণি গঙ্গামণি’ বলে ডাকতে লাগলাম। গঙ্গামণি সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে বললো, ‘… আমার একটা কী হয়েছে মা, বাবুর জন্য কেমন ভয় করে। রুটি করলাম, মনে হল বাবুর পায়ের আওয়াজটা থেমে গেল। অমনি দৌড়োলাম উপরে। গিয়ে দেখি ছাদে ফুটফুটে জ্যোৎস্না, মস্ত চাঁদ। বাবু সেই চাঁদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন। একটু বাদেই বুদ্ধদেব নেমে এলেন, বললেন, ‘কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে। তোমর টাইল পাতা ছাদটা তার আলোয় কী ভালো দেখাচ্ছিল!’’
এর কিছু দিন পরেই কবি চলে গেলেন। এবং আরেক কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় এক অপূর্ব এলিজি লিখলেন।
৩০শে নভেম্বর ২০১৫ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় দেওয়া কবি-কন্যা দময়ন্তী বসু সিং এক সাক্ষাৎকারে (প্রকাশকাল: আনন্দবাজার পত্রিকা, ১২ই ডিসেম্বর ২০১৫ সাল), তাঁর পিতাকে নিয়ে অনেক অজানা কথা জানিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকারটি নিম্নরূপ –
“দুপুর ছোঁওয়া ৩০ নভেম্বরের বিকেল। সল্টলেকে নিজের বাড়িতে বুদ্ধদেব-কন্যা দময়ন্তী বসু সিং। সামনে খোলা বাবার লেখার খাতা। টেবিলের সব কাগজ ঠেলে হাতে তুলে নিলেন ডায়েরিটা। কাগজের ওপর কালো মুক্তোমালার মতো অক্ষর। তার ওপরে আদরের হাত বুলিয়ে বললেন, ‘‘বলুন, আজ কী জানতে চান…’’
পত্রিকা: নতুন প্রজন্ম বুদ্ধদেব বসু মানেই জানে শুধু বিতর্ক। কীসের এত বিতর্ক?দময়ন্তী: আমার বাবা সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন। ওঁর প্রথম বই ‘বন্দীর বন্দনা’ থেকেই সেই কালের লোক ‘অশ্লীল’ কবি বা লেখক বলে ওঁকে চিহ্নিত করেছিলেন। আসলে উনি নারী-পুরুষের প্রেম এবং নারী দেহের বর্ণনা কবিতা বা গল্পের মধ্যে আনতে দ্বিধা করেননি। সেই সময় রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসও অশ্লীলতার দায়ে পোড়ানো হয়েছে। কিন্তু যখন বুদ্ধদেব বসুরা, তাঁর প্রজন্মের লেখক-কবিরা, মাথা তুলে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন, তখন তাঁরা রবীন্দ্রনাথ থেকে সরে গিয়ে আরও উঁচু কণ্ঠে কথা বলতে চেয়েছিলেন।
পত্রিকা: এই বিতর্কের প্রশ্নে অশ্লীলতা বড় ছিল? নাকি বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্র বিরোধী, এটা বড় ছিল?দময়ন্তী: এই প্রাথমিক পর্বে অশ্লীলতাটাই ‘আধুনিক’ কবি লেখকের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় বিতর্কের বস্তু ছিল। সেটা যে একচেটিয়া বুদ্ধদেবের উপরেই আরোপিত হয়েছিল তা নয়। ‘কল্লোল’ গোষ্ঠী, যার হোতা ছিলেন দিনেশ রঞ্জন, সঙ্গে ছিলেন অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র’র মতো তরুণ সাহিত্যিকরা, তাঁরাও আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। ঢাকা থেকে বুদ্ধদেব বসু ‘কল্লোল’-এর সঙ্গে যুক্ত হন। তখন থেকেই অচিন্ত্য-প্রেমেন-বুদ্ধদেব এই নাম তিনটি একসঙ্গে উচ্চারিত হত। ‘কল্লোল’-এই ‘রজনী হল উতলা’ বেরিয়েছিল। কাজেই বোঝা যাচ্ছে অশ্লীলতার দায় মাথায় নিয়ে সেই সময় থেকে শুরু করে ষাটের দশকে লেখা ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’ পর্যন্ত বুদ্ধদেব বসুকে চলতে হয়েছিল। উনি সহাস্যে চলেওছিলেন।
পত্রিকা: ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’ নিয়ে তো অশ্লীলতার দায়ে মামলা পর্যন্ত হয়েছিল …দময়ন্তী: সেটা একটা ঘটনাই বটে! এর আগেও তো বাবার একাধিক বই অশ্নীলতার দায়ে পুলিশের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে।
পত্রিকা: আচ্ছা, দ্বিতীয় বিতর্কটা কী নিয়ে ছিল ?দময়ন্তী: বাবা কলকাতায় এসে যখন ক্রমশ প্রতিষ্ঠা পাচ্ছেন, বাংলার সব্যসাচী লেখক বলে ওঁকে চিহ্নিত করা হচ্ছে, তখন মনে হয় কোথাও একটা প্রতিরোধ গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। এ নিয়ে অনেক ভেবেছি জানেন, কেন তাঁকে বার বার নানা ধরনের আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল। প্রাথমিক ভাবে আমার মনে হয় ঢাকা-কলকাতা সাংস্কৃতিক বিভেদ তখনও যথেষ্ট তীব্র ছিল। বাংলা সাহিত্যের জগৎটা পুরোটাই দখল করে ছিলেন খাস পশ্চিমবঙ্গীয় সাহিত্যিকরা। তখন বুদ্ধদেব বসু নিতান্তই কিশোর। হাতে লেখা ‘প্রগতি’ পত্রিকা বের করেন, সজনীকান্তের (দাস) ‘শনিবারের চিঠি’-তে বাবা এবং জীবনানন্দ দাশ অশ্লীল ভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। এই আক্রমণ আমাদের বড় হওয়া পর্যন্ত চলেছিল। একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে ‘শনিবারের চিঠি’ গোষ্ঠীর প্রতিটি লেখকই মূলত পশ্চিমবঙ্গীয়। হয়তো একজন বেঁটে কালো বাঙাল ছেলের হঠাৎ কলকাতায় এসে আধুনিক বাংলা কাব্য-সাহিত্য নামক দ্রুতগামী রথের সারথি হওয়াটা এঁরা কেউ মেনে নিতে পারেননি। কেননা বাবা কোনও দলাদলি পছন্দ করতেন না। কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে আড্ডা দিতেন না। চিরকাল নিজের ঘরে বসে প্রচুর কাজ করতেন। তখনও পরিশ্রম করে চলেছিলেন সমসাময়িক ও তরুণতর কবিদের প্রতিষ্ঠার জন্য। ১৯৩৫ থেকে ১৯৬১ অবধি প্রকাশিত ‘কবিতা’ পত্রিকা আজও তার সবচেয়ে বড় সাক্ষী। সত্যি বলতে তখন কবিতা প্রকাশের কোনও জায়গাই ছিল না। প্রতিষ্ঠিত মাসিকগুলিতে কবিতার জায়গা হত (রবীন্দ্রনাথ ছাড়া) গদ্য রচনার নীচে। ‘কবিতা’ পত্রিকার আগেও উনি বিষ্ণু দে’র কবিতার বই ছাপেন। সত্যি বলতে জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ থেকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘পদাতিক’ পর্যন্ত সবই সর্বপ্রথম কবিতা ভবন থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
পত্রিকা: এই বিতর্কের কথায় আপনি ‘প্রাথমিক’ কথাটা ব্যবহার করলেন। তা হলে আরও অন্যান্য কারণ আছে কি?দময়ন্তী (একটু হাসলেন): হ্যাঁ আছে। সেই সময় অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া। কবিতা ভবনে তখন বুদ্ধদেব বসুর চারপাশে অনেক তরুণ কবি, যাঁরা পুরোপুরি সেই দলভুক্ত। বাবা-মা দু’জনেই সক্রিয় ভাবে এই গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন।
পত্রিকা: তরুণ কবিরা কারা ছিলেন?দময়ন্তী: সমর সেন, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়—ছোটবেলা থেকেই এঁদের কাকা বলেই জানি। বামপন্থী আন্দোলন যখন দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে, ঠিক তার আগেই বুদ্ধদেব বসু অনুভব করেছিলেন অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট আন্দোলন আর আগের মতো নেই। শিল্পীর স্বাধীনতায় তাঁরা যেন হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেছিলেন। কে কী লিখবে, পড়বে, ওপর থেকে নির্ধারিত হয়ে আসতে শুরু করল। এই বাধ্যবাধকতা বুদ্ধদেব বসু যে মানতে পারবেন না, সেটা তো স্পষ্টই ছিল।
পত্রিকা: বুদ্ধদেব বসু কি দল ছাড়লেন তখন?দময়ন্তী: অবশ্যই বাবা দল ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। তখন থেকেই বাবার বিভিন্ন লেখায় ব্যক্তির স্বাধীনতা, শিল্পীর স্বাধীনতার কথা।এই বক্তব্য বার বার তাঁর নানা প্রবন্ধে এসেছে। কিন্তু পরবর্তী কালে বামপন্থীরা তাঁর দল ছেড়ে যাওয়া, স্বাধীন মত প্রকাশের এই সাহস বরদাস্ত করতে পারেননি। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদের মতো আপনজনরাও আর কবিতা ভবনের ছায়া মাড়াননি। পরে আমাকেও অনেক বিশেষ বিশেষ মানুষ বলেছেন, বুদ্ধদেব বসুর বই পড়া দলের মধ্যে নিষিদ্ধ হয়েছিল। তিনি নাকি ‘শ্রেণিশত্রু’। যাঁকে কমিউনিস্ট রেজিমে বলা হত ‘এনিমি অব দ্য পিপল।’
পত্রিকা: শুনেছি বুদ্ধদেব বসুকে একটি বিশেষ শ্রেণির লেখক বলে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। তিনি দারিদ্রচর্চায় মনোযোগী নন। তাঁর ওপর দক্ষিণপন্থী ও ‘গজদন্ত মিনারবাসী’, এটা ঠিক?দময়ন্তী: (বেশ রেগে) কবিতা ভবন নামক প্রতিষ্ঠানটি যে কোন ধরনের গজদন্তের মিনার, যাঁরা দেখেছেন তাঁরা জানেন। বুদ্ধদেব বসু নিজের জন্য কোনও দিন বাদ-প্রতিবাদে নামেননি। তাঁর জবাবটুকু ‘মিনার’ নামক কবিতাটা পড়লেই বোঝা যাবে।
পত্রিকা: আর দক্ষিণপন্থা?দময়ন্তী: একবার মার্কিন দেশে গেলেই মানুষকে যদি দক্ষিণপন্থী হতে হয় তা হলে বলার কিছু নেই। তিনি কেবল প্রতিষ্ঠিত লেখকই ছিলেন না, মেধাবী ছাত্রও ছিলেন। সেই জোরেই পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে সরকারি উদ্যোগে প্রথম ১৯৫৪-তে মার্কিন দেশে পড়াতে যান। এর পরে যাদবপুরে ১৯৫৬-য় তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন।
পত্রিকা: বুদ্ধদেব বসু’র নামে রবীন্দ্র বিরোধিতার ধুয়োটা কবে থেকে উঠল?দময়ন্তী: ( প্রচণ্ড উত্তেজিত) বিতর্ক সবচেয়ে বেশি উস্কেছিল রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষে (১৯৬১) যখন সারা পৃথিবী থেকে বাবার বক্তৃতা দেবার নিমন্ত্রণ আসে। প্যারিসে ওঁর একটি বিশেষ বক্তৃতা সূত্রে কোনও একটি সংবাদপত্র সম্পূর্ণ পরিকল্পিত মিথ্যা অপপ্রচার করতে শুরু করেছিল। আয়রনিক্যালি এই প্রবন্ধটি তার আগে ন’বার বাংলা ও ইংরেজিতে বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত হয়েছে। এবং প্রথম বেতার ভাষণ হিসেবে লেখা হয়েছিল। তখন আমি কলেজে। এটা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল কত মানুষের আগ্রহ আসলে নোংরা গসিপে। সত্য-মিথ্যা বিচারে নয়। একটা সংবাদপত্রের পাতায় কত যে নোংরামি করা যায়, এটা তার দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এ বিষয়ে কথা বলতে ঘেন্না বোধ হয়।
পত্রিকা: ওই বক্তৃতার মূল বাংলা ভার্সান তো ‘দেশ’ পত্রিকাতেই বেরিয়েছিল।দময়ন্তী: হ্যাঁ, ওই সময় আনন্দবাজার গোষ্ঠী আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। দেশ-এর সম্পাদক সাগরময় ঘোষ তখন বক্তৃতাটির বাংলায় পুনর্মুদ্রণ করেন। এই সঙ্গে এম.সি সরকারের কর্ণধার সুধীর সরকার মানহানির মামলা করতে উদ্যোগী হন। যেটা অবশ্য আমাদের পরিবারের সর্বসময়ের শুভাকাঙ্খী সত্যেন বসু এসে নাকচ করেন। সংগৃহীত কাগজপত্র তৎক্ষণাৎ জ্বালিয়ে দিয়ে বহ্ন্যুৎসব করা হয়।
পত্রিকা: অথচ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর অসাধারণ সব প্রবন্ধ, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ‘সব পেয়েছির দেশে’-র পাতায় পাতায় ছড়ানো আছে। দুই অসমবয়সি কবির মধ্যে লেখা চিঠিপত্রেও …দময়ন্তী: (থামিয়ে দিয়ে) বুদ্ধদেব রবীন্দ্রনাথকে যে ঠিক কী চোখে দেখতেন সেটা যদি কেউ জানতে চান, তা হলে শুধুমাত্র ‘সব পেয়েছির দেশে’ পড়াই যথেষ্ট। বাবা মাত্র ছয় বছর রবীন্দ্রনাথকে কাছে পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের আগ্রহে শান্তিনিকেতনে আমাদের পুরো পরিবার আমন্ত্রিত হয়েছিল তাঁর ব্যক্তিগত অতিথি হয়ে। আমেরিকা থেকে চিঠি লিখছেন বাবা— ‘‘চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে জগতের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য। আমাকে শুধু রবি-তৃষ্ণায় পেয়েছে’’।
পত্রিকা: কিন্তু ১৯৩৫-এ ‘কবিতা’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথের কবিতা চাইলেন না কেন?দময়ন্তী: রবীন্দ্র-পরবর্তী যাঁরা নিজেদের আধুনিক বলে ঘোষণা করেছিলেন, তাঁদের রবীন্দ্রনাথ থেকে বেরিয়ে আসতেই হত। বিশাল বটগাছের তলায় ছোট গাছ থাকলে তার মৃত্যু অনিবার্য। ‘কবিতা’ পত্রিকার পুরোধা হিসেবে রবীন্দ্রনাথের কবিতা না চেয়ে শুধুমাত্র নিজেদের প্রজন্মের কবিদের নিয়ে তিনি একটি ‘লিটল ম্যাগাজিন’ (এই শব্দটিও বুদ্ধদেব বসুর অবদান) তৈরি করেন। সেটা তাঁদের ঔদ্ধত্য ছিল না। ছিল তারুণ্যের যোশ। তাঁদের দেখাতেই হত যে তাঁরাও স্বকণ্ঠে তাঁদের নিজস্ব কথা নিজের ভঙ্গিতেই বলতে পারেন। তবুও প্রথম সংখ্যাটি বাবা সাহস করে প্রথম রবীন্দ্রনাথকেই পাঠান। শুধু তাই নয়, অনুরোধ করেন দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে কবিতা দেওয়ার জন্য। সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে রবীন্দ্রনাথ তৎক্ষণাৎ কবিতা পাঠিয়ে এই পত্রিকাকে স্বীকৃতি দেন।
পত্রিকা: চিঠিপত্রে দেখেছি ‘চোখের বালি’, ‘যোগাযোগ’ বিষয়ে বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথকে সরাসরি তাঁর মতামত দিয়েছিলেন। কী হয়েছিল?দময়ন্তী: ‘চোখের বালি’র শেষ অংশে অর্থাৎ বিনোদিনীর মধ্যে সাহস ও স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের একটা বদল ঘটে যায়। সেটা বাবার পছন্দ হয়নি। সরাসরি রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন যে তিনি মনে করেন লেখকের অনেক সাহসী হওয়া উচিত ছিল। রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেছিলেন এ কথা সত্যি। যা তিনি করতে চেয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত প্রকাশ্যে করে উঠতে পারেননি।
পত্রিকা: ‘যোগাযোগ’এর ক্ষেত্রে?দময়ন্তী: ‘যোগাযোগ’ প্রসঙ্গ অন্য রকম। বাবা বলেছিলেন ‘যোগাযোগ’-এর দ্বিতীয় খণ্ড হওয়া উচিত। কুমুদিনী-ই হোক বা বিনোদিনী, দেহ বিষয়ে তাদের ছুৎমার্গ ছিল না। তারা বঞ্চিত বলে বারে বারে প্রতিবাদ করেছে। বাবার এই কথা শুনে রবীন্দ্রনাথ প্রতিভা বসু’র দিকে নাকি তাকিয়ে মুচকি হেসে বলেছিলেন, দ্বিতীয় খণ্ড তোমার স্বামীকেই লিখতে বলো না গো।
পত্রিকা: রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আপনার মায়ের নাকি বুদ্ধদেব বসু’র সঙ্গে বিয়ের আগেই দেখা হয়েছিল?দময়ন্তী: ঠিক কথা। মা তখন হাওয়া বদলের জন্য কাকার কাছে দার্জিলিং-এ। শোনা গেল রবীন্দ্রনাথ আসছেন সেখানে। মা সারাদিন দাঁড়িয়ে রইলেন কবির যাওয়া-আসার পথে। কিন্তু কবির দেখা পেলেন না। সেদিন কবি অন্য পথে গিয়েছিলেন। মা যখন অপার দুঃখে হাহুতাশ করছেন তখনই এক বেয়ারা মারফত চিঠি এল। প্রতিমা দেবী লিখেছেন অমুক দিন বিকেলে ওঁর সঙ্গে চা খেলে বাবামশাই খুশি হবেন। মা তো আকাশ থেকে পড়লেন। রবীন্দ্রনাথ নাকি মায়ের দেখা পাওয়া মাত্র বলেছিলেন, তুমি তো সবার গান গাও। আমার গান তো গাও না! এখন থেকে রোজ ভোর হলেই চলে আসবে, আমি তোমায় গান শেখাব।”
এই সাক্ষাৎকারের মাঝে কবি কন্যা কবির দৈনিক রোজনামচা দিয়েছিলেন, সেটা নিম্নরূপ –
সাড়ে ছ’টায়: ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চা। (সেটা আর খেতেন না)।সকাল সাতটায় আবার গরম গরম চা।ন’টায় প্রাতরাশ: ডিম (অবশ্যই হাফ বয়েল। পরে সেটা আবার ওয়াটার পোচ হয়ে গিয়েছিল), টোস্ট। স্বাস্থ্যের কারণে পরে পাঁউরুটির ওপর চিকেন লিভার স্প্রেড দিয়ে।লেখার টেবিলে লেখা শুরু।দুপুর একটা থেকে দেড়টা: স্নান সেরে মধ্যাহ্নভোজ। ডাল, ভাত, মাছ (একটা ছোট মাছ। একটা বড় মাছ)। দই।আবার লেখার টেবিলে ফেরা। এর মাঝে অগুন্তি সিগারেট আর চা।বিকেল পাঁচটা: চা এবং সিগারেট। টায়ের খুব একটা চল ছিল না।দশটা: রাতের খাবার। শেষের দিকে গ্লাসভর্তি বরফে হাফ পেগ ইন্ডিয়ান হুইস্কি। রোজ।রুটি, মাংস।
“পত্রিকা: সবার গান গাও বলতে?দময়ন্তী: মা ধ্রুপদী গানের চর্চা করতেন। অতুলপ্রসাদ, নজরুল, দিলীপ রায়, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়—এঁদের গানই রেকর্ড করেছিলেন। ঢাকায় বসে সঠিক ভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার কোনও গুরু পাননি। সে কারণেই নিজের মনে গাইলেও রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড করার সাহস পাননি। তখন ভদ্র পরিবারে মেয়েদের রেকর্ড করা, গান করা ভাল চোখে দেখা হত না। কিন্তু ওঁর প্রতিভার আশৈশব এত খ্যাতি ছিল যে দিলীপ রায়, নজরুল—এঁরা তাঁকে নিজেদের গান নিজেরাই তুলিয়েছেন। দিলীপ রায় অবশ্য অতুলপ্রসাদ আর দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানও শিখিয়েছিলেন। দার্জিলিং যাত্রায় রবীন্দ্রনাথ নিজেই রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখালেন।
পত্রিকা: নজরুল এবং প্রতিভা বসু’র যে আশ্চর্য সম্পর্ক স্থাপন হয়েছিল সেটা নিয়ে বলুন না …দময়ন্তী: ‘জীবনের জলছবি’-তে মা লিখেছেন সে সব দিনের কথা। আমাদের বাড়িতে নজরুলের সেই গানের খাতা আজও আছে, যার মধ্যে মায়ের ঢাকার বাড়িতে বসে নজরুল মা-কে যত গান শিখিয়েছিলেন তার বড় অংশ নিজের হাতে লিখে দিয়েছিলেন। প্রতিটি গানের তলায় ওঁর সই। রাগ-এর নাম লেখা। মা-কে উনি গানের বই উৎসর্গ করেছেন। নিজের হাতে লিখেছেন—‘কিন্নরকণ্ঠী রাণু মনিকে কবিদা’, ‘কোকিলকণ্ঠী রাণু মনিকে কবিদা’। সেই বাচ্চা মেয়েটির মধ্যে যে প্রতিভা দেখেছিলেন, তাকে কুর্নিশ না করে পারেননি।
পত্রিকা: আপনাদের ২০২ বাড়ির আড্ডায় শুনেছি বসু দম্পতি পরবর্তী প্রজন্মকে প্রচুর প্রশ্রয় দিয়েছেন। এও শুনেছি যাঁরাই আসতেন, তাঁরাই আপনার মায়ের ভক্ত হয়ে যেতেন। আপনার বাবা …দময়ন্তী: (মুখের কথা কেড়ে নিয়ে) কী ভাবে নিয়েছেন, তাই তো?
পত্রিকা: তাই।দময়ন্তী: বাবা জানতেন, বিশ্বাস করতেন, মা একজন বিশেষ নারী। আমরা তো সারাক্ষণ মজা করে বলতাম, মা তোমার কাছে আমরা সবাই হেরে গেছি। ২০২ নম্বরে যিনিই আসতেন, তিনিই মায়ের ভক্ত হয়ে যেতেন। আনন্দবাজারের প্রাক্তন বার্তা সম্পাদক সন্তোষকুমার ঘোষ মায়ের নাতনি তিতির কিশোরী হওয়ার পরে হঠাৎ একদিন আমাকে আর দিদিকে বললেন, ‘তোমরা এখন মধ্যপদলোপী সমাস’ অর্থাৎ মা আর তিতিরের মধ্যে আমরা বেচারিরা একদম আউট! একজন রোম্যান্টিক কবি হিসেবে বাবা এটা উপভোগই করতেন। আসলে বাবার মধ্যে কোনও দিনই কোনও সন্দেহ, সংস্কার, এসব কিছুই দেখিনি। শুনেছি ফুলশয্যার রাতে বউয়ের শাঁখা ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন! কোনও সংস্কার আমাদের কারও মধ্যে থাকুক সেটা চাননি কখনও। বাঙালি বাড়ির রবিবারের দুপুরের মাংস-ভাতের মতোই আমাদের বাড়িতে হত বিফের ঝোল।
পত্রিকা: আপনার বাবার বিষয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন— ‘তরুণদের মধ্যেও তরুণতম।’ বুদ্ধদেব বসুর সন্তানের পরবর্তী প্রজন্ম থেকে এ রকম উক্তি আর কারও ভাগ্যে জোটেনি। আপনার বাবা কি সেই প্রজন্মের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন?দময়ন্তী: উনি তো সময়ের আগে হেঁটেছেন। তাই সবচেয়ে উপভোগ করতেন তরুণদের সংস্পর্শ। সুনীলের আগের প্রজন্মে যে চার যুবক ২০২-এর আবহাওয়াকে আনন্দে মুখর করতেন, তাঁরা ছিলেন অরুণ সরকার, নরেশ গুহ, অশোক মিত্র, নিরুপম চট্টোপাধ্যায়। এঁরা রাত তিনটেয় কড়া নেড়ে লেক-এর গাছ থেকে শিরীষ ফুল এনে চা দাবি করতেন। বাবা-মা আনন্দে তাঁদের আবদার মেটাতেন। এঁদের পাগলামি খানিক থিতু হওয়ার পর এল সুনীল-শক্তিদের দল। বাবার সঙ্গে বসে সিগারেট খাওয়া ওঁরা সবচেয়ে বেশি এনজয় করতেন। বাবা নিজেই সিগারেট অফার করতেন। আর অরুণ সরকার তো মায়ের জন্মদিনে কবিতাই লিখে ফেললেন, ‘সিন্দুক নেই : স্বর্ণ আনিনি,/ এনেছি ভিক্ষালব্ধ ধান্য।/ ও দুটি চোখের তাৎক্ষণিকের/ পাব কি পরশ যৎসামান্য?’ বাবা এক দিন আমাকে বললেন, ‘তোর জন্য খবর আছে। অরুণ সরকারের বিয়ে।’ আমি তো শুনে ধপাস করে মাটিতে বসে পড়েছিলাম (হাসি)।
পত্রিকা: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও তো ২০২-এ খুব নিয়মিত যেতেন!দময়ন্তী: সুনীল-শক্তি যখন তখন এসে প়ড়ত। বাবার সঙ্গে কবিতার ছন্দ নিয়ে তর্ক জুড়ে দিত ওরা। দু’জনেই খুব ভালবাসত বাবাকে। বাবারও ছিল তাদের প্রতি অপত্য স্নেহ।
পত্রিকা: আচ্ছা শিবনারায়ণ রায়ের কাছে সজনীকান্ত দাস আপনার বাবাকে কি কিছু মেসেজ পাঠিয়েছিলেন?দময়ন্তী: আজ যা বলব, তা পুরোটাই শিবনারায়ণ রায়ের মুখে শোনা। এই কথাটা প্রকাশ্যে বলতে পারি কি না, তার অনুমতিও শিবনারায়ণ রায়ের কাছ থেকে আমি নিয়ে রেখেছিলাম। সজনীকান্ত দাস যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন শিবনারায়ণ রায়কে বাবার কাছে পাঠিয়েছিলেন। বাবাকে বলতে বলেছিলেন, বাবার প্রতি তাঁর আচরণের জন্য তিনি সত্যিই অনুতপ্ত। বাবা যেন তাঁকে ক্ষমা করে দেন।
পত্রিকা: তার পর?দময়ন্তী: শিবনারায়ণ রায়ের কাছেই শুনেছি, কথাটা শুনে বাবা খানিক ভাবলেন। তার পর শিবনারায়ণ রায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি ওঁকে ক্ষমা করতে পারলাম না। এমনই দৃঢ়, ভেতরে ভেতরে কঠোর মনের মানুষ ছিলেন বাবা। কোথাও কোনও সমঝোতা করেননি। অথচ সেই বাবাই আমায় শিখিয়েছিলেন সজনীকান্তের মেয়ের সঙ্গে আমেরিকায় দেখা হলে বন্ধুসুলভ আচরণ করতে। বাবা বলেছিলেন, ‘‘আমরা ইতালিয়ান নই যে প্রজন্মের পর প্রজন্ম শত্রুতা টানব।’’
পত্রিকা: বাংলাদেশের কবিদের অনেক কবিতাও ‘কবিতা’ পত্রিকায় বেরিয়েছে। ওখানে বুদ্ধদেব বসুর প্রতি অনুরাগ এখনও প্রগাঢ়…দময়ন্তী: বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবিরা আমাকে নিজেরাই বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ কেমন করে পড়ব, তা শিখিয়েছেন বুদ্ধদেব। আবার জীবনানন্দ কেমন করে বুঝব, তাও জানিয়েছেন তিনিই। অন্য দিকে অমিয় চক্রবর্তীকেও বুদ্ধদেবের জন্যই চেনা।
পত্রিকা: দু’জন প্রতিভাবান মানুষের সন্তান আপনি। মা, না বাবা, কাকে আগে রাখবেন?দময়ন্তী: মা-বাবাকে কখনও কি আগে পরে করা যায়! তবে বাবার জন্য মন কেমন বড্ড বেশি। এত দেশ তো ঘুরলাম, কত জ্ঞানীগুণী মানুষও দেখলাম। আমার বাবার মতো অমন অসূয়াহীনচিত্ত আর একজনকেও পেলাম না। আজ মনে হয়, ‘প্রথম পার্থ’র সেই কর্ণ আর কেউ নয়, আমার বাবা-ই। লোহার বর্ম পিঠে নিয়ে অগুনতি সৈন্যের মাঝে লড়ছেন নিজের লড়াই। কেউ যদি সত্যিকারের গুণগ্রাহিতা নিয়ে বাবাকে পড়েন, তা হলে দেখবেন, উনি কী ভাবে ক্রমশ পরিণত হয়েছেন।আবেগে ভেসে না গিয়ে যে আঁধার আলোর অধিক, সেই জায়গায় নিজেকে পৌঁছে দিয়েছেন।
(তথ্যসূত্র)
১- বুদ্ধদেব বসুর অগ্রন্থিত গদ্য: ‘কবিতা’ থেকে (১ম, ২য়, ৩য় খণ্ড), সম্পাদনা: দময়ন্তী বসু সিংহ, বিকল্প (২০১৫)।
২- আত্মজৈবনিক, বুদ্ধদেব বসু, বাতিঘর (২০১৮)।
৩- বুদ্ধদেব বসু ও অন্যান্য, ড. করুণাময় গোস্বামী, কলি প্রকাশনী (২০১৪)।
৪- আমার ছেলেবেলা আমার যৌবন, বুদ্ধদেব বসু, মাটিগন্ধা (২০১৯)।
৫- জীবনের জলছবি, প্রতিভা বসু, আনন্দ পাবলিশার্স (১৯৯৩)।
৬- ৩০শে নভেম্বর ২০১৫ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় দেওয়া কবি-কন্যা দময়ন্তী বসু সিং এর সাক্ষাৎকার, প্রকাশকাল: আনন্দবাজার পত্রিকা, ১২ই ডিসেম্বর ২০১৫ সাল।
৭- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৫ই ডিসেম্বর ২০১৫ সাল।
৮- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৪ই সেপ্টেম্বর ২০১৩ সাল।
৯- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪শে জানুয়ারি ২০১৫ সাল।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত