এমনিতেই আমাদের দেশে ‘দিবসের’ অভাব নেই। আজ এই দিবস তো কাল ঐ দিবস। নানা দিবস খচিত ভারতবর্ষে আমরা নতুন আরেকটি দিবস উপহার পেয়েছি। এই উপহার দিয়েছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ২০১৫-র ১১ই অক্টোবর একটা গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে তিনি সংবিধান দিবস বলে একটি নতুন দিবস ঘোষণা করেছেন, যা পালিত হবে প্রতি বছরের ২৬শে নভেম্বর। এই দিনটিকে অবশ্য আর পাঁচটা অবান্তর দিবসের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। কারণ সংবিধান দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সংবিধান ছাড়া দেশ হয় না, স্বাধীনতাকে ঘিরে দেশের মানুষ যে স্বপ্ন দেখেন সংবিধান তাকে পূর্ণতা দেয়। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে একটি দিবস অবশ্যই পালন করা দরকার। কিন্তু আমার প্রশ্ন যারা এই দিবস পালনের ডাক দিচ্ছেন তারা নিজেরাই কি সংবিধানের প্রতি দায়িত্বশীল থাকছেন? মোদি যখন সংবিধানের কথা বলেন তখন তা আমার কাছে একটা নির্মম ঠাট্টা বলে মনে হয়। কারণ, ক্ষমতায় আসার পর থেকে তিনি লাগাতারভাবে মানুষের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছেন। তাই তিনি সংবিধানের কথা বললে তা স্রেফ একটা ব্র্যান্ড বিল্ডিং এক্সারসাইজ ছাড়া আর কিছুই নয়।
অবশ্য দেশের যা হালচাল তা থেকেই যে কোন কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ একমত হবেন যে ডিমনিটাইজেশন, এনআরসি, ধর্মের নামে মানুষকে ভাগ করার রাজনীতি, একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ শিল্পগুলির বেসরকারিকরণ সবগুলিই কিন্তু মানুষের মৌলিক অধিকারের ওপর আঘাত। শেষ বিচারে তা আমাদের সাংবিধানিক অধিকারকেই খর্ব করছে। এই সিদ্ধান্তগুলির একটিতেও আমার আপনার কোন লাভ হয়নি। ২০১৫-র ১১ই অক্টোবর ভারতের সংবিধান প্রণেতা বি আর আম্বেদকারের স্ট্যাচু অফ ইকুয়ালিটি মেমোরিয়াল উদ্বোধন করে এই দিবস পালনের ঘোষণা করেছিলেন মোদি। কিন্তু মানুষ জীবনের অভিজ্ঞতায় রোজ দেখছে আম্বেদকারের স্বপ্ন থেকে আজ কত দূরে সরে গেছে আমাদের দেশ! দেশের দলিত ও পিছিয়ে পড়া মানুষদের দুর্দশা আজ সবচেয়ে বেশি।
আমরা যেন চলেছি একটা অন্ধকার টানেলের মধ্যে দিয়ে। মানুষের কোন অধিকারের দাম সেখানে নেই। সংবিধান দিবস নয়, এই সরকারের আমলে প্রতিটি দিবসই যেন একটা কালা দিবস। একটা উদাহরণ দিই, ২০১৬-র ৮ই নভেম্বর আচমকা নোটবন্দির কথা ঘোষণা করলেন মোদি। এতে মানুষের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে সব থেকে বেশি। কালো টাকা ধরার নামে দেশের মানুষকে মৃত্যু, আতঙ্ক, হতাশা এবং চরম দুরাবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছেন তিনি। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে শুরু করে অর্থনীতিবিদরা এখন স্বীকার করছেন এতে কাজের কাজ তেমন কিছু হয়নি। মাঝখান থেকে শোকে, দুঃখে, আতঙ্কে, হতাশায় মারা গেলেন বহু মানুষ। রাতারাতি অসংখ্য মানুষ কাজ হারালেন, ছোট ব্যবসায়ীরা পথে বসলেন। সেই অর্থনৈতিক ধাক্কা দেশ আজও সামলে উঠতে পারেনি।
অথচ মোদি-অমিতদের এব্যাপারে বিন্দুমাত্র কোন অনুতাপ নেই। ঢাকঢোল পিটিয়ে তারা ঘোষণা করেছিলেন বাতিল হওয়া ৫০০, ১০০০টাকার নোটগুলো আর ব্যাঙ্কে ফিরবে না। সেই ঘোষণাকে মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়ে প্রায় সব টাকাই ব্যাঙ্কে ফিরেছে। কালো টাকার সমান্তরাল অর্থনীতির গায়ে ডিমনিটাইজেশন নামক সার্কাসটি কোন আঁচড় কাটতে পারেনি। আজ যারা সংবিধান দিবস পালন করার ডাক দিচ্ছেন তারা কিন্তু অপ্রস্তুত মানুষদের ওপর এই ব্যাপক অর্থনৈতিক আক্রমণ চালিয়ে সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করেছিলেন।
মোদি-অমিতদের মুখে সংবিধানের কথা যেন ভূতের মুখে রাম নাম। মানুষ কিন্তু এখন ধরে ফেলেছে দেশের সংবিধানের কোন তোয়াক্কা তারা করেন না। ১৯৪৯ এর ২৬শে নভেম্বর দেশের সংবিধান গৃহীত হয়েছিল। এটা কার্যকর হয় ১৯৫০এর ২৬শে জানুয়ারি, যে দিনটা আমরা প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করি। মোদির আমলে এসে সেই প্রজাতন্ত্র হয়ে গেছে মোদিতন্ত্র। যেখানে মুষ্টিমেয় কিছু পরিবার, কিছু কর্পোরেট সংস্থা, অবাধ লুঠপাটের স্বাধীনতা ভোগ করে। এই সত্যটাকে আড়াল করার জন্যই তাদের এখন সংবিধান দিবস পালন করার কথা বলতে হচ্ছে। সংবিধান যারা নিজেরাই মানেন না তারাই আজ হয়ে উঠেছেন স্বঘোষিত সংবিধান রক্ষক।
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ আমি আজ চোর বটে।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত