ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে, ১৯৭১ সালে ভারতীয় ক্রিকেট দেখেছিল এক রূপকথার জন্ম। সুনীল গাওস্করের সেই ঐতিহাসিক অভিষেক সিরিজ দেখার পরে ভারতীয় ওপেনারকে নিয়ে যে রূপকথা রচিত হয়েছিল, তা বদলে গিয়েছিল মহারাষ্ট্রের সেই ৫ ফুট ৫ ইঞ্চির লোকটা ক্রিকেট জগৎকে শাসন শুরু করার পর। ক্রিকেট রূপকথাও কখনও জন্মায়, কখনও বদলে যায়। গতকালের ইডেন আর এক রূপকথার জন্মের সাক্ষী থেকে গেল। কারণ ব্যাট হাতে কোনও এক বিরাট কোহলি যে ঐতিহাসিক গোলাপি বলের টেস্টে নতুন এক কাহিনী লিখে গেলেন। দিনরাতের টেস্টে ভারতের হয়ে প্রথম সেঞ্চুরিটি এল কোহলির ব্যাট থেকেই। তিন ধরনের ক্রিকেটে, তিন রকম বলে ধ্রুপদী ব্যাটিংয়ের শেষ কথা হয়ে থাকলেন ভারত অধিনায়ক।
কখনও স্বপ্নসুন্দর কভার ড্রাইভ, কখনও সময়কে থামিয়ে দেওয়া অন ড্রাইভ। কোহলির ১৩৬ রানের ইনিংসে রয়েছে ১৮টি বাউন্ডারি। একটা বাদ দিয়ে বাকি সব ক’টাই ম্যাচ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও চোখে ভেসে থাকবে। বাংলাদেশ পেসার আবু জায়েদকে মারা কোহলির পরপর চারটে চার অনেককেই কুড়ি বছরেরও আগের এক ইডেন টেস্টকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল। যে টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার ল্যান্স ক্লুজনারকে পরপর পাঁচটা চার মেরেছিলেন মহম্মদ আজহারউদ্দিন। কোহলির পঞ্চম শটটা বোলার কোনওমতে পা লাগিয়ে দেওয়ায় সেটা আর বাউন্ডারিতে পৌঁছতে পারে নি। কিন্তু ইডেনে তাঁর টানা দু’নম্বর টেস্ট সেঞ্চুরি করতে সমস্যা হল না। ডিপ স্কোয়ার লেগে তাইজুল ইসলাম শরীর শূন্যে ছুড়ে দিয়ে অবিশ্বাস্য ক্যাচটা না নিলে তিনি কোথায় থামতেন, বলা কঠিন। বর্তমান ভারত অধিনায়কের ব্যাটিং বিক্রম দেখে এক প্রাক্তন ভারত অধিনায়কের মন্তব্য, ‘‘বিরাট তো বুঝিয়ে দিল, গোলাপি বলে ব্যাট করাটা সোজা।’’ বক্তা এই দিনরাতের টেস্টের রচয়িতা স্বয়ং বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।
যাঁরা পরিসংখ্যানের শুষ্ক পাতায় ক্রিকেটকে খোঁজেন, তাঁদেরও তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার মতো রেকর্ড উপহার দিয়ে গেলেন কোহালি। সেই রেকর্ডের তালিকাটা এ রকম: এক, গোলাপি বলের টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ভারতীয় হিসেবে সেঞ্চুরি। দুই, ১৪১ ইনিংসে নিজের ২৭তম টেস্ট সেঞ্চুরি। একই সংখ্যক ইনিংসে একই সংখ্যক সেঞ্চুরি করেছিলেন শচীন তেন্ডুলকারও। তিন, দ্রুততম ৭০ আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি (৪৩৯ ইনিংস)। দু’নম্বরে সচিন (৫০৫ ইনিংস)। চার, অধিনায়ক হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ টেস্ট সেঞ্চুরি (২০)। টপকে গেলেন রিকি পন্টিংকে। সামনে শুধু গ্রেম স্মিথ (২৫)। পাঁচ, সব ধরনের ক্রিকেটে অধিনায়ক হিসেবে ৪১তম সেঞ্চুরি, যা পন্টিংয়ের সঙ্গে যুগ্মভাবে সর্বোচ্চ।
কোহালির রেকর্ড গড়ার দিনে ভারতীয় পেসারদের ‘মার্শাল ল’ জারি ছিল ইডেনে। মানে ওই ম্যালকম মার্শালদের মনে করিয়ে দেওয়ার মতো দুর্ধর্ষ বোলিং আর কী! কোহলি নয় উইকেটে ৩৪৭ রানে ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দেওয়ার পরে প্রেসবক্স থেকে সোশ্যাল মিডিয়া, একটা প্রশ্ন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। টেস্ট কি শনিবার, মানে দু’দিনেই শেষ হয়ে যাবে? বাংলাদেশের থেকেও তখন বেশি চিন্তায় দেখা গেল তাঁদের, যাঁরা তৃতীয় দিনের টেস্টের টিকিট কিনেছেন!
এর মধ্যে ইশান্ত শর্মা প্রথম ওভারেই ফিরিয়ে দিলেন ওপেনার শাদমান ইসলামকে। ইশান্তের বল তখন মোটামুটি অফস্টাম্পের দু’হাত বাইরে পড়ে ব্যাটসম্যানের ব্যাট-প্যাডের ফাঁক দিয়ে গলে লেগস্টাম্পের দু’হাত বাইরে চলে যাচ্ছে। ঋদ্ধিমানকে শরীর ছুড়ে ছুড়ে সে সব বল আটকাতে হচ্ছে।
শুধু তো সুইং নয়, এর পরে ইশান্ত-উমেশ-শামিদের ভয়ঙ্কর ক্ষেপণাস্ত্র আছড়ে পড়তে থাকল ব্যাটসম্যানদের শরীরে। মহম্মদ মিঠুনের হেলমেট প্রায় তুবড়ে গেল ইশান্তের বাউন্সারে। ওই সময় বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমে ক্রিকেটার বলতে অবশিষ্ট স্রেফ মুস্তাফিজুর রহমান। যাঁকে ব্যাট হাতে ‘কনকাশান সাব’ হিসেবে নামানোর চেয়ে কেঁপে যাওয়া মিঠুনকে খেলতে দেওয়া ভাল মনে করেছিল বাংলাদেশ। তাতে অবশ্য লাভ হয়নি। গোটা পাঁচেক বল পরে উমেশ যাদবের শিকার হয়ে ফিরে যান মিঠুন নিজেই। উমেশের বলে আহত হয়েছিলেন মুশফিকুর রহিমও। কিন্তু তিনি খেলা চালিয়ে গিয়েছেন। এই মুশফিকুরের লড়াকু অপরাজিত ৫৯ রান টেস্টটা টেনে নিয়ে গেল তৃতীয় দিনে। তিনি এবং মাহমুদুল্লা (হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পেয়ে বেরিয়ে যান) একটা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংসে ইতিমধ্যেই ইশান্ত তুলে নিয়েছেন চার উইকেট। উমেশ দুই। মহম্মদ শামির অত্যন্ত দুর্ভাগ্য, তাঁর বিষাক্ত সুইং ব্যাটসম্যানদের ব্যাটের কানা অল্পের জন্য ছোঁয়নি। দ্বিতীয় দিনের শেষে বাংলাদেশের রান ১৫২-৬। অঙ্কটা এখন খুব পরিষ্কার। ইনিংস পরাজয় এড়াতে বাংলাদেশকে আরও ৮৯ রান করতে হবে। ভারতকে তুলতে হবে চার উইকেট। এর মধ্যে চোট পাওয়া মাহমুদুল্লা ফের মাঠে নামবেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে বাংলাদেশ টিমের অন্দরেই।