সিনেমার নামেই পরিষ্কার ছিল, এই ছবি গল্প বলবে বর্তমান সময়ের। কিন্তু বাস্তব চিত্র যে এতটাও ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দিতে পারে সিনেমার পর্দায়, তা না দেখলে বিশ্বাসযোগ্য হবে না। অপর্ণা সেনের নতুন ছবি ‘ঘরে বাইরে আজ’ সম্পূর্ণরূপে এখনকার সময়ের ছবি। এখনকার বাংলা সিনেমায় এই সময়ের প্রতিফলন খুবই কম দেখা যায়। আজকের সময়ের অস্থির ও অস্বস্তিকর রাজনীতি কথা বাংলা সিনেমাতে দেখা যায় না বললেই চলে। শিল্পের ক্ষেত্রে রাজনীতির মেলবন্ধনে ক্ষেত্রে সবারই গা এড়িয়ে চলার ভাব। সেদিক থেকে অপর্ণা সেন সত্যিই সাহসের পরিচয় রেখেছেন এই সিনেমায়। নিখিলেশ-বিমলা-সন্দীপের সম্পর্কের মধ্যে প্রতিবাদের রাজনীতি, উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মভিত্তিক অসহিষ্ণুতার রাজনীতিকে সুন্দরভাবে চিত্রনাট্যের পরতে পরতে বুনে দিয়ে দর্শককে মাত করেছেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস থেকে সরে এসে শুধুমাত্র গল্পের কয়েকটি চরিত্র পুনর্নির্মাণ করেছেন তিনি। বৃন্দা অর্থাৎ বিমলাকে প্রতিবাদ ও প্রতিশোধের ‘তরোয়ালে’ বদলে দিয়েছেন। সন্দীপ-বৃন্দার সম্পর্কে শারীরিক দিকটা এসেছে স্বাভাবিকভাবেই। এমনকী বৃন্দাকে অন্তঃসত্ত্বা হিসেবেও দেখিয়েছেন। কিন্তু বিমলা (নাকি বৃন্দা!) হার মানেনি। মুক্তমনা স্বামী নিখিলেশের কাছে ‘ক্ষমা’ পেলেও, সন্দীপের মুখোশহীন চেহারাটি জানার পর নিজের হাতে বাইরের জগতের নোংরামিকে ‘সাফ’ করেছেন বৃন্দা। ঘরের বৃন্দা তখন আর সন্দীপের মক্ষীরানি (Bee) নয়, সে তখন প্রতিবাদের জ্বলন্ত মশাল।
কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের সাহায্য নিয়ে চিত্রনাট্যকে সুন্দরভাবে সাজাতে অপর্ণা অত্যন্ত কুশলী ও সংবেদনশীল শিল্পীর মতো কাজ করেছেন। একদা বামপন্থী থেকে অতি বাম সন্দীপের হিন্দুত্ববাদীতে বদলে যাওয়ার পর্ব ফ্ল্যাশব্যাকে খুব সুন্দরভাবে সাজিয়েছেন অপর্ণা সেন। পাশে দাঁড়ানো যথার্থ শিক্ষিত-অভিজাত নিখিলেশের অবস্থান দুটি চরিত্রের সম্পর্কের অভিঘাতকে আরও স্পষ্ট করে দেয়। এই ছবির প্রধান প্রেক্ষাপট দিল্লীর মহারানি বাগ। এটা আসলে দেশের রাজধানীর রাজনৈতিক চেহারাটার প্রকৃত সত্য তুলে ধরার প্রয়াস।
সিনেমায় মধ্যেই অপর্ণা সচেতনভাবে সমসাময়িক ঘটনা ও একাধিক ব্যক্তিত্বকে অন্য নামে নিয়ে এসেছেন। সমাজকর্মী শ্বেতা, বস্তারের ডাক্তার বিনয় সেনকে খুবই চেনা লাগে। তাঁদের ক্রিয়াকর্মের মধ্যেও সাম্প্রতিক ঘটনার প্রতিফলন স্পষ্ট। আর্মচেয়ার সোশ্যালিস্ট, ইন্ডিয়াল ভ্যালু সিস্টেম, আর্মড রেভোলিউশন, গৌরী লঙ্কেশ খুনের ঘটনাগুলো নানাভাবে ছায়া ফেলে যায় সিনেমার মধ্যে। অপর্ণার এমন সচেতন সমাজ-বীক্ষণের কাজটি এর আগেও আমরা দেখেছি। তবে এই ছবিতে সেটি আরও স্পষ্ট এবং জোরালো। বাংলা সিনেমায় প্রায় হারিয়ে যেতে বসা ‘রাজনীতি সচেতনতা’কে তিনি যেন নতুন আঙ্গিকে ফিরিয়ে আনলেন। এইজন্য সাধুবাদ প্রাপ্য তাঁর।
অভিনয়ে নতুন মুখ তুহিনা দাশ কিছু ক্ষেত্রে সত্যিই সাবলীল। আবার বেশ কিছু জায়গায় অভিনয়ের ক্ষেত্রে আড়ষ্ট ভাব চোখে লেগেছে বড্ড। চমকে দিয়েছেন নিখিলেশের চরিত্রে অনির্বাণ ভট্টাচার্যও। তাঁর চলনে-বচনে-দৃপ্তভঙ্গিমায় ও আভিজাত্যের ছোঁয়ার সঙ্গে একজন বিফল স্বামীর অন্তর্বেদনা এবং স্ত্রীর পরকীয়াকে গ্রহণ করে নেওয়ার উদারতাকে তিনি নিঃশব্দ অভিনয়ে বাঙ্ময় করে তুলেছেন। হিন্দুত্ববাদী নেতা ও একসময়ের ‘লেডিকিলার’ হিসেবে পরিচিত সন্দীপকে জীবন্ত করে তোলায় যিশু সেনগুপ্তের উজ্জ্বল উপস্থিতির পাশাপাশি তাঁর বাচিক অভিনয়ের প্রশংসা করতেই হবে। ছোট্ট চরিত্রে শ্রীনন্দাশংকর, ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়, সোহাগ সেন, অঞ্জন দত্ত সকলেই মানানসই এবং ঠিকঠাক।
আবার একই সঙ্গে অপর্ণার প্রকারণশৈলীর খামতিগুলোও নজর এড়ায়নি। বস্তারে গিয়ে নিখিলেশের গরিবগুর্বো মানুষগুলোর পীড়িত চেহারার ছবি কিংবা শুধু ভাত তরকারির পরিবর্তে হাত দিয়ে খাওয়ার পরামর্শগুলো যেন বড্ড ক্লিশে। যেমন, বাড়াবাড়ি লেগেছে দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই সন্দীপ-বৃন্দার মিলনদৃশ্য। যদিও ‘ছায়ে বাদরা কারে কারে’ গানটি ব্যবহার করে ওই দৃশ্যের উপস্থাপনাকে এক অভিনব নান্দনিক মোড়ক দিয়েছেন তিনি। এছাড়াও বেশ কিছু জায়গায় ঘেঁটে ফেলেছেন তিনি। আসলে বর্তমান সময়ের গল্প বলতে গিয়ে সবকিছু এক জায়গায় নিয়ে আসার ফলেই কিছু দৃশ্যে একটা ‘জগাখিচুড়ি’ ভাব তৈরি হয়েছে। তবে ভাল লাগবে নীল দত্তর আবহসঙ্গীত ও সঙ্গীতের ব্যবহার। ‘ভরা বাদর’ গানটিও সিনেমার সঙ্গে একেবারে যথাযথ। ক্যামেরায় সৌমিক হালদার এবং সম্পাদনায় রবিরঞ্জন মৈত্র বেশ বুদ্ধিমত্তার ছাপ রেখেছেন।
তবে এ ছবির সবটা জুড়েই পরিচালক অপর্ণা সেন। সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক বোধ এবং ভালবাসার চেতনা। ছবির মাধ্যমে বর্তমান ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করেছেন তিনি। আবার মুসলমানদ…