এই শব্দকটি মোট ১১বার মহাভারতে ব্যবহৃত হয়েছে। কখনো সবকটি সন্তান মারা যাবার পরে গান্ধারীর মুখ দিয়ে বলানো হয়েছে, কখনো অর্জুনের মুখ দিয়ে, যখন যুধিষ্ঠির ইতস্তত বোধ করছে নিজের পরিজনদের মারতে। ভীষ্ম ও কৌরবদের একই কথা বলে, উজ্জীবিত করে গেছে। ধর্মযুদ্ধতে ধর্ম বা ন্যায়ের দিকে থাকো। জয় তোমারাই হবে। “Where there is Dharma, there will be Victory”. যেদিক ধর্ম (ন্যায়) সেদিকেই জয়। কী কান্ড দেখুন। ধর্মনিরপেক্ষ দেশের সুপ্রিম কোর্ট এই “যতো ধর্মস্ততো জয়ঃ” শব্দকটাই নিজের মূলমন্ত্র হিসেবে ধরে স্বাধীনতার পর থেকে এগোচ্ছে৷ তার দেওয়ালে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা আছে আজ ও। কোন মানে আছে?
আমরা যারা শান্তির দূত বাবরের উদারতার কথা জানি তারা এটা বিশ্বাস করি, রামায়ণ, মহাভারত সেই যুগের হ্যারি পটার বা বুড়ো আংলা সিরিজ ছিল। সস্তা জোলো বই। যদি ও আমাদের মুরোদ নেই মরুভূমির কোন বই নিয়ে এসব মস্করা করার কারণ উদারতার আজীবন দায়িত্বটা এই রামায়ণ, মহাভারত এ বিশ্বাসীদেরই। তাই মরুভূমির সবকটা রুপকথা আদপে হয়েছিল আর রামায়ণ বা রাম বুড়ো আংলা। অবশ্য ‘বুড়ো আংলা’ বইতে ও “যথা ধর্ম স্ততো জয়ঃ” লেখাটি আছে। লাইনটা ছিল, “যতো ধর্মস্ততো জয়ঃ’ বলে খবরের কাগজের সম্পাদক খবরটা শেষ করলেন।” কোন মানে হয়? একটা চরম হিন্দুত্ববাদী স্তোত্রকে বছরের পর বছর এভাবে রেখে দেওয়া হচ্ছে পাঠ্যপুস্তকে।
ছেলেবেলায় রান্নাবাটি খেলায় অনেক বাক্স ব্যবহার হতো। একটাতে কিছুটা ঘাস, একটায় কয়েকটা নুড়িপাথর, তৃতীয়টায় এক খাবলা ধুলো রাখা থাকতো। ওসব আমার সম্পত্তি ছিল। কোনটা ডাল, কোনটা ভাত, কোনটা মাংস ভেবে খেতে দিতাম বন্ধুকে। বড় হয়ে ও বিভিন্ন তাক, বিভিন্ন বাক্স শোয়ার ঘরে বা রান্নাঘরে পেলে ভালো লাগতো৷ নানা জিনিস আলাদা আলাদা করে রাখা কিন্তু আদপে ওগুলো আমারই বা ওগুলো সবটা আমি।
ইদানিং এক সময় চলছে সবকটা বাক্স ছিনিয়ে নিয়ে একটা বাক্স এক একটা মানুষকে বরাদ্দ করার। তার চারপাশটা বাক্স বা বড়দের ভাষায় মতামত বা ভাবাদর্শ থাকতে পারেনা। তাদের সব্বাইকে দুটো ভাগে ভাগ হয়ে চলতে হবে দাবার ঘুটির মতো। লুডোর ঘুটি রংবেরঙের দিন শেষ।
এই ধরুন আপনি হিন্দু কিন্তু বিজেপি না। পুজোতে আছেন কিন্তু গরু কেটে বিফ ভুনাতে ও আছেন। দেশের জন্য দারুণ বুক ফুলে ওঠে কিন্তু ভারত মাতাকী শুনলেই যে জ্যায় বলে চিল্লাতে হবে তাতে বিশ্বাসী না। আপনি মুসলমানদের সাথে এক পাতে ভাত খেয়ে বড় হয়েছেন কিন্তু জামাতিদের ঘৃণা করেন। আপনি আদপে ওই লুডোর ঘুটি কিন্তু কিছু মানুষ বসে আছে আপনাকে দেগে দিতে কালো বা সাদায়।
আমি সনাতন হিন্দুধর্মের যে বিশালতা তাতে বিশ্বাসী, সিন্ধুসভ্যতার যে বিশাল ঐতিহ্য তাতে অভিভূত কিন্তু বিজেপির বিমুদ্রাকরণের নামে অপদার্থতা দেখে, অর্থনীতির বেহাল দশা দেখে, জয় শ্রী রাম বলে মানুষ খুন করা দেখে বিরক্ত। এবার আমাকে হয় লিবারেল নামক বিকট, অলীক বালখিল্যতায় সামিল হতে বলা হবে নয়তো বলা হবে বিজেপি হয়ে ঘুম থেকে উঠেই আইটি সেলের হয়ে ট্রোল করতে। এর বাইরে হিন্দু-প্রেমী হয়েছো কী চাড্ডী, সাংঘি, হিন্দুত্ববাদী বলে দেগে দেওয়া হবে।
আমাকে কাল থেকে সেরকমই করা হচ্ছে। আমার বেশ রাগ লাগলো বলেই এই লেখা। আমাকে আচমকা দেগে দেওয়া হলো চাড্ডী বলে কারণ আমি হিন্দুধর্মের প্রশংসা করেছি। আমি ও পাল্টা তাকে জামাত বললাম কারণ তিনি সাধারণ হিন্দু বা মুসলমানের মতো না দু তরফের লোকখেপানো নেতার মতো কথা বলছিলেন। আমি কিন্তু Judge করিনি ওনাকে ওনার ধর্ম নিয়ে।
9/11 এর ব্ল্যাক বক্স এর অডিও রেকর্ড এ কোন স্লোগানের শব্দ শুধু শোনা গেছিল হাইজ্যাকারদের মুখে সেই নিয়ে জাজ করিনি আজীবন। নিজেকে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছি যে সন্ত্রাসীদের ধর্ম হয়না। প্যারিসে কোন মধুর স্তোত্র শোনাতে শোনাতে মানুষ খুন করা হয়েছিল, তাই দিয়ে কাউকে জাজ করিনি। আমার মাথা কিন্তু ১৯৯২ বা ২০০২ এ হেট হয়েছিল।
মহাভারত, রামায়ণ বা রামকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত মানেই চাড্ডীপনা নয়, রামকৃষ্ণ মিশন, ইসকন, ভারতসেবাশ্রম সংঘ চাড্ডী নয়। এই দেশের সংস্কৃতির, তার ৩০০০ বছরের ঐতিহ্যের বিশালতাকে ও মানতে শিখুন ! যারা মসজিদ গুড়িয়ে দেয়, ওদের থেকে আমাদের মতো মানুষ বিশ্বাস করুন শতহস্ত দূরে থাকি, আমি ও চাই তাদের জেলে ঢোকানো হোক। আমরা চাই এদের থেকে আলাদা থাকি। আপনি ও নিশ্চয়ই বাগদাদি, মোল্লা ওমর, কাসবের থেকে নিজেকে আলাদা রাখেন!
ন্যায়ের কথা,ধর্মযুদ্ধের কথা মানেই যেমন জেহাদ নয়, সেরকমই যতো ধর্মস্ততো জয়ঃ বা রামায়ণ, মহাভারত প্রেম মানেই হিন্দুত্ববাদী নয়। সুপ্রিম কোর্ট আপনার বিপক্ষে রায় দিয়েছে মানে জজসাহেবরা হিন্দুদের দালাল নয়। মাথায় রাখবেন ওই যতো ধর্মস্ততো জয়ঃ লেখাটির নিচে কিন্তু একজন মুসলমান বিচারক ও ছিলেন – জাস্টিস আব্দুল নাজির। ওই গোটাটা মিলে আমাদের ভারত।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত