৮ নভেম্বর, ২০১৬। বছর তিনেক আগের এই একটি দিন, যা আজও প্রায় বেশিরভাগ দেশবাসীর কাছেই দুঃস্বপ্নের মতো। হঠাতই ওদিন সন্ধ্যায় ৭টায় দূরদর্শনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে এলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সকলেরই চোখ তখন টেলিভিশনের পর্দায়। তারপরই হল সেই বিশেষ ঘোষণা, রাত বারোটার পর থেকে গোটা দেশে বাতিল পুরোনো পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট। মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ল দেশবাসীর। তার পর থেকে ঠিক ৩ বছর কেটে গেল। এতদিনে প্রকট হয়েছে অর্থনীতির বেহাল দশা। দুর্নীতি রোধ, কালো টাকা উদ্ধার আর সন্ত্রাসবাদ খতম করতেই নাকি নোটবন্দী! কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, এগুলির কোনওটিতেই সফল হয়নি মোদী সরকার। বরং বেড়েছে দুর্নীতি, সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ, জাল নোটের কারবার।
বিরোধীদের অভিযোগ, ৩ বছর আগের মোদী সরকারের ভুলের চরম মাশুল দিতে হচ্ছে ভারতীয় অর্থনীতিকে। নোটবন্দীই দেশের অর্থব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিয়েছে। অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, নোটবন্দী, জিএসটির মতো সিদ্ধান্তই চলতি আর্থিক শ্লথতার অন্যতম কারণ। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর নোটবন্দীর পক্ষে দেশ থেকে কালো টাকা উৎখাত করা এবং জাল নোটের কারবার বন্ধ করার যুক্তি খাঁড়া করে দেশের মানু্ষকে ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড় করিয়েছিলেন মোদী। কিন্তু অর্থনীতিবিদ থেকে শিল্প মহলের অনেকেই বলছেন, সেসব কিছু তো হয়ইনি। বরং নোটবন্দীর সিদ্ধান্তে ক্ষতি হয়েছে কৃষক, শ্রমিক, ছোট ব্যবসায়ীদের।
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সুরজিৎ মজুমদারের বক্তব্য, ‘নোটবন্দীর প্রভাব যে অসংগঠিত ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি পড়েছিল তা স্পষ্ট হয়েছে এই ৩ বছরে। আয়করে বিশাল পরিমাণ অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা পড়বে বলা হয়েছিল। বাস্তবে তাও হয়নি। কালো টাকা উদ্ধারেও চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছে সরকার। নোটবন্দীর ফলে কৃষক ও নিম্ন-মধ্যবিত্তরা, ছোট-মাঝারি শিল্পোদ্যোগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতিতে।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকনমিক স্টাডিজ অ্যান্ড প্ল্যানিংয়ের অধ্যাপক চিরশ্রী দাশগুপ্ত বলেন, ‘নোটবন্দীর পরপরই জিএসটির ধাক্কায় ছোট ও মাঝারি উদ্যোগ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মচ্যুত হয় শ্রমিকরা। হাতে কাজ ও টাকাও না থাকায় স্বাভাবিকভাবেই চাহিদা কমে গিয়ে অর্থনৈতিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছে।’
অন্যদিকে, অর্থনীতিতে কালো টাকার রমরমা যেমন ছিল, ৩ বছর পরে তেমনই আছে৷ নতুন নোট বাজারে আসতে না আসতেই জাল হয়েছে। আর, জাল নোটের বেশিরভাগটাই ২,০০০ টাকার নোট। তাহলে নোটবন্দীতে কী লাভ হল? প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা। আসলে সরকার ভেবেছিল, কালো টাকার পরিমাণ মোট টাকার ১৫-২০ শতাংশ এবং তা ব্যাঙ্কে ফেরত আসবে না। কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হিসেব বলছে, বাতিল হওয়া নোটের ৯৯ শতাংশই ফেরত এসেছে। এনসিআরবি রিপোর্ট বলছে, ২০১৭ সালে ২৮.১ কোটির জাল নোট উদ্ধার হয়েছে। যা ২০১৬ সালের তুলনায় ৭৬ শতাংশ বেশি। আবার ২০১৭ সালে ৩,৫৫,৯৯৪টি নোট উদ্ধার হয়েছিল। সেখানে ২০১৬ সালে সংখ্যাটি ছিল ২,৮১,৮৩৯। অর্থাৎ, নোটবন্দীর পরের বছর প্রায় ২৬ শতাংশ জাল নোট বৃদ্ধি পেয়েছিল। এর থেকে স্পষ্ট মোদী সরকারের জাল নোটের কারবারকে সমূলে উৎপাটিত করার কৌশলও কাজে আসেনি।