লেখার সময় কখনই চেয়ার-টেবিল ব্যবহার করতেন না নারায়ণ বিছানায় বালিশ বুকে নীচে নিয়ে উপুড় হয়ে আধশোয়াভাবে বেশ আয়েশ করেই লিখতেন। বরাবরই এমন অভ্যাস ছিল তাঁর। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের সাথে বেশ কিছুকাল একই মেসে একই ঘরে কাটিয়েছিলেন। তখনও নারায়ণ লিখতেন তক্তপোশে উপুড় হয়ে শুয়ে আর নরেন্দ্র শিরদাঁড়া সোজা করে বসে। লম্বা ফুলস্কেপ কাগজের একপিঠে ছোট ছোট অণুবীক্ষণিক অক্ষরে লিখতেন। আয়েশ করে লিখতে বসলে কি হবে লেখার গতি ছিল দুরন্ত। ‘সুনন্দর জার্নাল’ লিখতে বড়জোর সময় লাগত ঘন্টা খানেক! ছোট গল্প লিখতে খুব বেশি হলে একদিন! আর মাঝারি মাপের উপন্যাস এক সপ্তাহের মধ্যে শেষ!
তাঁর ছবি আঁকার হাতটিও ছিল চমৎকার। লেখায় মনোসংযোগ করার জন্য লেখার খাতার মলাটে যা খুশি স্কেচ করতেন।
তাঁর বাড়িতে ছিল বিশাল বিড়ালবাহিনী। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা নাম। রোজ নিজের হাতে তাদের পঙক্তিভোজন করাতেন নারায়ণ। আর তাঁর নিজের খাবার সময়ে পুষ্যিরা ভিড় করে বসে থাকত পায়ের সামনে। পিতার বিড়ালাসাক্তির ছোঁয়াচ লেগেছিল পুত্র অরিজিতের মধ্যেও। মাঝেমাঝেই রাস্তা থেকে বাড়িতে তুলে নিয়ে আসত বিড়ালছানা। কাউকে নর্দমা থেকে কাদা মাখা অবস্থায় তুলে, তো কাউকে আবার অসুস্থ অবস্থায়। মা আশাদেবীর প্রবল আপত্তি কানেই তুলত না কিশোর অরিজিৎ। জানত বাবার বিপুল সায় রয়েছে। তারপর শুরু হত তাদের নাওয়ানো, প্রাথমিক চিকিৎসা ইত্যাদি। সে সব মিটলে ছাদে ইঁটের খুপরি বানিয়ে তার মধ্যে রেখে দিত ছানাদের। বাবা নারায়ণ বিকেলে বাড়ি ফেরার পরে তাদের বন্দিদশা থেকে মুক্তি মিলত আর বাকি জীবন জুটত ‘নারায়ণ-সেবা’।
সেবার উত্তরবঙ্গে প্রবল বন্যা, ঠিক হল কলকাতার সাহিত্যিকরা সকলে মিলে পদযাত্রা করবেন, সকলের কাছ থেকে অর্থসাহায্য ও জামাকাপড় সংগ্রহ করার জন্য। শ্যামবাজারের মোড় থেকে যেদিন পদযাত্রা শুরু হবে, সেদিন সকাল থেকেই আকাশে ছিল প্রচন্ড রোদ। দেখা গেল বেশিরভাগ সাহিত্যিকই অনুপস্থিত, কিন্তু নারায়ণ ঠিক এসে হাজির। সঙ্গে তাঁর স্ত্রী আশাদেবীকেও নিয়ে এসেছিলেন। তারপরে ওই রোদ মাথায় নিয়ে প্রায় চার ঘণ্টা হেঁটে দুর্গতদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহ করায় নেতৃত্ব দেন তিনি।
‘সুনন্দর জার্নাল’ – এর দোসর ছিল চন্ডী লাহিড়ীর কার্টুন। সুনন্দ’য় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় যা লিখতেন চন্ডী লাহিড়ী ছবি আঁকতেন ঠিক তার উল্টো। অর্থাৎ লেখা ও ছবি চূড়ান্ত পরস্পর বিরোধী হত। এটা ইচ্ছা করেই করতেন চন্ডী, যাতে নারায়ণ যে কথা বলে ওঠেন নি, চন্ডী তাঁর আঁকা ছবিতে সেই টুকুও বলে দিতেন। দু’জনের দারুন যুগলবন্দী জমে উঠেছিল। কিন্তু দু’জনেই পরস্পরের মুখোমুখি হতেন না। বিশেষ করে চন্ডী তো খুব সাবধানে এড়িয়েই চলতেন নারায়ণ কে। জানতেন তাঁর মতন মানুষের মুখোমুখি হলে প্রভাবিত হয়ে পড়বেন, আর যা ইচ্ছে ছবি আঁকতে পারবেন না। কিন্তু দু’জনেই ছিলেন দু’জনের গুণমুগ্ধ। শেষে একদিন আর পালিয়ে লুকোতে পারলেন না চন্ডী, ধরা দিতেই হল। আর নারায়ণও ছিলেন তেমনই মানুষ। তাঁর ও চন্ডী লাহিড়ীর প্রথম সাক্ষাতে দু’জনে অনেক গল্প করেছিলেন। কিন্তু নারায়ণ একবারের জন্যও ‘সুনন্দর জার্নাল’ ও তার ছবির প্রসঙ্গ তোলেন নি। চন্ডী বুঝেছিলেন যে নারায়ণ এটা ইচ্ছা করেই করেছিলেন, পাছে নারায়ণের কথায় চন্ডী প্রভাবিত হয়ে পড়েন। তবে এই আলাপের পরে নারায়ণ তাঁর এক সাংবাদিক বন্ধুকে বলেছিলেন, চন্ডী আমার টাক দেখে ফেলেছে। এবারে আমার টাকের ছবি না এঁকে বসে। সে কথা কানে গিয়েছিল চন্ডী লাহিড়ীর। কিন্তু নারায়ণের টাক মাথার ছবি কোনও দিন আঁকেন নি তিনি।
সুনন্দর জার্নাল তখন হই হই করে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। বাঙালি পাঠক প্রতি সংখ্যার জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকেন কলামটি পড়বেন বলে।প্রতিটি কিস্তিই যেন নলেন গুড়ের রসে ডোবানো এক-একটি তীক্ষ্ণ তির। তেমনই একটি সংখ্যায় পাড়ার কালীপুজো নিয়ে অসুস্থ শরীরে সুনন্দ লিখেছেন, ‘‘এই এক ঘণ্টার মধ্যে বার আষ্টেক শুনেছি, ‘আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিল’। অকালমৃত পান্নালাল ভট্টাচার্যের দুর্ভাগ্য (না না আমারই), এমন দরদ দিয়ে গাওয়া গানটিও আমার যমযন্ত্রণা হয়ে উঠেছে। যত দূর খবর পেয়েছি শ্যামাপুজোয় পরম উৎসাহী যুবকবৃন্দের দু’দিনে আনন্দের বন্যার সাধও মেটেনি, আশাও পোরেনি। তারা আরও দিন তিনেক প্রতিমা প্যান্ডেলে রেখে দেবেন এবং এই সঙ্গীতের মহোৎসব সমানে চালিয়ে যাবেন।’’ ব্যঙ্গরসের লেখাটির শেষ লাইন পড়ে একটু চমকেই উঠেছিলেন পাঠক। নারায়ণ লিখছেন, ‘‘সুতরাং অসুস্থ শরীরে জার্নাল লিখতে লিখতে ভাবছি পরের সংখ্যায় ‘দেশ’-এ সুনন্দর জার্নালের পাতাটি যদি অদৃশ্য হয় আশা করি তাহলে আপনারা কেউই বিস্মিত হবেন না। জানবেন আরেকটি কমনম্যান বাঙালীর অবলুপ্তি বা আত্মবিসর্জন ঘটল।’’ সেদিন অবশ্য সকলেই মুচকি হেসে ভেবেছিলেন, ধুস তাই আবার হয় নাকি! এও নিশ্চয়ই এক নারায়ণী রস। কিন্তু তারপর যখন আর সত্যিই প্রকাশ পেল না সুনন্দ, তত দিনে গোটা বাংলার মানুষ জেনে গিয়েছেন তাদের প্রিয় জার্নাল আর সত্যিই কোনও দিন প্রকাশ পাবে না। আজন্ম রসিক নারায়ণ এবার বড় বাস্তব রসিকতা করেছেন তার নিজের জীবনের সঙ্গেই! কী করে যে আগাম জেনে গিয়েছিলেন নিজের চলে যাওয়া!
বাবা প্রমথনাথ ছিলেন দুঁদে দারোগা। আরবি ঘোড়ায় চেপে তিরিশ মাইল দূরে ডাকাত ধরতে যেতেন। ডাকাত ধরে বাড়ি ফিরেই ছোট তারকনাথকে (নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের আসল নাম) প্রথম প্রশ্ন, যে বইগুলো ভিপিতে আসার ছিল এসেছে? এমনই ছিল তাঁর বইয়ের নেশা। সময় পেলেই ডুবে যেতেন দেশ বিদেশের নানা বইয়ে। ওই সময়ে পুলিশে বই পড়ছে সেটাকে পুলিশমহলে ভারী অন্যায় এবং লজ্জাজনক ব্যাপার বলে ধরা হতো, কিন্তু বাবা ছিলেন পুরো উল্টো। বই-অন্ত প্রাণ। বাড়িতে বিশাল লাইব্রেরি, সেখানে শেলি মিলটন শেক্সপিয়র এর পাশাপাশি থাকে বাংলাদেশের প্রায় সব সাহিত্যপত্রিকা। নিজে যেমন গোগ্রাসে পড়তেন ছেলের মধ্যেও ছড়িয়ে দিয়েছিলেন পড়ার নেশা। ফলে যে বয়েসে খোকাখুকুর গল্প পড়ে মন ভরার কথা, সেই বয়েসেই ছেলে পড়ে ফেলল ভারতবর্ষর পাতা থেকে ‘শ্রীকান্তর ভ্রমণ কাহিনী’, দেশবন্ধু দাশের ‘স্বামী’র মতো প্রাপ্তমনস্ক লেখা। সব যে বুঝত তা নয়, কিন্তু মনে এক অদ্ভুত দোলা লাগত। পড়তে পড়তে ইস্কুল জীবনেই একদিন শুরু হয়ে গেল কবিতা লেখা। নিভৃতে কবিতা চর্চার জায়গা হল বাড়ির বারান্দার এক কোণে ভাঙাচোরা জিনিসে ভর্তি এক কাঠের স্তুপ। সেই স্তূপের ওপরেই বসে চলতে লাগল অবিরাম কবিতাচর্চা। নীরব সাক্ষী শুধু অজস্র ইঁদুর। লেখে, ছিঁড়ে ফেলে আবার লেখে। এর মধ্যেই আনন্দলহরী সিরিজের বেশ কিছু ক্রাইম থ্রিলার পরে বালকের মনে হল এইরকম গল্প লিখলে কেমন হয়? ভাবা মাত্র কাজ শুরু। কাব্যচর্চা বন্ধ করে আপাদমস্তক একটি সাহিত্য পত্রিকা করে ফেললেন। সে পত্রিকার তিনিই সম্পাদক, লেখক, প্রচ্ছদশিল্পী, মুদ্রক এবং পাঠক। নিজের পত্রিকাতেই প্রকাশ পেল নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবনের প্রথম উপন্যাস।
সিটি কলেজে রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসব হবে। ছাত্ররা নাটকের মহলা দিচ্ছে। নারায়ণ তখন ওই কলেজেরই বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। ওঁর লেখা ‘রামমোহন’ নাটকটি মঞ্চস্থ হবে। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ছেলেদের মহলা দেখছেন নারায়ণ, প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছেন সকলকে। রামমোহনের চরিত্র করছে যে ছেলেটি, সে তখন বি এ-র থার্ড ইয়ারের ছাত্র। চুটিয়ে ছাত্র ফেডারেশন করা ছেলে। বামপন্থী রাজনীতি করে বলে নারায়ণের একটু বেশিই প্রিয়। নাটক মঞ্চস্থ হল। সকলেই রামমোহনের অভিনয়ে উচ্ছ্বসিত। কিন্তু তাও যেন ছেলেটির মন ভরে না। পরের দিন সটান গিয়ে হাজির তার প্রিয় মাস্টারশমাইয়ের বাড়িতে। ‘‘কাল আমার অভিনয় কেমন হয়েছে স্যার?’’ শিক্ষক নারায়ণ তার ছাত্রের দুই হাত নিজের মুঠোয় ধরে বললেন, দেখবে, ‘‘একদিন তুমি অনেক বড় অভিনেতা হবে। অনেক বড়। আর তখন আমি বসে বসে তোমার জীবনী লিখব।’’ বুকভর্তি আনন্দ নিয়ে সেদিন পটলডাঙার বাড়ি থেকে ফিরে এসেছিল সেই ছাত্র। মাস্টারমশায়ের সেই ভবিষ্যদ্বাবাণী ব্যর্থ হয়নি। সেদিনের ওই সদ্য তরুণটির নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ছাত্রদের যে কোনও ভাল কাজ মানেই শিক্ষক নারায়ণের বিপুল উৎসাহ। শিক্ষকমশাইকে নিয়েও ছাত্রদের একই রকম টান। কেউ কবিতা লিখেছে, সটান চলে গেল স্যারকে শোনাতে, কেউ গল্প লিখেও তাই। স্যারকে না পড়ালেই নয়। স্যারের পটলডাঙার বাড়িতে যখন তখন ছাত্রদের আসা-যাওয়া। হই হই আড্ডা। সে-আড্ডায় ছাত্রদের মধ্যে রয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অমিতাভ দাশগুপ্ত, নির্মাল্য আচার্য্যর মতো তরুণ লেখক। আবার ম্যাট্রিকে প্রথম হওয়া গৌরমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ও। যেতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও। অতি ব্যস্ততাতেও নারায়ণের সবসময় হাসিমুখ। ছাত্রদের লেখা পড়েন। মতামত দেন। কোনও ছাত্র বেশ কিছু দিন লেখা না দেখালে নিজেই জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘লেখা হচ্ছে তো ঠিকঠাক? কী লিখছ দেখিয়ো।’’ কলেজের ছাত্ররা ছিল নারায়ণের প্রাণ। আর সেই ভালবাসা যে শুধু ছেলেদের সাহিত্য চর্চায় উৎসাহ কিংবা ক্লাসে সুন্দর করে পড়ানোর মধ্যেই আটকে ছিল, তা নয়।
এক বারের কথা যেমন। সিটি কলেজে সেদিন নাইট শিফট চলছে। আকাশ মেঘে লালচে। হঠাৎই কলেজের মেন ইলেকট্রিক সুইচে আগুন লেগে গেল। সবাই আতঙ্কে ছুটোছুটি করে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসছে। এ দিকে নারায়ণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে। দেখে সহকর্মী অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী বললেন, ‘‘আরে শিগগির চলুন নেমে যাই।’’ শুনে স্বভাবমিষ্ট নারায়ণ বেশ রেগে গিয়েই ধমক দিলেন জাহ্নবীকে, ‘‘ছেলেগুলোকে ফেলে আমরা নামব আগে,’’ বলে পাঞ্জাবির পকেটে হাত পুরে অতন্দ্র প্রহরীর মতো উপরের সিড়ির মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। ভিড় হালকা হল। সব ছেলে নেমে গেল। তারপর তিনি নামলেন।
যে সৌমিত্রকে একদিন তিনি অনেক বড় অভিনেতা হবে বলে আশীর্বাদ করেছিলেন, সৌমিত্রর জীবনের প্রথম সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনিই। একদিন মাস্টারমশায়ের বাড়িতে বসে আড্ডা দিচ্ছেন ছাত্র সৌমিত্র। সে দিনের আড্ডায় রয়েছেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের এক প্রিয় বন্ধু চিত্র সাংবাদিক খগেন রায়। ‘দুর্গেশনন্দিনী’ ছবিরও পরিচালক ছিলেন তিনি। কথায় কথায় তরুণ সৌমিত্রকে তিনি প্রস্তাব দিয়ে ফেললেন, ‘‘তুমি অভিনয় করবে? যদি চাও তো ব্যবস্থা করে দিতে পারি।’’ উত্তরে সৌমিত্র কিছু বলার আগেই হাঁ হাঁ করে উঠলেন নারায়ণ— ‘‘না না খগেন, এ কী বলছ তুমি! ওর এখনও সিনেমায় নামার সময় হয়নি। আগে লেখাপড়া শেষ করুক, তার পরে না হয় ও সব হবে। পড়াশোনা থামিয়ে সিনেমায় যাওয়াটা ঠিক হবে না।’’ মাস্টারমশাইয়ের কথা একবাক্যে মেনে নিয়েছিল ছাত্রটিও। সুযোগ পেয়েও সিনেমায় অভিনয়ের ধারেকাছে ঘেঁষেনি। তার অনেক পর, ছাত্রজীবন শেষ। যখন পাকাপাকি ভাবে সিনেমায় নামবেন স্থির করলেন, প্রথমেই গেলেন মাস্টারমশায়ের কাছে। প্রিয় ছাত্রকে জড়িয়ে ধরে নারায়ণ বললেন, ‘‘আমি তো বলেইছি তুমি অনেক বড় অভিনেতা হবে। আসলে কী জানো, সিনেমার অভিনয়কে বোঝার জন্য পড়াশোনা করতে হবে। যখন যে চরিত্রেই অভিনয় করবে যত্ন নিয়ে, প্রাণ দিয়ে অভিনয় করবে।’’ স্যরের আশীর্বাদ নিয়ে সেদিন ফিরে এসেছিলেন তাঁর ছাত্র।
প্রথম সাহিত্যচর্চার প্রথম পাঠক হয়েছিল এক বাল্যবন্ধু।ইস্কুল জীবনেই দিনাজপুরের বাড়িতে আট পাতার ফুলস্কেপ কাগজে প্রকাশ করলেন পত্রিকা। নাম চিত্র-বৈচিত্র। নিজেই গল্প, কবিতা লিখে, ছবি এঁকে পত্রিকা তৈরি। শুধু তাই নয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের দরও ঠিক হয়ে গেল। কিন্তু বিজ্ঞাপনদাতা তো দূরের কথা, পত্রিকার পাঠক কই? অথচ প্রকাশক কাম লেখক এতই লাজুক স্বভাবের যে কাউকেই নিজের এই কীর্তির কথা জানাতে পারছে না। এ দিকে বারান্দার কোনে প্যাকিং বাক্সের ওপর বসে রোমহর্ষক সব কাহিনি নিয়ে হাতে গড়া পত্রিকার ওপর ইঁদূর আরশোলারা আক্রমণ চালাচ্ছে। শেষে একদিন ধরাই পড়ে গেলেন। বাল্যবন্ধু বেস্ত (সুধীন ঘোষ) এসে ডাকল মার্বেল খেলার জন্য।নারায়ণ গম্ভীর হয়ে বলল, ‘‘এখন যেতে পারব না গল্প লিখছি।’’ বন্ধু অবাক।— ‘‘কী গল্প? দেখি, পড় তো!’’ হত্যা, ডাকাতি, গুলি-গোলায় ভরা ধুন্ধুমার উপন্যাসের প্রথম কিস্তি শুনে বন্ধু বেস্তর চোখ ছানা বড়া। মার্বেল খেলা ভুলেটুলে তার চোখমুখ তখন উত্তেজনায় জ্বলছে। তারপর…তারপর কী হল? নারায়ণ আবার সম্পাদকীয়-গাম্ভীর্য নিয়ে উত্তর দিল, বাকিটা পরের সংখ্যায়। চাঁদা দিলে পরেরটা পাওয়া যাবে। ‘‘তোর পত্রিকার বার্ষিক চাঁদা কত?’’ নারায়ণ বলল, ‘‘নিয়মাবলি কাগজের পাতাতেই দেওয়া রয়েছে। বিজ্ঞাপন এক পৃষ্ঠা দু আনা, আধ পৃষ্ঠা এক আনা আর বার্ষিক গ্রাহকমূল্য সডাক চার পয়সা।’’ বন্ধু সঙ্গে সঙ্গে প্যান্টের পকেট থেকে হান্ডিভাজা খাওয়ার জন্য জমানো পয়সা বার করে বলল, ‘‘আমি গ্রাহক হব।’’ তারপর থেকেই পুরো দুই কপি কাগজ বেরোনো শুরু। এদিকে কাগজের একমাত্র গ্রাহকের কৌতূহলে পাগল-পাগল অবস্থা। তিনদিন পরেই সে এসে বলল,বড্ড বেশি দেরি হয়ে যাচ্ছে। তোর কাগজকে সাপ্তাহিক করে দে। একমাত্র পাঠক বলে কথা! তার আবদার কি অমান্য করা যায়? কাগজ হয়ে গেল সাপ্তাহিক। কিন্তু কিছু দিন পরেই সুধীন পড়াশোনার জন্য কলকাতায় চলে যাওয়ায় সেই উপন্যাসও আর শেষ হল না, কাগজও গেল বন্ধ হয়ে।
পত্রিকা বন্ধ হলেও কাব্যচর্চা থামল না। ইস্কুলে অঙ্ক ক্লাসে বসে অঙ্কখাতাতেও চলতে থাকল নিরন্তর কাব্যচর্চা। ‘মাস পয়লা’ কাগজে ছোটদের বিভাগে কবিতা পাঠিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করলেন। বুক আরও ফুলে গেল। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে সরাসরি দেশ পত্রিকায় কবিতা পাঠানো শুরু। সেখানেও পর পর ছাপা হতে লাগল কবিতা। হঠাৎই একদিন দেশ পত্রিকার সহ-সম্পাদক পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের চিঠি। গল্প দেবার আর্জি। গল্প! মাথায় হাত নারায়ণের। গল্প লিখব কী করে? কিন্তু ‘না’ বলার উপায় নেই। লিখলেন ‘নিশীথের মায়া’। তখন বয়স মাত্র সতেরো, কী আঠেরো। প্রবল সুখ্যাতি। তারপরেই ‘বিচিত্রা’, ‘শনিবারের চিঠি’…একের পর এক পত্রিকা থেকে ডাক আসা শুরু। আর পিছন ফিরতে হল না।
দিব্যি বড়দের গল্প লিখছেন। নামও ছড়িয়েছে বেশ।হঠাৎই একদিন বাড়িতে এলেন বন্ধু বিশু মুখোপাধ্যায়। এসেই ফরমাশ। অনেক বড়দের জন্য লেখা হয়েছে, এ বার ছোটদের জন্য লিখতে হবে। মৌচাক-এর জন্য লেখো। ছোটদের জন্য গল্প! সেই কবে শৈশব পেরিয়ে এসেছি, আর কি তেমন মন আছে? ছেলেবেলার সেই খুশির জগৎকে আর কোথায় পাব? ‘‘আরে ঠিক পারবে, লেখোই না,’’ উৎসাহ দিলেন বিশুদা। বিশুদার কথায় লিখলেন বটে। গম্ভীর-গম্ভীর গল্পই। ছাপাও হল কিন্তু নিজেরই মন ভরল না। এর পর বিশুদার আবার ফরমাশ, ‘‘এবার তোমাকে বার্ষিক সংখ্যার জন্য একটা হাসির গল্প লিখতে হবে। হাসির গল্প? আমি! ক্লাসে ছাত্রদের হাসি বন্ধ করাই আমার একমাত্র কাজ, সেই আমি লিখব হাসির গল্প! তারপর যা হল, শোনা যাক নারায়ণের নিজের কথা থেকেই, ‘‘তখন নিজের ছোটবেলায় ফিরে এলাম। স্মৃতির ভেতর থেকে খুঁজে আনতে লাগলাম সেইসব ঘটনাকে— যাদের কথা ভাবলে এখনও তরল হাসি ফুটে ওঠে ঠোঁটের কোনায়। এমন একটি গল্প দিলাম বিশুদাকে। সেই যে মনের ভেতর হাসির স্রোত বইল আজও তা আর থামল না।’’ আর বাংলা কিশোর সাহিত্যে জন্ম নিল এক অদ্বিতীয় চরিত্র— টেনিদা।
টেনিদা – ভালো নাম ভজহরি মুখার্জি। পটলডাঙার চাটুজ্জেদের রোয়াকের আড্ডার মধ্যমণি। পুরো ছ’হাত লম্বা। গন্ডারের খাঁড়ার মতন নাক। খটখটে জোয়ান। গড়ের মাঠে গোরা ঠেঙিয়ে স্বনামধন্য। পাকস্থলী তে একটি বিয়ে বাড়ির সব খাবার ভরে ফেলতে পারে। কিন্তু পড়াশোনার ব্যাপারে স্কুলে ক্লাস টেনে একেবারে মনুমেন্ট হয়ে বসে আছে। সেখান থেকে তাঁকে নড়ায় কার সাধ্য! টেনিদার মতে, ‘পাশ তো যে কেউই করতে পারে, কিন্তু পরীক্ষায় সব উত্তর লিখেও পাশ না করতে পারাই নাকি সব থেকে কঠিন।’ কান ছিঁড়ে কানপুরে পাঠানো কিংবা নাক মুলে নাসিকে পাঠিয়ে দেওয়া অথবা দাঁত পাঠানো দাঁতনে টেনিদার বাঁ হাতের খেল। টেনিদার প্রিয় ধমক হল, ‘কুরুবকের মতন বকবক করিসনি’।
হাবুল – ভালো নাম স্বর্ণেন্দু সেন। কাঠ ঢাকাই বাঙাল যাকে বলে, হাবুল ঠিক তাই। তবে পড়াশোনায় মন্দ নয়।
ক্যাবলা – ভালো নাম কুশলকুমার মিত্র। চারজনের মধ্যে পড়াশোনায় খুব ভালো। প্রতিবছর পরীক্ষায় ভালো ফল করে। এই জন্য টেনিদা মাঝেমাঝেই ক্যাবলার ওপরে বেজায় ক্ষেপে যায়।
প্যালারাম – ভালো নাম কমলেশ ব্যানার্জি। পড়াশোনায় চলে যায় আর কি! দু’পা হাঁটলেই তাঁর পিলে খটখট করে জানান দেয়। পটল দিয়ে পাতলা শিঙ্গি মাছের ঝোল আর ভাত, এই হল তাঁর দুই বেলার আহার।
চিরকালের স্বভাব লাজুক এবং আদন্ত্য বিনয়ী নারায়ণ।বাংলা সাহিত্যে এমএ-তে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন, সে-কথাও যেমন তিনি মুখফুটে কাউকে বলতেন না, তেমনই ক’জনই বা জানে, তিনি ডক্টরেট হয়েও জীবনে কখনও নিজের নামের আগে ‘ডক্টর’ শব্দটি বসাননি। এমনকী লেখক-জীবন শুরুর সময়েও নিজের নাম প্রকাশেও ছিল সংকোচ। যে তারকনাথ নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বর্ণপদক পেলেন, লেখা ছাপাতে দেওয়ার সময় নিজের নামটিও বদলে দিয়ে লিখেছিলেন— নারায়ণ। ঠিক একই ভাবে টেনিদা যতই জনপ্রিয় হোক না কেন, ঘনাদার প্রসঙ্গে ঠিক তিনি টেনির মুখ দিয়ে বলিয়ে ছেড়েছেন, ‘কী বললি প্রেমেন মিত্তিরের ঘনাদা! কী যে বলিস! তাঁর পায়ের একটু ধুলো মাথায় দিতে পারলে বর্তে যেতুম রে।’ শুধু তাই নয়, লেখক-পুত্র অরিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে জানা যায়, একবার তাঁকে একাডেমি পুরস্কার দেওয়ার কথাও উঠেছিল। কিন্তু শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতবাদ ভিন্ন হওয়ার জন্য পুরস্কার কমিটিতে থাকা এক স্বনামধন্য সাহিত্যিক একপ্রকার জোর করেই নারায়ণের নাম খারিজ করে দিলেন। পুরো বিষয়টাই পরে জানতে পেরেছিলেন নারায়ণ কিন্তু জীবনে একবারের জন্যও সেই সাহিত্যিকের প্রতি কারও কাছে উষ্মা প্রকাশ করেননি। আজীবন নিজেকে যেমন ‘কমনম্যান’ বলতেন, বিশ্বাসও করতেন তেমনই। ১৯৬৫ সালে আকাশবাণীতে স্বরচিত কবিতা পাঠে তিনি পড়লেন— ‘আমার কীর্তিরে আমি করি না বিশ্বাস/নিয়ত তরঙ্গাঘাতে দিনে দিনে দিবে লুপ্ত করি/ …এ বিশ্বেরে ভালবাসিয়াছি এ ভালোবাসাই সত্য এ জন্মের দান।’
ছাত্ররা যেমন মাস্টারমশাই বলতে অজ্ঞান। ছাত্রদেরও যে কোনও সমস্যায় তাদের স্যার সবার আগে। সে কেমন? একবার ছাত্র রাজনীতি করা এক গরিব ঘরের ছেলের কলেজে ‘ফিজ’ বাকি পড়ল অনেক টাকা। সে টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই তার। ছাত্র ইউনিয়ন অফিসে গিয়ে জানাতে ইউনিয়ন সেক্রেটারি জানাল, তারা মেরেকেটে সতেরো টাকা দিতে পারবে, তার বেশি সামর্থ্য নেই। ওতে কিছুই হবে না। শেষ উপায় নারায়ণ স্যার। তাঁর কাছে গিয়েই পুরো ঘটনা জানাল ছাত্রটি। শোনামাত্র আর এতটুকু সময় নষ্ট না করে নারায়ণ ছেলেটিকে সঙ্গে করে সটান নিয়ে গেলেন কলেজ রেজিস্ট্রারের কাছে। তাঁর অনুরোধে বকেয়া ‘ফিজ’ দুশো আটাত্তর থেকে নেমে এল সোজা আঠাশ টাকায়। ওই টাকা দেওয়ারও ক্ষমতা নেই জানতেন নারায়ণ। সুতরাং সে-টাকা নিজেই মিটিয়ে দিলেন। ছাত্রটি পরীক্ষায় বসার সুযোগ পেল। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতে যাতে এমন সমস্যায় আবার না পড়ে তার জন্য একটি প্রাইভেট টিউশনও জুটিয়ে দিলেন তিনি। ওই ছাত্র আর কেউ নয়, পরবর্তী কালে যাঁকে বাংলা সাহিত্যজগৎ চিনবে কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত নামে।
ছাত্রদের সঙ্গে একেবারে বন্ধুদের মতো মিশতেন নারায়ণ। অমিতাভর স্মৃতিচারণ থেকে এমনই আরেকটি ঘটনার কথা বলি। এক বর্ষার দুপুরে অনার্স ক্লাসের ছেলেরা মিলে দরজা বন্ধ করে ‘আজি বরষণ মুখরিত’ গাইছে। সবার ওপরে চড়া গলায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। গান তো চলছেই, সঙ্গে কাঠের বেঞ্চে উদ্দাম তবলার ঠেকা। দরজা খুলে ক্লাসে ঢুকলেন মাস্টারমশাই নারায়ণ। সঙ্গে সঙ্গে গোটা ক্লাস পাথর। সব চুপ। নারায়ণ বললেন, ‘‘কী হল? গান থামল কেন? চলুক।’’ ছাত্ররা তাতেও চুপ। নারায়ণ তখন সাফ জানালেন, গান শেষ না হলে তিনি কিছুতেই ক্লাস নেবেন না। অমিতাভ লিখছেন, ‘‘তাঁর নাছোড়বান্দা মেজাজ দেখে বহুকষ্টে ঠেলেঠুলে সৌমিত্রকে তুলে দিলাম। অমন স্মার্ট ছোকরা; প্রায় কনডেমড সেলের আসামির মতো কাঁপা গলায় শেষ করল গানটি।’’ তারপর রক্তকরবী-র বিশুপাগলকে নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন নারায়ণ।
পটলডাঙার বাড়িতে তখন সকলের অবাধ যাওয়া-আসা। সকলেই স্বাগতম। দেদার মজাদার আড্ডা, সঙ্গে চা, মুড়ি-ডালমুট। ছাত্ররা তো বটেই, অনেক নামী অনামী লেখকও চলে আসতেন আচমকা। এমনই একদিন মলিন ধুতি-পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোক এসে হাজির হলেন নারায়ণের বাড়িতে। ঘড়িতে বেলা এগারোটা কী বারোটা। তাকে দেখে বেজায় আনন্দিত নারায়ণ, ‘‘দাদা এসেছেন! আসুন আসুন কী সৌভাগ্য আমার!’’ ভদ্রলোক বললেন, ‘‘এই তো পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম ভাবলাম একবার দেখা করে যাই। বেশিক্ষণ বসব না। এই আধঘণ্টার মতো বসে একটু গল্প করেই চলে যাব।’’ ভদ্রলোকের গলা শুনে পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন নারায়ণ ঘরণি আশাদেবী। দাদা এসেছেন যখন দুপুরে চাট্টি ভাত খেয়ে যাবেন। ‘‘ভাত? আচ্ছা আপনি বলছেন যখন দুটি খেয়েই যাই। জমিয়ে রান্না করুন দেখি।’’ নারায়ণ ওই বেলায় ছুটলেন বাজারে। ইলিশ মাছ দিয়ে জমিয়ে ভাত খেয়ে তারপর শুরু হল মজলিশি আড্ডা। পাশের ঘর থেকে কান খাড়া করে সেই গল্প শুনছে নারায়ণ-পুত্র অরিজিৎ। সেই ভদ্রলোক এমনভাবে ঘন বন-জঙ্গল, জোৎস্না রাতের পাহাড়, নির্জন টিলার বর্ণনা দিচ্ছেন যে চোখের সামনে সব যেন ছবি হয়ে ধরা পড়ছে। বক্তা শ্রোতা সকলেই মোহিত। গল্পে গল্পে সেই বরাদ্দ আধঘণ্টা গড়িয়ে বিকেল। হঠাৎই হুঁশ ফিরল ভদ্রলোকের।— ‘‘সর্বনাশ! চারটে বেজে গেছে! আমি যে আধঘণ্টা থাকব ভেবেছিলাম। আমি বেরোলাম।’’ ‘‘একটু চা খেয়ে যান।’’ ‘‘না না আর চা নয়। আর দেরি হলে ফিরতে পারব না,’’ বলে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। নারায়ণ দেখলেন। তাড়াহুড়োয় যে দিকে যাবার কথা ঠিক তার উল্টো দিকের বাসে চড়ে বসলেন ভদ্রলোক। পরে অরিজিৎ জানতে পেরেছিলেন অমন সাধারণ দেখতে কিন্তু অলৌকিক প্রকৃতির বর্ণনা করতে পারা অন্যমনস্ক মানুষটির নাম ছিল বিভূতিভুষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল ঈর্ষা করার মতো। এক নিঃশ্বাসে গড়গড় করে বলে যেতে পারতেন লম্বা লম্বা কবিতা, এমনকী গল্পও। শেক্সপিয়র, মপাঁসা, রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ একেবারে কন্ঠস্থ। একবারের ঘটনা বলি।ক্লাস ভর্তি ছেলে। নারায়ণ তারাশঙ্করের ‘অগ্রদানী’ গল্পটি পড়াবেন। কিন্তু সে দিনই ক্লাসে কারও কাছে টেক্সট বই নেই। কী উপায়? নারায়ণ বললেন, দেখি একবার স্মৃতি থেকে চেষ্টা করে। বলতে শুরু করলেন। পুরো গল্পটার প্রথম লাইন থেকে শুরু করে একেবারে কমা সেমিকোলন পর্যন্ত উল্লেখ করে থামলেন ‘খাও হে চক্রবর্তী’তে। গোটা ক্লাস অভিভূত।
নারায়ণের স্মৃতিশক্তি নিয়ে এমন অনেক মজার ঘটনা রয়েছে। আরেকটি গল্প শোনানো যাক। নারায়ণ তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের তেতলার ঘরে বসে কয়েকজন সহকর্মী মিলে চা সহযোগে আড্ডা চলছে। সেই আড্ডায় অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ও রয়েছেন। আড্ডা চরমে। তখনই ঘরে ঢুকলেন প্রধান শিক্ষক প্রমথনাথ বিশী। আজ নারায়ণ প্র.না.বি-কে চা খাওয়াবেন এই ঘোষণা হওয়ার পর প্র.না.বি কথায় কথায় জানালেন, তিনি খুবই চিন্তিত। কারণ তাঁর নতুন কবিতার বই প্রকাশ হতে চলেছে। কিন্তু বঙ্গশ্রী পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রিয় কবিতা তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। অথচ সেই কবিতাটি সংকলনে রাখার খুবই ইচ্ছে। শুনে নারায়ণবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, কবিতাটির নাম জানতে পারি? প্রমথনাথের কাছে নাম শুনে লাজুকভাবেই নারায়ণ বললেন, ‘‘আমার পুরো কবিতাটিই মনে রয়েছে। প্রয়োজনে আপনি লিখে নিতে পারেন।’’ শুনে প্রমথবাবু পুরো হতভম্ব। তারপর মজার আড়ালে বেশ গম্ভীর হয়েই বলে উঠলেন, ‘‘দেখুন এত স্মৃতি ভালো নয়, ভালমন্দ সবই আপনি মনে রাখতে পারেন দেখছি।’’ হাসিতে ফেটে পড়ল সবাই।
শরীর ঠিক যাচ্ছিল না সেবার। কিন্তু বাইরে সে অসুস্থতার কোনও প্রকাশ নেই। সকলের সঙ্গে একরকম সুন্দর ব্যবহার আর হাসিমুখ। এক সময়ের ছাত্র সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে গাড়িতে এক কবিতা পাঠের আসরে যাবেন। তখন খ্যাতি গগনচুম্বী, তবু কুণ্ঠা।সুনীলকে বললেন, ‘‘আমার কবিতা বড্ড সেকেলে। তোমাদের মতো আধুনিক ভাষা আমার কই? পড়তে লজ্জা লাগে!’’ কথায় কথায় স্যারের শরীরের খবর নিলেন সুনীল। জানতেন অসুস্থ, ‘‘এখন কেমন আছেন স্যার?’’ ‘‘হ্যাঁ ভালো আছি।’’ চোখের নীচে ক্লান্তি থাকলেও মুখের হাসিটি একইরকম। অনুষ্ঠান শেষে সুনীলকে বলেন, ‘‘একদিন আমার বাড়িতে এসো না, কাছেই তো থাকি।’’ ‘‘হ্যাঁ স্যার, এর মধ্যেই একদিন যাব।’’
সে যাওয়া আর হয়ে উঠল না সুনীলের। ঠিক তার পরের দিনই শ’য়ে শ’য়ে মানুষের ভিড় শ্মশানে। হয়তো সেদিন সেই ভিড়ের মধ্যে ক্যাবলা হাবুল, প্যালারামও ছিল। কিশোর অবুঝ মন নিয়ে ভাবছিল এই এক্ষুনি বুঝি ‘ডি লা গ্রান্ডি মেফিস্টোফিলিস ইয়াক ইয়াক’ বলে একমুখ হাসি নিয়ে পালঙ্ক থেকে উঠে দাঁড়াবে তাদের বন্ধু। অপেক্ষা করছিল…
‘শিলালিপি’-র নায়কের শেষ চিহ্নটুকু যখন ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে গঙ্গার বুকে, সুচিত্রা মিত্র ভিজে গলায় গাইছেন— ‘তবু মনে রেখো…’।
(তথ্যসূত্র:
১- বাংলা ছোটগল্পের তিন নক্ষত্র: বনফুল-প্রেমেন্দ্র মিত্র-নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, শীতল চৌধুরী, প্রজ্ঞা বিকাশ (২০০৯)।
২- নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় শতবার্ষিকী সংকলন, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ।
৩- নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচনাবলী, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (২০১১)।
৪- টেনিদা সমগ্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স (১৯৯৬)।
৫- সুনন্দর জার্নাল, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (২০০১)।
৬- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৯শে অক্টোবর ২০১৬ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত