কুলগামে এ রাজ্য থেকে যাওয়া পাঁচজন শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনার পর বিজেপি নেতাদের কথাবার্তা শুনে আমার কবীর সুমনের এই গানটা বারবার মনে পড়ছে। সুমন লিখেছিলেন, আমি চাই বিজেপি নেতার সালমা খাতুন পুত্রবধু/ আমি চাই ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু। সুমন চাইলেও বিজেপি নেতারা একথা বুঝবেন না। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও বাঙালি বিদ্বেষ কতটা অন্ধ হতে পারে তার এক নতুন নমুনা দেখালেন মোদি-অমিত এবং তাদের চ্যালা হঠাৎ নেতা দিলীপ ঘোষ।
এখনও অবধি কুলগামের ঘটনায় নম নম করে নিন্দা করেছেন মোদি-অমিত। মৃত ব্যাক্তিদের নাম তারা কোন রাজ্যের বাসিন্দা সেকথা জানানোর মত স্বাভাবিক সৌজন্যও তারা দেখাননি। তাদের বঙ্গ বিদ্বেষী রাজনীতি এর মূল কারণ। দিলীপ ঘোষ অত কূটনীতির ধার ধারেন না। ভদ্রলোকের এক কথার মত তিনি বলে দিয়েছেন তাদের কাছে খুন হওয়া মুর্শিদাবাদের পাঁচ শহিদদের চাইতেও দলীয় সংঘর্ষে নিহত বিজেপি কর্মীদের বাড়ি যাওয়া অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং তিনি তাদের বাড়িতেই যাবেন। এদের কাছে দেশ নয়, দল বড়। মোদি-অমিতরা ভুলে যান মানুষ তাদের দলের প্রধানমন্ত্রী কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ভোট দেননি, ভোট দিয়েছেন গোটা দেশের মানুষের দায়িত্ব নেওয়ার জন্যই। অথচ তাদের ব্যবহারে বারবার তারা মনে করিয়ে দেন, দেশ নয়, তারা নিছক দলেরই লোক। তাই পাঁচজন বাঙালি শ্রমিক খুন হয়েছে তা বলতে তাদের লজ্জা লাগে। পাঁচজন শ্রমিকের মৃত্যুতে তাদের কোন প্রতিক্রিয়া হয়না।
বিজেপির ভুল রাজনীতি পাঁচজন নিরাপরাধ মানুষের খুনের ঘটনার গায়েও সাম্প্রদায়িক রঙ লাগিয়ে দিয়েছে। মানুষের পরিচয়টাকে তুচ্ছ করে তারা নিহতদের ধর্মীয় পরিচয়টাকেই বড় করে তুলে ধরেছেন। সব ধর্ম ছাপিয়ে তারা যে মানুষ, এই ঘটনা যে মানবতারই অপমান সেকথা তারা বলছে না। বিজেপি সুকৌশলে একটা প্রচার চালাচ্ছে যে, নিহতরা বহিরাগত। এটা এত হাস্যকর যে এর জবাব দিতেও আমার রুচিতে বাধে। ওরা বহিরাগত এটা কে ঠিক করলো? কীভাবেই বা ঠিক করলো? বৈধ নাগরিকত্বের প্রমাণ থাকা মানুষগুলিকে বহিরাগত বলার পিছনে বিজেপির সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ কাজ করছে।
এক দেশের মানুষ অন্য দেশে কাজ করতে গেলে বহিরাগত হবেন কেন? এতো খুনিদের পক্ষেই যুক্তি সাজানো হচ্ছে। এই বহিরাগত তত্ত্ব তো জঙ্গিরা দেয়, তারা বলে কাশ্মীরে তারা কোন বাইরের মানুষকে ঢুকতে দেবে না। আসলে এদের সব কথাই অন্ধ মুসলমান বিদ্বেষ থেকে বলা। মৃত ব্যাক্তিরা একে মুসলমান, তার ওপর আবার বাঙালি। তাই স্বাভাবিক কারণেই মোদিদের চোখের জল শুকিয়ে গেছে। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কারণেই কেন্দ্রীয় সরকার এই লেখাটি যখন লিখছি সেই সময় পর্যন্ত নিহত মানুষগুলির পরিবারকে কোন আর্থিক সাহায্য দেওয়ার কথা ঘোষণা করেননি। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু একাজটি তাদের আগে করে ফেলেছেন।
ওয়াকিবহাল মহলের মতে, এটা হল যাকে বলে এক ঢিলে তিন পাখি মারা। একদিকে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী বাঙালিদের শিক্ষা দেওয়া গেল, অন্যদিকে তার দায় জঙ্গিদের ঘাড়ে চাপিয়ে কাশ্মীরের মানুষের প্রতিবাদের প্রতি সহানুভূতিশীল বাঙালিদের কাশ্মীরি বিদ্বেষী করে তোলার চেষ্টা হল। এর পাশাপাশি এই নারকীয় হত্যার আরেকটা উদ্দেশ্য আছে, তা হল বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গতিশীল নেতৃত্বে এগিয়ে চলা রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করা।
রাজ্যের মেজো, সেজো, ছোট, ন বিজেপি নেতারা বলছেন, বাঙালি শ্রমিকদের বাইরে কাজ করতে যাওয়াটা রাজ্য সরকারের ব্যর্থতা। তাদের একটা ছোট কথা বলি, বাংলা দেশের সব প্রদেশের লোকেদের নিজেদের রাজ্যে জায়গা দেয়। তাদের কর্মসংস্থান, ব্যবসা ও বসবাসের ব্যাপারে কোন আপত্তি তোলে না। সেটা আমাদের উদারতা, পরকে আপন করে নেওয়ার মনোভাব। বিজেপির বড় বড় রাজনৈতিক পণ্ডিতদের মত অত বড় মাপের মানুষ না হলেও এ রাজ্যের কোন সাধারণ মানুষকে কখনও বলতে শুনিনি, এখানে বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, গুজরাটের মানুষের কাজ ও বসবাস করাটা সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলির ব্যর্থতা! গুজরাট দাঙ্গার মুখ কুতুবউদ্দিনকে এরাজ্যের মানুষই আশ্রয় দিয়েছিল, আপন করে নিয়েছিল দাঙ্গা বিধ্বস্ত এই যুবককে। তার জন্য আমাদের কোন আত্মপ্রচার করতে হয়নি।
বিজেপির জাতিবিদ্বেষী ও অপরিণামদর্শী রাজনীতি নিয়ে আমার বলার কিছু নেই। নিজেদের ল্যাজের আগুনেই তারা নিজেদের রাজ্যপাট পোড়াবেন। ইতিমধ্যেই এ ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। সদ্য সমাপ্ত দুটি রাজ্যের নির্বাচনের ফলে তার আভাস রয়েছে। ধর্ম, জাতি, বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকে মানুষ বলে দেখতে না শিখলে অচিরেই তাদের ক্ষমতার মসনদ থেকে সরে যেতে হবে।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত