১৮৯৮ সালের ২৮শে জানুয়ারি মার্গারেট ভারতের মাটিতে পা রাখলেন। ওই বছরের ২৫ মার্চ স্বামীজি মার্গারেটকে ব্রহ্মচর্য ব্রতে দীক্ষা দিলেন। তাঁর নাম দিলেন ‘নিবেদিতা’। ওই দিন স্বামীজি নিবেদিতাকে বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যৎ ভারতসন্তানদের কাছে তুমি একাধারে জননী, সেবিকা ও বন্ধু হয়ে ওঠ।’ তাই নিবেদিতার একমাত্র উদ্দেশ্য হল ভারতবর্ষের সেবা করা। ভারতের আধ্যাত্মিকতার আদর্শ জগৎকে চিরকাল কল্যাণের পথ দেখাবে। তাই তাঁর ভারতসেবা আসলে ছিল সমগ্র মানবজাতির সেবা।
সেবা ও শিক্ষার ক্ষেত্র ছাড়াও পরাধীন ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামে ভগিনী নিবেদিতার বিশেষ ভূমিকা ছিল। তবে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের তুলনায় এ ক্ষেত্রে নিবেদিতার চিন্তার একটি বিশেষ চরিত্র আছে। তিনি মনে করতেন, স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতীয় জীবনের গুরুত্ব আছে, এবং জাতীয় জাগরণের ক্ষেত্রে শিল্প জাগরণের বিশেষ প্রয়োজন। আইরিশ জাতীয়তাবাদের সমর্থক হিসেবে তিনি আয়ারল্যান্ডের শিল্প ও লোকসংস্কৃতির জাগরণ চেয়েছিলেন। ভারতে এসেও চাইলেন, চারু ও কারু, দুই শিল্পধারাতেই জাগরণ সংগঠিত হোক।
রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নানাবিধ মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি উপলব্ধি করলেন যে, ভারতবর্ষে নারীশিক্ষার প্রচলন অত্যন্ত প্রয়োজন। পরাধীন ভারতবর্ষের সামাজিক কুসংস্কারগুলিকে মুক্ত করতে হলে ঘরে ঘরে নারীশিক্ষার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। সেই সঙ্গে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করতে হবে। সে সময় বহু বিপ্লবী যেমন অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষ, বিপিন পাল, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত (বিবেকানন্দের ছোট ভাই) নিবেদিতার কাছে আসতেন স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যাপারে নানা আলোচনা করতে। তিনি বিভিন্নভাবে তাঁদের সাহায্য করতেন। ১৯০২ সালের অক্টোবর মাসে নিবেদিতা বক্তৃতা দিতে বরোদা গিয়েছিলেন। তাঁকে স্টেশনে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছিলেন শ্রীঅরবিন্দ। শ্রীঅরবিন্দ ইতিমধ্যে নিবেদিতার লেখা ‘কালী দি মাদার’ বইটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। শ্রীঅরবিন্দ তখন সবেমাত্র বিপ্লবীদের নিয়ে গুপ্ত সমিতি গঠন করেছেন। শ্রীঅরবিন্দের কাছ থেকে গুপ্ত সমিতির সম্পর্কে সব কিছু জেনে নিবেদিতা বরোদার মহারাজার সঙ্গে দেখা করে গুপ্ত সমিতিকে সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করলেন। পরবর্তীকালে দেখা যায় যে, শ্রীঅরবিন্দের হাতে গুপ্ত সমিতির যে দলটি ছিল, নিবেদিতা হাতে-কলমে সে দলটিকে পরিচালনা করেছিলেন।
ভারত-পূর্ব জীবনে নিবেদিতা তথা মার্গারেট নোবল-এর উইম্বলডনের স্কুলে শিল্পী এবেনজার কুক যুক্ত ছিলেন। এঁর কাছে তিনি শিল্পের পাঠ পেয়েছিলেন। তবে ভারতশিল্পকে দেখার চোখ তৈরি করে দেন তাঁর গুরু বিবেকানন্দ। জানা যাচ্ছে, ১লা ডিসেম্বর ১৮৯৯ তারিখে শিকাগোতে ভারতের চারু ও কারু শিল্পের ওপর বক্তৃতা দেন নিবেদিতা। বক্তৃতার আগে স্বামীজির কাছে কিছু বিষয় জেনে নিয়েছিলেন।
শিল্প যে নিছক বিলাসিতার বস্তু নয়, জাতীয় জীবনে শিল্পের গভীর তাৎপর্য— এই কথাটি নিবেদিতার মতো আর এক জন ইউরোপীয় অনুভব করেছিলেন। তিনি হলেন আর্নেস্ট বিনফিল্ড হ্যাভেল। তৎকালীন কলকাতার আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ হয়ে আসার পর ইনি শিল্পশিক্ষায় ব্যাপক রদবদল ঘটান। অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় হয়। অবনঠাকুর এঁকে গুরু মেনেছিলেন। এ হেন হ্যাভেলও ভারতশিল্পের নন্দনতত্ত্ব ও দর্শন বিষয়ে নিবেদিতার কাছে ভারতীয়দের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে চেয়েছেন। দু’জনের বন্ধুতা তৈরি হয়েছে ভারত শিল্পরসের ভিত্তিতে। হ্যাভেলের বিখ্যাত বই ‘ইন্ডিয়ান স্কাল্পচার অ্যান্ড পেন্টিং’ পেয়ে উচ্ছ্বসিত নিবেদিতা মডার্ন রিভিউ-তে পর পর তিনটি প্রবন্ধ লেখেন। উক্ত কাগজের প্রথম সংখ্যাতেই অবশ্য তিনি লিখেছিলেন, ‘দ্য ফাংশন অব আর্ট ইন শেপিং ন্যাশনালিটি’ শীর্ষক প্রবন্ধ।
হ্যাভেলের মতো শিল্পবিশেষজ্ঞ কাকুজো ওকাকুরাও প্রাচ্যশিল্পের ইতিহাস ও শিল্পবোধে নিবেদিতার গভীর জ্ঞান সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিলেন। জাপানের জাতীয় শিল্প-আন্দোলনে তাঁর অবদান বিরাট। ইনি বেলুড় মঠে বিবেকানন্দের সঙ্গে দেখা করেন। বিবেকানন্দের শিল্প-ব্যাখ্যায় মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। নিবেদিতার সাহায্যে তিনি লিখেছিলেন ‘আইডিয়ালস অব দ্য ইস্ট’। বইটির ভূমিকা লিখেছিলেন নিবেদিতা স্বয়ং। এ সব ১৯০২ সালের ঘটনা।
১৯০৫ সালে বাংলাদেশে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে যে আন্দোলনের সূচনা হয় তা পরে ব্যাপকভাবে স্বদেশিয়ানা এবং বিদেশি বয়কট আন্দোলনে পরিণত হয়। নিবেদিতা এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন। ওই বছরের ১১ই ফেব্রুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে লর্ড কার্জন তাঁর বক্তৃতাকালে প্রাচ্য দেশবাসীর সত্যতা সম্বন্ধে কটাক্ষ করে বলেন, ‘প্রাচ্য অপেক্ষা প্রতীচ্যের লোকদের নিকটে সত্য বিশেষ আদৃত।’ সভায় উপস্থিত বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি লর্ড কার্জনের এই উক্তিতে অপমানবোধ করলেন, কিন্তু কেউই তার প্রতিবাদ করলেন না। নিবেদিতা এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। নিবেদিতা ক্রোধে, অপমানে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন।
অমৃতবাজার পত্রিকার কার্যালয় ছিল বাগবাজারে, সেখানে নিবেদিতা থাকতেন। লর্ড কার্জনের বক্তৃতার আপত্তিকর অংশ ও তাঁর লেখা বইয়ের মিথ্যা বিবৃতির অংশ পাশাপাশি রেখে একটি প্রতিবাদপত্র ছাপার জন্য দিলেন। পরের দিন অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রতিবাদপত্রটি ছাপা হয়। ১৪ই ফেব্রুয়ারি পুনরায় প্রতিবাদপত্রটি স্টেটসম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। লর্ড কার্জনের বিরুদ্ধে দেশবাসীর মনে যে গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল তার কিছুটা প্রশমিত হল।
১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ফলে বাংলায় স্বদেশি হাওয়া জোরালো হয়ে উঠল। অবনীন্দ্রনাথ আঁকলেন ‘ভারতমাতা’। ছবিটি দেখে নিবেদিতার মন্তব্য (প্রবাসী, ভাদ্র, ১৩১৩), ‘এখানে এমন একটি ছবি পাচ্ছি যা ভারতীয় শিল্পে নবযুগ সূচনার আশা জাগাচ্ছে।’ বললেন, তাঁর যদি যথেষ্ট অর্থ থাকত, তা হলে ভারতের নবধারার প্রতীক এই ছবিটি ছাপিয়ে কেদার থেকে কুমারিকা পর্যন্ত ভারতের প্রতিটি চাষির ঘরে রাখার জন্য উপহার দিতেন। এর পর অবনীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে নন্দলাল, অসিতকুমার, সুরেন্দ্রনাথ প্রমুখ নব্য ভারতীয় ধারায় ছবি এঁকেছেন। সে সব ছবি ব্যাখ্যা করে সাধারণ জনের কাছে রসগ্রাহী করে তুলেছিলেন নিবেদিতা। এ কাজ তিনি করতে পেরেছিলেন অবশ্য রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মতো ভারতশিল্পের একনিষ্ঠ প্রচারকের জন্য। নিবেদিতা রামানন্দের যৌথ উদ্যোগে সাধারণ বাঙালির ছবি দেখার ক্ষমতা তৈরি হয়েছিল। অন্য দিকে, ইংরেজি মডার্ন রিভিউ-এর মাধ্যমে বৃহত্তর ভারতীয় সমাজ ও অ-ভারতীয়দের কাছে আধুনিক ভারতের শিল্পরূপ পৌঁছে গিয়েছিল।
নন্দলাল বসুকে অজন্তায় কপি করার কাজে নিবেদিতাই উদ্যোগী হয়ে পাঠান। নিজেও অজন্তা ভিত্তিচিত্র (ফ্রেস্কো) নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছিলেন। শিল্প-সংক্রান্ত অজস্র প্রবন্ধ ছাড়াও নিবেদিতার লেখা বইগুলি ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতির উপাদানে ভরা। শুধু লেখালিখি নয়, তাঁর স্কুলের ছাত্রীদের নিজেই ছবি আঁকা শেখাতেন। সূচিশিল্পেও তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। ১৯০৬ সালে কলকাতা কংগ্রেসে প্রদর্শিত জাতীয় পতাকাটির পরিকল্পনা করেছিলেন নিবেদিতা। প্রতীক ছিল তাঁর প্রিয় বজ্র। নিজেও বজ্রের নানা রেখাচিত্র এঁকেছিলেন।
নিবেদিতা ভারতের জাতীয় পতাকায় বজ্র চিহ্নের পরিকল্পনা করেন ১৯০৫ সালে। তাঁর এই পরিকল্পনা জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে পেশ করা হয় ১৯০৬ সালে। এই বজ্রচিহ্নের পরিকল্পনা নিবেদিতার ভাবনায় কী ভাবে উদয় হয়েছিল সেই বিষয়ে আভাস পাওয়া যায় যদুনাথ সরকারের স্মৃতিচারণে।
নিবেদিতার মৃত্যুর পর কনখল রামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রমে যদুনাথ একটি ভাষণে নিবেদিতার স্মৃতিচারণ করেছিলেন, যা ১৯৪৩ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয় ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ পত্রিকায়। সেই স্মৃতিচারণায় তিনি বলেন, ‘‘…এই বোধিবৃক্ষের কিছুটা দূরেই ছিল এক বড় বৃত্তাকার পাথরের টুকরো। তার উপর বজ্রের চিহ্ন আঁকা। কথিত আছে ইন্দ্র এটি বুদ্ধকে উপহার দিয়েছিলেন। অনেকেই সিস্টার নিবেদিতার বিভিন্ন গ্রন্থে এই চিহ্নের ব্যবহার নিশ্চয় খেয়াল করেছেন। বুদ্ধগয়ায় এই চিহ্নটি দেখে নিবেদিতা বলেছিলেন, বজ্রের এই চিহ্নটি ভারতবর্ষের জাতীয় প্রতীক হিসাবে গ্রহণ করা উচিত। তাঁর মতে এক জন মানুষ মানবসভ্যতার উন্নয়নে যখন তার সর্বস্ব উৎসর্গ করে, তখন ঈশ্বরের কাজে বজ্রের সম-বলশালী হিসেবে পরিগণিত হয়। বজ্র চিহ্নের মধ্যে নির্ভীকতা আর সাহসিকতার যে প্রতীকী তাৎপর্য তার ওপরেই নিবেদিতা সবিশেষ গুরুত্ব দিতেন।’’
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, ৮ই অক্টোবর ১৯০৪ সালে মহালয়ার দিন বিকেলে নিবেদিতা ও রবীন্দ্রনাথ সদলবলে বুদ্ধগয়ার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে অনুমান করা যায়, সেই দলে ছিলেন প্রায় ২০ জন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ও তাঁর স্ত্রী অবলা বসু, রবীন্দ্রনাথের ছেলে রথীন্দ্রনাথ, স্বামী সদানন্দ প্রমুখ। যদুনাথ সরকার এই দলের সঙ্গে যোগ দেন পটনায়। রথীন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, বুদ্ধগয়ায় তাঁদের সকলের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল মোহান্তের অতিথিশালায়।
‘প্রবুদ্ধ ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশিত যদুনাথের স্মৃতিচারণ থেকে নিবেদিতার সম্পর্কে আরও জানা যায়, ‘‘ইন্ডিয়ান স্ক্রিপচারস, আর্ট অ্যান্ড ফোক-লোর সম্বন্ধে নিবেদিতার অন্তঃপ্রবিষ্ট সুগভীর ব্যাখ্যায় আমরা সকলেই চমৎকৃত হতাম। রবীন্দ্রনাথ এই সব বিশ্লেষণ সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতেন। কবির নিজের প্রকাশভঙ্গিও অবশ্যই অপূর্ব। কিন্তু তিনি বলতেন, বস্তুর একেবারে মর্মে প্রবেশ করে ব্যাখ্যা করার এক অসাধারণ ক্ষমতা আছে নিবেদিতার।’’
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপ্লবী ও বিপ্লবাত্মক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিবেদিতার ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। অনুশীলন সমিতি তাঁর সক্রিয় সাহায্য ও উৎসাহ পেত। ১৯০০ সালে নিবেদিতার প্রথম বই ‘কালী দ্য মাদার’ প্রকাশিত হয়, যেখানে নিবেদিতার নির্ভীক মৃত্যুদর্শন ও অন্তরের উদ্দীপনার প্রবল আবেগের প্রকাশ ঘটেছে। এই বইটি মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে প্রবল সাহসিকতার সঙ্গে দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে লড়াই করার মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছিল সে-যুগের বিপ্লবীদের মধ্যে।
১৩ই ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ সালে নিবেদিতা স্বামীজির আগ্রহে অ্যালবার্ট হলে কালী ও কালীপুজো বিষয়ে একটি বক্তৃতা দেন, যা সেই সময় শিক্ষিত সমাজে প্রচণ্ড আলোড়ন ফেলে। সে দিনের সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার, ডা. নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ব্রজেন্দ্রমোহন গুপ্ত ও ব্রাহ্মসমাজের কয়েক জন গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব। ১১ই মার্চ ১৮৯৯ সালে ‘বোম্বে গার্ডিয়ান’, ২১শে মে ১৮৯৯ সালে ‘সোশ্যাল রিফর্মার’, ব্রাহ্ম মুখপত্র ‘ইউনিটি অ্যান্ড মিনিস্টার’ পত্রিকাগুলিতে নিবেদিতার এই বক্তৃতাকে কটাক্ষ করে তীব্র সমালোচনা করা হয়। যদিও ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকায় এই বক্তৃতার কিছু প্রশংসা করা হয়েছিল। কালী বিষয়ে নিবেদিতার এই বক্তৃতা বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল। ১৯০৫ সালে অরবিন্দ শক্তিদেবী রূপে ভবানীপুজোর মাহাত্ম্য বর্ণনা করে লিখেছিলেন ‘ভবানী মন্দির’।
নিবেদিতার সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথের প্রথম দেখা কলকাতায় মার্কিন-কনসালের দেওয়া এক অভ্যর্থনা সভায়। ১৯০২ সালে বিখ্যাত জাপানি মনীষী ওকাকুরা ভারতে আসেন। তাঁকে ঘিরে বাংলার শিল্প জগতে সে সময়ে এক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল, যার থেকে দূরে থাকতে পারেননি ঠাকুর বাড়ীর শিল্পীরাও। অবনীন্দ্রনাথ থেকে রবীন্দ্রনাথ কেউই নয়। ওকাকুরার আগমন উপলক্ষে মার্কিন কনসালের বাড়ীতে সেই অভ্যর্থনা সভায় অবনীন্দ্রনাথ প্রথম দেখেন নিবেদিতাকে। শ্বেতশুভ্র ঘাঘরা পরিহিতা, কন্ঠে রুদ্রাক্ষের মালা শোভিতা সে নিবেদিতা যেন মর্মর তপস্বিনীর মূর্তি। ওকাকুরা যেমন, ঠিক তেমনটি নিবেদিতা। দু’টি তারা যেন মিশেছে এক বিন্দুতে। প্রথম দর্শনের সেই সময় অবনীন্দ্রনাথ ধরে রেখেছেন তাঁর লেখনিতে— ‘সাজগোজ ছিল না, পাহাড়ের ওপর চাঁদের আলো পড়লে যেমন হয়, তেমনি ধীরস্থির মুর্তি তার। তার কাছে গিয়ে কথা কইলে মনে বল পাওয়া যেত।’ শিল্পী মনে এমনই প্রভাব ফেলেছিলেন রবীন্দ্রনাথের লোকমাতা।
অবনীন্দ্রনাথের ‘ভারতমাতা’ ছবির মধ্য দিয়েই ভারতবর্ষ যেন শিল্প ক্ষেত্রে নতুন যুগে প্রবেশ করল। প্রবাসী-তে রামানন্দ যখন ‘সীতা’ছবিখানি ছাপলেন নিবেদিতা লিখলেন একখানি চিত্র-পরিচিতি। তাঁর ভাষায়, “সত্য বটে ভাব ও চিন্তা ব্যক্ত করিবার আধুনিক যুগের নানাবিধ উপায়ের সাহায্য লইয়া অবনীন্দ্রবাবু এই ছবি আঁকিয়াছেন, কিন্তু তাহা হইলে চিত্রপটে তৎকর্তৃক পরিব্যক্ত মানসিক আদর্শটি খাঁটি ভারতীয় ছিল। আকার প্রকারও ভারতীয়। পদ্মগুলির বক্ররেখা ও শিরোবেষ্টক প্রভাত মণ্ডলের শুভ্রদীপ্তি সংযোগে এশিয়োদ্ভুত কল্পনাজাত মূর্তিটি সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি পাইয়াছে। চারিবাহু দৈবশক্তির বহুত্বের চিত্র স্বরূপ। ইহাই প্রথম উৎকৃষ্ট ভারতীয় চিত্র, যাহাতে এক ভারতীয় শিল্পী যেন মাতৃভূমির অধিষ্ঠাত্রীকে—ভক্তিদায়িনী-বাদ্যদাত্রী, বসন-দায়িনী, অন্নদা মায়ের আত্মাকে—দেশরূপী শরীর হইতে স্বতন্ত্র করিয়া তাহার সন্তানগণের মানস ক্ষেত্রে তিনি যেরূপ প্রতিভাত হন, সেই ভাবে অঙ্কিত করিয়াছেন। মায়ে শিল্পী কি দেখিয়াছেন, তাহা এই চিত্রে আমাদের সকলের কাছে বিশদ হইয়া গিয়াছে। কুহেলিকার মত অস্পষ্ট পদ্মরাজি ও শ্বেত আভা, তাঁহার চারিবাহুও অনন্ত প্রমেরই মত, তাঁহাকে অতিমানব করিয়া রাখিয়াছে। অথচ তাঁহার শাঁখা, তাঁহার সর্বদেহাচ্ছাদক পরিচ্ছদ, তাঁহার খালি পা, তাঁহার খোলা, অকপট মুখের ভাব, এই সকলে তিনি কি আমাদের পরম আত্মীয়, হৃদয়ের হৃদয়, একাধারে ভারতের মাতা ও দুহিতা বলিয়া প্রতিভাত হইতেছেন না? প্রাচীন কালের ঋষিদিগের নিকট বৈদিক উষা যেমন ছিলেন?” (প্রবাসী, ৬ষ্টভাগ, ৫ম সংখ্যা) নিবেদিতার এ স্তুতি নিঃসন্দেহে অবনীন্দ্রনাথকে অনুপ্রাণিত করে থাকবে।
শিল্প-তাত্বিক নিবেদিতা মনে করতেন, শিল্প-সৃষ্টির মহতি শৈলীগুলি আত্মবিনাশ না ঘটিয়ে নতুন জ্ঞানের উদ্ভাসে উদ্ভাসিত হয়ে থাকে যুগে যুগে। বোধকরি এ ধারণাই তাঁকে প্রণোদিত করেছিল ভারতবর্ষের স্বকীয় শিল্প-বৈশিষ্ট্যের জাগরণকে আহ্বান করতে। পরানুকরণ নয়, অন্য শিল্পের মহৎ বৈশিষ্ট্যের সাঙ্গিকরণের মাধ্যমে স্বতন্ত্র নিজস্ব শিল্পরীতি বিকাশের ওপর যে গুরুত্ব তিনি আরোপ করেছিলেন, অবনীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর প্রতিমূর্তি। ১৯০৮-এর মডার্ন রিভিউ-এর মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত হল অবনীন্দ্রনাথের ‘সীতা’, সঙ্গে বেরলো নিবেদিতা রচিত চিত্র-পরিচিতি। তাঁর দৃষ্টিতে অবনীন্দ্রনাথের ‘সীতা’ ভারতীয় ধরনের শ্রেষ্ঠ সুমুখশ্রী নয়। ঢালু কপাল, স্থূল গ্রীবা সমন্বিত সে মূর্তির আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় হিন্দু রমণীর বৈশিষ্ট্য । এ সীতা যতখানি মহিয়ষী নারী, ততখানি মহিয়ষী পত্নী নন। নিবেদিতার ভাষায় একটুখানি শোনা যাক যে ‘সীতা’র বর্ননাঃ “In this picture, with its noble proportions and splendid vigour, we see that Sita who could laugh at hardships, and burn with her disdain Ravana himself, we catch a glimpse even of the woman of the last great scene of wounded withdrawal, before the popular insult.” ‘রাজ্ঞীগর্বে সমুন্নত শক্তিময়ী মহিমান্বিত নারীত্বের’ যে প্রকাশ এখানে ঘটেছে তাঁকে স্বাগত জানিয়ে নিবেদিতা এ সীতাকে ভারতীয় ম্যাডনার নবরূপ বলে চিহ্নিত করলেন। আর লিখলেন, “The outstanding impression made by this picture is one of extraordinary mental intensity…In the strong and noble womanhood, in the regal pride brought low, and the hoping yet despairful wifehood, of this Sita, by Mr. Tagore, we have achieved something too deeply satisfying for us again to be contented without an effort in its direction.”
মর্ডান রিভিউতে ১৯০৭-এর মে মাসে ‘শাহজাহানের মৃত্যু প্রতীক্ষা’ চিত্রটি প্রকাশিত হলে, নিবেদিতা তাকে “superb original of the drawing” বলে তাঁর আহ্লাদ ব্যক্ত করলেন। প্রখ্যাত শিল্প সমালোচক আনন্দ কুমারস্বামীকে উদ্ধৃত করে অবনীন্দ্রনাথ সম্পর্কে উচ্চকিত নিবেদিতা এ সময়ে লিখেছিলেন, “not only is he what could not have been expected in India at present, but also probably of first rank in Europe.” ‘শাহজাহানের তাজ-স্বপ্ন’ ছবিতে যমুনা তীরে রাত্রিকালে অশ্বারূঢ় মুঘল সম্রাট তাজ নির্মাণের কথা ভাবছেন। নিশিথের নিস্তব্ধতা আর কল্পিত তাজ বিবির শৌধের ওপর চুইয়ে পড়া অবগুণ্ঠিত চন্দ্রালোকের আলোআঁধারিতে শাহজাহানের অন্তরের আধ্যাত্মিকতা যেন বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। চিত্রের বিষয়বস্তু ও ভাবাবেগের চালচিত্র মেলে ধরে এর চিত্র-সমালোচনায় নিবেদিতা লিখলেন, “The drawing is full of strength. But we do wish that we might again enjoy colour at the hands of Mr. Tagore! We long for some of those bright and tender interpretations which were once so characteristic of the art of this land of bright skies and limpid atmospheres, those interpretations in which Mr.Tagore himself is so well fitted to excel!” (‘Notes on Abanindranath Tagore’ in The Modern Review January, 1910 )
জন্মলগ্ন থেকেই মর্ডান রিভিউ-এর পাতায় চিত্র-সমালোচক রূপে নিবেদিতা আমৃত্যু অবনীন্দ্রনাথ ও অন্য তরুণ শিল্পীদের দেখিয়ে দিতেন কোথায় কি বর্জন করতে হবে, আর কোন পথ অনুসরণ করতে হবে। ইতিহাস, জাতিবিজ্ঞান, চারুকলা—সর্বত্র আমাদের আধুনিক গবেষণাকে অগ্রসর করার জন্য, উৎসাহ দেবার জন্য—সমালোচনা ও সংশোধন করার জন্য নিবেদিতা সর্বদা আগ্রহী ছিলেন। তার এ সব কর্মকাণ্ডের পিছনে প্রত্যক্ষদর্শী ইতিহাসচার্য যদুনাথ সরকার দেখেছিলেন অকদর্প দেশ সেবার প্রেরণা। (আচার্য যদুনাথ সরকার, ‘ভগিনী নিবেদিতা’)। ঠিক একই কথা বলেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসুও।
১৯০৭ সালে যুগান্তরের মামলায় বিপ্লবী প্রবন্ধ লেখার জন্য ভূপেন্দ্রনাথ দত্তকে গ্রেপ্তার করে। ভূপেন্দ্রনাথের পক্ষে নিবেদিতা জামিনদার হয়েছিলেন। ইতিমধ্যে ব্রিটিশ গোয়েন্দা বাহিনী নিবেদিতাকে সন্দেহের চোখে দেখতে লাগল। এই সময়ে জাতীয় নেতাদের পরামর্শে নিবেদিতা গ্রেপ্তার এড়াতে ভারতবর্ষ থেকে লন্ডনে পাড়ি দেন। আয়ারল্যান্ড ও আমেরিকা ঘুরে তিনি ১৯০৯ সালে ‘মিসেস মার্গট’ ছদ্মনামে জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে পুনরায় ভারতে ফিরে আসেন। নিবেদিতার অনুপস্থিতিতে বিপ্লবী আন্দোলন কিছুটা স্থিমিত হয়েছিল।
তাঁর শেষ ইচ্ছাপত্রে নিবেদিতা লিখেছিলেন,
‘জনসাধারণ যদি আমার স্মৃতি রক্ষার জন্য কোনো অর্থদান করে, তা যেন মিউজিয়াম এবং ঐতিহাসিক স্থানসমূহে রক্ষিত ভাস্কর্যের প্রতিরূপ করার কাজের পুরস্কার রূপে ব্যয়িত হয়।’
(তথ্যসূত্র:
১- ভগিনী নিবেদিতা ও বাংলায় বিপ্লববাদ, গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরী, অরুণা প্রকাশন (২০১২)।
২- নিবেদিতা লোকমাতা, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, আনন্দ পাবলিশার্স।
৩- ভারতকন্যা নিবেদিতা, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, পত্র ভারতী।
৪- বিদ্রোহিনী নিবেদিতা, শশীভূষন দাশগুপ্ত, সুপ্রিম পাবলিশার্স (২০১৩)।
৫- নিবেদিত নিবেদিতা, ডঃ দীপক চন্দ্র, দে’জ পাবলিশিং।
৬- ভারতপ্রাণা নিবেদিতা, পূর্বা সেনগুপ্ত, আনন্দ পাবলিশার্স।
৭- বর্তমান পত্রিকা, ১০ই আগস্ট ২০১৯ সাল।
৮- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৮শে অক্টোবর ২০১৬ সাল।
৯- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬শে জুলাই ২০১৯ সাল।
১০- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩১শে ডিসেম্বর ২০১৮ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত