সুকান্ত লিখেছিলেন, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। দেশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ভারতে বিজেপি জমানায় সেই রাজ্যপাট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অচ্ছে দিন বলে মোদি-অমিতরা যতই লাফালাফি করুন না কেন বিজেপি জমানায় দেশের আসল ছবিটা ঠিক কিরকম তা স্পষ্ট করে দিয়েছে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের অবস্থান। নামতে নামতে সেখানে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মায়ানামারও আমাদের টপকে চলে গেছে। ক্ষুধা সূচকে ১০২তম স্থানে পৌঁছেও আমাদের নির্লজ্জ শাসকদের কোন হেলদোল নেই। অপদার্থতার একটা রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন তারা। এই রিপোর্ট একইসঙ্গে ধরে ফেলেছে সরকারি উদ্যোগের ফাঁকিবাজিও। শুধু বিজেপির আমলেই নয়, ক্ষুধার দিকে দেশের যাত্রা শুরু কিন্তু সেই কংগ্রেস আমল থেকেই। গরিব মানুষদের দিকে সে আমলেও সরকার কোন মনোযোগ দেয়নি। কাজেই তারাও নিজেদের দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারবেন না।
আমার মনে পড়ছে, সম্ভবত গত বছরই কেন্দ্রীয় সরকার বলেছিলেন, ২০৩০ এর মধ্যে তারা তৈরি করবেন ক্ষুধাহীন ভারত। কিন্তু ক্ষুধা সূচকে লাগাতার অবনমন দেখে আমার মনে হচ্ছে কিছুদিনের মধ্যে ভারত পরিণত হবে একটি ক্ষুধাময় রাষ্ট্রে। আশ্চর্যের ব্যাপার মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারত ক্ষুধা তালিকায় ক্রমাগত নিচের দিকে নামছে। বিজেপি যতই তাদের সাফল্যের জয়ঢাক বাজাক না কেন তালিকা বলছে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি না খেতে পাওয়া মানুষ ভারতে বাস করে। মোদি-অমিতদের ঠাটবাট আর লাগাতার মিথ্যে কথা বলা তাতে কমেনি। কোন গঠনমূলক সমালোচনাকেই তারা আমল দিতে নারাজ। এমনকি সরকারের ত্রুটি যুক্তি দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন বলে তারা প্রকাশ্যে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়দের কটু কথা বলতে ছাড়েননি।
আমার খুব দুঃখ লাগে, বিশ্বের অন্যান্য দেশ যা করতে পারে এত সম্ভাবনা, শক্তি ও মেধা থাকতে আমাদের দেশ তা করতে পারে না কেন? মানুষকে একটু সুযোগ, একটু সহায়তা দিলেই তো সে অনেকটা এগোতে পারে। আমি নিজেই তো একটা নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে হয়েও এভাবেই উঠে এসেছি। শাকপাতা খেয়ে চরম দারিদ্রের মধ্যে আমার বড় হয়ে ওঠা। আমি দেখেছি আমাদের বড় করতে বাবা মাকে কি কষ্ট করতে হয়েছে। সে দিনগুলি আমি কোন দিন ভুলতে পারবো না। মনে পড়ছে ছোটবেলায় পায়েস খেতে চেয়েছিলাম বলে আমার মা আমাকে চিনি আর তেজপাতা দিয়ে রেশনের আতপ চালের পায়েস করে দিয়েছিল। সেটাই তৃপ্তি করে খেয়েছিলাম। অল্পতে খুশি হওয়া, সামান্য সুযোগ পেলে এগোনোর এমন কাহিনি বাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে আছে। অথচ কোন কেন্দ্রীয় সরকারই দেশের গরিবদের সেটুকু সুযোগও দেয়নি। তাদের সেই দৃষ্টিভঙ্গিটাই নেই।
স্থানীয় স্তরে ছোট ছোট হস্তক্ষেপ, সহজে করা যায় কিন্তু সম্ভাবনা বিপুল এমন দূরদর্শী কর্মসূচী, অবস্থাটা বদলে দিতে পারে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো সেই কাজটাই করে চলেছেন। ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়ার জন্য সাইকেল, লেখাপড়ার সুযোগ, বাল্যবিবাহ রোধ করার জন্য কন্যাশ্রী, সবুজসাথীর মত কর্মসূচীগুলি যে রাজ্যের শিক্ষা, স্বাস্থ্যের ছবিটা বদলে দিয়েছে তা এখন কট্টর সরকার বিরোধীরাও স্বীকার করেন। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় দারিদ্র দূর করার জন্য সরাসরি স্থানীয় স্তরে দারিদ্রকে আঘাত করার কথা বলেছেন। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু ঠিক সেটাই করেছেন, তার ফলও মিলেছে। আমাদের বুঝতে হবে বড় বড় কথা না বলে খালি পায়ে চলা মানুষদের জুতোর ব্যবস্থা করে দিলেও অনেক রোগ কমে। বস্ত্রহীন শিশুদের জামা দিলেও তাদের ঠাণ্ডার প্রকোপে মৃত্যু রোধ করা যায়। এরকম ছোট ছোট প্রচেষ্টাই কিন্তু সামগ্রিকভাবে ভাল ফল দিতে পারে।
কিন্তু চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি। ধর্ম, ধর্ম করে লাফালেও মানবধর্ম পালন করেননি তারা। দেশের শিশুদের মুখে দুমুঠো অন্ন তুলে দিতেও তারা ব্যর্থ হয়েছেন। অথচ খাদ্যশস্য উৎপাদনে দেশের অবস্থা কিন্তু মানুষের না খেতে পাওয়ার মত নয়। স্রেফ কয়েকটি নির্দিষ্ট ধনী পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতা ও ফাটকাবাজদের তোল্লাই দিয়ে দলীয় তহবিল পুষ্ট করা ছাড়া তাদের আর কোন দিকেই লক্ষ্য নেই। জনকল্যাণমূলক কর্মসূচী নিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বদলে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে দেশের মানুষকে বিভক্ত করাই তাদের মূল লক্ষ্য। এরই পরিণতিতে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে দেশ আজ এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে।
কাজ একটাই, দেশের ক্ষমতার তখত থেকে বিজেপিকে বিদায় করা, নাহলে এই অবনমন ঠেকানো যাবেনা। একাজ না করা মানে দেশের আরও বেশি শিশুদের ক্ষুধা, অনাহার, অপুষ্টির দিকে ঠেলে দেওয়া। ক্ষুধার রাজ্যপাটের ভিত আরও পোক্ত করা। পূর্ণিমার চাঁদকে তখন সত্যি ঝলসানো রুটি বলে মনে হবে।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত